ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ

-ড. এমদাদুল হক

১০৪
শেখা কঠিন নয়, কিন্তু শেখা জিনিস ভুলে যাওয়া খুবই কঠিন। শুনতে-শুনতে এমন অনেককিছু আমরা শিখে ফেলি, যা শত চেষ্টা করেও ভুলা যায় না। বীজগণিত, ইতিহাস, ভূগোল আমরা ভুলে যাই, কিন্তু ভুলতে পারি না, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, সিন্দবাদের ভূত।

লাঠি সাপ হওয়া, পাখির সেনাবাহিনী, পিঁপড়ার ভাষা বুঝা, মাছের পেটে অবস্থানের পবিত্র গল্পগুলো আমাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে যায়। মন এই গল্পগুলোর সঙ্গে এমনভাবে আটকে থাকে যে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়।

নতুনদিনের বাস্তবতা আমরা মিলিয়ে দেখি পুরানোদিনের গল্পের সঙ্গে। যদি মিল থাকে, তবে গ্রহণ করি সংযোজন হিসেবে। যদি মিল না থাকে, তবে প্রত্যাখ্যান। প্রত্যাখ্যান থেকে প্রতিরোধ। প্রতিরোধ থেকে সংঘর্ষ। একেই বলে মৌলবাদিতা।

যার জানার জগৎটি যত সংকীর্ণ, সে তত কট্টর মৌলবাদী। যে যত কট্টর মৌলবাদী তার প্রত্যাখ্যানও হয় তত বেশি।

গাছের নিচে যেমন গাছ হয় না, তেমনি গল্পের নিচে গল্প হয় না। নতুন গাছ রোপন করতে হলে যেমন পুরাণ গাছ তুলে ফেলতে হয় তেমনি নতুন গল্প শুরু করতে হলে, পুরাণ গল্প মুছে ফেলতে হয়।

শেখা জিনিস ভুলা যায় কেবল উচ্চতর জ্ঞান দিয়ে। এ জন্য চাই একটি উন্মুক্ত মন। যে জানে- সে জানার ভারে ভারাক্রান্ত। জানার আগ্রহ থাকলে জানা যায়।

১০৫
জীবনযাপনের জন্য অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, আশ্রয় চাই। কোত্থেকে আসবে অন্ন, বস্ত্র আশ্রয়? বস্ত্র বিক্রেতাকে যদি অনুরোধ করি, ‘ভাই, দয়া করে আমাকে একটি বস্ত্র দিন, ঈশ্বর পরকালে আপনাকে ৭০টি বস্ত্র দিবেন’; কিংবা ফ্ল্যাট বিক্রেতার কাছে যদি অনুরূপ আবেদন করি, তবে তারা কি বস্ত্র কিংবা ফ্ল্যাট দিবেন?

যদি দেয়ও, এটি নিয়ম না। নিয়ম হলো, ন্যায্য মূল্য পরিশোধ করা। বস্তু জগতে যেই নিয়ম- আধ্যাত্মিক জগতেও সেই নিয়ম।

দৈহিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়। আধ্যাত্মিক প্রয়োজন- জ্ঞান, প্রেম, আনন্দ। অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় যেমন ফ্রি পাওয়া যায় না, তেমনি জ্ঞান, প্রেম, আনন্দও ফ্রি পাওয়া যায় না- যথাযথ মূল্য পরিশোধ করতে হয়।

জ্ঞানের মূল্য অহং।
প্রেমের মূল্য বাসনা।
আনন্দের মূল্য হিংসা।

অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ভিক্ষা চাওয়া যেমন মনুষ্যত্বের অবমাননা তেমনি জ্ঞান প্রেম আনন্দ ভিক্ষা চাওয়াও মনুষ্যত্বের অবমাননা।

অন্ন বস্ত্র আশ্রয় চুরি করা যায় বটে, কিন্তু চুরি করা অপরাধ। আর জ্ঞান প্রেম আনন্দ চুরি করাই যায় না। পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর জন্য যেমন উপার্জন করা শ্রেয় তেমনি পারমার্থিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যও উপার্জন করা শ্রেয়।

আমার টাকা আমার পকেটেই থাকবে, কিন্তু ফ্ল্যাটটি আমার হবে- এটি যেমন সম্ভব না তেমনি আমার অহঙ্কার, বাসনা, হিংসা আমার মধ্যেই থাকবে অথচ জ্ঞান প্রেম আনন্দ আমার হবে, এটি সম্ভব না।

একটি পেতে হলে আরেকটি ছাড়তে হবে- এটিই জগতের নিয়ম।

১০৬
ডাক্তারের অভাব নেই- রোগীরও অভাব নেই।
ওষুধের অভাব নেই- অসুখেরও অভাব নেই।
ধর্মগুরুর অভাব নেই- অধর্মেরও অভাব নেই।

মসজিদ, মাদ্রাসার অভাব নেই- দুর্নীতি, ধর্ষণ, খুনেরও অভাব নেই।

এ কেমন কথা?

ঢাকা হলো মসজিদের শহর। ক্যাসিনো, দুর্নীতির শহরও ঢাকাই। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ওষুধ সেবন হয় বাংলাদেশে। রোগ বেশি- তাই ওষুধ বেশি।

আচ্ছা, দুর্নীতি বেশি বলেই কি মসজিদ, মাদ্রাসা, দরবার, পীর-ফকিরের সংখ্যাও বেশি?

বাংলাদেশ অলি-আউলিয়ার দেশ।

পানি রান্না করতে হয় কোন দেশে? বাংলাদেশে। খাদ্যে ভেজাল কোন দেশে সবচেয়ে বেশি? বাংলাদেশে। তবে কি অধর্ম করার জন্যই মানুষ ধর্মের মুখোশ পরে আছে?

যারা যত বেশি দান করে, তারা কি তত বেশি দুর্নীতিও করে? মসজিদের মার্বেল পাথর, এসি; দরবারগুলোর আড়ম্বরের উৎসও কি দুর্নীতি?

পাপ এবং অধর্ম এক সঙ্গে থাকে। মসজিদ, মাদ্রাসা, দরবার কয়টা আছে তা দিয়ে ধর্মের বিচার হয় না। পাপের অবস্থা কেমন, তা দিয়ে ধর্মের বিচার হয়।

রোগ এবং অধর্মও একসঙ্গে থাকে। পশুদের রোগ কম হয়- কারণ তারা অধর্ম করে না। তারা ভালো আছে, কারণ তাদের জীবনবীমা নেই, ব্যাংক নেই, ব্যাংক-ব্যালেন্সও নেই।

মানুষ তো আবার আশরাফুল মাখলুকাত! মানুষের মগজ ভরে আছে কুরআন-কিতাব, নবী-রসুলের বাণীতে। আর জীবন জুড়ে আছে হিংসা, দ্বেষ, প্রতিযোগিতা।

এটি প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, মসজিদ, মাদ্রাসা, দরবারের সংখ্যা বৃদ্ধি করে মানুষকে মানুষ করা যাবে না। এজন্য চাই সুশাসন ও সুশিক্ষা; ধর্মনিরপেক্ষতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা।

ডাক্তার, ওষুধ, হাসপাতালের সংখ্যা বৃদ্ধি করে রোগ কমানো যাবে না। এজন্য চাই দূষণমুক্ত পানি ও পানীয়; দূষণমুক্ত বায়ু ও খাদ্য এবং অবশ্যই দূষণমুক্ত পরিবেশ।

১০৭
সে ছিল ওহাবি, হয়েছে সুফি। ওহাবি থেকে সুফি হওয়া মানে কিন্তু জীবনধারার পরিবর্তন না- দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কঠিন কিছু না। কঠিন হলো জীবনধারার পরিবর্তন- সত্য জীবনযাপন; বিরোধিতা, হিংসা, পরনিন্দা, অহং বর্জন।

সুফি গোত্রভুক্ত হওয়ার মধ্যে কোনো মহত্ত্ব নেই। মহত্ত্ব রয়েছে পবিত্রতা অর্জনে, হৃদয়ে সকলের প্রতি প্রেমভাবের উদয়ে।

সে ছিল নাস্তিক, হয়েছে আস্তিক। অবিশ্বাস থেকে সে বিশ্বাসে এসেছে। ভালো কথা। সে কি মিথ্যাচার ছেড়েছে? সে কি পরনিন্দা ছেড়েছে? সে কি দুর্নীতি ছেড়েছে?

ছাড়েনি যখন, তখন আস্তিক হলেই কী, নাস্তিক হলেই বা কী? যখন নাস্তিক ছিল তখনও সে দুর্নীতি করতো, যখন আস্তিক হলো তখনও সে দুর্নীতি করে। পরিবর্তনটি হলো কোথায়? সাইনবোর্ডে। সাইনবোর্ডের পরিবর্তন, কোনো পরিবর্তন না।

মিথ্যাবাদী, অসৎ, ব্যভিচারী সুফি থেকে সত্যবাদী, সৎকর্মপরায়ণ ওহাবি উত্তম নয় কি?

অভদ্র, উদ্ধত, অশান্ত, নিষ্ঠুর আস্তিক থেকে ভদ্র, বিনয়ী, শান্ত, দয়ালু নাস্তিক উত্তম নয় কি?

সুতরাং কে ওহাবি, কে সুফি, কে আস্তিক, কে নাস্তিক, কে মুসলিম, কে হিন্দু- এসব বাজে প্রশ্ন উত্থাপন না করে, প্রশ্নটি হোক- কে সত্য বলে? কে সৎকর্ম করে? কে আস্থাভাজন? কে পরনিন্দা-পরচর্চা করে না? কে ন্যায়ের প্রতি নিষ্ঠাবান?

কে মানুষের ক্ষতি করে না? কে অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে না? কে দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে? কে ভদ্র, বিনয়ী, শান্ত, দয়ালু? কে পবিত্র?

১০৮
যে নিজেকে পবিত্র করতে চায়- সে অন্যের দোষের দিকে মনোযোগ দেয় না। সে সতর্ক থাকে নিজের দোষ সম্বন্ধে। ভিন্নমত থাকার কারণে গায়ে পড়ে সে বিরোধিতা শুরু করে না। সে চর্চা করে বিনয় ও করুণার; মানুষের দোষগুলো দেখে ক্ষমার দৃষ্টিতে। সে কখনো প্রমাণ করার চেষ্টা করে না যে, কেবল তার ধর্মই ঠিক; বরং জাতি, ধর্ম, গোত্রের ঊর্ধ্বে উঠে সে উপলব্ধি করে মানবজাতির ঐক্য।

যে অন্যকে অসম্মান করে সে নিজেকেই অসম্মান করে। যে আরেকজনকে গালি দেয় সে নিজেকেই গালি দেয়। ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। আরেকজনকে দৌঁড়ালে নিজেকেও দৌঁড়তে হয়।

সুতরাং যে অপমানিত হতে না চায়, সে আরেকজনকে অপমান না করুক। সত্যানুসন্ধানীরা সত্য নিয়ে থাকুক- বিভেদ ও বিরোধিতা এড়িয়ে চলুক, আক্রমণাত্মক না হোক; নিজে বড় হোক- অন্যকে ছোট না করুক।

সত্য, সত্যের বিরোধী হতে পারে না। সুতরাং যেখানে বিরোধিতা আছে সেখানে সত্য নেই।

বিরোধিতার জন্মভূমি মিথ্যা। যে নিজের ধর্মকে সত্য এবং অন্যের ধর্মকে মিথ্যা বলে সে নিজ ধর্মের সত্য এখনও বুঝতে পারেনি। সব ধর্মের গভীরে রয়েছে এক ধর্ম। সব অবতারের অন্তরালে রয়েছেন- এক অবতার।

মানুষ সংঘর্ষ করে ধর্মের নামে প্রচলিত মিথ্যাচারগুলো নিয়ে। সত্য নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কেউ বলে না যে, মিথ্যা ভালো, দুর্নীতি ভালো, পরনিন্দা ভালো, ব্যভিচার ভালো। সবধর্মের মূল কথা- ভালো থাকা, ভালো করা, ভালো রাখা। সুতরাং দ্বন্দ্ব ভালো নিয়ে নয়- দ্বন্দ্ব মন্দ নিয়ে। যারা ভালোর চর্চা করতে রাজি না, তারাই মন্দ নিয়ে দ্বন্দ্ব করে।

‘আমি কতো ভালো, আর তুমি কতো মন্দ!’- এটিই মন্দের বীজ।

(চলবে…)

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!