ভবঘুরেকথা
সীতারাম

সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: পাঁচ

মহামন্ত্র-

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

এই মন্ত্রে আটবার হরে, চারবার কৃষ্ণ ও চারবার রাম বলা হয়েছে- তার উদ্দেশ্য কি?

হরে শব্দের অর্থ হরণ, কৃষ্ণ শব্দের অর্থ কর্ষণ, রাম শব্দের অর্থ রমণ।
আটবার ‘হরে’ এই নামের দ্বারা ভক্ত কাকে হরণ করবার জন্য শ্রীভগবানকে আহ্বান করেন?

‘ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনোবুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।’
-শ্রীগীতা (৭ম অধ্যায়)

ভূমি, জল, অনল, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার- এই অষ্ট প্রকারে বিভক্তা শ্রীভগবানের অপরা প্রকৃতি। এই আটটিকে হরণ করবার নিমিত্ত মহামন্ত্রে আটবার এই নাম বলা হয়েছে।

পৃথিবীর পাঁচটি তত্ত্ব- অস্থি, মাংস, নাড়ী, ত্বক এবং রোম। জলের পাঁচটি তত্ত্ব- শোণিত, লালা, মূত্র, স্বেদ ও শুক্র। তেজের পাঁচ তত্ত্ব- ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আলস্য, নিদ্রা ও ক্লান্তি। বায়ুর পাঁচ তত্ত্ব- চলন, বলন, ধাবন, প্রসারণ ও আকুঞ্চন। আকাশের পাঁচ তত্ত্ব- কাম, ক্রোধ, শোক, মোহ ও ভয়। মনের বৃত্তি- সংকল্প বিকল্প। বুদ্ধির বৃত্তি- নিশ্চয়। অহঙ্কারের বৃত্তি- অহং কর্তা- এই অভিমান।

এই ভূমি- প্রভৃতি আটটি অপরা প্রকৃতির বহির্মুখতা হরণ করবার জন্যই আটবার ‘হরে’ পদটি মহামন্ত্রে বলা হয়েছে, আট প্রকার প্রকৃতিই মহামন্ত্র জপের দ্বারা ভগবন্মুখী হয়।

চারবার ‘কৃষ্ণ’ পদের দ্বারা কাদের কর্ষণ অর্থাৎ আকর্ষণের কথা বলা হয়েছে। মন, বুদ্ধি, অহংকার এরা অন্তরিন্দ্রিয় মাত্র। বহির্মুখতা হরণ করলেও কার্য্য সিদ্ধি হবে না, তজ্জন্য এদের কর্ষণও প্রয়োজন। মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার- শব্দের দ্বারা চিত্তকেও গ্রহণ করা হয়েছে।

‘রসো বৈ সঃ’ আনন্দময় তাঁর রসতম স্বরূপে মনকে আকর্ষণ করলে মন রসতমের সঙ্কল্প বিকল্পই করবে। বুদ্ধি তাঁকেই নিশ্চয় করে স্থির হয়ে যাবে। অহঙ্কার- ‘আমি কর্ত্তা’ এই অভিমান ত্যাগ করে- ‘আমি রসতমের দাস’ এই অভিমান করতে থাকবে, চিত্ত নিয়ত আনন্দময়ের অনুসন্ধানে নিরত হবে।

মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহঙ্কারকে আকর্ষণ করবার জন্য মহামন্ত্রে চারবার কৃষ্ণ নাম কথিত হয়েছে।

আর চিরবাঞ্ছিত চারটি স্থানে রমণ করবেন বলে ভক্ত, চারবার রামকে আহ্বান করেন। জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয়- এই চার অবস্থাতেই, আনন্দময় লীলা করবেন বলে মহামন্ত্রের দ্বারা ভক্ত প্রাণারাম রামকে আহ্বান করে থাকেন- হে প্রিয়তম! তুমি আমার জাগ্রতে, স্বপ্নে, সুষুপ্তি ও তুরীয়ে রমণ কর।

তুমি ভিন্ন যেন কোন অবস্থাতেই আমার আর কোন কিছু গ্রহণীয় না থাকে। তোমার আনন্দে, তোমার রসে রসিত হয়ে আমি যেন সকল সময় থাকতে পারি। হে রসতম! আমায় অমৃতময়, রসময়, মধুময় কর।

-শ্রীশ্রীমহামন্ত্র কল্পতরু

 

তুমির তোপ-

তুমির তোপে সব উড়িয়ে দিলেই ব্যস, তুমি আমি সব একাকার হয়ে সে কি আনন্দ! রাম রাম সীতারাম। ক্ষেপা বলছে- যা দেখবে, যা শুনবে, যা খাবে- সব তুমির তোপে উড়িয়ে দেবে। সব আর আলাদা অলাদা থাকবে না- সব তুমি হয়ে যাবে।

যদি বলি বাইরের সব কিছু না হয় তুমির তোপে উড়িয়ে দিলাম, কিন্তু ভেতরের খসর মসর চেল্লাচিল্লি- পূজো করতে বসে জুতো কেনা, রামকে ভাবতে বসে ছাই রাই ভাবা এ সবের কি উপায় হবে?

ও সবও তুমির তোপে উড়িয়ে দিতে হবে। জপ করতে বসে ভাবলে- ‘হরেকৃষ্ণ’ আমায় গালাগালি দিয়েছে, ঝাড়লে তুমির তোপ, হরেকৃষ্ণ হয়ে তুমি আমার পাপক্ষয় করে দিলে, চালাও জপ। মন বললে ছেলেটা অবাধ্য- মারো তুমির তোপ, উড়ে যাক্, ছেলে ও তার অবাধ্যতা।

বৌমাটি বড় মুখরা- ঝাড়ো তুমির তোপ, বৌমা উড়ে গিয়ে সেখানে দেখবে ‘তুমি’ দাঁড়িয়ে হাসছ। কুকুর, বেড়াল, শেয়াল, ভালোমন্দ, কাম, ক্রোধ, ভিটকুলুমি, লোকের চোখে ধুলো দিয়ে সাধু সাজা- যা এসে সম্মুখে দাঁড়াবে- সীতারাম, ঝড়াম্ ঝড়াম্ করে তুমির তোপে সব উড়িয়ে দিয়ে, তুমির অখণ্ড সাম্রাজ্যে তোমার তুমিকে অভিষিক্ত করে, আশেপাশে, সমুখে-পিছুতে, রোগে, শোকে, অভাবে, সাধুবাদে- তুমিকে দেখতে দেখতে তুমিও তুমিময় হয়ে যাবে।

রাম রাম করবে, খালি রাম রাম- তাহলেই এই কথাটি মনে থাকবে। সাধারণ তোপের সীমা আছে, এ তুমির তোপ অসীম, অনন্ত, অফুরন্ত- কখনও ফুরোবে না। যতদিন জগৎ থাকবে, এ তুমির তোপ কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। ওড়াও ওড়াও- তুমির তোপে দৃশ্যমাত্রকে উড়িয়ে দিয়ে, চল সেই অভয়-আনন্দ-অমৃতের মহাসাম্রাজ্যে।

-শ্রীশ্রী সীতারামদাস ওঙ্কারনাথদেব

 

নামে বিশ্বাস-

একি অন্ধ-বিশ্বাস নয়?

না না, নামে বিশ্বাস- অন্ধ-বিশ্বাস নয়। এখন নাম করছি, মরে বৈকুণ্ঠে যাব- এতে লাভ কি? সঙ্গে সঙ্গে কিছু হয় কি- যেমন খেলেই ক্ষুধানিবৃত্তি?

নিশ্চয় হয়।

ঐ তো অন্ধ-বিশ্বাসের কথা! খেলুম, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধা শান্তি। ‘হরি হরি’ করলুম, কৈ সঙ্গে সঙ্গে কিছু তো পেলুম না?

কি খেয়ে ক্ষুধা শান্তি হয়?

ধর- ভাত।

বেশ! সীতারাম, এই ভাত কি করে হয়?

কেন, চাল সিদ্ধ করলে ভাত হয়।

চাল কি করে হয়?

ধান সিদ্ধ, শুকনো করে ঢেঁকিতে ভেনে হয়।

ধান কি করে হয়?

জমিতে চাষ দিয়ে, রুয়ে নিড়িয়ে, ধান পাকলে বাড়ীতে এনে, ধান ঝেড়ে।

জয় জয় সীতারাম। তাহলে ভাত খেলে ক্ষুধা শান্তি হয় একথা সত্য, কিন্তু সীতারাম! ভাতটি করতে কত ব্যাপার দরকার?

তাও তো বটে!

যেমন তেমন করে ডাকো, উঠতে বসতে খেতে শুতে ডাকো- শান্তি মিলবেই।

নাম করব মনে করি, কিন্তু প্রবল কামাদি-রিপু বড় ব্যাঘাত করে।

নাম কর কাম যাবে।

নাম করলে কাম কি করে যাবে?

সীতারাম! কামের দুইটি অর্থ- একটি কামনা, অপরটি স্ত্রীসঙ্গ স্পৃহা।

ঐ দুইটিই তো প্রবল।

সীতারাম। কাম, সঙ্কল্প- এ সমস্তই মন, মনের চঞ্চলতাতেই এরা নেচে নেচে বেড়ায়। নাম করতে করতে মনের চঞ্চলতা যাবে।

কেমন করে যাবে?

জগতে যা কিছু পদার্থ সবই চঞ্চল। জন্মজন্মান্তর মন সেই চঞ্চলের সঙ্গ করেছে, এবারও করছে। তাই চঞ্চলতা কমা তো দূরের কথা- বেড়েই যাচ্ছে।

স্থির এক সেই ভগবান। তাঁকে ধরতে হবে, আপন করে ফেলতে হবে।

কি করে ধরা যায় বলতে পার?

তাই তো বলছি- নাম আর নামী ভিন্ন নন। কেবল নাম ধরে থাকলে মন স্থির হয়ে যাবে। নামী যেমন স্থির, নামও তেমনি স্থির। নামের সঙ্গ করতে করতে মন স্থির হয়ে যাবেই।

নাম স্থির কি করে?

ধর, ‘রাম’ এই নামটি কত কল্প-কল্পান্তর, কত যুগ-যুগান্তর একভাবেই আছেন, এর আর পরিবর্তন হয় নাই। স্থির নামের সঙ্গ কর- কেবল রাম রাম কর, সব ঠিক হয়ে যাবে।

-শ্রীশ্রী সীতারামদাস ওঙ্কারনাথদেব

সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: ছয়>>

……………….
আরও পড়ুন-
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: এক
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: দুই
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: তিন
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: চার
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: পাঁচ
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: ছয়
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: সাত
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: আট
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: নয়

……………….
আরও পড়ুন-
মহানবীর বাণী: এক
মহানবীর বাণী: দুই
মহানবীর বাণী: তিন
মহানবীর বাণী: চার
ইমাম গাজ্জালীর বাণী: এক
ইমাম গাজ্জালীর বাণী: দুই
গৌতম বুদ্ধের বাণী: এক
গৌতম বুদ্ধের বাণী: দুই
গৌতম বুদ্ধের বাণী: তিন
গৌতম বুদ্ধের বাণী: চার

গুরু নানকের বাণী: এক
গুরু নানকের বাণী: দুই
চৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী
কনফুসিয়াসের বাণী: এক
কনফুসিয়াসের বাণী: দুই

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!