ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে-১
পূর্বাভাষ
ব্যক্তিগণ-স্বামী বিবেকানন্দ, তাঁহার গুরুভ্রাতৃবৃন্দ ও শিষ্যমণ্ডলী। কয়েক জন পাশ্চাত্য অভ্যাগত এবং শিষ্য-ধীরামাতা, জয়া নাম্নী এক মহিলা ও নিবেদিতা তাঁহাদের অন্যতম।

স্থান-ভারতের বিভিন্ন অংশ
কাল-১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দ

এ বৎসর দিনগুলি কি সুন্দর ভাবেই না কাটিয়াছে! এই সময়েই যে আদর্শ বাস্তবে পরিণত হইয়াছে! প্রথমে নদীতীরে বেলুড়ের কুটীরে, তারপর হিমালয়-বক্ষে নৈনীতাল ও আলমোড়ায়, পরিশেষে কাশ্মীরে নানা স্থানে পরিভ্রমণ-কালে-সর্বত্রই সব সময় আসিয়াছিল, যাহা কখনও ভুলিবার নয়, এমন সব কথা শুনিয়াছি, যাহা আমাদের সারা জীবন ধরিয়া প্রতিধ্বনিত হইতে থাকিবে।

বিরাট প্রতিভার বিশাল খেয়ালে আমরা কৌতুক করিয়াছি, বীরত্বের উচ্ছ্বাসে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছি-এ সমস্ত দিব্য লীলার, মনে হয়, শিশু ভগবান্‌ যেন জাগিয়া উঠিতেছেন, আর আমরা দাঁড়াইয়া সাক্ষিস্বরূপ নিরীক্ষণ করিয়াছি!

… দেখিতেছি নক্ষত্রালোকিত হিমাচল-অরণ্যানীর দৃশ্যাবলী আর দেখিতেছি দিল্লী এবং তাজের রাজভোগ্য সৌন্দর্যরাশি। স্মৃতির এই সকল নিদর্শন বর্ণনা করিতে কাহার না আগ্রহ হয়! কিন্তু বর্ণনায় উহা বিবর্ণ হইয়া উঠিবে-কেন না সে যে অসম্ভব! তাই স্মৃতির আলেখ্যে নয়, স্মৃতির আলোকেই তাহাদের অক্ষয় পুণ্যপ্রতিষ্ঠা। আর সেই প্রতিষ্ঠায় চিরসংযুক্ত হইয়া বিদ্যমান থাকিবে তথাকার কোমলহৃদয় শান্তপ্রকৃতি অধিবাসিবৃন্দ।

কিরূপ মানসিক অবস্থায় নূতন নূতন ধর্ম-বিশ্বাস প্রসূত হয়, এবং কী ধরনের মহাপুরুষেরা এইরূপ ধর্ম-বিশ্বাস সঞ্চারিত করেন-আমরা তাহা কতকটা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। কারণ, আমরা এমন এক মহাপুরুষের সঙ্গলাভ করিয়াছি, যিনি সকল রকম লোককেই নিজের কাছে আকর্ষণ করিতেন, সকলের বক্তব্য শুনিতেন, সকলের প্রতি সহানুভূতি দেখাইতেন, কাহাকেও প্রত্যাখ্যান করেন নাই।

বিদেশীর উপহাসস্থল, কিন্তু দেশবাসীর পূজাস্পদ ভিক্ষুকের বেশে তাঁহাকে আমরা দেখিয়াছি; তাই মনে হয়-শ্রমলব্ধ জীবিকা, সামান্য কুটীরে বাস, এবং শস্যক্ষেত্রবাহী সাধারণ পথ-কেবল এই সমস্ত পারিপার্শ্বিক দৃশ্যপটের মধ্যেই এমন জীবনের প্রকৃত শোভা ফুটিতে পারে।

তাঁহার স্বদেশবাসী বিদ্বান্ রাষ্ট্রনীতি-বিশারদ পণ্ডিতমণ্ডলী তাঁহাকে যেমন ভালবাসিতেন, নিরক্ষর অজ্ঞেরাও তাঁহাকে তেমনি ভালবাসিত। তাঁহার নৌকার মাঝি-মাল্লারা পথ চাহিয়া থাকিত, কতক্ষণে তিনি আবার নৌকায় ফিরিয়া আসিবেন। যে গৃহে তিনি অতিথি হইতেন, সেই গৃহের পরিচারক ভৃত্যদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়িয়া যাইত, কে আগে তাঁহার সেবা করিবে। আর এই সকল ব্যাপার সর্বদাই যেন একটা খেলার আবরণে জড়িত থাকিত। ‘তাঁহারা যে ভগবানের খেলার সঙ্গী’-এই ভাব তাহাদের মনে স্বতই জাগরূক থাকিত।

যাঁহারা এরূপ শুভমুহূর্তের আস্বাদ পাইয়াছেন, জীবন তাঁহাদের নিকট অধিকতর মূল্যবান্, অধিকতর মধুময়। দীর্ঘ নিরানন্দ রজনীর তালবন-সঞ্চারী বায়ুও উদ্বেগ ও আশঙ্কার পরিবর্তে তাঁহাদের কর্ণে শান্তিময় ‘শিব! শিব!’ বাণী ধ্বনিত করিয়া তোলে।


স্থান-বেলুড় গঙ্গাতীরে একখানি বাড়ী
কাল-মার্চ হইতে ১১ মে পর্যন্ত

গঙ্গাতীরস্থ বাড়ীখানির সম্বন্ধে স্বামীজী একজনকে বলিয়াছিলেন, ‘ধীরামাতার ক্ষুদ্র বাড়ীখানি তোমার স্বর্গ বলিয়া মনে হইবে। কারণ, ইহার আগাগোড়া সবটাই ভালবাসা-মাখা।’

বাস্তবিকই তাই। ভিতরে এক অবিচ্ছিন্ন মেলা-মেশার ভাব, এবং বাহিরে প্রতি জিনিষটি সমান সুন্দর; শ্যামল বিস্তৃত শষ্পরাজি, উন্নত নারিকেল বৃক্ষগুলি, বনমধ্যস্থ ছোট ছোট বাদামী রঙের গ্রামগুলি-সবই সুন্দর!

যাঁহাদের মনে অতীতের স্মৃতি জাগরূক রহিয়াছে, এমন অনেকে মাঝে মাঝে আসিতেন, এবং আমরা স্বামীজীর অষ্টবর্ষব্যাপী ভ্রমণের কিছু কিছু বিবরণ শুনিতে পাইতাম; গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে গমন-কালে তাঁহার নাম-পরিবর্তনের কথা, তাঁহার নির্বিকল্প সমাধির কথা, এবং যাহা বাক্যের অতীত ও সাধারণ দৃষ্টির বহির্ভূত, যাহা কেবল প্রেমিক হৃদয়েরই অনুভবগম্য, পরার্থে স্বামীজীর সেই পবিত্র মর্মবেদনার কথাও আমরা শ্রবণ করিতাম। আর স্বয়ং স্বামীজী তথায় আসিতেন, উমা-মহেশ্বরের ও রাধাকৃষ্ণের গল্প বলিতেন, কত গান ও কবিতার আংশিক আবৃত্তি করিতেন।

বেশীর ভাগ, তিনি আজ একটি, কাল একটি-এইরূপ করিয়া ভারতীয় ধর্মগুলিই আমাদের নিকট বর্ণনা করিতেন; তাঁহার যখন যেমন খেয়াল হইত, যেন তদনুসারেই কোন একটিকে বাছিয়া লইতেন। কিন্তু তিনি কেবল যে ধর্মবিষয়ক উপদেশই আমাদিগকে দিতেন, তাহা নহে। কখনও ইতিহাস, কখনও লৌকিক উপকথা, কখনও বা বিভিন্ন সমাজ, জাতিবিভাগ ও লোকাচারের বহুবিধ উদ্ভট পরিণতি ও অসঙ্গতি-এ সকলেরও আলোচনা হইত। বাস্তবিক তাঁহার শ্রোতৃবৃন্দের মনে হইত, যেন ভারতমাতা শেষ এবং শ্রেষ্ঠ পুরাণ-স্বরূপ হইয়া তাঁহার শ্রীমুখাবলম্বনে স্বয়ং প্রকটিত হইতেছেন।

ভারত-সংক্রান্ত বিষয়ে, যাহা কিছু পাশ্চাত্য মনের পক্ষে আস্বাদ করা অসম্ভব বলিয়া তাঁহার বোধ হইত, সেগুলিকে শিক্ষার প্রারম্ভেই খুব করিয়া বাড়াইয়া আমাদের সমক্ষে উপস্থিত করিতেন। এইরূপে, হয়তো তিনি হরগৌরীমিলনাত্মক একটি কবিতা১ আবৃত্তি করিতেনঃ

কস্তূরিকাচন্দনলেপনায়ৈ,… …
শ্মশানভস্মাঙ্গবিলেপনায়।চাম্পেয়গৌরার্ধশরীরকায়ৈ,
সৎকুণ্ডলায়ৈ ফণিকুণ্ডলায়,কর্পূরগৌরার্ধশরীরকায়।
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥ধম্মিল্লবত্যৈ চ জটাধরায়,
মন্দারমালাপরিশোভিতায়ৈ,নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥
কপালমালাপরিশোভিতায়।অম্ভোধরশ্যামলকুন্তলায়ৈ,
দিব্যাম্বরায়ৈ চ দিগম্বরায়,বিভূতিভূষাঙ্গজটাধরায়।
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥জগজ্জনন্যৈ জগদেকপিত্রে,
… …নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥

আলোচনার বিষয় যাহাই হউক না কেন, উহা সর্বদাই পরিণামে অদ্বয় অনন্তের কথায় পর্যবসিত হইত। সাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব অথবা বিজ্ঞান-যে-কোন তত্ত্বের বিচারেই তিনি প্রবৃত্তি হউন না কেন, সেটি যে সেই চরম অনুভূতিরই একটি দৃষ্টান্ত মাত্র, তাহা তিনি সদাই আমাদের মনে বদ্ধমূল করিয়া দিতেন। তাঁহার চক্ষে কোন জিনিষই ধর্মের এলাকার বহির্ভূত ছিল না। বন্ধনমাত্রকেই তিনি অত্যন্ত ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন, এবং যাহারা ‘শৃঙ্খলকে পুণ্যের আররণে ঢাকিতে চাহে’ তাহাদিগকে তিনি ভয়ানক লোক বলিয়া গণ্য করিতেন; কিন্তু তাই বলিয়া উচ্চ স্তরের রসশিল্পের এবং এই বিষয়ের মধ্যে প্রকৃত সমালোচক যে ব্যবধান দেখিতে পান, তাহা কখনও তাঁহার দৃষ্টি এড়াইত না। একদিন আমরা কয়েক জন ইওরোপীয় ভদ্রলোককে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলাম। স্বামীজী সেদিন পারসিক কবিতার বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিয়াছিলেনঃ

‘প্রিয়তমের মুখের একটি তিলের বদলে আমি সমরকন্দের সমস্ত ঐশ্বর্য বিলাইয়া দিতে প্রস্তুত!’

এই পদটি আবৃত্তি করিতে করিতে তিনি সহসা সোৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, ‘দেখ, যে লোক একটা প্রেমসঙ্গীতের মাধুর্য বুঝিতে পারে না, তাহার জন্য আমি এক কানাকড়িও দিতে রাজী নই।’ তাঁহার কথাবর্তা সরস উক্তসমূহে পূর্ণ থাকিত। সেই দিনই অপরাহ্নে, কোন রাজনৈতিক বিষয়ের বিচার করিতে করিতে তিনি বলিলেন, ‘দেখা যাইতেছে যে, একটি জাতিগঠনের পক্ষে সাধারণ প্রীতির ন্যায় একটা সাধারণ বিরাগেরও আবশ্যকতা আছে!’

কয়েক মাস পরে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘যাহার জগতে কোন বিশেষ কাজ করিবার আছে, তাহার কাছে আমি কখনও উমা এবং মহেশ্বর ভিন্ন অন্য দেবদেবীর কথা বলি না। কারণ, মহেশ্বর এবং জগন্মাতা হইতেই কর্মবীরগণের উদ্ভব।’ ভগবানের প্রতি উদ্দাম প্রেমে আত্মহারা হওয়া যে কি জিনিষ, তাহার আভাস তিনি না দিয়া থাকিতে পারিতেন না। তাই তিনি আমাদের কাছে এই সব গানও সুর-সংযোগে গাহিতেনঃ

‘প্রেমের রাজা কুঞ্জবনে কিশোরী,
প্রেমের দ্বারে আছে দ্বারী, করে মোহন বাঁশরী,
বাঁশী বলচে রে সদাই, প্রেম বিলাবে কল্পতরু রাই,
কারু যেতে মানা নাই!
ডাকচে বাঁশী-আয় পিপাসী জয় রাধে নাম গান করে।’২

তিনি তাঁহার বন্ধু-রচিত৩ গোপগোপীগণের উত্তর-প্রত্যুত্তর-সূচক ভাবগম্ভীর গীতটিও গাহিয়া শুনাইতেনঃ

‘পরমাত্মক পীতবসন নবঘনশ্যামকায়।
কালা ব্রজের রাখাল ধরে রাধার পায়।
বন্দ প্রাণ নন্দদুলাল নমো নমো পদপঙ্কজে,
মরি মরি মরি, বাঁকা নয়ন গোপীর মন মজে।
পাণ্ডবসখা সারথি রথে, বাঁশী বাজায় ব্রজের ঘাটে পথে।
যজ্ঞেশ্বর বীতভয় হর যাদবরায়,
প্রেমে রাধা বলে নয়ন ভেসে যায়।’

২৫ মার্চ। প্রাতে কুটীরে আসিয়া সকালের দিকে কয়েক ঘণ্টা সেখানে অতিবাহিত করা, আবার বৈকালে পুনরায় আসা-ইহাই স্বামীজীর এই সময়ের নিয়ম ছিল। কিন্ত এইরূপ সাক্ষাতের দ্বিতীয় দিন সকালে-শুক্রবার ঈশাহিগণের জ্ঞাপনোৎসবের৪ দিন-তিনি ফিরিবার সময় আমাদের তিন জনকে সঙ্গে করিয়া মঠে লইয়া গেলেন, এবং সেখানে ঠাকুরঘরে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানান্তে একজনকে ব্রহ্মচর্যব্রতে দীক্ষিত করিলেন। সেই প্রভাতটি জীবনে সর্বাপেক্ষা আনন্দময় প্রভাত! পূজাশেষে আমরা উপর তলায় গেলাম। স্বামীজী যোগী শিবের ন্যায় জটা, বিভূতি ও হাড়ের কুণ্ডল পরিধান করিয়া একঘণ্টাকাল ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র-সংযোগে ভারতীয় গীত গাহিলেন।

তারপর সন্ধ্যার সময় গঙ্গাবক্ষে আমাদের নৌকায় বসিয়া তিনি আমাদের নিকট অকপটভাবে তাঁহার গুরুদেবের নিকট হইতে দায়রূপে প্রাপ্ত সেই মহৎ কার্য সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন এবং ভাবনাবিষয়ক অনেক কথা বলিলেন।

আর এক সপ্তাহ পরেই তিনি দার্জিলিঙ যাত্রা করিলেন।

৩ মে। তারপর আমাদের মধ্যে দুইজন পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর গৃহে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইলেন। তখনকার রাজনীতিক গগন তমসাচ্ছন্ন। একটা ঝড়ের সূচনা দেখা যাইতেছিল। ইতঃপূর্বেই প্লেগ, আতঙ্ক এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিজ নিজ ভীষণ মূর্তি দেখাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। আচার্যদেব আমাদের দুইজনকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘মা কালীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে কতকগুলি লোক ব্যঙ্গ করে। কিন্তু ঐ দেখ, আজ মা প্রজাগণের মধ্যে আবির্ভূতা হইয়াছেন। ভয়ে তাহারা কূলকিনারা দেখিতে পাইতেছে না, এবং মৃত্যুর দণ্ডদাতা সৈনিকবৃন্দের ডাক পড়িয়াছে। কে বলিতে পারে যে, ভগবান্ শুভের ন্যায় অশুভ রূপেও আত্মপ্রকাশ করেন না! কিন্তু কেবল হিন্দুই তাঁহাকে অশুভ রূপেও পূজা করিতে           সাহস করে।’

মহামারী দেখা দিয়াছিল এবং জনসাধারণকে সাহস দিবার জন্য ব্যবস্থাও চলিতেছিল। যতদিন এই আশঙ্কা সব দিক্‌ আতঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছিল, ততদিন স্বামীজী কলিকাতা পরিত্যাগ করিতে সম্মত হইলেন না। এই আশঙ্কা কাটিয়া গেল বটে, কিন্তু সঙ্গে সেই সুখের দিনগুলিও অন্তর্হিত হইল। আমাদেরও যাত্রা করিবার সময় আসিল।


স্থান-হিমালয়
কাল-১১ হইতে ২৫ মে পর্যন্ত

আমরা একটি বড় দল, অথবা প্রকৃতপক্ষে দুইটি দল-বুধবার সন্ধ্যাকালে হাওড়া ষ্টেশন হইতে যাত্রা করিয়া শুক্রবার প্রাতে হিমালয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম।

তিনটি ঘটনা নৈনীতালকে মধুময় করিয়া তুলিয়াছিল-খেতড়ির রাজাকে আমাদের নিকট পরিচিত করিয়া দিয়া আচার্যদেবের আহ্লাদ; দুইজন বাঈজীর আমাদিগের নিকট সন্ধান জানিয়া লইয়া স্বামীজীর নিকট গমন এবং অন্যের নিষেধ সত্ত্বেও স্বামীজীর তাঁহাদিগকে সাদর অভ্যর্থনা করা; আর একজন মুসলমান ভদ্রলোকের এই উক্তিঃ ‘স্বামীজী, যদি ভবিষ্যতে কেহ আপনাকে অবতার বলিয়া দাবী করেন, স্মরণ রাখিবেন যে, আমি মুসলমান হইয়াও তাঁহাদের সকলের অগ্রণী।’

এই নৈনীতালেই স্বামীজী রাজা রামমোহন রায় সম্বন্ধে অনেক কথা বলেন, তাহাতে তিনি তিনটি বিষয় এই আচার্যের শিক্ষার মূলসূত্র বলিয়া নির্দেশ করেনঃ তাঁহার বেদান্ত গ্রহণ, স্বদেশপ্রেম প্রচার, এবং হিন্দু-মুসলমানকে সমভাবে ভালবাসা। এই-সকল বিষয়ে রাজা রামমোহন রায়ের উদারতা ও ভবিষ্যদ্দর্শিতা যে কার্যপ্রণালীর সূচনা করিয়াছিল, তিনি নিজে মাত্র তাহাই অবলম্বন করিয়া অগ্রসর হইয়াছেন বলিয়া দাবী করিতেন।

নর্তকীদ্বয়-সংক্রান্ত ঘটনাটি আমাদের নৈনী-সরোবরের উপরে অবস্থিত মন্দিরদ্বয় দর্শন উপলক্ষে ঘটিয়াছিল। এইস্থানে আমরা দুইজন বাঈজীকে পূজায় রত দেখিলাম। পূজান্তে তাহারা আমাদের নিকট আসিল, এবং আমরা ভাঙা ভাঙা ভাষায় তাহাদের সহিত আলাপ করিতে লাগিলাম। স্বামীজী তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিতে অস্বীকার করায় উপস্থিত জনমণ্ডলীর মনোমধ্যে একটা আন্দোলন চলিয়াছিল। খেতড়ির বাঈজীর যে গল্প তিনি বারংবার করিতেন, তাহা প্রথমবার সম্ভবতঃ এই নৈনীতালের বাঈজীদের প্রসঙ্গেই বলিয়াছিলেন। খেতড়ির সেই বাঈজীকে দেখিতে যাইবার নিমন্ত্রণ পাইয়া তিনি ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন, কিন্তু পরিশেষে অনেক অনুরোধে তথায় গমন করেন এবং তাহার সঙ্গীতটি শ্রবণ করেনঃ

প্রভু মেরা অবগুণ চিত ন ধরো, সমদরশী হৈ নাম তুম্‌হারো।
এক লোহ পূজামে রহত হৈ, এক রহে ব্যাধ ঘর পরো।
পারশকে মন দ্বিধা নেহী হোয়, দুঁহু এক কাঞ্চন করো॥
এক নদী এক নহর বহত মিলি নীর ভয়ো।
জব মিলে তব এক বরণ হোয়, গঙ্গানাম পরো॥
এক মায়া, এক ব্রহ্ম, কহত সুরদাস ঝগরো।
অজ্ঞানসে ভেদ হোয়, জ্ঞানী কাহে ভেদ করো॥

অতঃপর আচার্যদেব নিজ মুখে বলিয়াছেন, যেন তাঁহার চক্ষের সম্মুখ হইতে একটি পর্দা উঠিয়া গেল এবং, সবই যে এক বৈ দুই নহে-এই উপলব্ধি করিয়া তিনি তারপর আর কাহাকেও মন্দ বলিয়া দেখিতেন না।

যখন আমরা নৈনীতাল হইতে আলমোড়া যাত্রা করিলাম তখন বেলা পড়িয়া আসিয়াছে, এবং বনপথ অতিবাহন করিতে করিতেই রাত্রি হইয়া গেল। অবশেষে বৃক্ষরাজির অন্তরালে পর্বতগাত্রে অপরূপভাবে স্থাপিত একটি ডাকবাংলায় পৌঁছিলাম। স্বামীজী কিয়ৎক্ষণ পরে দলবলসহ তথায় পৌঁছিলেন। তাঁহার বদন আনন্দোৎফুল্ল, স্বীয় অতিথিগণের স্বাচ্ছন্দ্যবিধায়ক প্রত্যেক খুঁটিনাটির দিকে তাঁহার পূর্ণ দৃষ্টি।

প্রাতরাশের সময় আমাদের নিকট আসিয়া কয়েক ঘণ্টা কথাবার্তায় কাটাইয়া দেওয়া স্বামীজীর পুরাতন অভ্যাস ছিল। আমাদের আলমোড়া পৌঁছিবার দিন হইতেই স্বামীজী এই অভ্যাস পুনরায় শুরু করিলেন। তখন (এবং সকল সময়ই) তিনি অতি অল্প সময় ঘুমাইতেন এবং মনে হয়, তিনি যে এত প্রাতে আমাদের নিকট আসিতেন, তাহা অনেক সময় আরও সকালে সন্ন্যাসিগণের সহিত তাঁহার এক প্রস্থ ভ্রমণ শেষ করিয়া ফিরিবার মুখে। কখনও কখনও, কিন্তু কালেভদ্রে, বৈকালেও আমরা তাঁহার দেখা পাইতাম, হয় তিনিই বেড়াইতে বাহির হইতেন, নয় তো আমরা নিজেরাই, তিনি যেখানে দলবলসহ অবস্থান করিতেছিলেন, সেই ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের গৃহে যাইয়া তাঁহার সহিত দেখা করিতাম।

আলমোড়ার এই প্রাতঃকালীন কথোপকথনগুলিতে একটি নূতন এবং অনুভূতপূর্ব ব্যাপার আসিয়া জুটিয়াছিল। উহার স্মৃতি কষ্টকর হইলেও শিক্ষাপ্রদ। স্বামীজী উল্লাসের সহিত তাঁহার দীক্ষিতা এক ইংরেজ মহিলাকে প্রশ্ন করিয়াছিলেন, তুমি এখন কোন্ জাতিভুক্তা? উত্তর শুনিয়া স্বামীজী বিস্মিত হইলেন, দেখিলেন-তিনি ইংরেজের জাতীয় পতাকাকে কি প্রগাঢ় ভক্তি ও পূজার চক্ষে দেখেন; দেখিলেন-একজন ভারতীয় নারীর তাঁহার ইষ্টদেবতার প্রতি যে ভাব, ইহারও এই পতাকার প্রতি অনেকটা সেই ভাব। স্বামীজী বলিয়া উঠিয়াছিলেন, ‘বাস্তবিকই, তোমার যেরূপ স্বজাতিপ্রেম, উহা তো পাপ! অধিকাংশ লোকই যে স্বার্থের প্ররোচনায় কাজ করিয়া থাকে, আমি চাই, তুমি এইটুকু বোঝ; কিন্তু তুমি ক্রমাগত ইহাকে উল্টাইয়া দিয়া বলিয়া থাক যে, একটি জাতিবিশেষের সকলেই দেবতা। অজ্ঞতাকে এরূপে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকা তো শয়তানি!’

সুতরাং আলমোড়ার এই প্রাতঃকালীন আলোচনাসমূহ আমাদের সামাজিক, সাহিত্যিক ও ললিতকলা-বিষয়ক বদ্ধমূল পূর্ব সংস্কারগুলির সহিত সংঘর্ষের আকার ধারণ করিত, অথবা তাহাতে ভারতীয় এবং ইওরোপীয় ইতিহাস ও উচ্চ উচ্চ ভাবের তুলনা চলিত, এবং অনেক সময় অতি মূল্যবান্ প্রাসঙ্গিক মন্তব্যও শুনিতে পাইতাম। স্বামীজীর একটি বিশেষত্ব এই ছিল যে, কোন দেশবিশেষ বা সমাজবিশেষের মধ্যে অবস্থানকালে তিনি উহার দোষগুলিকে প্রকাশ্যে এবং তীব্রভাবে সমালোচনা করিতেন, কিন্তু তথা হইতে চলিয়া আসিবার পর যেন সেখানকার গুণ ভিন্ন অন্য কিছুই তাঁহার মনে নাই, এইরূপ বোধ হইত।


স্থান-আলমোড়া
কাল-মে ও জুন

প্রথন দিন সকালে কথোপকথনের বিষয় ছিল-সভ্যতার মূল আদর্শ প্রতীচ্যে সত্য, প্রাচ্যে ব্রহ্মচর্য। হিন্দু-বিবাহ-রীতিগুলিকে তিনি এই বলিয়া সমর্থন করিলেন যে, তাহার এই আদর্শের অনুসরণের ফলেই জন্মিয়াছে এবং সর্ববিধ সংহতিগঠনেই স্ত্রীলোকের রক্ষাবিধান প্রয়োজন। সমস্ত বিষয়টির অদ্বৈতবাদের সহিত কি সম্বন্ধ, তাহাও তিনি বিশ্লেষণপূর্বক দেখাইলেন।

আর একদিন সকালে তিনি এই বলিয়া কথা আরম্ভ করিলেনঃ যেমন জগতে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র-এই চারটি মুখ্য জাতি আছে, তেমনি চারিটি মুখ্যজাতীয় কার্যও আছে-ধর্মসন্বন্ধীয় কার্য অর্থাৎ পৌরোহিত্য, যাহা হিন্দুরা নিষ্পন্ন করিতেছে; সামরিক কার্য, যাহা রোমক সাম্রাজ্যের হস্তে ছিল; বাণিজ্যবিষয়ক কার্য, যাহা আজকালকার ইংলণ্ড করিতেছে; এবং প্রজাতন্ত্রমূলক কার্য, যাহা আমেরিকা ভবিষ্যতে সম্পন্ন করিবে। এই স্থলে তিনি, কিরূপে আমেরিকা অতঃপর শূদ্রজাতির স্বাধীনতা এবং একযোগে কার্যকারণরূপ সমস্যাগুলি পূরণ করিবে, সে বিষয়ে কল্পনাসহায়ে ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কনে প্রবৃত্ত হইলেন, এবং যিনি আমেরিকাবাসী নন, এরূপ একজন শ্রোতার দিকে ফিরিয়া মার্কিন জাতি কিরূপ বদান্যতার সহিত সেখানকার আদিম অধিবাসিগণের জন্য বন্দোবস্ত করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন, সে বিষয় বর্ণনা করিলেন।

তিনি উল্লাসপূর্বক ভারতবর্ষের অথবা মোগলবংশের ইতিহাসের সার সঙ্কলন করিয়া দিতেন। মোগলগণের গরিমা স্বামীজী শতমুখে বর্ণনা করিতেন। এই সারা গ্রীষ্ম-ঋতুটিতে তিনি প্রায়ই মধ্যে মধ্যে থাকিয়া থাকিয়া দিল্লী ও আগ্রার বর্ণনায় প্রবৃত্ত হইতেন। একবার তিনি তাজমহলকে এইরূপ বর্ণনা করেন, ‘ক্ষীণালোক, তারপর আরও ক্ষীণালোক-আর সেখানে একটি সমাধি!’-আর একবার তিনি শাজাহানের কথা বলিতে বলিতে সহসা উৎসাহভরে বলিয়া উঠিলেন, ‘আহা, তিনিই মোগলকুলের ভূষণস্বরূপ ছিলেন!’ অমন সৌন্দর্যানুরাগ ও সৌন্দর্যবোধ ইতিহাসে আর দেখা যায় না। আবার নিজেও একজন কলাবিদ্ লোক ছিলেন! আমি তাঁহার স্বহস্তচিত্রিত একখানি পাণ্ডুলিপি দেখিয়াছি, সেখানি ভারতবর্ষের কলা-সম্পদের অঙ্গবিশেষ। কি প্রতিভা!’ আকবরের প্রসঙ্গ তিনি আরও বেশী করিয়া করিতেন। আগ্রার সন্নিকটে সেকেন্দ্রার সেই গম্বুজবিহীন অনাচ্ছাদিত সমাধির পাশে বসিয়া আকবরের কথা বলিতে বলিতে স্বামীজীর কণ্ঠ যেন অশ্রুগদগদ হইয়া আসিত।

সর্ববিধ বিশ্বজননী ভাবও আচার্যদেবের হৃদয়ে উদিত হইত। একদিন তিনি চীনদেশকে জগতের কোষাগার বলিয়া বর্ণনা করিলেন; এবং বলিলেন, তত্রত্য মন্দিরগুলির দ্বারদেশের উপরিভাগে প্রাচীন বাঙলা-লিপি খোদিত দেখিয়া তাঁহার রোমাঞ্চ হইয়াছিল।

কথাপ্রসঙ্গে তিনি সুদূর ইটালী পর্যন্ত চলিয়া যাইতেন। ইটালী তাঁহার নিকট ‘ইওরোপের সকল দেশের শীর্ষস্থানীয়, ধর্ম ও শিল্পের দেশ, একাধারে সাম্রাজ্যসংহতি ও ম্যাটসিনির জন্মভূমি, এবং উচ্চভাব সভ্যতা ও স্বাধীনতার প্রসূতি!’

একদিন শিবাজী ও মহারাষ্ট্র-জাতি সম্বন্ধে এবং কিরূপে শিবাজী সাধুবেশে বর্ষব্যাপী ভ্রমণের ফলে রায়গড় প্রত্যাবর্তন করেন, সে বিষয়ে কথা হইল। স্বামীজী বলিলেন, ‘আজও পর্যন্ত ভারতের কর্তৃপক্ষ সন্ন্যাসীকে ভয় করে, পাছে তাহার গৈরিক বসনের নীচে আর একজন শিবাজী লুক্কায়িত থাকে।’

অনেক সময়, ‘আর্যগণ কাহারা এবং তাঁহাদের লক্ষণ কি?’-এই প্রশ্ন তাঁহার পূর্ণ মনোযোগ আকর্ষণ করিত। তাঁহাদের উৎপত্তি-নির্ণয় এক জটিল সমস্যা-এইরূপ মত প্রকাশ করিয়া তিনি কিরূপে সুইজারলণ্ডে থাকিয়াও বোধ করিতেন যেন চীনদেশে রহিয়াছেন-উভয় জাতির আকৃতিগত সাদৃশ্য এত বেশী, সে গল্পও আমাদের নিকট করিতেন। নরওয়ের কতক অংশের সম্বন্ধেও এটি সত্য বলিয়া তাঁহার ধারণা ছিল। তারপর দেশভেদে আকৃতিভেদ সম্বন্ধে কিছু কিছু তথ্য এবং সেই হাঙ্গেরীদেশীয় পণ্ডিতের মর্মস্পর্শী গল্প (যিনি ‘তিব্বতই হুনদিগের আদিস্থান’ এই আবিষ্কার করিয়াছিলেন এবং দার্জিলিঙে যাঁহার সমাধি আছে)-এইরূপ নানা কথা শুনিতে পাইতাম।

কখনও কখনও ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়গণের বিরোধের আলোচনা-প্রসঙ্গে স্বামীজী ভারতবর্ষের সমগ্র ইতিহাসকে এতদুভয়ের সংঘর্ষ মাত্র বলিয়া বর্ণনা করিতেন; এবং জাতির উন্নতিশীল, এবং শৃঙ্খল-অপনয়নকারী প্রেরণাসমূহ ক্ষত্রিয়গণের মধ্যেই চিরকাল নিহিত ছিল, তাহাও বলিতেন। আধুনিক বাঙলার কায়স্থগণই যে মৌর্যরাজত্বের পূর্বতন ক্ষত্রিয়কুল, তাঁহার এই বিশ্বাসের অনুকূলে তিনি উৎকৃষ্ট যুক্তির অবতারণা করিতে পারিতেন। তিনি এই দুই পরস্পরবিরোধী সভ্যতাদর্শের এইরূপ চিত্র উপস্থাপিত করিতেনঃ একটি প্রাচীন, গভীর এবং পরম্পরাগত আচার-ব্যবহারের প্রতি চিরবর্ধমান-শ্রদ্ধাসম্পন্ন; অপরটি স্পর্ধাশীল, আবেগপ্রবণ এবং উদারদৃষ্টি-সম্পন্ন। রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ এবং ভগবান্‌ বুদ্ধ-ইঁহারা সকলেই ব্রাহ্মণকুলে না জন্মিয়া যে ক্ষত্রিয়কুলে উৎপন্ন হইয়াছিলেন, সেটি ঐতিহাসিক ক্রমপরিণতির এক গভীর নিয়মেরই ফলস্বরূপ। এই আপাত-বিসংবাদী সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যাত হইবামাত্র মনে হইত, বৌদ্ধধর্ম জাতিভেদ ধ্বংস করিবার একটি সূত্র-‘ক্ষত্রিয়কুল কর্তৃক উদ্ভাবিত ধর্ম’ ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাঙ্ঘাতিক প্রতিপক্ষ।

বুদ্ধ সম্বন্ধে স্বামীজী যে সময় কথা কহিতেন, সেটি একটি মাহেন্দ্রক্ষণ; কারণ জনৈক শ্রোত্রী স্বামীজীর একটি কথা হইতে বৌদ্ধধর্মের ব্রাহ্মণ্য-প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবটিই তাঁহার মনোগত ভাব, এই ভ্রমাত্মক সিদ্ধান্ত করিয়া বলিলেন, ‘স্বামীজী! আমি জানিতাম না যে, আপনি বৌদ্ধ!’ উক্ত নাম শ্রবণে তাঁহার মুখমণ্ডল দিব্যভাবে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল; প্রশ্নকর্ত্রীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘আমি বুদ্ধের দাসানুদাসগণের দাস। তাঁহার মত কেহ কখনও জন্মিয়াছেন কি? স্বয়ং ভগবান্‌ হইয়াও তিনি নিজের জন্য একটি কাজও করেন নাই-আর কি হৃদয়! সমস্ত জগৎটাকে তিনি ক্রোড়ে টানিয়া লইয়াছেন। এত দয়া যে, রাজপুত্র এবং সন্ন্যাসী হইয়াও একটি ছাগশিশুকে বাঁচাইবার জন্য প্রাণ দিতে উদ্যত! এত প্রেম যে, এক ব্যাঘ্রীর ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য স্বীয় শরীর পর্যন্ত দান করিয়াছিলেন এবং আশ্রয়দাতা এক চণ্ডালের জন্য আত্মবলি দিয়া তাহাকে আশীর্বাদ করিয়াছিলেন! আর আমার বাল্যকালে একদিন তিনি আমার গৃহে আসিয়াছিলেন, আমি তাঁহার পাদমূলে সাষ্টাঙ্গে প্রণত হইয়াছিলাম! কারণ, আমি বুঝিয়াছিলাম ভগবান্‌ বুদ্ধই স্বয়ং আসিয়াছেন!’

অনেক বার-কখনও বেলুড়ে অবস্থানকালে এবং কখনও তাহার পরে-তিনি এই ভাবে বুদ্ধদেবের কথা বলিয়াছিলেন। একদিন তিনি আমাদিগকে-প্রাণস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করিয়া বলেন সেই রূপসী অম্বাপালীর উপাখ্যান, যিনি মুখ্যবারাঙ্গনা হইয়াও বুদ্ধকে পরিতোষপূর্বক ভোজন করাইয়াছিলেন।

একদিন প্রাতঃকালে এক সর্বাপেক্ষা অধিক নূতনত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা হইয়াছিল। সেদিনকার দীর্ঘ আলোচনার বিষয় ছিল ‘ভক্তি’-প্রেমাস্পদের সহিত সম্পূর্ণ তাদাত্ম্য, যাহা চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ভূম্যধিকারী ভক্তবীর রায় রামানন্দের মুখে এরূপ সুন্দরভাবে প্রকাশ পাইয়াছেঃ

পহিলহি রাগ নয়নভঙ্গ ভেল;
অনুদিন বাঢ়ল অবধি না গেল।
না সো রমণ, না হাম রমণী
দুঁহু মন মনোভাব পেশল জানি।৫

সেই দিন প্রাতঃকালেই তিনি পারস্যের বাব-পন্থিগণের (Babists) কথা বলিয়াছিলেন-সেই পরার্থে আত্মবলিদানের যুগের কথা, যখন স্ত্রীজাতিকর্তৃক অনুপ্রাণিত হইয়া পুরুষগণ কাজ করিত এবং তাহাদিগকে ভক্তির চক্ষে দেখিত। নিশ্চিয় সেই সময়েই তিনি বলিয়াছিলেন, প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা না রাখিয়া ভালবাসিতে পারে বলিয়াই তরুণবয়স্কগণের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব; এবং তাহাদের মধ্যে ভাবী মহৎ কার্যের বীজ সূক্ষ্মভাবে নিহিত থাকে-ইহাই তাঁহার ধারণা।

আর একদিন অরুণোদয়কালে উদ্যান হইতে যখন ঊষার আলোকরঞ্জিত চিরতুষাররাশি দৃষ্টিগোচর হইতেছিল, সেই সময় স্বামীজী আসিয়া শিব ও উমা সম্বন্ধে দীর্ঘ আলাপ করিতে করিতে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘ঐ যে ঊর্ধ্বে শ্বেতকায় তুষারমণ্ডিত শৃঙ্গরাজি, উহাই শিব; আর তাঁহার উপর যে আলোকসম্পাত হইয়াছে, তাহাই জগজ্জননী!’ কারণ, এই সময়ে এই চিন্তাই তাঁহার মনকে বিশেষভাবে অধিকার করিয়াছিল যে, ঈশ্বরই জগৎ-তিনি জগতের ভিতরে বা বাহিরে নহেন, আর জগৎও ঈশ্বর বা ঈশ্বরের প্রতিমা নহে, পরন্তু ঈশ্বরই এই জগৎ এবং যাহা কিছু আছে সব।

একদিন সন্ধ্যাকালে পরমহংস শুকের আখ্যানটি আমরা শুনিয়াছিলাম।

বাস্তবিক, শুকই ছিলেন স্বামীজীর মনের মত যোগী। তাঁহার নিকট শুক সেই সর্বোচ্চ অপরোক্ষানুভূতির আদর্শরূপ, যাহার তুলনায় জীবজগৎ ছেলেখেলা মাত্র! বহুদিন পরে আমরা শুনিয়াছিলাম কিশোর স্বামীজী (নরেন্দ্রনাথ)-কে শ্রীরামকৃষ্ণ বর্ণনা করিয়াছিলেন ‘যেন আমার শুকদেব’। ‘অহং বেদ্মি শুকো বেত্তি ব্যাসো বেত্তি ন বেত্তি বা’-গীতার প্রকৃত অর্থ আমি জানি এবং শুক জানে, আর ব্যাস জানিলেও জানিতে পারেন। ভগবদ্‌গীতার গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ এবং শুকের মাহাত্ম্য-দ্যোতক এই শিববাক্য দাঁড়াইয়া উচ্চারণ করিতে করিতে তাঁহার মুখে যে অপূর্ব ভাবের বিকাশ হইয়াছিল, তাহা আমি কখনই ভুলিতে পারিব না; তিনি যেন আনন্দসমুদ্রের গভীর তলদেশ পর্যন্ত নিরীক্ষণ করিতেছিলেন।

আর একদিন স্বামীজী, হিন্দু-সভ্যতার চিরন্তন উপকূলে-আধুনিক চিন্তাতরঙ্গরাজির বহুদূরব্যাপী প্লাবনের প্রথম ফলস্বরূপ বঙ্গদেশে যে-সকল উদারহৃদয় মহাপুরুষের আবির্ভাব হইয়াছিল, তাঁহাদিগের কথা বলিয়াছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের কথা আমরা ইতঃপূর্বেই নৈনীতালে তাঁহার মুখে শুনিয়াছিলাম। এক্ষণে বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্বন্ধে তিনি সাগ্রহে বলিলেন, ‘উত্তর ভারতে আমার বয়সের এমন একজন লোকও নাই, যাহার উপর তাঁহার প্রভাব না পড়িয়াছে!’ এই দুই ব্যক্তি এবং শ্রীরামকৃষ্ণ যে একই অঞ্চলে মাত্র কয়েক ক্রোশের ব্যবধানে জন্মিয়াছেন, এ কথা মনে হইলে তিনি যারপরনাই আনন্দ অনুভব করিতেন।

স্বামীজী এক্ষণে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আমাদের নিকট ‘বিধবাবিবাহ-প্রবর্তনকারী এবং বহুবিবাহ-রোধকারী মহাবীর’ বলিয়া উল্লেখ করিলেন। কিন্তু সে-সম্বন্ধে তাঁহার (বিদ্যাসাগরের) একটি প্রিয় গল্প ছিল, সেটি এইঃ

একদিন তিনি ব্যবস্থাপক সভা হইতে-এই চিন্তা করিতে করিতে গৃহে ফিরিতেছেন, ঐরূপ স্থানে সাহেবী পরিচ্ছদ পরিধান করা উচিত কিনা, এমন সময় তিনি দেখিলেন যে, ধীরে সুস্থে এবং গুরুগম্ভীর চালে গৃহগমনরত এক স্থূলকায় মোগলের নিকট এক ব্যক্তি দ্রুতপদে আসিয়া সংবাদ দিল, ‘মহাশয়, আপনার বাড়ীতে আগুন লাগিয়াছে!’ এই সংবাদে মোগলপ্রবরের গতির লেশমাত্রও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিল না; ইহা দেখিয়া সংবাদবাহক ইঙ্গিতে ঈষৎ বিজ্ঞজনোচিত বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছিল। তৎক্ষণাৎ তাহার প্রভু ক্রোধে তাহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘পাজি! খানকয়েক বাখারি পুড়িয়া যাইতেছে বলিয়া তুই আমায় বাপ-পিতামহের চাল ছাড়িয়া দিতে বলিস!’-এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তাহার পশ্চাতে আসিতে আসিতে দৃঢ় সঙ্কল্প করিলেন যে, ধুতি চাদর এবং চটি জুতা কোনক্রমে ছাড়া হইবে না; ফলে দরবার যাত্রাকালে একটা জামা ও একজোড়া জুতা পর্যন্ত পরিলেন না!

‘বালবিধবাগণের বিবাহ চলিতে পারে কিনা?’-মাতার এইরূপ সাগ্রহ প্রশ্নে শাস্ত্রপাঠার্থ বিদ্যাসাগরের একমাসের জন্য নির্জনগমনের চিত্রটি খুব চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল। নির্জনবাসের পর তিনি শাস্ত্র এরূপ পুনর্বিবাহের প্রতিপক্ষ নহেন’, এই মত প্রকাশ করিয়া এ-বিষয়ে পণ্ডিতগণের স্বাক্ষরযুক্ত সম্মতি-পত্র সংগ্রহ করিলেন। পরে কতিপয় দেশীয় রাজা ইহার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হওয়ায় পণ্ডিতগণ নিজ নিজ স্বাক্ষর প্রত্যাহার করিলেন; সুতরাং সরকার বাহাদুর এই আন্দোলনের পক্ষে সাহায্য করিতে কৃতসঙ্কল্প না হইলে ইহা কখনই আইনরূপে পরিণত হইত না। স্বামীজী আরও বলিলেন, ‘আর আজকাল এই সমস্যা সামাজিক ভিত্তির উপর স্থাপিত না হইয়া বরং একটা অর্থনীতিসংক্রান্ত ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে।’

যে ব্যক্তি কেবল নৈতিক বলে বহুবিবাহকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তিনি যে প্রভূত আধ্যাত্মিকশক্তিসম্পন্ন ছিলেন, তাহা আমরা অনুধাবন করিতে পারিলাম। যখন শুনিলাম যে, এই মহাপুরুষ ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষে অনাহারে এবং রোগে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক কালগ্রাসে পতিত হওয়ায় মর্মাহত হইয়া ‘আর ভগবান্‌ মানি না’ বলিয়া সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞেয়বাদের চিন্তাস্রোতে গা ঢালিয়া দিয়াছিলেন, তখন ‘পোশাকী’ মতবাদের উপর ভারতবাসীর কিরূপ অনাস্থা, তাহা সম্যক্ উপলব্ধি করিয়া আমরা যারপরনাই বিস্ময়াভিভূত হইয়াছিলাম।

বাঙলার শিক্ষাব্রতীদের মধ্যে একজনের নাম স্বামীজী ইঁহার নামের সহিত উল্লেখ করিয়াছিলেন, তিনি ডেভিড হেয়ার; সেই বৃদ্ধ স্কটল্যাণ্ডবাসী নিরীশ্বরবাদী-মৃত্যুর পর যাঁহাকে কলিকাতার যাজকবৃন্দ ঈশাহিজনোচিত সমাধি-দানে অস্বীকার করিয়াছিলেন। তিনি বিসূচিকারোগাক্রান্ত এক পুরাতন ছাত্রের শুশ্রূষা করিতে করিতে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁহার নিজ ছাত্রগণ তাঁহার মৃতদেহ বহন করিয়া এক সমতল ভূমিখণ্ডে সমাধিস্থল করিল, এবং উক্ত সমাধি তাহাদের নিকট এক তীর্থে পরিণত হইল। সেই স্থানই আজ শিক্ষার কেন্দ্রস্বরূপ হইয়া কলেজ স্কোয়ার নামে অভিহিত হইয়াছে, আর তাঁহার বিদ্যালয়ও আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীভূত, এবং আজিও কলিকাতার ছাত্রবৃন্দ তীর্থের ন্যায় তাঁহার সমাধিস্থান দর্শনে গিয়া থাকে।

এইদিন আমরা কথাবার্তার মধ্যে কোন সুযোগে স্বামীজীকে জেরা করিয়া বসিলাম-ঈশাহিধর্ম তাঁহার উপর প্রভাব বিস্তার করিয়াছে কিনা। এইরূপ সমস্যা যে কেহ সাহস করিয়া উত্থাপন করিতে পারিয়াছে, ইহা শুনিয়া তিনি হাস্য সংবরণ করিতে পারিলেন না; এবং আমাদিগকে খুব গৌরবের সহিত বলিলেন যে, তাঁহার পুরাতন শিক্ষক স্কটল্যাণ্ডবাসী হেষ্টিসাহেবের সহিত মেলামেশাতেই ঈশাদি প্রচারকগণের সহিত তাঁহার একমাত্র সংস্পর্শলাভ ঘটিয়াছিল। এই উগ্রমস্তিষ্ক বৃদ্ধ অতি সামান্য ব্যয়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেন এবং নিজ গৃহকে তাঁহার ছাত্রদেরই গৃহ বলিয়া মনে করিতেন। তিনি প্রথমে স্বামীজীকে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাইতে বলিয়াছিলেন, এবং তাঁহার ভারত-প্রবাসের শেষভাগে বলিতেন, ‘হাঁ বাবা, তুমিই ঠিক বলিয়াছিলে! তুমিই ঠিক বলিয়াছিলে! সত্যই সব ঈশ্বর!’ স্বামীজী সানন্দে বলিলেন, ‘আমি তাঁহার সম্পর্কে গৌরবান্বিত, তিনি যে আমাকে তেমন ঈশাহিভাবাপন্ন করিয়াছিলেন, এ-কথা তোমরা বলিতে পার কি? আমার তো মনে হয় না।’

লঘুতর প্রসঙ্গেও আমরা চমৎকার চমৎকার গল্প শুনিতাম। তাহার একটিঃ আমেরিকার এক নগরে স্বামীজী এক ভাড়াটিয়া বাড়ীতে বাস করিতেন। সেখানে তাঁহাকে স্বহস্তে রন্ধন করিতে হইত, রন্ধনকালে এক অভিনেত্রী এবং এক দম্পতির সহিত তাঁহার প্রায়ই দেখা হইত। অভিনেত্রী প্রত্যহ একটি করিয়া পেরু কাবাব করিয়া খাইত এবং সেই দম্পতি লোকের ভূত নামাইয়া জীবিকা নির্বাহ করিত। স্বামীজী ঐ ভদ্রলোকটিকে তাঁহার লোকঠকান ব্যবসা হইতে নিবৃত্তি করিবার জন্য ভর্ৎসনা-সহকারে বলিতেন, ‘তোমার এরূপ করা কখনও উচিত নহে।’ অমনি স্ত্রীটি পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়া সাগ্রহে বলিত, ‘হাঁ, মহাশয়! আমিও তো উঁহাকে ঠিক ঐ কথাই বলিয়া থাকি; কারণ উনিই যত ভূত সাজিয়া মরেন, আর টাকাকড়ি যা কিছু তা মিসেস উইলিয়াম্‌স্‌ই লইয়া যায়।’

এক ইঞ্জিনীয়র যুবকের গল্পও বলিয়াছিলেন। লোকটি লেখাপড়া জানিত। একদিন ভূতুড়ে কাণ্ডের অভিনয়কালে স্থূলকায়া মিসেস উইলিয়াম‍্‍স‍্‍ পর্দার আড়াল হইতে তাহার ক্ষীণকায়া জননীরূপে আবির্ভূতা হইলে সে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘মা, মা, তুমি প্রেতরাজ্যে গিয়া কি মোটাই হইয়াছ!’ স্বামীজী বলিলেন, ‘এই দৃশ্য দেখিয়া আমি মর্মাহত হইলাম; কারণ আমার মনে হইল যে, লোকটার মাথা একেবারে বিগড়াইয়াছে!’ কিন্তু স্বামীজী হটিবার পাত্র নহেন। তিনি সেই ইঞ্জিনীয়র যুবককে এক রুশদেশীয় চিত্রকরের গল্প বলিলেন। চিত্রকর এক কৃষকের মৃত পিতার আলেখ্য অঙ্কিত করিতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন, এবং আকৃতির পরিচয়স্বরূপে এইমাত্র শুনিয়াছিলেন, ‘তোমায় তো বাপু-কতবার বলিলাম, তাঁর নাকের উপর একটি আঁচিল ছিল!’ অবশেষে চিত্রকর এক সাধারণ কৃষকের চিত্র অঙ্কিত করিয়া, তাহার নাসিকাদেশে এক বৃহৎ আঁচিল বসাইয়া দিয়া সংবাদ দিলেন, ‘ছবি প্রস্তুত’ এবং কৃষকপুত্রকে উহা দেখিয়া যাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। সে আসিয়া কিছুক্ষণ চিত্রের সম্মুখে দাঁড়াইয়া থাকিবার পর শোকবিহ্বল চিত্তে বলিয়া উঠিল, ‘বাবা! বাবা! তোমার সঙ্গে শেষ দেখা হবার পর তুমি কত বদলে গেছ!’ এই ঘটনার পরে ইঞ্জিনীয়র যুবক আর স্বামীজীর সঙ্গে বাক্যালাপ করিত না।

যাহা হউক, এই প্রকার সাধারণভাবে চিত্তাকর্ষক নানা বিষয় থাকা সত্ত্বেও স্বামীজীর মনের ভিতর এই সময় একটা সংগ্রাম প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। জীবনে নির্যাতনের কথা আশ্চর্যভাবে তিনি অনেকবার বলিয়াছিলেন; এবং তাঁহার বিশ্রাম ও শান্তির যে একান্ত প্রয়োজন হইয়াছিল-এ বিষয়ে তিনি দু-একটি কথা বলিয়াছিলেন বটে, অতি অল্প হইলেও তাহাই যথেষ্ট। তিনি কয়েক ঘণ্টা পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, ‘নির্জনবাসের জন্য আমার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগিয়াছে, আমি একাকী বনাঞ্চলে যাইয়া শান্তিলাভ করিব।’

তারপর ঊর্ধ্বে দৃষ্টিপাত করিয়া, তিনি মাথার উপর তরুণ চন্দ্রের দীপ্তি দেখিতে পাইয়া বলিলেন, ‘মুসলমানগণ শুক্লপক্ষীয় শশিকলাকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিয়া থাকেন। আইস, আমরাও নবীন শশিকলার সহিত নবজীবন আরম্ভ করি!’-এই বলিয়া তিনি তাঁহার মানস-কন্যাকে প্রাণ খুলিয়া আশীর্বাদ করিলেন।

২৫ মে। তিনি যেদিন যাত্রা করিলেন, সেদিন বুধবার। শনিবারে ফিরিয়া আসিলেন। পূর্বেও তিনি প্রতিদিন দশঘণ্টা করিয়া অরণ্যানীর নির্জনতার মধ্যে বাস করিতেন বটে কিন্তু রাত্রিকালে নিজ তাঁবুতে ফিরিয়া আসিলে চারিদিক হইতে এত লোক সঙ্গলাভের জন্য সাগ্রহে তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরিত যে, তাঁহার ভাব ভঙ্গ হইয়া যাইত, এবং সেইজন্যই তিনি এইরূপে পলায়ন করিয়াছিলেন। এখন তাঁহার মুখমণ্ডলে জ্যোতিঃ ফুটিয়া উঠিয়াছে। তিনি দেখিয়াছেন যে, তিনি এখনও সেই পুরাতন, নগ্নপদে ভ্রমণক্ষম এবং শীতাতপ ও অল্পাহার-সহিষ্ণু সন্ন্যাসীই আছেন; প্রতীচ্য-বাস তাঁহার ক্ষতি করিতে পারে নাই।

২ জুন। শুক্রবার প্রাতঃকালে আমরা বসিয়া কাজ কর্ম করিতেছিলাম, এমন সময়ে এক ‘তার’ আসিল। তারটি একদিন দেরীতে আসিয়াছিল। তাহাতে লেখা ছিল-‘কল্য রাত্রে উতকামণ্ডে গুডউইনের দেহত্যাগ হইয়াছে।’ সে অঞ্চল যে (typhoid) মহামারীর সূত্রপাত হইতেছিল, আমাদের বন্ধু তাহারই করালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন; তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বামীজীর কথা কহিয়াছিলেন।

৫ জুন। রবিবার সন্ধ্যার সময় স্বামীজী স্বীয় আবাসে ফিরিয়া আসিলেন। আমাদের ফটক এবং উঠান হইয়াই তাঁহার রাস্তা। তিনি সেই রাস্তা ধরিয়া আসিলেন এবং সেই প্রাঙ্গণে আমরা মুহূর্তেকের জন্য বসিয়া তাঁহার সহিত কথা কহিলাম। তিনি দুঃসংবাদের বিষয় জানিতেন না, কিন্তু ইতঃপূর্বেই যেন এক গভীর বিষাদচ্ছায়া তাঁহাকেও আচ্ছন্ন করিয়াছিল এবং অনতিবিলম্বেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া তিনি আমাদিগকে সেই মহাপুরুষের৬ কথা স্মরণ করাইয়া দিলেন, যিনি গোখুরা সর্প কর্তৃক দষ্ট হইয়া এইমাত্র বলিয়াছিলেন, ‘প্রেমময়ের নিকট হইতে দূত আসিয়াছে,’ এবং যাঁহাকে স্বামীজী শ্রীরামকৃষ্ণের পরেই সর্বাপেক্ষা অধিক ভালবাসিতেন। তিনি বলিলেন, এইমাত্র আমি এক পত্র পাইলাম, তাহাতে লেখা আছে ‘পওহারী বাবা নিজ দেহ দ্বারা তাঁহার যজ্ঞসমূহের পূর্ণাহুতি প্রদান করিয়াছে। হোমাগ্নিতে তিনি স্বীয় দেহ ভস্মীভূত করিয়াছেন।’ তাঁহার শ্রোতৃবৃন্দের মধ্য হইতে একজন বলিয়া উঠিলেন, ‘স্বামীজী! এটি কি অত্যন্ত খারাপ কাজ হয় নাই?’

স্বামীজী গভীর আবেগ-কম্পিতকণ্ঠে উত্তর করিলেন, ‘তাহা আমি জানি না। তিনি এত বড় মহাপুরুষ ছিলেন যে, আমি তাঁহার কার্যকলাপ বিচার করিবার অধিকারী নই। তিনি কি করিতেছিলেন, তাহা তিনিই জানিতেন।’

৬ জুন। পরদিন প্রাতে তিনি খুব সকাল সকাল আসিলেন। দেখিলাম, তিনি এক গভীরভাবে ভাবিত। পরে বলিলেন যে, তিনি রাত্রি চারিটা হইতেই জাগরিত এবং একজন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়া গুডউইন-সাহেবের মৃত্যুসংবাদ তাঁহাকে দিয়াছে। আঘাতটি তিনি নীরবে সহিয়া লইলেন, কয়েক দিন পরে তিনি যে-স্থানে প্রথম ইহা পাইয়াছিলেন, সে-স্থানেই আর থাকিতে চাহিলেন না; বলিলেন, তাঁহার সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত শিষ্যের আকৃতি রাতদিন তাঁহার মনে পড়িতেছে, এবং ইহা যে দুর্বলতা, এ-কথাও জ্ঞাপন করিলেন। ইহা যে দোষাবহ, তাহা দেখাইবার জন্য তিনি বলিলেন যে, কাহারও স্মৃতি দ্বারা এইরূপে পীড়িত হওয়াও যা, আর ক্রমবিকাশের উচ্চতর সোপানে মৎস্য কিম্বা কুক্কুরসুলভ লক্ষণগুলি অবিকল বজায় রাখাও তাই, ইহাতে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নাই। মানুষকে এই ভ্রম জয় করিতে হইবে এবং জানিতে হইবে যে, মৃতব্যক্তিগণ যেমন আগে ছিলেন, এখনও ঠিক তেমনি-এইখানে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন। তাঁহাদের অনুপস্থিতি এবং বিচ্ছেদটাই শুধু কাল্পনিক। আবার পরক্ষণেই কোন ব্যক্তিবিশেষের (সগুণ ঈশ্বরের) ইচ্ছানুসারে এই জগৎ পরিচালিত হইতেছে, এইরূপ নির্বুদ্ধিতামূলক কল্পনার বিরুদ্ধে তিনি তীব্রভাবে প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, ‘গুডউইনকে মারিয়া ফেলার জন্য এরূপ ঈশ্বরকে যুদ্ধে নিপাত করাটা মানুষের অধিকার এবং কর্তব্যের মধ্যে নহে কি?-গুডউইন বাঁচিয়া থাকিলে কত বড় বড় কাজ করিতে পারিত!

স্বামীজীর এই উক্তিটির সহিত, এক বৎসর পরে যে আর একটি উক্তি শুনিয়াছিলাম, তাহার উল্লেখ বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। আমরা যে-সকল অলীক কল্পনা সহায়ে সান্ত্বনা পাইবার চেষ্টা করি, তাহা দেখিয়া ঠিক এইরূপ তীব্র বিস্ময়ের সহিত তিনি বলিয়া উঠিয়াছিলেন, ‘দেখ, প্রত্যেক ক্ষুদ্র শাসক এবং কর্মচারীর জন্য অবসর ও বিশ্রামের সময় নির্দিষ্ট আছে। আর চিরন্তন শাসক ঈশ্বরই বুঝি শুধু চিরকাল বিচারাসনে বসিয়া থাকিবেন, তাঁহার আর কখনও ছুটি মিলিবে না!’

কিন্তু এই প্রথম কয়েক ঘণ্টা স্বামীজী তাঁহার বিয়োগদুঃখে অটল রহিলেন এবং আমাদের সহিত বসিয়া ধীরভাবে নানা কথা কহিতে লাগিলেন। সেদিন প্রাতঃকালে তিনি ক্রমাগত ভক্তি যে তপস্যায় পরিণত হয়, সেই কথা বলিতে লাগিলেন, কিরূপে প্রগাঢ় ভগবৎ-প্রেমের খরতর প্রবাহ মানুষকে ব্যক্তিত্বের সীমা ছাড়াইয়া বহুদূর ভাসাইয়া লইয়া গেলেও আবার তাহাকে এমন একস্থানে ছাড়িয়া দিয়া যায়, যেখানে সে ব্যক্তিত্বের মধুর বন্ধন হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য ছটফট করে।

সেদিন সকালের ত্যাগসম্বন্ধীয় উপদেশসমূহ শ্রোতৃবর্গের মধ্যে একজনের নিকট অতি কঠিন বলিয়া বোধ হইল; পুনরায় তিনি আসিলে উক্ত মহিলা তাঁহাকে বলিলেন, ‘আমার ধারণা-অনাসক্ত হইয়া ভালবাসায় কোনরূপ দুঃখোৎপত্তির সম্ভাবনা নাই, এবং ইহা স্বয়ংই সাধ্যস্বরূপ।’

হঠাৎ গম্ভীরভাব ধারণ করিয়া স্বামীজী তাঁহার দিকে ফিরিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘এই যে ত্যাগ-রহিত ভক্তির কথা বলিতেছ, এটা কি? ইহা অত্যন্ত হানিকার!’ সত্যই যদি অনাসক্ত হইতে হয়, তবে কিরূপ কঠোর আত্মসংযমের অভ্যাস আবশ্যক, কিরূপে স্বার্থপর উদ্দেশ্যগুলির আবরণ উন্মোচন করা চাই এবং অতি কুসুম-কোমল হৃদয়েরও যে, যে-কোন মুহূর্তে সংসারের পাপ-কালিমায় কলুষিত হইবার আশঙ্কা বর্তমান, এই সম্বন্ধে তিনি সেইখানে এক ঘণ্টা বা ততোধিক কাল দাঁড়াইয়া আলোচনা করিতে লাগিলেন। তিনি সেই ভারতবর্ষীয়া সন্ন্যাসিনীর কথা উল্লেখ করিলেন, যিনি ‘মানুষ কখনও ধর্মপথে আপনাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ জ্ঞান করিতে পারে?’ এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া উত্তরস্বরূপ ‘এক খুরি ছাই’ প্রেরণ করিয়াছিলেন। রিপুগণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সুদীর্ঘ ও ভয়ঙ্কর, এবং যে-কোন মুহূর্তেই বিজেতার বিজিত হওয়ার আশঙ্কা রহিয়াছে।

বহু সপ্তাহ পরে কাশ্মীরে যখন তিনি পুনরায় (ত্যাগ, সংযম, দীনতার) কথা কহিতেছিলেন, সেই সময় আমাদের মধ্যে একজন সাহস করিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল-তিনি এইরূপে যে-ভাবের উদ্রেক করিয়া দিতেছেন, উহা ইওরোপ যে দুঃখ-উপাসনাকে রোগীর লক্ষণ বলিয়া অত্যন্ত ঘৃণার চক্ষে দেখে, তাহাই কিনা?

মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া স্বামীজী উত্তর করিলেন, ‘আর সুখের পূজাটাই বুঝি ভারি উঁচুদরের জিনিষ?’ তারপর একটু থামিয়া পুনরায় বলিলেন, ‘কিন্তু আসল কথা এই যে, আমরা দুঃখেরও পূজা করি না, সুখেরও পূজা করি না; এই উভয়ের মধ্য দিয়া যাহা সুখদুঃখের অতীত, তাহাই লাভ করা আমাদের উদ্দেশ্য।’

৯ জুন। এই বৃহস্পতিবার প্রভাতে শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে কথাবার্তা হইল। জন্মগত হিন্দু শিক্ষাদীক্ষার জন্য স্বামীজীর মনের এক বিশেষত্ব এই ছিল যে, তিনি হয়তো একদিন কোন একটি ভাবে ভাবিত হইয়া সেই ভাবের গুণব্যাখ্যা করিলেন, আবার পর দিনই হয়তো উহাকে কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করিয়া একেবারে বিধ্বস্ত করিয়া ছাড়িয়া দিতে পারিতেন। এইরূপ চিন্তাপ্রণালীর প্রথম আভাস তিনি বাল্যকালে তাঁহার গুরুদেবের নিকট পাইয়াছিলেন। কোন এক ধর্মভাবের ঐতিহাসিক প্রামাণিকতা-বিষয়ে সন্দিহান হওয়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, ‘কি! তাহা হইলে তুমি কি মনে কর না যে, যাহারা এরূপ সব ভাবের ধারণা করিতে পারিত, তাহারাই সেই সব ভাবের মূর্তিমান বিগ্রহ ছিল?’

যেমন খ্রীষ্টের অস্তিত্ব-বিষয়ে, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব-সম্বন্ধেও তিনি কখনও কখনও তাঁহার স্বভাবসুলভ সাধারণ সন্দেহের ভাবে কথাবার্তা বলিতেনঃ ধর্মাচার্যগণের মধ্যে কেবল বুদ্ধ ও মহম্মদই সৌভাগ্যক্রমে ‘শত্রু-মিত্র’ দুই-ই পাইয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহাদের জীবনের ঐতিহাসিক অংশে সন্দেহের লেশমাত্র নাই। আর শ্রীকৃষ্ণ, তিনি তো সকলের চেয়ে বেশী অস্পষ্ট। কবি, রাখাল, শক্তিশালী শাসক, যোদ্ধা এবং ঋষি-হয়তো এই সব ভাবগুলি একত্র করিয়া গীতাহস্তে এক সুন্দর মূর্তিতে পরিণত করা হইয়াছিল।

আজ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সকল অবতারের মধ্যে আদর্শস্থানীয় বলিয়া বর্ণিত হইলেন, পরবর্তী অপূর্ব চিত্রে ভগবান্‌ সারথিবেশে অশ্বগুলিকে সংযত করিয়া রণক্ষত্রের চতুর্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন এবং নিমেষে ব্যূহসংস্থান লক্ষ্য করিয়া শিষ্যস্থানীয় রাজপুত্রকে গীতার গভীর আধ্যাত্মিক সত্যগুলি শুনাইতে আরম্ভ করিলেন।

স্বামীজী একটা কথা বারংবার বলিতেন যে, ভারতবর্ষীয় বৈষ্ণবগণ কল্পনামূলক গীতিকাব্যের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া গিয়াছেন।

কিন্তু এই কয় দিবস যাবৎ স্বামীজী কোথাও গিয়া একাকী বাস করিবার জন্য ছটফট করিতেছিলেন। যে-স্থানে তিনি গুডউনের মৃত্যুসংবাদ পাইয়াছেন, সেই স্থান তাঁহার নিকট অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল, এবং পত্র আদান-প্রদানে সেই ক্ষত ক্রমাগত নূতন হইয়া উঠিতেছিল। একদিন তিনি বলিয়াছিলেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণ বাহির হইতে কেবল ভক্তিময় বলিয়া মনে হইলেও প্রকৃতপক্ষে ভিতরে তিনি পূর্ণ জ্ঞানময় ছিলেন; কিন্তু তিনি (স্বামীজী) নিজে বাহ্যতঃ কেবল জ্ঞানময় বলিয়া মনে হইলেও ভিতরে ভক্তিতে পূর্ণ, এবং সেইজন্য মাঝে মাঝে তাঁহাতে নারী-সুলভ দুর্বলতা ও কোমলতার ভাব দেখা যাইত।

একদিন তিনি কোন একজনের লেখার কয়েকটি ক্রুটিপূর্ণ পঙ্‌ক্তি লইয়া গেলেন এবং উহাকে একটি ক্ষুদ্র কবিতারূপে৭ফিরাইয়া আনিলেন। সেটি স্বামিহীনা গুডউইন-জননীকে তাঁহার পুত্রের স্মরণে স্বামীজী-প্রদত্ত চিহ্নস্বরূপ প্রেরিত হইল।

সংশোধনের পর আসল কবিতাটির কিছুই রহিল না বলিয়া এবং যাঁহার লেখা সংশোধিত হইল, তিনি ক্ষুণ্ণ হইবেন এইরূপ আশঙ্কা করিয়া, তিনি আগ্রহ-সহকারে অনেকক্ষণ ধরিয়া বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করিতে লাগিলেন, ‘কেবল ছন্দ ও মাত্রা মিলাইয়া কথা গাঁথা অপেক্ষা কবিত্বপূর্ণভাবে অনুভব করা কত বড় জিনিষ!’

১০ জুন। আলমোড়া-বাসের শেষদিন অপরাহ্নে আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের সেই প্রাণঘাতিনী পীড়ার গল্প শুনিলাম। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার আহূত হইয়াছিলেন। তিনি আসিয়া রোগটিকে রোহিণী নামক ব্যাধি (Cancer) বলিয়া নির্দেশ করেন এবং ফিরিবার পূর্বে শিষ্যগণকে বহুবার বুঝাইয়া দেন-ইহা সংক্রামক রোগ। অর্ধ ঘণ্টা পরে ‘নরেন্দ্র’ (তখন তাঁহার ঐ নাম ছিল) আসিয়া দেখিলেন, শিষ্যেরা একত্র হইয়া ঐ-বিষয়ে আলোচনা করিতেছেন। ডাক্তার কি বলিয়া গিয়াছেন নিবিষ্টচিত্তে শুনিয়া, তারপর মেজের দিকে তাকাইয়া তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ের গোড়ায় ভুক্তাবশিষ্ট পায়সের বাটিটি দেখিতে পাইলেন। গলদেশের খাদ্যবাহী নলীটির সঙ্কোচনবশতঃ শ্রীরামকৃষ্ণ উক্ত পায়স গলাধঃকরণ করিবার জন্য অনেকবার ব্যর্থচেষ্টা করিয়াছিলেন, সুতরাং উহা তাঁহার মুখ হইতে বার বার বাহির হইয়া পড়িয়াছিল, এবং ঐ দুঃসাধ্য রোগের বীজাণুপূর্ণ শ্লেষ্মা ও পুঁজ নিশ্চয়ই তাহার সহিত ছিল। ‘নরেন্দ্র’ বাটিটি উঠাইয়া লইয়া সর্বসমক্ষে উহা নিঃশেষে পান করিয়া ফেলিলেন। ক্যান্সারের সংক্রামকতার কথা আর কখনও শিষ্যগণের মধ্যে উত্থাপিত হয় নাই।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!