ভবঘুরেকথা
লালন বলে কুল পাবি না

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

-ঘর-সংসার করে কি করে সাধন করা যায় জীবন দা’? এই বিদ্যা শিখাবেন আমাকে?

-বাপ! আমি শেখানোর কেউ না। আপনি শিখতে চাইলে আপনি নিজেই শিখতে পারবেন। যদি মনে বাসনা থাকে তাহলে চেষ্টা শুরু করেন। আর যদি দেখা হয় তাহলে তো আমি থাকলামই। তবে চেষ্টাটা নিজের।

-শিষ্য তৈরি না হলে গুরুর কোনো দ্বায়ভার থাকে না! নাকি পুরোটাই শিষ্যকে বহন করতে হয়?

-দুইজনকেই বাপ দ্বায়ভার নিতে হয়। তবে দোষ হয় গুরুর। কারণ হিসেবে বলা যায়। গুরুর দায় ছিল শিষ্য বানানোর কিন্তু শিষ্যর দায় ছিল না গুরু বানানোর। সে চায় সুশিক্ষা-শুদ্ধশিক্ষা। তা দেয়ার দায়িত্ব গুরুর। তার দায়িত্ব গ্রহণ করা। আর শিষ্য কিভাবে কিরূপে কি পদ্ধতিতে তা গ্রহণ করতে পারবে তাও নির্ণয় করতে হয় গুরুকেই।

সর্বপ্রকার যত্ন-আত্ত্বি করার পরও যদি খোয়াড়ের কোন গরু দুধ না দেয় তাহলে পশুটারে মারলে-পিটলে বা বাতিল করে দিলে কি আর সমাধান হয় বাপ? এমন পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝতে হয় গরুটা অন্যসব গরুর মতো না। তার চিকিৎসা ভিন্ন। তার যত্ন-আত্ত্বি ভিন্ন। তাকে সেই মতো লালন-পালন করতে হইব।

গুরু-শিষ্যেরও বাপ তেমনি ধারা। কিন্তু গোয়ালা যদি যে দুর্বল পশু তার দিকে অধিক যত্ন না নেয় তাহলে কি হইব? সে অসুস্থ তো হইবোই? তার দেখাদেখি অন্যরাও আক্রান্ত হইব। তেমনি গুরুরও দায়িত্ব যে শিষ্য দুর্বল বা বেয়ারা তার প্রতি অধিক নজর দেয়া। গুরুরা তাই করে বাপ। তবে কোনো কোনো গুরু অধিক ভক্ত তৈরি করার আশায় অনেক কিছু নজরআন্দাজ করে। দেখেও দেখে না।

তারা ভক্তের মোহে পরে যায়। আবার অনেকক্ষেত্রে গুরুরা কোনো কোনো ভক্তরে এতোটাই প্রেম করে যে তার সব গুনা মাফ করে দেয়। তার সকল বেয়াদবিও মাইনা নেয়। এ গুরু-শিষ্যের খেলা বাপ সামান্য জ্ঞানে ধরবো না। এ বড় আজব কুদরতিরে বাপ… আজব কুদরতি…

সাধারণ মানুষের হাতে সময় কম। তারা দ্রুত সিদ্ধান্তে আসে, ব্যক্তি-বস্তু-পরিস্থিতি দেখে। এটাতে অনেকসময় ভুল হয়ে যায়। সিদ্ধান্তে আসতে হলে সময় দিতে হয় বাপ। মানুষ সারাজীবন সাধনা কইরা নিজেরেই চিনতে পারে না। কিন্তু হঠাৎ করে এক সেকেন্ডে অন্যরে চিনে ফেলার চেষ্টা করে। কারো সম্পর্কে মুর্হূতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। উনি ভালো- উনি খারাপ।

কিন্তু বাস্তবে বিষয়গুলো এতো সহজ নয়। ভাবতে হয় দেখতে হয় তলানি থেকে… গভীর থেকে। এ সংসার এক মায়ার খেলা বাপ। এখানে সবকিছুতেই মায়া। সবকিছুই লীলা। এই মায়াজ্বাল ভেদ করে কয়জন দেখা পায় সেই সহজ শুদ্ধ জ্ঞান?

-বলেন কি? এভাবে তো ভাবি নাই।

তাহলে হাজার মাইল দূরে থেকেও মা সন্তানের বিপদআপদ ঠিকই টের পায়। এটা বিজ্ঞানের ভাষায় আপনি কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দিতেই পারেন। কিন্তু যেদিন প্রত্যক্ষ করবেন সেইদিন বুঝবেন বাপ। এ কোন অলৌকিক ঘটনা না।

-বাপ চোখ থাকলেই দেখা যায় না। দেখতে শিখতে হয়। তেমনি বলতে শিখতে হয়, শুনতে শিখতে হয়; সকল কিছুই শিখতে হয়। আমরা উপরি উপরি যা যা করি তা কিন্তু পুরোপুরি ব্যবহার না ইন্দ্রিয়ের। এই চোখ, কান, নাক দিয়ে আরো অনেক কিছু দেখা যায়, শোনা যায়, সুগন্ধি পাওয়া যায় বাপ। আত্মতত্ত্বে না ডুবলে, নিজেতে নিজে না মজলে সে ভেদ প্রকাশ প্রায় না।

আর যে মানুষ যত জানে সে তত নরম হয়। আর নরম হইলে নিজের দেহের সাথে প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়। আর সম্পর্ক তৈরি হইলে আমরা কি করি বাপ। একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করি। মতবিনিময় করি। কুশলাদির খোঁজ নেই।

বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াই। মনে সাহস দেই। শ্রদ্ধা করি। ভক্তি করি। এইখানেও তাই ঘটে বাপ। এটা অলৌকিক কোনো কাণ্ডকারখানা না। এটাও বিজ্ঞানই বাপ।

এই যেমন মায়ের সাথে সন্তানের একটা অন্তরের সম্পর্ক থাকে। এর মূল কারণ কি জানেন? মা সন্তানকে উপরি উপরি দেখে না। ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করে এবং নিজের ভেতর দিয়ে সন্তানের ভেতরে দেখে। তাই একটা সংযোগ তৈরি হয়।

মনে করে দেখেন আপনি হয়তো কিছু গোপন করতে চেয়েছিলেন ছোটবেলায় কিন্তু মা ঠিকঠিক ধরে ফেলেছিল। কারণ হইল বাপ মা সন্তানের সাথে এমন এক সম্পর্ক তৈরি করে যাতে সন্তান কাছে না থাকলেও সে ফিল করতে পারে। তার বিপদে আপদে সে শারীরিক না হোক মানুষিকভাবে যাতে তার পাশে থাকতে পারে।

মায়ের এক ধরনের প্রেম ও উৎকণ্ঠার কারণে সেই সংযোগ তৈরি হয়। একাধিক সন্তান হলে সকল সন্তানের সাথে মায়ের সেই সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। আবার সন্তান বড় হতে হতে মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে গেলে সেই সম্পর্ক সন্তান টের পায় না। কিন্তু মায়ের মনে যদি সন্তানের প্রতি সেই প্রেম থেকে যায় কোনো বাঁধাবিঘ্নতেই সেই প্রেম বিন্দুমাত্র না কমে।

তাহলে হাজার মাইল দূরে থেকেও মা সন্তানের বিপদআপদ ঠিকই টের পায়। এটা বিজ্ঞানের ভাষায় আপনি কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দিতেই পারেন। কিন্তু যেদিন প্রত্যক্ষ করবেন সেইদিন বুঝবেন বাপ। এ কোন অলৌকিক ঘটনা না।

আধুনিক বিজ্ঞানও এই ভাবেই চলে। চলে তরঙ্গ দিয়ে। এই যে এখন সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করে এটাও তো তরঙ্গর খেলা তাই না? এই তরঙ্গ কি কেবল যন্ত্র ধরতে পারে? মানুষ পারে না? অবশ্যই পারে বাপ।

অগ্নি উঠে গিয়ে নিজের চায়ের কাপটা রেখে আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। সাথে করে একটা পান আর পানের বোটায় চুন এনে জীবন দা’র হাতে দিয়ে পাশে বসে পরল। জীবন দা পান চিবুতে চিবুতে চোখ আধো মুদে ফেলল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি শরাবান তহুরা খাচ্ছেন। মনে হচ্ছে পান নয় যে অমৃত চিবুচ্ছেন।

মানুষ যন্ত্র থেকে অনেকবেশি উন্নত। তার ক্ষমতা অনেক বেশি। কিন্তু সে ব্যবহার করতে জানে না। কারণ প্রযুক্তিগত বিজ্ঞান যত তাকে প্রযুক্তি তুলে দিচ্ছে হাতে। তত সে নিজেকে ব্যবহার করা থেকে সরে আসছে।

একসময় কিন্তু ক্যালকুলেটর ছাড়াই বড় বড় হিসাব হইত। দেশও চলত। এখন কিন্তু ক্যালকুলেটার ছাড়া ২ অংকের হিসাবও করা যায় না। এই আর কি বাপ। সাধনা মানুষকে নিজের সাথে প্রকৃতির সাথে পুনরায় সম্পর্ক তৈরির পথ দেখায়। এরবেশি কিছু না।

এ মানুষের চিয়ারিত চরিত্র। সে প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিতই, কিন্তু তার অব্যবহারে তা ম্লান হয়ে গেছে। একটু সূত্র পেলেই আবার সংযোগ তৈরি হয়। যেমন নেটওয়ার্কের কাছে গেলেই সংকেত দেয় এখানে ওয়াইফাই আছে। ঠিক তেমনি জ্ঞানীর কাছে গেলে যে জ্ঞান খুঁজছে সে জানতে পায় এইটাই ঠিকানা।

-জীবন দা’ আপনি কে বলুন তো। এতো কিছু জানলেন কিভাবে? আপনাকে দেখলে কিন্তু মনে হয় না আপনি এতো আধুনিক বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা রাখেন। শুধু ধারণা রাখেন তা না। আমরা যেভাবে দেখি তারচেয়ে অনেকবেশি গভীরভাবে কিন্তু সহজ করে ভাবতে ও দেখতে পারেন।

আপনার এই কথাগুলো বলতে হলে হয়ত একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ বহু কঠিন কঠিন শব্দ বা ভাষার মারপ্যাঁচ ব্যবহার করত। তাতে বিষয়টা কঠিন হয়ে যেত কিন্তু আপনি কি সাবলীলভাবে বলে গেলেন। ইচ্ছে করে শুনতেই থাকি। আরেক কাপ চা খাবেন জীবন দা?

-চা আর খাবো না বাপ। একটা খয়ের-জর্দা ছাড়া পান খাইতে পারি।

অগ্নি উঠে গিয়ে নিজের চায়ের কাপটা রেখে আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। সাথে করে একটা পান আর পানের বোটায় চুন এনে জীবন দা’র হাতে দিয়ে পাশে বসে পরল। জীবন দা পান চিবুতে চিবুতে চোখ আধো মুদে ফেলল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি শরাবান তহুরা খাচ্ছেন। মনে হচ্ছে পান নয় যে অমৃত চিবুচ্ছেন।

অগ্নি দেখছে আর ভাবছে ভদ্রলোক সবকিছুতে এতো আনন্দ খুঁজে পায় কি করে? আচ্ছা জাগতিক এই যে অস্থিরতা নিয়ে আমরা জীবন কাটাই, অফিস-বাড়ি-সংসার-পরিজন-উপার্জন-অর্জন এতো সব চাহিদার মাঝে থেকেও কি এমন আনন্দে থাকা সম্ভব? কি করে সাধকরা এসব করে। তাদের অবশ্য কোনো কাজ নেই। তারা তো করতেই পারে কিন্তু আমরা কি আর চাইলেই করতে পারি?

এই যে আজ কাজটা হলো না। অফিসেও ফিরে গেলাম না। এর ফল কাল ভোগ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা মোবাইলও বন্ধ। সবকিছু মিলিয়ে একটা অস্থিরতা কাজ করার সাধারণ নিয়ম থাকলেও অগ্নির এই মুর্হূতে তা হচ্ছে না তাই নিজেই নিজেকে দেখে অবাক হচ্ছে। হতবাক হচ্ছে। অগ্নি আনমনে আওরাতে শুরু করলো-

“গাঢ় অন্ধকার থেকে আমরা এ-পৃথিবীর আজকের মুহূর্তে এসেছি।
বীজের ভেতর থেকে কী ক’রে অরণ্য জন্ম নেয়,-
জলের কণার থেকে জেগে ওঠে নভোনীল মহান সাগর,
কী ক’রে এ-প্রকৃতিতে—পৃথিবীতে, আহা,
ছায়াচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে মানব প্রথম এসেছিল,
আমরা জেনেছি সব,—অনুভব করেছি সকলই।
সূর্য জেলে,—কল্লোল সাগর জল কোথাও দিগন্তে আছে, তাই
শুভ্র অপলক সব শঙ্খের মতন
আমাদের শরীরের সিন্ধু-তীর।”

-বাহ্! বাপ ভালো বলছেন তো।

-জীবনানন্দ দাসের ‘অন্ধকার থেকে’ নামের এই কবিতাটা কলেজের ফংশনের বলার জন্য মুখস্থ করেছিলাম। কিন্তু সেদিন মুখ থেকে কিছুই বের হয় নাই। স্টেজে উঠে সব ভুলে গিয়েছিলাম। অথচ স্টেজ থেকে নামার পর থেকে আজ পর্যন্ত এর দাড়িকমা পর্যন্ত বলে দিতে পারি। এই কবিতার অর্থ খুঁজি নাই কখনো।

সে অর্থে বুঝি না বা বোঝার চেষ্টাও করি নাই কখনো। কিন্তু মুখস্থ হয়ে মাথার কোথাও রয়ে গেছে। আসলে ঘরে একটাই কবিতার বই ছিল। কেউ হয়ত রেখেছিল “বেলা অবেলা কালবেলা”। সেটা থেকেই কবিতাটা মুখস্থ করেছিলাম অনুষ্ঠানে বলব বলে। এখনো মাঝেমধ্যে খুব একা লাগলে এই লাইনগুলো মাথায় চলে আসে।

-বাপ! আমরা যা শুনি-দেখি-বলি-স্বাদ নেই সবই আমাদের মাথার ভেতর নিজের অজান্তেই মজুদ করে রাখি। ঘটনার প্রেক্ষিতে তা প্রকাশ পায় বা উদয় হয়। তাই ভালো বলতে হয়, ভালো শুনতে হয়, ভালো দেখতে হয় নইলে খারাপ গুলোও মজুদ থেকে যায়। মন্দ দেখলে, মন্দ শুনলে, মন্দ বললে মানুষ তেমনি হইয়া যায় বাপ।

এই যে আমি জীবনের প্রায় প্রতিটি এ্যাটিকেট মেনে চলার চেষ্টা করি। রাগ-ক্রোধ না করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। কিন্তু সবসময় কি তা পারি? কখনো কখনো এতো বেশি উত্তেজিত হয়ে যাই যে। অনেকে বলে এর জন্য কাউন্সিলিং নেয়া প্রয়োজন। আপনি ঠিকই বলেছেন ভেতরে একটা আগ্নেয়গিরি আছে ঘুমিয়ে, তা যে কোনো সময় জাগতে পারে।

এর থেকে মুক্তি নাই। তাই চিন্তাতেও শুদ্ধতা আনতে হয়। আপনি মনে যা ভাবেন তাই যদি মুখে প্রকাশ করতে পারেন তাহলেই তা হয় সত্য বচন। এ বড় সহজ কাজ তাই না, যা ভাবেন তাই বলবেন? তাই না। কোনো অভিনয় না, কোনো কল্পনা না, কোনো মিথ্যা না যা ভাবা তাই বলা। কিন্তু এটাই কঠিন হয়ে যায় যদি মনে শুদ্ধতা না থাকে।

-বাপরে বাপ। বলেন কি এতো কিছু করেন কিভাবে?

-আমি কি আর সব পারি। তবে চেষ্টায় আছি। চেষ্টা করতে করতে একদিন হয়ে যাবে এই আশায় আছি।

-আপনি তো আশাবাদী মানুষ। আমিও প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ। আশাবাদী অবশ্য সত্য সত্য কিনা তাতে সন্দেহ আছে আমার নিজেরই। আসলে আমাকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে আশাবাদী থাকার জন্য। কাজ করার সময় ‘ক্লাইন্ট অলওয়েজ রাইট’ আর ‘কাজটা করতেই হবে’ এই দুই মূলমন্ত্র দিয়ে আমাদের কাজ শুরু ও শেষ করতে হয়। তাই আশাবাদী থাকার অভিনয় করতে হয়।

যাতে টিমের অন্যদের মনোবল না ভেঙ্গে পরে। তার জন্য এই অভিনয় হতে হয় সূচারু। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তো দূরের কথা চোখের পাপড়িতেও যাতে ধরা না পরে অভিনয়; আর তা করতে করতে আমি বা আমার মতো মানুষরা আশাবাদী ঠিক না; আশাবাদী টাইপ হয়ে গেছি। তবে আপনার আশাবাদটা নিশ্চয়ই আমাদের মতো না তাই না?

-নিজের সাথে অভিনয় করা মানে নিজের কাছে প্রতিনিয়ত পরাজিত হওয়া। আর এই নিজের কাছে হেরে যাওয়া মানুষরা নিজের ভেতরে একটা তপ্ত আগ্নেয়গিরি পুষে রাখে। যে কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তা বিস্ফোরণ হতে পারে। তখন আর পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। দিশেহারা হয়ে যায়।

-ঠিক বলেছেন। এই যে আমি জীবনের প্রায় প্রতিটি এ্যাটিকেট মেনে চলার চেষ্টা করি। রাগ-ক্রোধ না করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। কিন্তু সবসময় কি তা পারি? কখনো কখনো এতো বেশি উত্তেজিত হয়ে যাই যে। অনেকে বলে এর জন্য কাউন্সিলিং নেয়া প্রয়োজন। আপনি ঠিকই বলেছেন ভেতরে একটা আগ্নেয়গিরি আছে ঘুমিয়ে, তা যে কোনো সময় জাগতে পারে।

কথা সত্য আমরা যারা এইভাবে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি, প্রতিদিন যুদ্ধ করি ভালোভাবে বাঁচবো বলে, আসলে কতটা ভালো আছি সেটা বিশাল এক প্রশ্ন। আসলে ভালো থাকার অভিনয় মাত্র। এ যেন বড় উপহাস নিজের সাথে নিজের মাঝেই।

বৌ তার ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে একবার জোর করে নিয়ে গেল। তারপর থেকে শুরু হয়ে গেল সকাল ছয়টায় উঠে দৌঁড়াদৌঁড়ি। ভাগ্যিস বৌ নিজেই দিন ১৫/১৬ পর অসুস্থ হয়ে গেল। সেই যাত্রায় রক্ষা হয়েছিল। তারপর এ্যাটার্পমেন্টে কি এক লাফিং ক্লাব চলল কিছুদিন সকালে উঠে হা হা করে হাসি। সেটাও চলেনি বেশি দিন।

আসলে আমাদের মেকি জীবনে সবকিছুই সাময়িক। মৌসুমী বাতাসের মতো আসে। প্রথম প্রথম ভালো লাগে। তারপর তার প্রেমে পরে যাই। কিন্তু কিছুদিন পর তা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কন্টিনিউটি রাখা হয় না জীবন দা। কন্টিনিউটি রাখা হয় না।

এই পথে মৌমাছির মতো শত শত লক্ষ লক্ষ মানুষের তো দরকার নাই বাপ। অল্প আর গুণি মানুষ দরকার। যাতে তার মাঝে তৈরি হয় সত্যিকারের মানুষ। আর একজন মানুষ সত্য সত্য আলো ছড়াইতে পারলে লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি মানুষ তৈরি হইতে সময় লাগে না।

-সবকিছুই সারাজীবন করে যেতে হবে এমন কথা নেই। তবে যতটা করার পর তা শুদ্ধ হয় ততটা করতেই হয়। আর একবার শুদ্ধ হয়ে গেলে এসব আর বোঝা মনে হয় না তা চরিত্র হয়ে যায়। তখন আর কষ্ট হয় না। আর এ অভ্যাস জোর করে হয় না। হয়ে যায়। এ অর্জন। এই অর্জন আনন্দ দেয়। প্রশান্তি দেয়। এতে অভিনয় থাকে না।

-মানে… একটু পরিষ্কার করে বলবেন?

-এই যে মনে করেন আপনি মিথ্যা বলা ছেড়ে দিলেন। প্রথমে কষ্ট হবে। কেউ কেউ আপনার সত্য বচনে কষ্টও পেতে পারে। কিন্তু আপনি যদি সেটা নিয়মিত করতেই থাকেন। অল্প সময় পর আপনি মিথ্যা বলতে গেলে আপনার বিবেকে আটকাবে। তখন যদি আপনি আপনার বিবেকের কথা শুনেন।

তাহলে আপনি আপনার সত্য বচনের যাত্রা চালিয়ে যেতে পারবেন। আর এটা একসময় অভ্যাসে দাঁড়াবে। একদিন দেখবেন আপনি আর মিথ্যা বলতে পারছেন না।

এতে আপনার মধ্যে একটা অর্জনের ভাব জাগবে। এতে কোনো প্রাপ্তি নাই… নাই কোনো পুরুষকার। কিন্তু নিজের কাছে জিতে যাওয়ার আনন্দ আছে। তবে যদি এই অর্জনে আপনার মধ্যে অহঙ্কারের ভাব জাগে তাহলে আপনি আরো বড় গোলে পরলেন। তবে আর অনন্দ থাকবে না মনে। মনে বাসা বাঁধবে অহং। সেটা মিথ্যা থেকেও ভয়ঙ্কর।

-আপনি তো কোনো আশার কথাই বলেন না জীবন দা’। যাও একটু আশার কিরণ পাই তাও আপনি দপ করে নিভিয়ে দেন।

-বাপ! মিথ্যা আশ্বাস দিয়া কি হইব? আপনি এখন তো ভালোই আছেন। আমার মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত কথা শুনে যদি আপনি সত্য সত্যই এ পথে যাত্রা শুরু করেন তাহলে তো কয়েক কদম হেঁটেই হতাশ হয়ে পরবেন। এ পথে কোনো প্রাপ্তি নাই আছে কেবল আনন্দ। কিন্তু সকলেই চায় প্রাপ্তি। তাই অল্পতে হতাশ হয়। আর যেখানে প্রাপ্তি নেই সেখানে লোভী-কামুক-আসক্ত মানুষ এই পথে আসে না।

আবার অনেকে না বুঝে বা বেশি বুঝে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ পথে চলে আসে। তবে এভাবে এসে যারা ফিরে যেতে পারে তারা বেঁচে যায়। কিন্তু যারা আর বেরুতে পারে না তাদের হয় খাঁচার বাঘের মতো অবস্থা। অন্তরে মুক্ত বনের অভিলাশ কিন্তু নিয়তি বন্দি খাঁচা। তাই মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বা লোভ দেখিয়ে লাভ কি?

এই পথে মৌমাছির মতো শত শত লক্ষ লক্ষ মানুষের তো দরকার নাই বাপ। অল্প আর গুণি মানুষ দরকার। যাতে তার মাঝে তৈরি হয় সত্যিকারের মানুষ। আর একজন মানুষ সত্য সত্য আলো ছড়াইতে পারলে লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি মানুষ তৈরি হইতে সময় লাগে না। কিন্তু প্রথম একজন তো তৈরি হইতে হইব; তাই না? যে বর্তমান সময়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে।

-বলে যান জীবন দা… বলে যান…

-আমি আর কি বলবো বাপ সবই লালন সাঁইজি বলে গেছেন। আমরা কেবল ধরতে পারি না নিজেদের যাবতীয় সংস্কারের জন্য। সাঁইজি কি বলেছেন শুনেন তবে-

মানুষ অবিশ্বাসে পায় না রে
সে মানুষ নিধি ।
এই মানুষে মিলত
মানুষ চিনতাম যদি ।।

অধর চাঁদের যতই খেলা সর্ব
উত্তম মানুষ লীলা না বুঝে মন
হলি ভুলা মানুষ বিবাদি ।।

যে অঙ্গের অবয়ব
মানুষ জান না রে মন
বেহুঁশ মানুষ ছাড়া নয়
সে মানুষ অনাদির আদি ।।

দেখে মানুষ চিনলাম না রে
চিরদিন মায়ার ঘোরে
লালন বলে এ দিন পরে
কি হবে গতি ।।

-মানুষ চেনা বড়ই কঠিন যদি নিজেরে চেনা না যায়রে বাপজি। আগে নিজেরে চিনতে হবে; সেটাই সূচনা। তা না হলে সবই ফাঁকিঝুকি।

-কিন্তু নিজেকে চিনব কিভাবে? আপনি তো কিছুই বলছেন না। কেবল কথার মারপ্যাঁচ দিচ্ছেন। কিছু তো বলেন।

-বাপ! আগের কাজ আগে করতে হয়। আগেই তো বলছি সিন্ধান্ত চূড়ান্ত কিনা সেটা নিজেই পরীক্ষা করে দেখেন আগে। তারপরও যদি মনে হয় আপনি আসলেই জানতে চান। তাহলে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেন নিজের মতো করে কি করে শুদ্ধ হওয়া যায়। তাতো আপনার মতো মানুষ জানেই। তারপরও যদি ঘাটতি থাকে তাহলে কার কাছ থেকে জ্ঞান নিবেন তাকে খোঁজ করেন।

আমার সাথে হঠাৎ দেখা হইছে বলেই আমার কাছ থেকেই জানতে হবে এমনতো কথা নাই বাপ। পূর্ণ ভক্তি না আসলে কয়দিন পর আর ভালো লাগবো না। তারচেয়ে বুঝে শুনে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়াই উত্তম।

এই সব প্রথম প্রথম ভালো লাগে শুনতে তারপর করতে গেলে টের পাওয়া যায় এতে রোমান্টিকতার চেয়েও বাস্তবতা বেশি। তবে একটা কথা, যদি ভেতর থেকে ডাক আসে তাহলে কোনো বাঁধাই বাঁধা থাকে না।

-আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তাই না?

-আপনি আপনাকে বিশ্বাস করছেন?

-হুমম। ঠিক ধরেছেন আমি নিজেও নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। সত্যি কথা বলতে আপনাকেও যে পুরোপুরি বিশ্বাস করছি তাও কিন্তু না। আমি মার্কেটিং-এর মানুষ শেষ পর্যন্ত কাজ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে বিশ্বাস করি না। এটাই এখন আমার স্বভাব।

তবে ছোট্টবেলায় বিষয়টা কিন্তু এমন ছিল না। রাস্তা ধরে যে ফেরীওয়ালা ডাক দিতে দিতে কটকটি বিক্রি করতে করতে যেত। তার পিছু পিছু চলে যেতাম কতটা পথ।

স্কুল পালিয়ে মাথা গুজে যে বন্ধুর সাথে সিনেমা হলে যেতাম। আরো কত কি। এসবে কোন ভণিতা ছিল না। আজ কাল সবকিছুতেই ভণিতা। মাঝে মাঝে বড় ক্লান্ত লাগে জীবন দা। বড় ক্লান্ত লাগে। আবার এই সব ঐশর্যও যে খারাপ লাগে তাও কিন্তু না। সংসার-বৌ-কন্যা-বন্ধু-পরিজন-সহকর্ম; বাড়ি-গাড়ি-টাকা এসব ছাড়া কি আর নিজেকে ভাবতে পারি?

এই মত পথ সকলের জন্য না। সকলে ধারণ করতে পারে না। দূর থেকে দেখে লোভ হয় বটে কিন্তু ডুব দিলে তল খুঁজে পাওয়া যায় না। সব ঝিনুকে মুক্ত হয় না বাপ। আর দুধ-জল মিশায়া দিলেও রাজহাঁস জল বাদ দিয়া কেবল দুধ পান করতে পারে। অন্যে কি তা পারে?

এই ইঁদুর দৌঁড়ের জীবনকে ঘৃণা করলেও একে ছেড়ে যে সুখ হবে তাও ভাবতে পারি না। আসলে আমি কি চাই আমি নিজেও জানি না জীবন দা’। আমরা কেউ জানি না। কেবল চাই আর চাই। কতটা পেলে খুশি তাও জানি না।

এই যে আপনার কথা শুনছি এসবের মাঝেও আমি কিন্তু আমার চাহিদাই খুঁজে নিয়েছি। ভাবছি নিজেকে জানলে হয়ত আরো অনেক এচিভম্যান্ট হবে। নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে জীবন দা।

-বাপ! একদিনে তো কিছু হয় না। আজ পর্যন্ত আপনি নিজেকে যে রূপে তৈরি করেছেন তা তো একদিন হয়নি। এর থেকে বের হতে চাইলেও কি আর একদিনে তা সম্ভব হবে? সবই সময়; সময়ের ব্যাপার। সময় দিতে হবে, তাহলে হবে। আর যদি না হয় তাতেই বা কি আপনি তো আপনি যা চাইছেন তা করার চেষ্টা করছেন; সেটাই বা কম কি? কয়জন এইটুকু পারে?

বেশিভাগ মানুষ ভেবে ভেবেই জীবন পার করে দেয়। কিছু মানুষ এর থেকেও এগিয়ে যায় তারা শুধু ভেবে ক্ষ্যান্ত দেয় না প্রচুর প্ল্যান করে। কিন্তু সেই নকশা পর্যন্তই থেকে যায়। তবে সবচেয়ে ভালো হলো যদি করার ইচ্ছা হয় তাহলে করা। আর যদি মনে হয় আমার দ্বারা হবে না। সেটা যদি নিশ্চিত হওয়া যায় তাহলে সেই চিন্তা মাথায় আসার সাথে সাথে তা বাতিল করা উচিত।

-জীবন দা’ আপনি তো বলেই খালাস। এতো সহজে কি আর ভুত ঘাড় থেকে নামানো যায়। একবার চেপে বসলে সে ঘর বেঁধে বাচ্চাকাচ্চা জন্ম না দিয়ে যায় না।

-মায়া মোহ আসক্তি এসব বড়ই নাছরবান্দা। স্বভাবে ঢুকে পরলে মুক্তি পাওয়া বড়ই কঠিন। যতক্ষণ অর্থ-সম্পর্ক-জীবনের গতি অঢেল থাকে ততক্ষণ চলে যায় জীবন আমোদের। কিন্তু কোনোটাতে ঘাটতি দেখা দিলেই বিপদ। তবে বেশিভাগ মানুষ তো চালিয়ে নিচ্ছে জীবন এমনভাবেই। ক্ষতি কি?

-আপনি বলছেন ক্ষতি কি? বিশ্বাস হচ্ছে না।

-বাপ! এই মত পথ সকলের জন্য না। সকলে ধারণ করতে পারে না। দূর থেকে দেখে লোভ হয় বটে কিন্তু ডুব দিলে তল খুঁজে পাওয়া যায় না। সব ঝিনুকে মুক্ত হয় না বাপ। আর দুধ-জল মিশায়া দিলেও রাজহাঁস জল বাদ দিয়া কেবল দুধ পান করতে পারে। অন্যে কি তা পারে? চাতক পাখি মেঘের জল ভিন্ন অন্য জল পান করে না। এমন চাতক হইতে হয় এই সাধন পথে।

-আপনি সাহস না দিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন কেন জীবন দা?

-আপনি না বুঝে জানতে শুরু করলে শুধু আপনার বিপদ হবে তা তো নয় আমারো বিপদ।

-আপনার বিপদ মানে? আপনি বিপদে ভয় পান?

-সেই বিপদ না বাপ। বিপদ হইলো আপনি মত পরিবর্তন করলে আপনার আশপাশের মানুষজন চিন্তিত হইব। তারা তখন খুঁজতে খুঁজতে আমার সন্ধান করব। আমারে ত্যক্ত করব। আমি ত্যক্ত হবো সেটা বড় বিষয় না। তারা মানুষিক যন্ত্রণায় থাকব, তারা অস্থির থাকব। পরোক্ষভাবে তো আমার জন্য তারা অস্থির হইব তাই না? মানুষরে এই অস্থির করতে মন চায় না বাপজি।

-হুমম।

-আপনি ভাবেন বাপ। ভালো কইরা ভাবেন। সময় নেন। নইলে সময় নষ্ট হবে। আর কিছু হবে না। আগে মন ঠিক তারপর ঘর ঠিক তার পর সাধন ভজন বাপ। কাউরে অস্থির করে মনে কষ্ট দিয়ে সাধন হয় না। ঘরে অশান্তি থাকলে বাইরে শান্তি আসে না বাপ। সাঁইজি বলছেন

বসত বাড়ির ঝগড়া কেজে
আমার তো কই মিটলো না।
কার গোয়ালে কে দেয় ধূমা
সব দেখি তা নানা না।।

ঘরের চোরে ঘর মারে যার
বসতের সুখ হয় কিসে তার।
ভূতের কীর্তি যেমন প্রকার
তেমনি তার বসতখানা।।

দেখে শুনে আত্মকলহ
বাড়ির কর্তাব্যক্তি হত হলো।
সাক্ষাতে ধন চোরে গেল
এ লজ্জা তো যাবে না।।

সর্বজয় হাকিমের তরে
আর্জি করি বারে বারে।
লালন বলে আমার পানে
একবার ফিরে চাইলে না।।

(চলবে…)

<<লালন বলে কুল পাবি না: ছয় ।। লালন বলে কুল পাবি না: আট>>

.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই

লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!