-ড. এমদাদুল হক
১৩৮
“আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে; নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?”
একটি রাজ্য আছে, যেই রাজ্যের নিরঙ্কুশ রাজা আমরা স্বয়ং। কি নাম এই রাজ্যটির? মনের রাজ্য, জীবনের রাজ্য। রাজ্যটির সীমানা কতদূর? মনের সীমানা কি দেহ? মন এই ক্ষণে ভ্রমণ করতে পারে হাজার কোটি মাইল দূরের অজানা নক্ষত্রে; জলে স্থলে অন্তরিক্ষে যখন যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারে।
গোটা মহাবিশ্ব রয়েছে মনের ভেতর।
১০ হাজার কোটি বছর আগে কী ছিল, মন তা জানে। ১০ হাজার কোটি বছর পর কী হতে পারে, তাও মন জানে। মনের অবস্থান স্থান-কালে নয়- বরং মনের ভেতরেই রয়েছে স্থান-কাল।
ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ, বিদ্যা-অবিদ্যা, ঘৃণা-প্রেম, দ্বৈত-অদ্বৈত আরো যাকিছু আছে সবকিছুর অবস্থান এই মনে। সব শব্দ ও পরিভাষা মন থেকেই উৎপন্ন হয়। মন থেকেই উৎপন্ন হয় কর্ম ও কর্মফল- এমনকি স্বর্গ নরক ঈশ্বর। ঈশ্বরের মধ্যে মন থাকে না, বরং মনের মধ্যে থাকে ঈশ্বর।
মনে নৈরাজ্য পাপ ঘৃণা অথচ মুখে দাঁড়ি মাথায় টুপি হাতে তাসবিহ লেবাসে ফিটফাট- কী হয় তাতে? কতো বড় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তুমি! মনের ব্যবস্থাপনা জানলে না- কী লাভ হলো তাতে?
মন্ত্রী তুমি- মন্ত্র জানো না।
মন্ত্র কি? মনের তাড়ন যাহাতে তাই তো মন্ত্র!
কোথায় আছে মনের তাড়ন? জানে শুধু মনের অধিশ্বর। মানুষ পারে অধিশ্বর হতে আপন মনের; যদি না পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত না পারে- স্বস্তি নাই, শান্তি নাই, পূর্ণতা নাই।
এই মনকে যে জয় করেছে, সে-ই বিশ্ববিজয়ী বীরশ্রেষ্ঠ।
রাজার সঙ্গেই তো রাজার সাক্ষাৎ হয়। মনের রাজাই তো সাক্ষাৎ পায় জগৎ রাজার। মানুষ হয় মনের প্রজা, না হয় মনের রাজা। মনের প্রজা অপবিত্র। মনের রাজা পবিত্র। যে পবিত্র, সে প্রশান্ত।
হে প্রশান্ত মন!
তুমি সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে
সাক্ষাৎ করো তোমার রাজার সনে।
রাজা তুমি, থাকো রাজাদের সঙ্গে
এবং প্রবেশ করো নন্দনকাননে।
১৩৯
জীবনের বিধান কোনটি? ক্ষমা, নাকি প্রতিশোধ? “প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত, জখমের বদলে একই জখম”- এই যদি হয় জীবনের বিধান, তবে মরণের বিধান কোনটি?
প্রতিশোধ কখনো ‘জখমের বদলে একই জখমে’ সীমাবদ্ধ থাকে না। দাঁতের বদলে ঠিক সেই দাঁতটি ফেলে দেওয়ার জন্য কেউ মুখ খুলে বসে থাকে না।
নিজের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে রাখা আধ্যাত্মিকভাবে আত্মহত্যার শামিল। জ্ঞানের সূচনা হয় ক্ষমা অনুশীলনের মাধ্যমে। আঘাতের বিনিময়ে আঘাত দেওয়ার প্রয়াসে মন থেকে স্বস্তি ও শান্তি চলে যায়।
শুষ্ক বালিতে গোলাপ ফুটে না, আগুন লাগা ঝোপে পাখিরা গান গাইতে পারে না। বুকের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন নিয়ে প্রেম করা যায় না, জ্ঞানের প্রদীপও জ্বালানো যায় না।
প্রতিশোধ নিতে মরিয়া তারাই যারা অজ্ঞতা ও অন্ধকারের বাসিন্দা। প্রতিশোধের বিধানগুলো জাহেলিয়াতের বিধান। জাহেলিয়াত কোনো অতীত যুগের নাম নয়- এটি মানবমনের পতিত অবস্থার নাম।
প্রতিশোধ স্পৃহা এমন একটি ভাইরাস যা মনের সব কোমলতা খেয়ে ফেলে। ফলে হৃদয় থেকে উড়ে যায় প্রেমের তৃষ্ণা, সহযোগিতার ইচ্ছা। হৃদয়ে বাসা বাধে অহঙ্কারের পোকা, সন্দেহ, ভয়।
পক্ষান্তরে, ক্ষমা নিয়ে আসে প্রেমের বার্তা। ক্ষমার মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় সংযোগ-উন্মুক্ত হয় প্রশান্তির দুয়ার।
অন্ধকার দ্বারা যেমন অন্ধকার দূর করা যায় না, তেমনি প্রতিশোধ দ্বারা শত্রুতা দূর করা যায় না। পরাজিত শত্রু আরো বেশি বিপজ্জনক হতে পারে। কাউকে পরাজিত করা মানে তার হৃদয় জয় করা না। প্রকৃত জয় হলো হৃদয় জয় করা। হৃদয় প্রতিশোধ দ্বারা জয় করা যায় না- হৃদয় জয় করা যায় প্রেম দ্বারা।
ক্ষমা করে দেয়া কাউকে কিছু দেয়া না, এটি নিজেকে দেয়া। নিজের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা পোষে রাখলে যেমন নিজেরই ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি তেমনি ক্ষমা করে দিলে নিজেরই উপকার হয় সবচেয়ে বেশি।
একদিন পিতর যীশুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রভু, আমার ভাই আমার বিরুদ্ধে অন্যায় করলে, আমি কতবার তাকে ক্ষমা করবো? সে কি সাত বার পর্যন্ত?” যীশু তাঁকে বললেন, “সাত বার নয়- সত্তর গুণ সাত বার পর্যন্ত।”
১৪০
আত্মসম্মান ও অহং-কে অনেকেই একরকম দেখে। বাস্তবে আত্মসম্মান ও অহং এক তো নয়ই বরং পরস্পরের বিপরীত।
অহং হলো মুখোশ- আত্মসমান হলো পোশাক। মুখোশ পরিহার্য- পোশাক অপরিহার্য। অহং অজ্ঞানের পরিচয়- আত্মসম্মান জ্ঞানের পরিচয়।
অহং হলো মানুষের কাছ থেকে সম্মান পাওয়া, আর আত্মসম্মান হলো নিজে নিজেকে সম্মান করা। যে নিজেকে সম্মান করে না, সে কাউকেই সম্মান করে না- কারো কাছ থেকে সম্মান পায়ও না। যা পায় তা হলো, তোষামোদ।
যার আত্মসম্মানবোধ আছে নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে সে কর্তব্য পালন থেকে বিরত থাকে না।
যে নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে কর্তব্য পালন থেকে বিরত থাকে কিংবা আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়, তাকে বলা হয় কাপুরুষ।
অপদার্থ কাকে বলে? যার অহং প্রতুল, কিন্তু আত্মসম্মান অপ্রতুল, তাকে বলা হয় অপদার্থ। অহঙ্কারী ব্যক্তি নিজের অজ্ঞতা ঢেকে রাখে; শিখতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। সে ‘জানি না’ বলতে পারে না, তাই জানতেও পারে না।
যে নিজেকে সম্মান করে, সে কী জানে, আর কী জানে না, তা ভালো করেই জানে। ‘জানি না’ বলতে সে কুণ্ঠাবোধ করে না। তাই সে জানতে পারে।
অহঙ্কার নির্ভর করে রূপ, বংশ, অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির উপর।
আত্মসম্মান নির্ভর করে সততা, শুদ্ধতা, আন্তরিকতা, চরিত্র ও উদারতার উপর। অনেক সময় অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করা অহং মনে হতে পারে, কিন্তু এটি অহং নয়- আত্মসম্মান।
আত্মসম্মানী ব্যক্তি সকলকে ‘যথাযোগ্য’ সম্মান দেয়। যারা সম্মানের যোগ্য নয়, ভয়ে সে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না। এটিও অন্যদের কাছে অহঙ্কার মনে হতে পারে, কিন্তু এটি অহং নয়- আত্মসম্মান।
আত্মসম্মান অর্জন করতে হলে নিজেকে শুদ্ধ করতে হয়। তাই আত্মসম্মান অর্জনের সঙ্গে অহং নিজ থেকেই সুস্থ হয়ে উঠে।
ধর্মশিক্ষার মূল বিষয় হওয়া উচিত আত্মসম্মান অর্জন করা।
১৪১
আমরা কি শান্তিতে (ইসলামে) আছি?
আমরা কি শান্ত?
শান্ত না হলে কি শান্তিতে থাকা যায়?
মানুষ শান্তির জন্য কাতর, কিন্তু শান্ত হতে চায় না। মানুষ করছে কলহ, আর চাইছে স্বর্গীয় আনন্দ! জীবনে যদি বাস্তবেই শান্তির প্রবেশ ঘটে, তবে কলহ বিদায় নেয়; যদি প্রেমের প্রবেশ ঘটে ঘৃণা বিদায় নেয়। এটিই নিয়ম। কলহ ও শান্তি, প্রেম ও ঘৃণা একই হৃদয়ে একসঙ্গে থাকতে পারে না।
তুমি শান্ত নও, কিন্তু প্রচার করছো শান্তির ধর্ম; তাই অশান্তিতে ভরে গেছে পৃথিবী। তুমি যেখানে যাও সেখানেই দলিল দেখাও, আর বিস্ময় প্রকাশ করো, পৃথিবীতে এতো দলাদলি কেনো! তুমি বুঝতেই পারছো না যে, অশান্তির প্রচারক তুমি! দলিল দেখিয়ে দলাদলি উৎপন্ন করছো তুমিই!
যে প্রকৃতই শান্তি চায়, সে নিজে শান্ত হয়।
শান্তি ন্যায়ের সুরক্ষা দেয়। যে যতক্ষণ শান্তির সুরক্ষায় থাকে ততক্ষণ তার ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
শান্ত কে? যে লালসা ও ক্রোধ, বিদ্বেষ ও অহংকার, স্বার্থপরতা ও লোভকে জয় করেছে সে শান্ত।
কাফির কে? কাফির অর্থ ঢাকিয়া রাখা। যাহা শান্তি ঢাকিয়া রাখে তাহাই কাফির। শান্তি ঢাকিয়া রাখে লালসা, ক্রোধ, বিদ্বেষ, অহংকার, স্বার্থপরতা, লোভ। এইসব শত্রুদের যে পরাস্ত করতে পেরেছে শান্তি তাঁর কাছেই রয়েছে।
শান্ত হলে শান্তি পাওয়া যায়। কেউ কাউকে শান্তি দিতে পারে না। শান্তির জন্য যুদ্ধ করা যায় না। শান্তির কোনো পক্ষ নাই।
শান্তি নিরপেক্ষ।
শান্তি হলো অখণ্ড নীরবতা।
শান্তি হলো প্রেম।
আমি সবাইকে ভালোবাসি, সবাই আমাকে ভালোবাসে- এমন একটি মনস্তাত্বিক অবস্থার নাম শান্তি (ইসলাম)।
১৪২
কিছু সিদ্ধান্তের সমষ্টিই জীবন। যার সিদ্ধান্ত সন্দেহজনক- তার জীবনটিই সন্দেহজনক। একটি ভুল সিদ্ধান্ত জীবনকে ব্যর্থতার স্রোতে নিয়ে যেতে পারে।
যে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায়, সিদ্ধান্ত নিতে সবচেয়ে বেশি ভুল করে সে-ই। সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্তহীনভাবে ভুল করা, বড় ভুল। ভুল সিদ্ধান্ত ১টি ভুল। সিদ্ধান্তহীনভাবে ভুল করা হলো ২টি ভুল। ভুল সিদ্ধান্ত দুর্বলতা নয়। দুর্বলতা হলো দোদুল্যমান সিদ্ধান্ত।
সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে সতর্ক থাকা চাই- সে কী জানে, আর কী জানে না; কী পারে, আর কী পারে না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে দৃঢ়তার সঙ্গে হাঁ কিংবা না বলার জন্য প্রস্তুত থাকা চাই।
শুধু যুক্তিসঙ্গত হলেই সিদ্ধান্ত সঠিক হয় না। মানুষের মন প্রত্যেক বিষয়ের পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম। যুক্তির সঙ্গে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের দিকটিও খেয়াল রাখা চাই।
সিদ্ধান্তের যথাযথতা নির্ণয়ের মানদণ্ড হলো ‘লক্ষ্য’। লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত সঠিক। লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত সব সিদ্ধান্ত ভুল।
যার লক্ষ্য নেই তাকে সিদ্ধান্তের জন্য বারবার অন্যের শরণাপন্ন হয়। অন্যের সিদ্ধান্তে রাজা হওয়ার চেয়ে নিজের সিদ্ধান্তে ফকির হওয়াও ভালো।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতার মাধ্যমেই ব্যক্তি তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখে। আমরা এখন যে অবস্থায় আছি তা অতীত সিদ্ধান্তের ফল। এখন আমরা যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো সেসব সিদ্ধান্তই নির্মাণ করবে আমাদের ভবিষ্যৎ।
সিদ্ধ+অন্ত = সিদ্ধান্ত। সিদ্ধ ব্যক্তিত্বই সম্যক সময়ে সম্যক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সিদ্ধ কি?
সিদ্ধ শব্দের সাধারণ অর্থ- আগুনের উত্তাপে পরিশোধিত হওয়া। অনেক তাপ সহ্য করে, অনেক কষ্ট ও ক্ষতির পর মানুষ সিদ্ধ হয়। সিদ্ধ হবো কিনা এটিও একটি সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব