ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ ২

-ড. এমদাদুল হক

২৬
প্রশ্ন: ইসলাম ধর্মের খুঁটি কয়টি?

উত্তর: ইসলাম দুই প্রকার। যথা- ধনীদের ইসলাম ও গরিবের ইসলাম। ধনীদের ইসলামের খুঁটি পাঁচটি: ইমান, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত। গরিবের ইসলামের খুঁটি তিনটি: ইমান, নামাজ, রোজা। ধনীদের ইসলামে খুঁটি ছাড়াও রয়েছে কুরবানি, দান, সদকা, ফিতরার মতো এডিশনাল খুঁটি। গরিবের ইসলামে এসব নাই।

প্রশ্ন: জামাতে নামাজ পড়া কি ওয়াজিব?

উত্তর: ইসলাম দুই প্রকার। যথা- পুরুষের ইসলাম ও নারীর ইসলাম। পুরুষের ইসলামে জামাতে নামাজ পড়া ওয়াজিব। নারীর ইসলামে জামাতে নামাজ পড়া ওয়াজিব নয়। পুরুষের ইসলামে বিবাহ চারটি কিংবা ততোধিক। নারীর ইসলামে বিবাহ ১টি।

পুরুষের ইসলামে পর্দা নাই, নারীর ইসলামে পর্দা ওয়াজিব। সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের অর্ধেক কিন্তু নামাজ রোজা অর্ধেক না। তদুপরি জাহান্নামের বেশিরভাগ সদস্য হবে নারী। যদিও মাতার পদতলে সন্তানের জান্নাত।

প্রশ্ন: টাখনুর নিচে কাপড় পরা কি জায়েজ?

উত্তর: ইসলাম দুই প্রকার। যথা- শীতকালের ইসলাম ও গ্রীষ্মকালের ইসলাম। গ্রীষ্মকালে টাখনুর নিচে কাপড় পরা জায়েজ নয়। শীতকালে টাখনুর নিচে কাপড় পরা জায়েজ।

প্রশ্ন: মুর্শিদ ছাড়া কি ইসলাম সম্ভব না?

উত্তর: ইসলাম দুই প্রকার। যথা- সৌদী ইসলাম ও ইরানী ইসলাম। সৌদী ইসলাম মুর্শিদ দ্বারা সম্ভব না। ইরানী ইসলাম মুর্শিদ ছাড়া সম্ভব না।

প্রশ্ন: নামাজ ও পর্দা এই দুটি বিষয় নিয়ে সমাজে অনেক মতভেদ দেখা যাচ্ছে। এই সম্বন্ধে আপনার কাছে বিস্তারিত জানতে চাই।

উত্তর: আগে বলো, তুমি কোন ইসলামে বিশ্বাস কর-সুফি ইসলামে, নাকি ওহাবি ইসলামে?

প্রশ্ন: এটি আবার কি? এখানেও বিভাজন? আল্লাহ এক, নবী এক, ইসলামে এতো ভাগ করলো কারা?

উত্তর: মোল্লা, পুরোহিতরা। এইজন্যই আমি এই সম্বন্ধে কিছু বলি না। ইসলাম সম্বন্ধে সবাই, সবকিছু জেনে গেছে। দারোয়ানও ঐদিন কুরবানির হাকিকত বুঝাচ্ছিল-পশুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে যায়; কোরবানির পশুর প্রত্যেকটি পশমের জন্য একটি করে সওয়াব রয়েছে ইত্যাদি, ইত্যাদি।

সারাদিন মোবাইলে ওয়াজ শুনে তো, অ-নে-ক জানে! আমি চুপ থেকে তার বয়ান শুনেছি। তুমিও চুপ থাকো। মনে রেখো, তুমি যা বলবে, তারই বিরোধিতা করার জন্য একটি দল প্রস্তুত আছে। দলাদলি ভালো না! যদি প্রকৃতই বুঝতে চাও, অন্বেষণ কর-“নিজের মধ্যে”।

অনুমান করি, এক শতাংশ মানুষ ধর্ম বুঝতে চায়। তাদের মধ্যে এক শতাংশ সঠিক বুঝটি নিতে পারে। তাদের মধ্যে এক শতাংশ যা বুঝে তা করে। তাদের মধ্যে ১ শতাংশ লক্ষ্যে পৌঁছে। ৯৯ শতাংশ মানুষ, যারা বুঝতেই চায় না, তারাই শাস্ত্রের উল্টা-পাল্টা ব্যাখা ও ফতোয়া দিয়ে বিভেদ তৈরি করে এবং নতুন-নতুন দল গঠন করে। কারণ দলাদলি ছাড়া ধর্মব্যবসা জমে না।

২৭
একসময় মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল ছিল-এখন নেই। এটি কি সাংঘর্ষিক? একসময় স্কুলে যেতাম-এখন যাই না। এটি কি সাংঘর্ষিক? একসময় বিশ্বাস করতাম, পৃথিবীর চারিদিকে সূর্য ঘুরে-এখন বিশ্বাস করি সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী ঘুরে-এটি কি সাংঘর্ষিক?

একসময় সিনেমা দেখতাম-এখন দেখি না। এটি কি সাংঘর্ষিক? একসময় ওয়াজ শুনতাম-এখন শুনি না। এটি কি সাংঘর্ষিক? একসময় ভাবতাম তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না, এখন দেখছি তোমার সান্নিধ্যে থাকলে বাঁচবো না-এটি কি সাংঘর্ষিক?

দূর গন্তব্যে পৌঁছতে হলে গরুরগাড়ি ছেড়ে বাস, বাস ছেড়ে ট্রেন, ট্রেন ছেড়ে উড়োজাহাজে উঠতে হয়। বাহন পরিবর্তন করা যদি তোমার কাছে সাংঘর্ষিক মনে হয়-তবে শুনো খোকা- গরুরগাড়িতে চড়ে স্ট্যাচু অফ অফ লিবার্টি পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেই।

অবিদ্যায় আচ্ছন্ন মন বাহনের প্রেমে পড়ে যায় এবং সারাজীবন ‘গরুরগাড়ি জিন্দাবাদ’ করতে থাকে। বিকাশ মানেই সংঘর্ষ, জীবন মানেই সংঘর্ষ-বৈপরীত্যের সমাহার ও দ্বন্দ্ব। প্রেমের বাতি জ্বালানোর জন্য বৈপরীত্যের সমাহার দরকার। উত্তল ও অবতল দরকার। দ্বন্দ্ব দরকার।

‘তিনিই সাদা, তিনিই কালো’-এটি তোমার কাছে সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে! কিন্তু একত্ব এমনই। ‘তিনিই ভালো, তিনিই মন্দ’-তোমার সন্দেহে ভরা মন মানতে চায় না। কিন্তু সত্য এমনই।

তোমার জড় মন দিন-রাত, পাহাড়-নদী, আগুন-পানি, আলো-আঁধার, শক্ত-নরমের মধ্যে সাংঘর্ষিকতা আবিষ্কার করে কারণ তুমি আরেকজনকে ছোট করে, নিজে বড় হতে চাও। যতটুকু প্রেম থাকলে বিপরীতকে ‘পরিপূরক’ ভাবা যায়, তা তোমার নেই। তোমার মন এখনও দ্বৈততার মধ্যে অদ্বৈত অনুভবের জন্য প্রস্তুত হয়নি।

এন্টি-থিসিস ছাড়া থিসিস পূর্ণতা পায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত জানার জগতে দ্বন্দ্ব উৎপন্ন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞানের কিরণ প্রবেশ করবে না হৃদয়ে।

২৮
প্রতিদিন প্রযুক্তির আপডেট ভার্সন আসছে। নতুন নতুন আলু কাটার যন্ত্র থেকে শুরু করে হিউম্যানোয়েড রোবট আসছে বাজারে। জীবনকে সহজ করার, আরো গতিময় করার নিরন্তর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে গোটা মানবজাতি। এই গতিময় জগতে গতি হলো না শুধু ধর্মের।

ধারণের বিষয়, গুণ, পরিমাণ সব বদলে গেছে, তবু ধর্ম রয়ে গেছে অনড়। দাড়ি, টুপি, লেবাস, বাড়ি, গাড়ি সবকিছুর নবায়ন হয়, শুধু ধর্মের নবায়ন হয় না। কেন হয় না?

কারণ ধর্মের ভিত্তি হলো ধর্মপ্রবর্তকদের প্রাচীন জ্ঞান। তাদের জ্ঞান লিপিবদ্ধ হয়েছিল প্রাচীন পদ্ধতিতে, প্রাচীন ভাষায়। এবং ধারণা করা হয় যে, শাস্ত্রগুলো প্রাচীনত্ব বজায় রেখেছে।

একবার ভাবুন তো, ২০০ বছর আগের বাংলাভাষা বুঝতে পারবেন? ভাষা বদলে গেছে, শব্দ বদলে গেছে, শব্দের তাৎপর্য বদলে গেছে, অক্ষর বদলে গেছে, অক্ষরের আকার বদলে গেছে, অনেক নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে। অথচ আমরা কি করছি? আমরা এখনকার অর্থ দিয়ে হাজার-হাজার বছরের পুরানো শাস্ত্রগুলো বুঝার চেষ্টা করছি, আর মতভেদ তৈরি করছি।

কেউ কেউ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে শব্দগুলোর অদ্ভুত অর্থ আবিষ্কার করে দলাদলি করছে। আর সাধারণ মানুষ এগুলো নিয়েই নাচানাচি করছে। খুব কম মানুষই সত্যটি ধরতে পারে। কিন্তু সময়ের কাছে তারা বড়ই অসহায়। কেন? উত্তরটি দিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ-

“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।”

২৯
টাকা চাও? চাপা মারো।

ক্ষমতা চাও? চামচামি করো।

জানতে চাও? মানতে থাকো।

প্রশংসা চাও? প্রশস্তি করো।

শিখতে চাও? মুক্ত হও।

মুক্তি চাও? খাঁচা ভাঙো।

প্রেম চাও? বিশ্বাস করো।

জ্ঞান চাও? নিজেকে জানো।

আনন্দ চাও? এক হও।

তুমি যা চাইবে, তা-ই পাইবে;

কিন্তু সব চাইতে পারবে না।

৩০
গতকাল তার সঙ্গে আমার কথোপকথনটি ছিল এরকম:

-আপনি বলেছেন, “যে যা চায় সে তা-ই পায়” -কথাটি ঠিক না। আমি ঈশ্বর চেয়েছিলাম। পাওয়ার জন্য সব করেছি। কিন্তু কিছুই পাইনি।

: তাই নাকি? কতদিন আপনি সাধনায় কাটিয়েছেন?

-২৪ বছর।

: ওয়াও! এর মধ্যে আপনি ঘুমাননি?

-ঘুমিয়েছি অবশ্যই। না ঘুমিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে নাকি?

: বিয়ে করেছেন?

-অবশ্যই! বিয়ে করা তো ফরজ!

: ছেলেমেয়ে কয়জন?

-পাঁচজন। মুসলমানের বংশবৃদ্ধি করা অবশ্য কর্তব্য।

: চাকরি করেন?

-অবশ্যই। চাকরি না করলে খাওয়াবে কে?

: টিভি দেখেন না? ক্রিকেট খেলা? স্টার জলসা?

-স্টার জলসা কখনো দেখি না। তবে ক্রিকেট খেলা মিস করি না। ইউটিউবে পুরানো খেলাও দেখি মাঝেমধ্যে।

: কতদিন আপনি সাধনায় কাটিয়েছেন যেন? সপ্তাহে একদিন পীরের দরবারে হাজিরা দিয়ে মিলাদ পড়েছেন, তেহারি খেয়েছেন, গান-বাজনা করেছেন; আর একেই আপনি ২৪ বছরের সাধনা বলছেন, তাই তো? শুনুন, ধর্ম ওয়িকেন্ড এন্টারটেইনমেন্ট না।

গতকাল বলেছিলাম, আজ আবার বলি-তুমি যা চাইবে, তা-ই পাইবে; কিন্তু সব চাইতে পারবে না। ভবের বাজারে আমরা যা খুশি কিনতে পারি কিন্তু সব কিনতে পারি না। ‘সব’ রাখার জায়গা নাই। ‘সব’ কেনার সময় নাই-প্রয়োজনও নাই।

ক্ষুদ্র এই জীবন। নাতি, খাতি, শুতি বেলা যায় চলে। দেখতে দেখতে চামড়া কুঁচকে যায়, শক্তি কমে যায়। ‘সব’ পাওয়া যায় না, কারণ ‘সব’ স্থান কাল পাত্র থেকে অনেক বেশি। একসঙ্গে দুই জায়গায় হাজিরা দেওয়া যায় না। সুতরাং “কী চাই”-তা ঠিক করা চাই সর্বাগ্রে।

একই সঙ্গে হারানোর জন্য প্রস্তুত থাকা চাই। যে যা চায় সে তা-ই পায়, কিন্তু একটি পাওয়ার জন্য আরেকটি ত্যাগ করতে হয়। যা পাওয়া যত বেশি কঠিন, তা পাওয়ার জন্য তত বেশি ত্যাগ আবশ্যক।

 

(চলবে…)

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!