ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

চৈতন্যকে চৈতন্যরূপে প্রত্যক্ষ করাই ধর্ম, জড়রূপে দেখা নয়।

ধর্ম হইতেছে বিকাশ। প্রত্যেককে নিজে উহা উপলব্ধি করিতে হইবে। খ্রীষ্টানগণের বিশ্বাস, মানবের পরিত্রাণের নিমিত্ত যীশুখ্রীষ্ট প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন। তোমাদের নিকট উহা একটি বিশিষ্ট মতবাদের উপর বিশ্বাস, এবং এই বিশ্বাসেই নিহিত তোমাদের মুক্তি। আমাদের নিকট মুক্তির সহিত বিশিষ্ট মতবাদের কোন প্রকার সম্পর্ক নাই। প্রত্যেকেরই স্বীয় মনোমত কোন মতবাদে বিশ্বাস থাকিতে পারে; অথবা সে কোন মতবাদে বিশ্বাস না করিতেও পারে।

যীশুখ্রীষ্ট কোন এক সময়ে ছিলেন, অথবা তিনি কোনদিন ছিলেন না, তোমার নিকট এই উভয়ের পার্থক্য কি? জ্বলন্ত ঝোপের (burning bush) মধ্যে মুশার ঈশ্বর-দর্শনের সহিত তোমার কি সম্পর্ক? মুশা জ্বলন্ত ঝোপে ঈশ্বরকে দর্শন করিয়াছিলেন, এই তত্ত্বের দ্বারা তোমার ঈশ্বর-দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাই যদি হয়, তবে মুশা যে আহার করিয়াছিলেন, ইহাই তোমার পক্ষে যথেষ্ট; তোমার আহার-গ্রহণে নিবৃত্ত হওয়া উচিত।

প্রকৃত আধ্যাত্মিক-শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি চৈতন্যকে চৈতন্যরূপেই প্রত্যক্ষ করেন, জড়রূপে নয়। চৈতন্যই প্রকৃতিকে গতিশীল করে, চৈতন্যই সত্য বস্তু। ক্রিয়ার অস্তিত্ব প্রকৃতির মধ্যেই বিদ্যমান, চৈতন্যে নয়। চৈতন্য সর্বদা এক, অপরিণামী ও শাশ্বত। চৈতন্য ও জড় প্রকৃতপক্ষে এক, কিন্তু চৈতন্য স্ব-স্বরূপে কখনই জড় নয়। জড় কখনও জড়সত্তা-রূপে চৈতন্য হইতে পারে না। 

একটি অপরটির মতই সমভাবে যুক্তিযুক্ত। আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষগণের বিবরণসমূহ আমাদিগকে তাঁহাদের পথে অগ্রসর হইতে ও স্বয়ং ধর্ম উপলব্ধি করিতে প্রণোদিত করে, ইহা ব্যতীত অপর কোন কল্যাণ সাধন করে না। যীশুখ্রীষ্ট, মুশা বা অপর কেহ যাহা কিছু করিয়াছেন, তাহা আমাদিগকে অগ্রসর হইতে উৎসাহিত করা ব্যতীত আর কিছুমাত্র সাহায্য করিতে পারে না।

প্রত্যেক ব্যক্তির একটি বিশেষ স্বভাব আছে, উহা তাহার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। ঐ বৈশিষ্ট্য তাহাকে অনুসরণ করিতেই হইবে। উহার মধ্য দিয়াই তাহাকে মুক্তির পথ খুঁজিতে হইবে। তোমার গুরুই তোমাকে বলিয়া দিবেন, তোমার নির্দিষ্ট পথ কোন্‌টি এবং সেই পথে তোমাকে পরিচালিত করিবেন। তোমার মুখ দেখিয়া তিনি বলিয়া দিবেন, তুমি কোন্ অবস্থায় ও কিরূপ সাধনার অধিকারী এবং ঐ বিষয়ে তোমাকে নির্দেশ দিবার ক্ষমতাও তাঁহার থাকিবে।

অপরের পথ অনুসরণ করিবার চেষ্টা করা উচিত নয়, কেননা উহা তাঁহার জন্যই নির্দিষ্ট, তোমার জন্য নয়। নির্দিষ্ট পথ পাইলে নিশ্চিন্ত হইয়া থাকা ব্যতীত আর কিছুই করিবার নাই, স্রোতই তোমাকে মুক্তির দিকে টানিয়া লইয়া যাইবে। অতএব যখন সেই নির্ধারিত পথ পাইবে, তাহা হইতে ভ্রষ্ট হইও না। তোমার পন্থা তোমার পক্ষে শ্রেয়ঃ, কিন্তু উহা যে অপরের পক্ষেও শ্রেয়ঃ হইবে, তাহার কোন প্রমাণ নাই।

প্রকৃত আধ্যাত্মিক-শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি চৈতন্যকে চৈতন্যরূপেই প্রত্যক্ষ করেন, জড়রূপে নয়। চৈতন্যই প্রকৃতিকে গতিশীল করে, চৈতন্যই সত্য বস্তু। ক্রিয়ার অস্তিত্ব প্রকৃতির মধ্যেই বিদ্যমান, চৈতন্যে নয়। চৈতন্য সর্বদা এক, অপরিণামী ও শাশ্বত। চৈতন্য ও জড় প্রকৃতপক্ষে এক, কিন্তু চৈতন্য স্ব-স্বরূপে কখনই জড় নয়। জড় কখনও জড়সত্তা-রূপে চৈতন্য হইতে পারে না। আত্মা কখনও ক্রিয়া করেন না। কেনই বা করিবেন? আত্মা বিদ্যমান-ইহাই যথেষ্ট। আত্মা শুদ্ধ, সৎ ও নিরবচ্ছিন্ন। আত্মায় ক্রিয়ার কোন আবশ্যকতা নাই।

হইতেছে স্বীয় স্বভাবের পরিণতি-মানসী ক্রিয়া অর্থে সৃষ্ট। শব্দ চিন্তার ও রূপ (আকার) শব্দের অনুসরণ করে। মনে আত্মা প্রতিফলিত হইবার পূর্বে মানসিক ও শারীরিক সর্বপ্রকার কার্য করিবার সঙ্কল্প রুদ্ধ করা প্রয়োজন।

নিয়ম দ্বারা তুমি বদ্ধ নও। উহা তোমার মায়িক প্রকৃতির অন্তর্গত। মন প্রকৃতিরই এলাকায় ও নিয়মাধীন। সমগ্র প্রকৃতি স্বীয় কর্মজনিত নিয়মের অধীন এবং এই নিয়ম অলঙ্ঘনীয়। প্রকৃতির একটি নিয়মও যদি লঙ্ঘন করিতে সমর্থ হও, তবে মুহূর্তমধ্যে প্রকৃতি ধ্বংস হইবে, প্রকৃতি বলিয়া কিছু থাকিবে না। যিনি মুক্তিলাভ করেন, তিনিই প্রকৃতির নিয়ম ভাঙিয়া ফেলিতে সমর্থ, তাঁহার নিকট প্রকৃতি লয়প্রাপ্ত হয়; প্রকৃতির কোন প্রভাব আর তাঁহার উপর থাকে না। প্রত্যেকেই একদিন চিরকালের জন্য এই নিয়ম ভাঙিয়া ফেলিবে, আর তখনই প্রকৃতির সহিত তাহার দ্বন্দ্ব শেষ হইয়া যাইবে।

গভর্ণমেণ্ট, সমিতি প্রভৃতি অল্পবিস্তর ক্ষতিকর। সকল সমিতিই কতকগুলি দোষযুক্ত সাধারণ নিয়মের উপর স্থাপিত। যে মুহূর্তে তোমরা নিজেদের একটি সঙ্ঘে পরিণত করিলে, সেই মুহূর্ত হইতে ঐ সঙ্ঘের বহির্ভূত সকলের প্রতি বিদ্বেষ আরম্ভ হইল। যে কোন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের অর্থ নিজের উপর গণ্ডী টানা ও স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা। প্রকৃত কল্যাণ হইতেছে সর্বোত্তম স্বাধীনতা।

প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হইতে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সাধুতা যত বাড়ে কৃত্রিম নিয়মও তত হ্রাস পায়। ঐগুলি বাস্তবিক পক্ষে নিয়মই নয়। কারণ-উহা যদি সত্যই নিয়ম হইত, তবে কখনই উহা লঙ্ঘন করা যাইত না। এই তথাকথিত নিয়মগুলি যে ভাঙিয়া ফেলা যায়, তাহাতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, ঐগুলি প্রকৃত নিয়ম নয়। যথার্থ নিয়ম অলঙ্ঘনীয়।

যখন কোন চিন্তা দমন করিয়া ফেল, তখন উহা স্প্রিং-এর ন্যায় কুণ্ডলী পাকাইয়া অদৃশ্যভাবে চাপা পড়িয়া থাকে মাত্র। সুযোগ পাইলেই মুহূর্তমধ্যে-দমনের ফলে সংহত সমস্ত রুদ্ধশক্তি লইয়া সবেগে বাহির হইয়া আসে, এবং তারপর যাহা ঘটিতে বহু সময় লাগিত, কয়েক মুহূর্তে তাহা ঘটিয়া যায়।

প্রতিটি ক্ষুদ্র সুখ বৃহৎ দুঃখ বহন করে। শক্তি এক-এক সময়ে যাহা আনন্দরূপে ব্যক্ত হয়, অন্য সময়ে তাহারই অভিব্যক্তি দুঃখ। কতকগুলি অনুভূতির অবসান হইলেই অপর কতকগুলি আরম্ভ হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে উন্নততর ব্যক্তিগণের কাহারও মধ্যে দুইটি, এমন কি একশত বিভিন্ন চিন্তা একই সময়ে কার্য করিতে থাকে।

হইতেছে স্বীয় স্বভাবের পরিণতি-মানসী ক্রিয়া অর্থে সৃষ্ট। শব্দ চিন্তার ও রূপ (আকার) শব্দের অনুসরণ করে। মনে আত্মা প্রতিফলিত হইবার পূর্বে মানসিক ও শারীরিক সর্বপ্রকার কার্য করিবার সঙ্কল্প রুদ্ধ করা প্রয়োজন।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!