ভবঘুরেকথা
রাধা কৃষ্ণ

-স্বামী জয়ানন্দ

একদিন শ্রীরাধার ইচ্ছে হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পরীক্ষা করার- সত্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে ভালবাসেন কিনা! এরপর নানা অছিলায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে শ্রীরাধার মন কষাকষি-মান-অভিমান শুরু হলো। বন্ধ হয়ে গেল উভয়ের চাক্ষুষ সাক্ষাৎ দর্শন।

শ্রীরাধার অভিমানের পারদ ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগলো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর কেন আসেন না, কেন দর্শন দেন না, আর কেন কোনো কথা বলেন না- এই সব কথা ভাবতে ভাবতে শ্রীরাধার দিন কাটতে থাকে, প্রাণ কাঁদতে থাকে।

শ্রীরাধার চোখের জল আর শুকোয় না। মনে নানা দুঃশ্চিন্তার উদয় হতে থাকে। রাগ ক্ষোভও বাড়তে থাকে। এও ভাবতে থাকেন- ‘গোপিনীদের পেয়ে বংশীধারী বুঝি আমাকে ভুলেছে!’

শ্রীরাধা স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তিনি সংসারের কাউকে তাঁর মনের অবস্থা বুঝতে দিতে চান না। খাওয়া-দাওয়া কমেছে। শরীরও ভাঙতে শুরু করেছে। মন এরূপ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যদি কোনদিন নিজের থেকে এসে তাঁর কাছে ধরাও দেন, তাহলেও তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন!

শ্রীরাধা চেষ্টা করতে শুরু করেছেন মন থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মুছে ফেলতে! মন’কে নানা কাজে ভরিয়ে রেখে ভোলার চেষ্টা করছেন। তবুও কাজের ফাঁকে, কাজের শেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর মনে পড়ছে। চোখের জল মুছতে মুছতে প্রতিজ্ঞা করছেন- আর জল ফেলবেন না! ভাবতে ভাবতে আবার দু-চোখ জলে ভরে যাচ্ছে!

আবার কখনো শ্রীরাধা সখীদের সঙ্গে কথা বলে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন- তবুও তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে একটিবারের জন্যে ভুলতেও পারছেন না আবার তাঁকে আহ্বানও করছেন না!

তাঁর মনে জেদ দৃঢ় ভাবে তৈরি হয়েছে, ভাবছেন- ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যদি আমাকে এতই ভালোবাসেন, তাহলে কেন তিনি চুপ করে আছেন? তিনি কি আমার অবস্থা বুঝতে পারছেন না? নাকি তিনিও জেদ করে বসে আছেন! নাকি তিনি আমাকে উপেক্ষা করতে চাইছেন!’

অভিমানের সঙ্গে রাগ, রাগের সঙ্গে ক্ষোভ, ক্ষোভের সঙ্গে দুঃখ- সব মিলিয়ে শ্রীরাধার প্রায় নিষ্প্রাণ জড় বস্তুর হওয়ার উপক্রম!

শ্রীরাধার মনের এরূপ অবস্থায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সামনে হাজির হলেন। শ্রীরাধা তখন মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কথা বলা তো অনেক দূরের কথা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিকে ফিরেও তাকালেন না পর্যন্ত! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কিছু বলতে চাইলে শ্রীরাধা কোনো কিছুই শুনতে চান না- এমনই এক পরিস্থিতি। সবখানেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীরাধার রাগ ঝরে ঝরে পড়ছে!

পরিস্থিতি বেশ বিগড়ে গিয়েছে দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধাকে বলে যেতে লাগলেন- ‘এতদিন আমি তোমার অন্তরেই অবস্থান করে ছিলাম। এতদিন তুমি যা যা করে গেছ- সে সব কিছুই আমি জানি’ -বলে প্রমাণ স্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার প্রতিটি ক্ষণ-মুহূর্ত ও অবস্থার কথা বর্ণনা করে যেতে লাগলেন।

শ্রীরাধা ভাবতে লাগলেন- ‘এ সবই তো আমার একান্তভাবে অত্যন্ত গোপনীয়, অন্য কারুর তো জানার কথা নয়!’

শ্রীরাধা বুঝলেন এবং দেখলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সবই সত্যি বলছেন। তাঁর মন থেকে বিষাদ ভাব চলে গেল। সব অভিমান চলে গেল, সব রাগ, সব ক্ষোভ দূর হয়ে গেল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সামনে দেখে শ্রীরাধার মন অনুরাগে প্রেমে আর্দ্র হয়ে অশ্রুর ধারা হয়ে দুচোখ থেকে অঝোর ধারায় ঝরে পড়তে লাগলো।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার চোখের জল মুছে দিতে লাগলেন। শ্রীরাধাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চোখ থেকেও আশ্রু গলে গলে পড়তে লাগলো। এভাবে শ্রীরাধার জীবনে দুঃখের অবসান ঘটলো।

রাধ্‌ ধাতু হইতে রাধা শব্দটি উৎপত্তি। রাধ্‌ ধাতুর অর্থ সাধনা, পূজা বা তুষ্ট করা। যিনি সাধনার মাধ্যমে, পূজা করার মধ্য দিয়ে বা প্রেম, অনুরাগ, ভালবাসার মধ্য দিয়ে ভগবানকে তুষ্ট করেন, -তিনিই রাধা।

আর কৃষ্ ধাতু হইতে কৃষ্ণ শব্দটি এসেছে। কৃষ্ ধাতুর অর্থ আকর্ষণ করা;-যিনি সাধনাকারিণী শক্তির সৰ্ব্বেন্দ্রিয় আকর্ষণ করেন বা অনুরাগের পথে আকর্ষণ করেন, তাঁকেই কৃষ্ণ বলে।

আসলে ভগবান সবসময় আমাদের অন্তরেই অবস্থান করছেন আর তাঁকে আমরা বৃথাই বাইরে খোঁজার চেষ্টা করে চলেছি। বাইরে যত না তাঁর প্রকাশ অন্তর মধ্যে তাঁর অবস্থান এবং প্রকাশ বেশি। আমাদেরকে তাঁকে অন্তরের অন্তঃস্থলে হৃদয়ে দেখতে হবে। আর সেখানে দেখার অবিরাম চেষ্টা করাটাই হচ্ছে সাধনা।

……………………………………
স্বামী জয়ানন্দজীর অন্যান্য লেখা পড়ুন:
আপন স্বরূপ
মানসিক বিপর্যয়ে মুক্তির পথ
সম্পর্ক বিপর্যয়ে মুক্তির পথ

এতো চিন্তা কিসের?

শ্রীকৃষ্ণের মেয়ে-জামাই
শ্রীরাধা’র দুঃখ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!