ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে


কাঠগুদামের পথে

১১ জুন। শনিবার প্রাতে আমরা আলমোড়া ত্যাগ করিলাম। কাঠগুদাম পৌঁছিতে আমাদের আড়াই দিন লাগিয়াছিল।

রাস্তার এক স্থানে এক অদ্ভুত রকমের পুরানো পানচাক্কীর এবং শূন্য কামারশালের কাছে আসিয়া স্বামীজী ধীরামাতাকে বলিলেন, ‘লোকে বলে, এই পার্বত্য অঞ্চলে একজাতীয় গন্ধর্বসদৃশ অশরীরী জীবের বাস। আমি একটি সত্য ঘটনা জানি, তাহাতে এক ব্যক্তি এইখানে প্রথমে ঐ সকল মূর্তির দর্শন পান এবং তাহার বহু পরে এই জনশ্রুতির বিষয় অবগত হন।’

এখন গোলাপের মরসুম উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, কিন্তু অপর এক প্রকার ফুল (কামিনী ফুল) ফুটিয়া রহিয়াছে, স্পর্শমাত্রেই উহা ঝরিয়া পড়ে। ভারতীয় কাব্যজগতের সহিত ইহার স্মৃতি বিশেষভাবে জড়িত বলিয়া স্বামীজী উহা আমাদিগকে দেখাইয়া দিলেন।

১৩ জুন। রবিবার অপরাহ্নে আমরা সমতল ভূমির সন্নিকটে একটি হ্রদ ও জলপ্রপাতের উপরিভাগে একস্থানে বিশ্রাম করিলাম। সেইখানে স্বামীজী আমাদের জন্য রুদ্র-স্তুতিটির অনুবাদ করিলেনঃ

‘অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মাঽমৃতং গময়।

আবিরাবির্ম এধি, রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্।’

আমাদিগকে অসত্য হইতে সত্যে লইয়া যাও, আমাদিগকে তম হইতে জ্যোতিতে লইয়া যাও, আমাদিগকে মৃত্যু হইতে অমৃতে লইয়া যাও, আমাদিগের নিকট আবির্ভূত হও, আবির্ভূত হও, আমাদিগের নিকট আগমন কর। হে রুদ্র, তোমার যে করুণাপূর্ণ দক্ষিণমুখ, তদ্দ্বারা আমাদিগকে নিত্য রক্ষা কর।

‘আবিরাবির্ম এধি’-এই অংশের অনুবাদে তিনি অনেকক্ষণ ইতস্ততঃ করিলেন, ভাবিতে লাগিলেন, ইহার অনুবাদ এইরূপ দিবেন কিনাঃ ‘আমাদের অন্তস্তলে আসিয়া আমাদের সহিত মিলিত হও।’ কিন্তু অবশেষে তিনি আমাদের নিকট তাঁহার চিন্তার কারণ ব্যক্ত করিয়া সঙ্কোচের সহিত বলিলেন, ‘ইহার আসল মানে এই, আমাদেরই ভিতর দিয়া আমাদের নিকট আইস।’ ইহার আরও আক্ষরিক অনুবাদ এইরূপ হইবে, ‘হে রুদ্র, তুমি কেবল তোমার নিজের নিকটেই প্রকাশিত আছ, তুমি আমাদের নিকটেও আত্মপ্রকাশ কর।’ এক্ষণে তাঁহার অনুবাদটিকে সমাধিকালীন অনুভূতিরই এক ক্ষিপ্র ও সাক্ষাৎ প্রতিরূপ মাত্র বলিয়া মনে করি। উহা যেন সংস্কৃতের মধ্য হইতে সজীব হৃদয়টিকে পৃথক্ করিয়া লইয়া তাহাকেই পুনরায় ইংরেজী ভাষার আবরণে প্রকাশ করিতেছে।

বাস্তবিক সে অপরাহ্নটি যেন অনুবাদের শুভলগ্ন বলিয়া মনে হইল, এবং তিনি হিন্দুদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অঙ্গীভূত অতি সুন্দর মন্ত্রগুলির অন্যতম মন্ত্রটির৮ কিছু কিছু আমাদের নিকটে অনুবাদ করিয়া দিলেনঃ

আমি পরব্রহ্মকে লাভ করিতে ইচ্ছা করিতেছি; বায়ুসকল আমার অনুকূল হউক, নদীসকল অনুকূল হউক, ওষধিসকল অনুকূল হউক, রাত্রি ও ঊষা আমাদের অনুকূল হউক, পৃথিবীর ধূলি আমাদের অনুকূল হউক, দ্যৌরূপী পিতা আমাদের অনুকূল হউন, বনস্পতি সকল আমাদের অনুকূল হউক, সূর্য আমাদের অনুকূল হউন, গোসকলও আমাদের অনুকূল হউক। ওঁ মধু, ওঁ মধু, ওঁ মধু।

পরে স্বামীজী খেতড়ির নর্তকীর নিকট সুরদাসের যে গানটি শুনিয়াছিলেন, সেটি আমাদের নিকট পুনরায় গাহিলেনঃ

প্রভু মেরা অবগুণ চিত ন ধরো,
সমদরশী হৈ নাম তুমহারো, ইত্যাদি-।৯

সেই দিন কি আর এক দিন, তিনি আমাদের নিকট কাশীর সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর কথা বলিলেন, যিনি তাঁহাকে একপাল বানর কর্তৃক উত্ত্যক্ত দেখিয়া, এবং তিনি পশ্চাৎপদ হইয়া ফিরিয়া পলাইতে পারেন, এই আশঙ্কা করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিয়াছিলেন, ‘সর্বদা জানোয়ারগুলার সম্মুখীন হইও।’

বড় আনন্দেই আমরা উক্ত কয়দিন পথ চলিয়াছিলাম। প্রতিদিনই চটিতে পৌঁছিয়া দুঃখ বোধ হইত। এই সময়ে রেলযোগে ‘তরাই’ নামক সেই ম্যালেরিয়া-গ্রস্ত ভূখণ্ড অতিক্রম করিতে আমাদের একটি সারা বিকাল লাগিয়াছিল, এবং স্বামীজী আমাদের স্মরণ করাইয়া দিলেন যে, ইহাই বুদ্ধের জন্মভূমি।

স্থান-বেরিলী হইতে বারামুল্লা
কাল-১৪ হইতে ২০ জুন

১৪ জুন। পরদিন আমরা পঞ্জাব প্রবেশ করিলাম; এই ঘটনায় স্বামীজী অতিশয় উল্লসিত হইলেন। এই প্রদেশের প্রতি তাঁহার এত প্রীতি ছিল যে, উহা ঠিক যেন তাঁহার জন্মভূমি বলিয়া বোধ হইত। স্বামীজী বলিলেন, ‘এখানে মেয়েরা চরকা কাটিতে কাটিতে তাহার ‘সোঽহং সোঽহং’ ধ্বনি শুনিয়া থাকে।’ বলিতে বলিতে সহসা বিষয়ান্তর আলোচনায় তিনি সুদূর অতীতে চলিয়া গেলেন এবং আমাদের সমক্ষে যবনগণের সিন্ধুনদ-তীরে অভিযান, চন্দ্রগুপ্তের আবির্ভাব এবং বৌদ্ধসাম্রাজ্যের বিস্তার, এই-সকল মহান্ ঐতিহাসিক দৃশ্যাবলী একে একে উদ‍্‍ঘাটন করিতে লাগিলেন। এই গ্রীষ্মে তিনি যেমন করিয়া হউক আটক পর্যন্ত গিয়া, যেখানে বিজয়ী সেকেন্দর প্রতিহত হইয়াছিলেন, সেই স্থানটি স্বচক্ষে দর্শন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। তিনি আমাদের নিকট গান্ধার-ভাস্কর্যের বর্ণনা করিলেন (নিশ্চয়ই সেগুলি তিনি পূর্ব বৎসর লাহোরের যাদুঘরে দেখিয়া থাকিবেন) এবং ‘কলাবিদ্যা-সম্বন্ধে ভারতবর্ষ চিরকাল যবনগণের শিষ্যত্ব করিয়াছে’-ইওরোপীয়গণের এই অর্থহীন অন্যায় দাবী নিরাকরণ করিতে করিতে তিনি যারপরনাই উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। গোধূলির আলোকে এই সকল পার্বত্য ভূখণ্ডের কোন একটি অতিক্রমকালে স্বামীজী আমাদিগকে তাঁহার সেই বহুদিন পূর্বের অপূর্ব দর্শনের কথা বলিলেন। তিনি তখন সবেমাত্র সন্ন্যাস-জীবনে পদার্পণ করিয়াছেন এবং পরে তাঁহার বরাবর এই বিশ্বাস ছিল যে, সংস্কৃতে মন্ত্র আবৃত্তি করিবার প্রাচীন রীতি তিনি এই ঘটনা হইতেই পুনঃপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

তিনি বলিলেন, ‘সন্ধ্যা হইয়াছে; আর্যগণ সবেমাত্র সিন্ধুনদ-তীরে পদার্পণ করিয়াছেন, ইহা সেই যুগের সন্ধ্যা। দেখিলাম, বিশাল নদের তীরে বসিয়া এক বৃদ্ধ। অন্ধকার-তরঙ্গের পর অন্ধকার তরঙ্গ আসিয়া তাঁহার উপর পড়িতেছে, আর তিনি ঋগ্বেদ হইতে আবৃত্তি করিতেছেন। তারপর আমি সহজ অবস্থা প্রাপ্ত হইলাম এবং আবৃত্তি করিয়া যাইতে লাগিলাম। বহু প্রাচীনকালে আমরা যে সুর ব্যবহার করিতাম, ইহা সেই সুর।’

এই আলোচনা-প্রসঙ্গে আর একদিন তিনি বলিতেছিলেন, ‘শঙ্করাচার্য বেদের ধ্বনিটিকে ঠিক ধরিতে পারিয়াছিলেন, উহাই আমাদের জাতীয় তান। বলিতে কি, আমার চিরন্তন ধারণা-’ বলিতে বলিতে হঠাৎ তাঁহার কণ্ঠস্বর যেন আবেগময় হইয়া আসিল এবং দৃষ্টি যেন সুদূরে নিবদ্ধ হইল-‘আমার চিরন্তন ধারণা এই যে, তাঁহারও শৈশবে আমার মত কোন এক অলৌকিক দর্শন-লাভ নিশ্চয়ই ঘটিয়াছিল, এবং তিনি ঐরূপে সেই প্রাচীন তানকে উদ্ধার করিয়াছিলেন। ইহা সত্য হউক বা না হউক, বেদ ও উপনিষদ্‌সমূহের সৌন্দর্যকে স্পন্দিত করাই তাঁহার সমগ্র জীবনের কাজ।’

রাওলপিণ্ডি হইতে মরী পর্যন্ত আমরা টঙ্গায় গেলাম এবং কাশ্মীর-যাত্রার পূর্বে তথায় কয়েক দিন অতিবাহিত করিলাম। এইখানে স্বামীজী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যদি তিনি প্রাচীনপন্থী পরিবেশে কোন ইওরোপীয়কে শিষ্যরূপে বা স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রহণ করাইতে কোন চেষ্টা করেন, তাহা হইলে তাহা বাঙলা দেশে করাই ভাল। পঞ্জাবে বিদেশীয়দিগের প্রতি অবিশ্বাস এত প্রবল যে, সেখানে এরূপ কোন কার্যের সফলতার সম্ভাবনা নাই। মধ্যে মধ্যে এই সমস্যাটি তাঁহার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করিত; এবং তিনি কখনও কখনও বলিতেন যে, বাঙালীরা রাজনীতি-বিষয়ে ইংরেজের বিরোধী, অথচ উভয়ের মধ্যে পরস্পর ভালবাসা ও বিশ্বাসের একটা প্রবণতা রহিয়াছে; ইহা আপাতবিরুদ্ধ হইলেও সত্য।

অপরাহ্নের অনেকটা সময় আমরা ঝড়ের জন্য ঘরের মধ্যে কাটাইতে বাধ্য হইয়াছিলাম। ডুলাই-এ আমাদের হিন্দুধর্ম-বিষয়ক জ্ঞানলাভের এক নূতন অধ্যায় খুলিয়া গেল। কারণ, স্বামীজী গম্ভীর ও বিশদভাবে এই ধর্মের আধুনিক অধোগতির কথা আমাদিগকে বলিলেন, এবং উহাতে যে-সকল কুরীতি বামাচার নামে প্রচলিত রহিয়াছে, সেগুলির প্রতি স্বীয় আপসহীন বিরোধিতার কথাও উল্লেখ করিলেন।

যিনি কাহাকেও নিরাশ করা সহ্য করিতে পারিতেন না, সেই শ্রীরামকৃষ্ণ এই সব কি দৃষ্টিতে দেখিতেন, এ কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, ‘ঠাকুর বলিতেন-হাঁ, তা বটে, কিন্তু প্রত্যেক বাড়ীরই একটা পায়খানার দুয়ারও তো আছে!’ অতঃপর স্বামীজী দেখাইয়া দিলেন যে, সকল দেশেই যে-সকল সম্প্রদায়ে কদাচারের ভিতর দিয়া ধর্মলাভের চেষ্টা করা হয়, তাহারা এই শ্রেণীভুক্ত।

আমরা স্বামীজীর সহিত পালা করিয়া টঙ্গায় যাইবার ব্যবস্থা করিলাম, এবং এই পরবর্তী দিনটি যেন অতীত স্মৃতির আলোচনাতেই পূর্ণ ছিল।

তিনি ব্রহ্মবিদ্যা সম্বন্ধে-‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ সত্তার সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে বলিতে লাগিলেন, এবং প্রেমই যে পাপের একমাত্র ঔষধ, তাহাও বলিলেন। তাঁহার স্কুলের একজন সহপাঠী বড় হইয়া ধনশালী হইলেন, কিন্তু তাঁহার স্বাস্থ্য ভাঙিয়া গেল। রোগটির ঠিক পরিচয় পাওয়া যাইতেছিল না; উহার ফলে দিন দিন তাঁহার জীবনীশক্তি ক্ষীণ হইতেছিল, এবং চিকিৎসকগণের নৈপুণ্য সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হইয়াছিল। অবশেষে ‘স্বামীজী চিরকাল ধর্মাভাবাপন্ন’-ইহা জানা থাকায় এবং অন্য সব উপায় বিফল হইলে মানুষ ধর্মের আশ্রয় লয় বলিয়া তিনি স্বামীজীকে একবার আসিতে অনুরোধ করিয়া লোক পাঠাইলেন। আচার্যদেব তথায় পৌঁছিলে একটি কৌতুককর ঘটনা ঘটিল।

‘যিনি ব্রহ্মকে আপনা হইতে অন্যত্র জানেন, ব্রহ্ম তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করেন; যিনি ক্ষত্রিয়কে আপনা হইতে অন্যত্র জানেন, ক্ষত্রিয় তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করেন; এবং যিনি লোকসকলকে আপনা হইতে অন্যত্র ভাবেন, লোকসকল তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করেন।’-এই শ্রুতিবাক্য১০ তাঁহার মনে পড়িল এবং রোগীও ইহার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিয়া রোগ হইতে মুক্ত হইলেন। পরে স্বামীজী বলিলেন, ‘সুতরাং যদিও আমি অনেক সময় তোমাদের মনের মত কথা বলি না, বা রাগিয়া কথা বলি, তথাপি মনে রাখিও যে, প্রেম ভিন্ন অন্য কিছু প্রচার করা আদৌ আমার অন্তরের ভাব নহে। আমরা যে পরস্পরকে ভালবাসি, এইটুকু হৃদয়ঙ্গম হইলেই এই সব গণ্ডগোল মিটিয়া যাইবে!’

সম্ভবতঃ সেই দিনই (অথবা পূর্বদিনও হইতে পারে) তিনি ‘মহাদেব’-প্রসঙ্গে আমাদের নিকট বলিলেন, শৈশবে তাঁহার জননী পুত্রের দুষ্টামি দেখিয়া হতাশ হইয়া বলিতেন, ‘এত জপ, এত উপবাসের ফলে শিব কিনা একটি পুণ্যাত্মার পরিবর্তে তোকে-ভূতকে পাঠাইলেন!’ অবশেষে তিনি যে সত্য-সত্যই শিবের একটি ভূত, এই ধারণা তাঁহাকে পাইয়া বসিল। তাঁহার মনে হইল, যেন কোন শাস্তির নিমিত্ত তিনি কিছুদিনের জন্য শিবলোক হইতে নির্বাসিত হইয়াছেন, আর তাঁহার জীবনের একমাত্র চেষ্টা হইবে-সেখানে ফিরিয়া যাওয়া।

তিনি একদিন বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার প্রথম আচার-মর্যাদালঙ্ঘন পাঁচ বৎসর বয়সে হইয়াছিল। সেই সময় তিনি খাইতে খাইতে ডান হাত এঁটো-মাখা থাকিলে বাঁ হাতে জলের গেলাস তুলিয়া লওয়া কেন অধিক পরিচ্ছন্নতার কাজ হইবে না, এই মর্মে তাঁহার মাতার সহিত এক তুমুল তর্কে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এই দুষ্টামি অথবা এই জাতীয় অন্য সব দুষ্টামির জন্য জননীর অমোঘ ঔষধ ছিল-বালককে জলের কলের নীচে বসাইয়া দেওয়া, এবং তাঁহার মস্তকে শীতল জলধারা পড়িতে থাকিলে ‘শিব! শিব!’ উচ্চারণ করা। স্বামীজী বলিলেন, এই উপায়টি কখনও বিফল হইত না। মাতার জপ তাঁহাকে তাঁহার নির্বাসনের কথা মনে পড়াইয়া দিত, এবং তিনি মনে মনে ‘না, না, এবার আর নয়!’ এই বলিয়া আবার শান্ত এবং বাধ্য হইতেন।

মহাদেবের প্রতি তাঁহার অপরিসীম ভালবাসা ছিল, এবং একদা তিনি ভারতের ভাবী স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন, যদি তাহারা তাহাদের নূতন নূতন কর্তব্যের মধ্যে মনে করিয়া মধ্যে মধ্যে শুধু ‘শিব! শিব!’ বলে, তাহা হইলেই তাহাদের পক্ষে যথেষ্ট পূজা করা হইবে। তাঁহার নিকট হিমালয়ের বাতাস পর্যন্ত সেই অনাদি অনন্ত ধ্যানের বিষয়ীভূত মূর্তি দ্বারা ওতপ্রোত, যে-ধ্যান সুখচিন্তার দ্বারা ভগ্ন হইবার নহে; এবং তিনি বলিলেন-এই গ্রীষ্ম ঋতুতেই তিনি প্রথম সেই প্রাকৃতিক কাহিনীর অর্থ বুঝিলেন, যাহাতে মহাদেবের মস্তকে এবং সমতল প্রদেশে অবতরণের পূর্বে, শিবের জটার মধ্যে সুরধুনীর ইতস্ততঃ সঞ্চারণ কল্পিত হইয়াছে। তিনি বলিলেন যে, তিনি বহুদিন ধরিয়া পর্বতমধ্যবাহিনী নদী ও জলপ্রপাতসকল কি কথা বলে, ইহা জানিবার জন্য অনুসন্ধান করিয়াছিলেন এবং অবশেষে জানিয়াছেন, ইহা সেই অনাদি অনন্ত ‘হর হর বম্ বম্’ ধ্বনি! তিনি একদিন শিবের প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন, ‘হ্যাঁ, তিনিই মহেশ্বর, শান্ত, সুন্দর এবং মৌন! আর আমি তাঁহার পরম ভক্ত।’

আর এক সময় তাঁহার বক্তব্য বিষয় ছিল-বিবাহ কিরূপে ঈশ্বরের সহিত জীবাত্মার সম্বন্ধেরই আদর্শস্বরূপ। তিনি উৎসাহভরে বলিলেন, ‘এই জন্যই-যদিও মাতার স্নেহ কতকাংশে এতদপেক্ষা মহত্তর, তথাপি পৃথিবীসুদ্ধ লোক স্বামী-স্ত্রীর প্রেমকেই আদর্শ বলিয়া থাকে। অপর কোন প্রেমেই এরূপ মনের মতন করিয়া গড়িয়া লইবার অপূর্ব শক্তি নাই। প্রেমাস্পদকে যেমনটি কল্পনা করা যায়, সত্য সত্যই সে ঠিক তেমনটিই হইয়া উঠে, এই প্রেমে প্রেমাস্পদকে রূপান্তরিত করিয়া দেয়।’

পরে কথাপ্রসঙ্গে জাতীয় আদর্শের কথা উঠিল, এবং বিদেশপ্রত্যাগত পান্থ কিরূপ আনন্দের সহিত আবার স্বদেশের নরনারীকে স্বাগত জানায়, স্বামীজী তাহা উল্লেখ করিলেন। সারা জীবন ধরিয়া মানুষ অজ্ঞাতসারে এই শিক্ষা লাভ করিয়া আসে যে, সে স্বদেশবাসীর মুখে এবং আকৃতিতে ভাবের মৃদুতম আলোড়নটি পর্যন্ত বুঝিতে পারে।

পথে যাইতে যাইতে আমাদের পুনরায় একদল পদচারী সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হইল। তাঁহাদের কৃচ্ছ্রানুরাগ দেখিয়া স্বামীজী কঠোর তপস্যাকে ‘বর্বরতা’ বলিয়া তীব্র সমালোচনা করিতে লাগিলেন। যাত্রিগণ তাহাদের আদর্শের নামে ধীরে ধীরে ক্রোশের পর ক্রোশ পথ অতিবাহন করিতেছে, এই দৃশ্যে তাঁহার মনে কষ্টকর স্মৃতি-পরম্পরার উদয় হইল, এবং মানব-সাধারণের পক্ষ হইতে তিনি ধর্মের উৎপীড়নে অধীর হইয়া উঠিলেন। পরে আবার ঐ ভাব যেমন হঠাৎ আসিয়াছিল, তেমনই হঠাৎ চলিয়া গেল এবং তৎপরিবর্তে সমান দৃঢ়তার সঙ্গে যুক্ত হইল-এই ‘বর্বরতা‘ না থাকিলে বিলাস আসিয়া মানুষের সমুদয় মনুষ্যত্ব অপহরণ করিত।


কাশ্মীর উপত্যকা
স্থান-বিতস্তা নদী (বারামুল্লা হইতে শ্রীনগর)
কাল-২০ হইতে ২২ জুন
‘ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়’-পরম উল্লাসে এই কথা বলিতে বলিতে স্বামীজী আমাদের ডাকবাংলার কামরায় ফিরিয়া আসিলেন, এবং ছাতাটি জানুদ্বয়ের উপর রাখিয়া উপবেশন করিলেন; কোন সঙ্গী না লইয়া আসায় তাঁহাকেই সাধারণ ছোটখাট কাজগুলি সম্পাদন করিতে হইতেছিল, ডোঙা ভাড়া করা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় কাজের জন্য তিনি বাহির হইয়াছিলেন। কিন্তু বাহির হইয়াই হঠাৎ একজন লোকের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়, তিনি স্বামীজীর নাম শ্রবণে কাজের সমস্ত ভার নিজের উপর লইয়া তাঁহাকে নিশ্চিন্ত মনে ফিরিয়া যাইতে বলিয়াছিলেন। সুতরাং দিনটি আমাদের আনন্দে কাটিয়াছিল। আমরা সামাভারে তৈরী কাশ্মীরী চা পান করিলাম, এবং ঐ দেশের মোরব্বা খাইলাম। পরে প্রায় চারিটার সময় আমরা তিনডোঙ্গা-বিশিষ্ট এক ক্ষুদ্র নৌ-বহর অধিকার করিলাম এবং আর বিলম্ব না করিয়া শ্রীনগরাভিমুখে যাত্রা করিলাম। প্রথম সন্ধ্যাটিতে আমরা স্বামীজীর জনৈক বন্ধুর বাগানের পাশে নঙ্গর করিয়াছিলাম।

পরদিন আমরা তুষারমণ্ডিত পর্বতরাজি দ্বারা পরিবেষ্টিত এক মনোরম উপত্যকায় উপস্থিত হইলাম। ইহাই ‘কাশ্মীর উপত্যকা’ নামে পরিচিত; কিন্তু হয়তো ‘শ্রীনগর উপত্যকা’ বলিলে ইহার ঠিক ঠিক পরিচয় দেওয়া হয়।

সেই প্রথম প্রভাতে ক্ষেতের উপর দিয়া লম্বা এক চোট ভ্রমণের পর আমরা এক বিস্তৃত গোচারণ-ভূমির মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি প্রকাণ্ড চেনার গাছের নিকট উপস্থিত হইলাম। সত্য-সত্যই দেখিলাম, যেন এই গাছের কোটরে প্রবাদোক্ত বিশটা গরু স্থান পাইতে পারে! কিরূপে ইহাকে এক সাধু-নিবাসের উপযোগী করিয়া লওয়া যাইতে পারে, স্বামীজী এই স্থাপত্যবিষয়ক আলোচনায় ব্যাপৃত হইলেন। বাস্তবিকই এ সজীব বৃক্ষটির কোটরে একটি ক্ষুদ্র কুটীর নির্মিত হইতে পারিত। পরে তিনি ধ্যানের কথা বলিতে লাগিলেন; ফলে দাঁড়াইল এই যে, ভবিষ্যতে চেনার গাছ দেখিলেই ঐ কথার স্মৃতি উহাকে পবিত্রতায় মণ্ডিত করিয়া দিবে!

তাঁহার সহিত আমরা নিকটস্থ গোলাবাড়ীতে প্রবেশ করিলাম। সেখানে দেখিলাম, তরুতলে বসিয়া এক পরম সুশ্রী বর্ষীয়সী রমণী। তাঁহার মাথায় কাশ্মীরীনারী-সুলভ লাল টুপী এবং শ্বেত অবগুণ্ঠন। তিনি বসিয়া পশম হইতে সূতা কাটিতেছিলেন এবং তাঁহার চারি পাশে তাঁহার দুই পুত্রবধূ এবং তাহাদের ছেলেপিলেরা তাঁহাকে সাহায্য করিতেছে। স্বামীজী পূর্ব শরৎ ঋতুতে আর একবার এই গোলাবাড়ীতে আসিয়াছিলেন, এবং সেই অবধি এই বৃদ্ধাটির স্বধর্মে আস্থা এবং গৌরব-বোধের কথা অনেকবার বলিয়াছিলেন। সে-বার তিনি জল খাইতে চাহিয়াছিলেন, এবং বৃদ্ধাও তৎক্ষণাৎ তাহাকে জল দিয়াছিলেন। বিদায় লইবার পূর্বে তিনি তাঁহাকে ধীরভাবে জিজ্ঞাসা লরিয়াছিলেন, ‘মা, আপনি কোন্ ধর্মাবলম্বিনী?’ সগর্বে জয়ের উল্লাসে উচ্চকণ্ঠে বৃদ্ধা উত্তর দিয়াছিলেন, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! প্রভুর কৃপায় আমি মুসলমানী!’ এক্ষণে এই মুসলমান পরিবারের সকলে মিলিয়া স্বামীজীকে পুরাতন বন্ধুরূপে অভ্যর্থনা করিলেন এবং তিনি যে বন্ধুগণকে সঙ্গে আনিয়াছিলেন, তাঁহাদের প্রতিও তাঁহারা সর্ববিধ সৌজন্য-প্রকাশে রত হইলেন।

শ্রীনগর পৌঁছিতে দুই-তিন দিন লাগিয়াছিল, এবং একদিন সন্ধ্যাকালে আহারের পূর্বে ক্ষেতের উপর বেড়াইতে বেড়াইতে আমাদের মধ্যে একজন (যিনি কালীঘাট দেখিয়াছিলেন) আচার্যদেবের নিকট অভিযোগ করিলেন যে, কালীঘাটে ভক্তির অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস তাঁহার বিসদৃশ বোধ হইয়াছিল, এবং বলিয়া উঠিলেন, ‘প্রতিমার সম্মুখে লোকে ভূমিতে সাষ্টাঙ্গ হয় কেন?’ স্বামীজী একটি তিলের ক্ষেতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিতেছিলেন, ‘তিল আর্যগণের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন তৈলবাহী বীজ’, কিন্তু এই প্রশ্নে তিনি হস্তস্থিত ক্ষুদ্র নীল ফুলটি ফেলিয়া দিলেন, পরে স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া প্রশান্ত গম্ভীর স্বরে বলিলেন, ‘এই পর্বতমালার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গ হওয়া আর সেই প্রতিমার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গ হওয়া কি একই কথা নয়?’

আচার্যদেব আমাদিগের নিকট প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, গ্রীষ্মাবসানের পূর্বেই তিনি আমাদিগকে কোন শান্তিপূর্ণ স্থানে লইয়া গিয়া ধ্যান শিক্ষা দিবেন। স্থির হইল যে, আমরা প্রথমে দেশটি দেখিব-তারপর নির্জনবাস করিব।

শ্রীনগরে প্রথম রজনীতে আমরা কতিপয় বাঙালী রাজকর্মচারীর গৃহে ভোজন করিয়াছিলাম, এবং নানা কথার প্রসঙ্গে পাশ্চাত্য অভ্যাগতগণের মধ্যে একজন মত প্রকাশ করিলেন, ‘প্রত্যেক জাতির ইতিহাস কতকগুলি আদর্শের রূপায়ণ এবং বিকাশ-স্বরূপ; উক্ত জাতির সকল লোকেরই উচিত সেইগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া থাকা।’ আমরা দেখিয়া কৌতুক অনুভব করিলাম যে, উপস্থিত হিন্দুগণ ইহাতে আপত্তি উত্থাপন করিলেন। তাঁহাদের চক্ষে ইহা তো স্পষ্টই একটি বন্ধন, এবং মানবমন কখনই চিরকাল ইহার অধীন হইয়া থাকিতে পারে না। উক্ত মতের বন্ধনাত্মক অংশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া তাঁহারা সমগ্র ভাবটির প্রতিই অবিচার করিলেন বলিয়া মনে হইল। অবশেষে স্বামীজী মধ্যস্থ হইয়া বলিলেন, ‘তোমরা বোধ হয় স্বীকার করিবে যে, মানব প্রকৃতির ক্ষেত্রে চূড়ান্ত শ্রেণীভাগের একক (unit) মনস্তাত্ত্বিক; ভৌগোলিক বিভাগ অপেক্ষা ইহা অধিকতর স্থায়ী। প্রণালী হিসাবে এই ভাবগত সাদৃশ্যগ্রহণকে একদেশবর্তিতামূলক সাদৃশ্যগ্রহণ অপেক্ষা চিরস্থায়ী করা যায়।’ তারপর তিনি আমাদের সকলেরই পরিচিত দুইজনের কথা উল্লেখ করিলেন; তন্মধ্যে একজনকে-তিনি জীবনে যত খ্রীষ্টান দেখিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে আদর্শস্থানীয় বলিয়া বরাবর মনে করিতেন অথচ তিনি একজন বঙ্গনারী; এবং আর একজনের জন্মভূমি পাশ্চাত্যে, কিন্তু স্বামীজী বলিতেন, ঐ ব্যক্তি তাঁহার চেয়েও ভাল হিন্দু। সব দিক্‌ ভাবিয়া দেখিলে এ অবস্থায় ইহাই কি সর্বাপেক্ষা বাঞ্ছনীয় ছিল না যে, উহাদের একে অপরের দেশে জন্মগ্রহণ করিয়া নিজ নিজ আদর্শের যথাসম্ভব প্রসার বিধান করে?

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!