ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ ২

-ড. এমদাদুল হক

১৬
যত্রতত্র পশু জবাই নিষিদ্ধ হবে না কেন? যেখানে-সেখানে পশু জবাই করলে জনস্বাস্থ্য প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে থাকে, পরিবেশ দূষিত হয় মারাত্মকভাবে। তাই উন্নত দেশগুলোতে জবাইখানা ছাড়া পশু জবাই নিষিদ্ধ। মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে যত্রতত্র পশু জবাই করা দণ্ডনীয় অপরাধ। বৃটিশ আমলে স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড় ক্যাম্পাসে ঈদ-উল আযহার দিনে পশু জবাই নিষিদ্ধ করেছিলেন।

আমাদের দেশেও পশু জবাই আইন আছে। ‘পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন: ২০১১’-তে বলা আছে- জবাইখানার বাইরে পশু জবাই করা যাবে না; জবাইয়ের পরিবেশ হতে হবে মানসম্মত; থাকতে হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা; মাংস বানানোর কর্মীদের সংক্রামক রোগ মুক্ত হতে হবে; সিটি করপোরেশনের নিজস্ব প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা এ বিষয়গুলো পরিদর্শন করবেন ইত্যাদি।

কিন্তু এই আইনটি উৎসব দিবসের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেসব কারণে ‘পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন’ করা হলো উৎসব দিবসেও ঐ কারণগুলো উপস্থিত থাকে। উৎসব দিবসে জবাইকৃত পশুর মাংসও মানুষ খায়। কুরবানির পশুতেও বর্জ্য থাকে, ঐ বর্জ্যতেও পরিবেশ নষ্ট হয়, কুরবানির পশুর মাংস খেয়েও মানুষ অসুস্থ হয়। জমজমের পানি পান করলেও প্রস্রাব হয়।

বর্জ্য বর্জ্যই। সুতরাং ‘পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন’ উৎসব দিবসের জন্য প্রযোজ্য হবে না কেন? উৎসবের পর পশুর বর্জ্য থেকে যদি ডেঙ্গুর বংশবৃদ্ধি দ্বিগুণ হয়-এর দায় কে নেবে?

ইসলাম অর্থ শান্তি। যেসব কাজ অশান্তি উৎপন্ন করে তা অনৈসলামিক নয় কি? প্রয়োজনীয় জবাইখানা স্থাপন কি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়? অন্যান্য মুসলিম দেশে ঈদগাহ নাই, কিন্তু জবাইখানা আছে। আমাদের দেশে ঈদগাহ আছে- জবাইখানা নাই কেন?

ঈদগাহ বানানো যায়- জবাইখানা বানানো যায় না কেন? কোনটির প্রয়োজন বেশি?

১৭
বাস, বাসা, বাসি
ঘুষ, ঘুষা, ঘুষি
দেই, দিচ্ছি, দিব
খাই, খাচ্ছি, খাবো।

কুর, কুরা, কুরি
বান, বানা, বানি
খাস, খাসা, খাসি
হাঁস, হাসা, হাসি।

কুল, কুলা, কুলি
নাচ, নাচা, নাচি
মার, মারা, মারি
কর, কারা, কারি।

কান, কানা, কানি
বল, বলা, বলি
শুন, শোনা, শুনি
মান, মানা, মানি।

গুম, গুমা, গুমি
কাঁদ, কাঁদা, কাঁদি
চল, চলা, চলি
কাল, কালা, কালি।

১৮
বাস, বাসা, বাসি- তাৎপর্য কি? বাসের আধার হলো বাসা। বাস অর্থ একদিকে ফুলের বাস (সুগন্ধ, সৌরভ) অন্যদিকে আচ্ছাদন, বস্ত্র, থাকার জায়গা, থাকা ইত্যাদি। মানব অস্তিত্বকে ঘিরে রাখে বাস। অথবা বলা যায়, যা কিছু মানব অস্তিত্বকে ঘিরে রাখে তার সবকিছুই কোনো না কোনো প্রকারের আচ্ছাদন বা বাস।

যেমন বস্ত্র হলো দেহের আচ্ছাদন বা বাস। এই বাসই হয়ে যায় লেবাস। দেহ রক্ষার জন্য খাদ্য চাই। খাদ্যের প্রতীক হলো বাসন। শুধু বাসন হলে চলে না-কোশনও লাগে। তাই বাসনকোশন। থাকিবার জায়গা বা বাসাও অতি প্রয়োজন।

এইসব পাওয়ার জন্য মনে যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়, তাকে বলে বাসনা। বাসনা পূরণের জন্য মন নিত্য নতুন বস্ত্র চায়, অত্যাধুনিক বাসা চায় মানুষ বাসা বানাতে শিখে, বাসা সাজানো শিখে কিন্তু বাসার ভিতরে শান্তিতে বাস করতে শিখে না।

যে বাসায় শান্তি নেই সে বাসা ঝকমকে হলেও, ভালো বাসা নয়। ভালো বাসা হলো মানুষের হৃদয়। প্রত্যেকেই চায় তার ভালোতে কেউ বাস করুক এবং সে বাস করুক কারো ভালোতে। নাই কোনো ভালো বাসা-ভালোবাসা ছাড়া। তাই ভালোবাসি ভালোবাসা।

১৯
ঘুষ, ঘুষা, ঘুষি শব্দগুলোর ক্রিয়ামূল √ঘুষ্। ঘুষ্ এর রহস্য হলো ঘ। গ্+হ্=ঘ। গ হলো গমন। গমন হ্ হলে (থেমে গেলে) ঘ হয়। গন্তব্যে পৌঁছে থেমে গেলে হ্ থেকে হনন উৎপন্ন নাও হতে পারে। কিন্তু বাধা পেয়ে থামতে বাধ্য হলে ঘ হয়ে যায় ঘা।

ঘ-এর উত্তরণ হলো ঘু। ঘু মানে ঘুরাও হয়। ঘুরতে শক্তি লাগে। এই শক্তি অর্জনের জন্য ঘু যদি আরেকজনের ‘পেট কাটা শক্তি’ বা ‘ষ’-এর উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়, তখন তাকে বলে ঘুষ।

ঘুষের লেনদেন প্রকাশ্যে হয় না। ঘুষ নেওয়া হয় হাত মুঠ করে। মুষ্টিবদ্ধ হলেই হাত অতিরিক্ত শক্তির আধার হয়ে উঠে, অর্থাৎ ঘুষ হয়ে উঠে ঘুষা বা ঘুষের আধার।

বারবার ঘুষ নিতে নিতে ঘুষের আধার বা ঘুষা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এবং ঘুষি বা ঘা দেওয়ার মতো শক্তিমান হয়ে যায়। ফলে উৎপন্ন হয় সংঘর্ষ। সংঘর্ষ থেকে সংহার।

ঘুষের লেনদেন হয় কেন? বাস, বাসা ও বাসি থেকে উৎপন্ন বাসনা পূরণের জন্য। সত্য বটে, নাই কোনো ভালো বাসা- ভালোবাসা ছাড়া। কিন্তু মানুষ ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না- মানুষ বিশ্বাস করে টাকায়। তাই বলা হয়েছে- ঘুষ, ঘুষা, ঘুষি/ দেই, দিচ্ছি, দিব/ খাই, খাচ্ছি, খাবো।

অনেকেই মন্তব্য করেছেন “জীবনবেদ ১৭”-এর বেদ উদ্ধার করতে পারেননি। তাই এই সংক্ষিপ্ত তর্জমা। বাকি অংশটুকুর তর্জমা না করাই ভালো। রস চিপে বের করে দিতে হয় শিশুদের। পরিণতরা রস চিপে বের করেই মজা পায়।

২০
কুরবান শব্দের অর্থ-নিকটে আসা। একজনের নিকটে আসতে হলে আরেকজনের সঙ্গ ত্যাগ করতে হয়। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। একটিতে উঠতে হলে আরেকটি ছাড়তে হয়। ক বিন্দু থেকে দূরত্ব যতটা বৃদ্ধি পায়, ততটাই খ বিন্দুর নিকটবর্তী হয়। তাই নিকটে আসা এবং ত্যাগ করা সমান্তরাল।

পশুর রক্ত-মাংসের মাধ্যমে নয়- ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় ‘তাকওয়া’। তাকওয়া মানে ‘মনুষ্যত্বের উদ্বোধন‘।
মনুষ্যত্বের উদ্বোধন করতে হলে পশুত্ব ত্যাগ করতে হয়। পশুত্ব ত্যাগ করা এমন কোনো বিষয় নয়, যা বৎসরে একবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করা যায়। এটি দৈনন্দিন জীবনে চর্চার বিষয়।

মানুষ সারাজীবন টাকার পিছে ঘুরে। তাই ত্যাগ বলতে লোকে টাকা-পয়সা দান করা বুঝে- মনুষ্যত্বের উদ্বোধন বুঝে না। টাকা ছাড়া মানুষের ভাণ্ডে দেওয়ার মতো কিছু নেইও। মনুষ্যের চরম দরিদ্র্যতা এখানেই।

ঈশ্বরকে টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট করা যায় না। আসমান জমিনের মালিক টাকা দিয়ে কী করবেন? তিনি অভাবমুক্ত, তাই চির সন্তুষ্ট। যিনি সন্তুষ্ট হয়েই আছেন, তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা, বাতুলতা ছাড়া আর কি!

বাতুল দানবীরের অভাব নেই পৃথিবীতে। বাংলাদেশের সব মসজিদ, মাদ্রাসা, দরবার গড়ে উঠেছে দানের টাকায়। এসব দানের উদ্দেশ্য-ইহকালে ১টাকা দিলে পরকালে ৭০টাকা পাওয়া যাবে। পরকালে টাকা দিয়ে কী করবে? স্বর্গ কিনবে। তার মানে লোকে দিচ্ছে পাওয়ার লোভে।

পাওয়ার লোভে দেওয়া ত্যাগ নয়- ইনভেস্টম্যান্ট। ত্যাগ কি তাহলে?

যে দেওয়ার মধ্যে পাওয়ার লোভ নেই, সেই দেওয়াই ত্যাগ। এই রকম দেওয়ার নামই প্রেম- নিকটে আসা। যখন প্রেম আসে জীবনে তখনই ঘটে মনুষ্যত্বের উদ্বোধন- জীবনের স্বপ্ন থেকে জাগরণ। এই জাগৃতিই পরমানন্দ। আনন্দযোগ।

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!