-বৃন্দাবন সরকার
ইতিহাস সবসময় সত্য বলে না বা ইতিহাসে সবসময় সত্য লেখা হয় না। যখন চাটুকার, ছলনাকারী, ঠগ, প্রতারক কিংবা মিথ্যাবাদীরা ইতিহাস লেখে, সে ইতিহাস সত্য হয় না, সত্যকে লুকানো হয় কিংবা মিথ্যাকে সত্যের প্রলেপ দিয়ে জড়িয়ে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়া হয় (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দেখলেই দেখা যাবে সত্যকে কি করে আড়াল করার চেষ্টা চলেছে বহুবার-বহুভাবে)।
ইতিহাসের এই অন্ধকার প্রকষ্ঠে অনেক জ্ঞানী-গুণীর কর্ম গুমরে কাঁদে আবার অনেকে কর্ম ও গুণ ছাড়াই সর্বজনের পূজনীয় হয়ে আছেন। এরূপ দু’জন মনিষীর বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য এই খোলা। আমি যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ের সামাজিক অবস্থা ও নমশূদ্র তথা পতিত জাতির কি অবস্থা ছিল, তা বুঝার জন্য দু-তিনটি বিশেষ অবস্থা তুলে ধরছি।
প্রথমে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি অতীত ও বর্তমানে শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাতঃস্মরণীয় যে মনিষী তার দিকে। সবাই একবাক্যে মেনে নিবেন যে তার নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শিক্ষার ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদানের কথা স্বীকার করেই বলছি, তিনি আমাদের জন্য কতটা করেছেন যে তাকে আমরা মনে রেখেছি, ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই দিয়ে গুণকীর্তন করি।
আসল ইতিহাস জানলে একটা চরম বৈপরীত্য চোখে পড়বে। আমরা বর্তমান প্রজন্ম ও নিকট অতীতের প্রজন্মের মানুষরা ছোটবেলায় বিদ্যাসাগরের ‘আদর্শ লিপি’ পড়ে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হয়েছি। কিন্তু একবারও কি কারো মনে এসেছে, যে বইটি পড়ছি, সে বইটি আদৌ সবার জন্য লেখা হয়েছিল?
না, সবার জন্য লেখা হয়নি। বিদ্যাসাগর বইটি লিখেছিলেন তার সমগোত্রীয় ও উচ্চবর্ণের মানুষদের আরো শিক্ষিত করে তোলার একান্ত মানসে। যারা গোটা সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। কিন্তু তৎকালীন সমগ্র ভারতবর্ষের অধিকাংশ লোক নিম্নবর্ণ ও দলিত শ্রেণির, যাদের শিক্ষার জন্য এই মহান শিক্ষানুরাগী বিদ্যাসাগর কি করেছেন জানেন কি?
রঘুনন্দন স্মৃতি মতে বৈদ্যরাও শূদ্র; কায়স্থদের তুল্য। বৈদ্য জাতির মত কায়স্থদেরও সংস্কৃত কলেজে পড়তে দিতে আমার আপত্তি নাই। তবে কায়স্থ ছাড়া অন্য নিম্নবর্ণের লোকেদের এ কলেজে ভর্তিতে আমার আপত্তি আছে। কারণ জাতের সিড়িতে তারা অনেক নীচের এবং সম্ভ্রান্ত নয়।
তিনি নিজে ত কিছু করেন নাই, আরো তৎকালীন বৃটিশ সরকার যখন সবার জন্য শিক্ষার কথা বলেছিলেন, তখন তিনি তার বিরোধিতা করেন। ১৮৫৯ সালে বৃটিশ সরকার যে শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন, তার উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে সমাজের নীচু স্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়ানো।
এই শিক্ষানীতি সম্পর্কে মতামত জানিয়ে বিদ্যাসাগর বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর জেনারেল স্যার জন পিটার গ্রান্টকে একই সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এক চিঠি লেখেন। তার কিছু অংশের বঙ্গানুবাদ এরকম, “এদেশে এবং ইংল্যান্ডে এমন একটি অলিক ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছে যেন উচ্চবর্ণীয়দের শিক্ষার ব্যাপক সাফল্য অর্জন করা গেছে, এখন নিম্নবর্ণের লোকেদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
কিন্তু বিষয়টি যদি অনুসন্ধান করে দেখা হয়, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে। তাই আমার বিনীত অনুরোধ, শিক্ষা বিস্তারের একমাত্র উৎকৃষ্ট পন্থা হিসেবে সরকার সমাজের উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমিত রাখুন। উঁচু জাতের মধ্যে ব্যাপক শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে পারলেই শিক্ষা নীতি সফল হবে” (Education Department proceedings, October 1960, No. 53, 25 quoted by R.K. Biswas in article ‘A Nation of slow Learners’ in the Telegraph, Calcutta, December 23, 1993)
ভারতবর্ষের বিখ্যাত সংস্কৃত কলেজের সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুধু উচ্চবর্ণীয়রা ওখানে পড়াশোনা করতে পারত। অব্রাহ্মণদের সংস্কৃত কলেজে পড়ার অধিকার নিয়ে প্রথম প্রশ্ন ওঠে ১৮৫১ সালে। এডুকেশন কাউন্সিলের সচীব Captain F.F.C. Hayes ১৮৫১ সালের ১৮ মার্চ সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতামত চেয়ে চিঠি লেখেন।
বিদ্যাসাগর তার মতামত জানিয়ে দীর্ঘ এক পত্র দেন। সেই পত্রের সার অংশ সবার জন্য তুলে ধরছি- “শাস্ত্র মতে শূদ্রের কর্তব্য হল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য -এই তিন উৎকৃষ্ট বর্ণের সেবা করা। মনুর কালের বিধান। তবুও এ নিয়ম তাদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি কঠোরভাবে প্রযোজ্য নয়।
গোঁড়া ব্রাহ্মণগণ আজকাল তাদের শাস্ত্র শিক্ষা ও দীক্ষা দিচ্ছে। সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ নয়; তারা কেবল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারবে না। বর্তমানে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বৈদ্যজাতি সংস্কৃত কলেজে পড়ার অধিকারী।
রঘুনন্দন স্মৃতি মতে বৈদ্যরাও শূদ্র; কায়স্থদের তুল্য। বৈদ্য জাতির মত কায়স্থদেরও সংস্কৃত কলেজে পড়তে দিতে আমার আপত্তি নাই। তবে কায়স্থ ছাড়া অন্য নিম্নবর্ণের লোকেদের এ কলেজে ভর্তিতে আমার আপত্তি আছে। কারণ জাতের সিড়িতে তারা অনেক নীচের এবং সম্ভ্রান্ত নয়।
তাদের ভর্তি করা হলে এ মহাবিদ্যালয়ের মান ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে বলে আমি আশঙ্কা করি। পরিশেষে জানানো দরকার যে কায়স্থদের এই কলেজে ভর্তির প্রস্তাবে এখানকার পণ্ডিতরা ঘোর খাপ্পা; এটা তাদের আদৌ মনঃপূত নয়।” (বিনয় ঘোষঃ বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ; ওরিয়েন্ট লং ম্যান, কলকাতা ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ৫৪২~৫৪৪, শিপ্রা বিশ্বাস কর্তৃক উদ্ধৃত, অণ্বেষণ ২য় পর্ব, অদল বদল, আগস্ট, ১৯৯৪)
এই যখন সামাজিক অবস্থা, তখন পূর্ণব্রহ্ম পূর্ণাবতার শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের যোগ্য পুত্র নমশূদ্র জাতির ত্রাণকর্তা শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর (হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মিলিত শক্তিরূপে শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ নাম ধারণ করেন) কি করেছেন, তার একটা ছোট্ট বর্ণনার প্রয়োজন রয়েছে।
এর চার বছর পরে যখন সুবর্ণ বণিকদের সংস্কৃত কলেজে পড়ার প্রশ্ন ওঠে তখন শিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ং-কে বিদ্যাসাগর যে চিঠিটি পাঠান তার সার সংক্ষেপ হল, ‘‘১৮৫১ সাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্য জাতিকে এই কলেজে ভর্তি করা হত। তারপর শূদ্র জাতের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত জাতি কায়স্থদের এখানে পড়বার সুযোগ দেওয়া হয়।
পরে ১৮৫৪ সালে কলেজের দ্বার সম্ভ্রান্ত সমস্ত জাতির জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আবেদনকারী সুবর্ণ বণিকদের সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করা যাবে না। এটা সত্যি কথা এই জাতির অনেকে কলকাতায় খ্যাতিমান এবং জনপ্রিয়। তা হলে কী হবে? জাতের সিঁড়িতে তারা অতি নীচুতে।
ছোট জাতের লোকদের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশাধিকার এখানকার পণ্ডিতদের মর্মপীড়া এবং অখ্যাতির কারণ হবে। কলেজের জনপ্রিয়তা ভীষণ ভাবে হ্রাস পাবে। যত উদারতা ও সহানুভূতি সম্ভব, পূর্বেই দেখিয়েছি; এর পরে আর নয়। কলেজের দ্বার আবেদন প্রার্থীদের জন্যে খুলে দিতে আমি রাজী নই। পারলে আমি খুশী হতাম।” (বিনয় ঘোষঃ বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ; শিপ্রা বিশ্বাস কর্তৃক উদ্ধৃত, অণ্বেষণ ২য় পর্ব, অদল বদল, আগষ্ট, ১৯৯৪)
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ওরফে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বর্তমান ও অতীতের বহুজনের প্রণম্য ব্যক্তিত্ব। আমি তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই বলছি, এই উক্তিসমূহ উদ্ধৃতি দেওয়া হল শুধুমাত্র তৎকালীন সামাজিক অবস্থার বৈষম্য বহু বছর পর আজকের সময়ে বসে উপলব্ধি করার জন্য, যা তৎকালীন অধিকাংশ ইতিহাসবিদেরা লিখে যান নাই।
শুধু বিদ্যাসাগর মহাশয় নন, তখন সমাজের আনাচেকানাচে হাজার হাজার এমন বিদ্যাসাগর ছিলেন যারা সাধারণ, দলিত, পতিত শ্রেণির মানুষের শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিল। যাদের কারণেই সমাজের মানুষে মানুষে এই বিশাল বৈষম্য ছিল এবং আজও আছে।
এই যখন সামাজিক অবস্থা, তখন পূর্ণব্রহ্ম পূর্ণাবতার শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের যোগ্য পুত্র নমশূদ্র জাতির ত্রাণকর্তা শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর (হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মিলিত শক্তিরূপে শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ নাম ধারণ করেন) কি করেছেন, তার একটা ছোট্ট বর্ণনার প্রয়োজন রয়েছে।
১. শিক্ষা আন্দোলন:
সামাজিক স্তরে স্তরে যখন এই বৈষম্য বিরাজ করছিল তখন গুরুচাঁদ ঠাকুর উপলব্ধি করেছিলেন যে, এদের মুক্তির উপায় শিক্ষা। তাই তিনি তার অনুসারীদের অর্থাৎ তৎকালীন মতুয়াদের শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। একটা ব্যাপার এখানে লক্ষণীয় যে, তখনও কিছু কিছু পণ্ডিতী শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল।
কিন্তু তাতে সবাই পড়ালেখা করার সুযোগ পেত না। এই সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষকে শিক্ষার আলো দিতে গুরুচাঁদ ঠাকুর ১৮৮০ সালে শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে প্রথম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই বিদ্যালয়েই তিনি প্রথম শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করেন।
পরে এই বিদ্যালয়টিকে মিডল ইংলিশ স্কুলে রূপান্তর করেন। এই কাজ তথাকথিত কোন সমাজ সংস্কারক, মনিষী করেন নাই, শহর থেকে বহু দূরে অন্তজ গ্রামের সাধারণ মানুষের একজন নিজ জাতির চিন্তা করে করেছিলেন। তিনি এটা জানতেন যে, সমাজের বর্ণ হিন্দুদের থেকে কোন প্রকার সাহায্য পাওয়া যাবে না (চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন)।
তাই খ্রিষ্টান মিশনারির মহামানব ড. সী এস মীডের সহায়তা গ্রহণ করেন এবং তারই সাহায্যে সরকারী সাহায্যে ১৯০৮ সালে ওড়াকান্দির মিডল ইংলিশ স্কুলকে হাই ইংলিশ স্কুলে পরিণত করেন। ১৮৮১ সালে খুলনা জেলার দত্তভাঙ্গাতে ঈশ্বর গায়েনের বাড়ি নমশূদ্র মহাসম্মেলনে তিনি শিক্ষা বিকাশের আহবান জানান।
“বিদ্যা ধর্ম বিদ্যা কর্ম বিদ্যা সর্বসার।
বিদ্যা বিনা এ জাতির নাহিক উদ্ধার।।
বিদ্যাহীন জাতি হয় পশুর সমান।
বিদ্যার আলোকে জ্বলে ধর্ম তত্ত্ব জ্ঞান।।”
এবং
“বিদ্যা যদি পাও, কাহারে ডরাও, কার দ্বারে চাও ভিক্ষা।
রাজশক্তি পাবে, বেদনা ঘুচিবে, কালে হবে সে পরীক্ষা।।”
এই আহবানের ফলে চারিদিকে বিদ্যালয় তৈরি শুরু হয় জোরাল ভাবে। কথিত আছে, গুরুচাঁদ ঠাকুর তৎকালীন সময়ে নিজ উদ্যোগে প্রায় ১২০০ স্কুল এবং তার ভক্তবৃন্দের সহযোগিতায় কয়েক হাজার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, তৎকালীন বেশীরভাগ স্কুল মানুষের বাড়িতে তৈরি হত সাধারণ ঘরের মত। ফলে যখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা বিস্তার শুরু হল, তখন এসব স্কুলের বেশীরভাগ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে আজ তার অস্তিত্ব পাওয়া বেশ দুষ্কর।
২. নারীর উন্নয়ন:
সবার জন্য শিক্ষার পাশাপাশি নারী শিক্ষাকেও গুরুচাঁদ ঠাকুর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেজন্যই তার গঠিত “শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মিশন”-এর উদ্যোগে তালতলাতে “শান্তি-সত্যভামা বালিকা বিদ্যালয়” নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
এছাড়া মীডের সহযোগিতায় ১৯০৮ সালেই একটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। তা ছাড়াও প্রসূতি মা ও শিশু সেবার জন্য “মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র” তৈরি করেন, যা আজও কালের সাক্ষী হিসেবে ওড়াকান্দিতে রয়েছে।
৩. চন্ডালত্ব মোচন:
পূর্বে এই নমশূদ্র জাতিকে বর্ণহিন্দুরা ষড়যন্ত্র করে আদমশুমারির রিপোর্টে চণ্ডাল বলে আখ্যায়িত করেছিল। আর চণ্ডালের ব্যাখ্যা দিয়েছিল এরকম যে, “এরা চরিত্রহীন, প্রতারক ইত্যাদি ইত্যাদি।”
গুরুচাঁদ ঠাকুর এই চণ্ডালত্ব গালি ঘোচানোর জন্য লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন। ড. সী এস মীডের সহযোগিতায় অবশেষে ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে চণ্ডাল কেটে এই জাতির নতুন নামকরণ হয় “দ্বিজ নমশূদ্র”।
৪. তেভাগা আন্দোলনের ফল:
১৮৫২ সালের পর থেকে উচ্চবর্ণীয় জমিদার-জোতদার-মহাজনের অত্যাচার চরম সীমায় পৌঁছায়। গুরুচাঁদ ঠাকুর ১৮৮০ সাল থেকে শুরু করেন “তেভাগা আন্দোলন”। ভাগ চাষে উৎপন্ন ফসলের তিনভাগের দুই ভাগ কৃষকের প্রাপ্য -এই দাবী নিয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর নিয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর টানা ১৯০৯ সাল পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যান।
এই আন্দোলন ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পরে। ১৯২১ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রচেষ্টায় সদ্য জেতা দুই নমশূদ্র এমএলএ বা আইন পরিষদের সদস্য ভীষ্মদেব দাস ও নীরদ বিহারী মল্লিক বাংলার আইন সভায় “লাঙ্গল যার জমি তার” আইন পাশ করিয়ে জমিদারী প্রথা ভেঙ্গে আমূল সংস্কারের দাবী তুলে ধরেন।
৫. নীল বিদ্রোহ:
১৮৫৮ সালে কৃষক বিদ্রোহ এবং ১৮৫৯-৬০ সালে নিম্ন শ্রেণির কৃষকদের মধ্যে নীল বিদ্রোহ হয়। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন হরিচাঁদ ঠাকুর। ১৮৭২-১৯৭৬ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদার ও তাদের অনুচরদের সংঘবদ্ধ কৃষকেরা আক্রমণ করে যার নেতৃত্ব দেন গুরুচাঁদ ঠাকুর।
৬. সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও চাকরীতে অধিকার দান:
১৯০৭ সালে বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড ল্যান্সলেট বিশেষ কাজে ফরিদপুর এলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে তাকে স্মারক লিপি প্রদান পূর্বক অনুন্নত শ্রেণির ছেলেমেয়েদের জন্য চাকুরীর দাবী করেন। গভর্নর সেই দাবী মেনে নিয়ে সর্ব প্রথম গুরুচাঁদ ঠাকুরের পুত্র শ্রীশশিভূষণ ঠাকুরকে সাব রেজিস্টার পদে নিয়োগ করেন।
এর ফলে খুলে যায় সারাদেশের নিপীড়িত মানুষের জন্য চাকুরীর দুয়ার। ১৯১১ সালে দেশের পিছিয়ে পরা মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য লর্ড কারমাইকেলের নিকট স্মারকলিপি প্রেরণ করেন এবং শোষিত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষের জন্য বিশেষ সংরক্ষণের দাবী করেন।
ব্রিটিশ সরকার সেই দাবী মেনে নিয়ে সর্বপ্রথম ৩১টি পিছিয়ে পরা জাতিকে নিয়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করে ভারতের বঙ্গদেশে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৯ সালে মন্টেন্ড চেমস ফোর্ড অ্যাক্টের মাধ্যমে সমগ্র ভারতে এই সংরক্ষণ প্রথার বিস্তার হয়।
৭. পত্রিকা প্রকাশ ও সংগঠন গঠন:
গুরুচাঁদ ঠাকুর তার সামাজিক সংস্কার আন্দোলন জোরদার করা ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য “শ্রীশ্রী হরি-গুরু মিশন” নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। “যার দল নেই, তার বল নেই”-এই ছিল তার মূলনীতি। সংগঠনের সাহায্যে তিনি রাস্তাঘাট, পাঠশালা, ছাত্রাবাস গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেন।
এছাড়া তিনি “নমশূদ্র কল্যাণ সমিতি” নামে একটি সমিতি গঠন করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল বহুমুখী। শিক্ষা বিস্তার, রাস্তাঘাট নির্মাণ, মজা পুকুর খনন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, সৎ উপায়ে জীবন ধারণ করা, মানুষকে সাহায্য করা ছিল এর উদ্দেশ্য।
বর্তমান গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে তৎকালীন সময়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর “লক্ষ্মীর গোলা” নামে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এখানে মরসুমের সময় ধান সংগ্রহ করে রাখা হত, দাম বাড়লে বিক্রি করে বিভিন্ন সামাজিক কাজে ব্যয় করতেন। এখান থেকে লোকেরা ধান ধার নিতেও পারত, তবে ফেরত দেয়ার সময় কিছু ধান বেশী দিতে হত। যা আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার তৎকালীন রূপ।
তৎকালীন সময়ে শ্রীধাম ওড়াকান্দির ঠাকুর বাড়ি থেকে পত্রিকা বের করা হয়। তাতে তৎকালীন বিষয় নিয়ে আলোচিত হত।
৮. বাল্যবিবাহ বন্ধ ও বিধবা বিবাহ প্রচলন:
গুরুচাঁদ ঠাকুর তার সময়ে নমশূদ্র ছেলের জন্য ২০ বছর ও নমশূদ্র মেয়ের জন্য ১০ বছর নুন্যতম বয়স নির্ধারণ করে দেন এবং এর কমে বিবাহ নিষিদ্ধ করেন। তিনি বিধবা বিবাহ করার জন্য তার অনুসারীদের নির্দেশ দেন।
এই মনিষীর কর্ম বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তার সারাজীবনের কর্ম ধারা ও ধর্ম ধারা বিবেচনা করে ১৯১২ সালে পঞ্চম জর্জ তাকে “দরবার” মেডেল দিয়ে সম্মানিত করেন।
এই মহামানব শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ১৮৪৬ সালের ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার অনুসারীরা তিথি হিসেবেই তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।
হরিবোল হরিবোল হরিবোল।
……………………………
তথ্যসূত্র:
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত।
শিক্ষা আন্দোলনে গুরুচাঁদ ঠাকুর।
সরকারি চাকুরীতে গুরুচাঁদ ঠাকুরের অবদান।
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন
তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর
……………………………
আরো পড়ুন:
মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া
বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বর্ণবাদীদের গাত্রদাহ
ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
বিধবাবিবাহের প্রচলন ও গুরুচাঁদ ঠাকুর