গন্তব্য যদি পরিষ্কার না হয়, তাহলে আমি এগোবে না। এই গন্তব্য কিন্তু স্থূল জগতের পারে। সমস্যাটা হচ্ছে যে আমরা মেনে নিতে পারি না যে আমরা স্থূল জগতের পারের এক অতীন্দ্রিয় অস্তিত্ব। আমাদের নিজেদের ভেতরে উঁকি মারা উচিত।
আমরা ‘আমি’র উপর এত গুরুত্ব আরোপ করি অথচ যদি এই শরীরের মধ্যে ‘আমি’-কে খুঁজতে যাই, তাহলে সেখানে তাকে পাওয়া যায় না। তাহলে নিশ্চয়ই ‘আমি’ দেহাতীত কিছু।
এটা আমরা মেনে নিতে পারি না কারণ আমাদের শারীরিক আত্মপরিচয়টা অত্যন্ত দৃঢ়। আসলে অহংবোধ কিন্তু শূন্য। অভিজ্ঞতা থেকেই ব্যক্তিত্ব রূপ পায়, আর সেই ব্যক্তিত্বই তখন অস্তিত্বের কেন্দ্র দখল করে বসে।
স্বরূপতঃ এই কেন্দ্রবিন্দুটি একেবারে স্থির। ঐ নিশ্চল, নিস্পন্দতাই ‘আমি’। কিন্তু কাজকর্ম এবং স্থান, কাল ও বস্তুকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এত গতি যুক্ত হয়েছে ‘আমি’র সাথে যে গতিটাই প্রধান ভূমিকা নিয়ে ফেলেছে। ব্যক্তিত্ব এক রকম থাকে না, সর্বদা পরিবর্তনশীল।
কিন্তু এই গতিবেগ তাকে মনের মধ্যে ধরে রেখেছে। আমরা কি নিজেদের সম্পূর্ণ শূন্য বলে কল্পনা করতে পারি? এটা করতে পারলেই আমরা transcend করতে পারব। কিন্তু আমরা অবিশ্রাম গতিবেগ চাই, স্থিরতা চাই না। এই শান্ত, স্থিরতার মধ্যে কোনো ‘করা’ নেই, কোনো ‘চলা’ নেই, কোনো ‘কাজ’ নেই।
কল্পনা করা যায় না যে আমরা স্বরূপতঃ তাই। কিন্তু যদি আমরা একটু ভাবতে পারি যে বাস্তবিক আমরা নিশ্চল, স্থির, তাহলেই বুঝব যে আমরা গতিময়তা নিয়ে খেলছি। এই গতিময়তা যতক্ষণ সুখদায়ক, ততক্ষণ আমরা তার সঙ্গে চলি, কিন্তু যখনই তা আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, তখন আমরা চিৎকার করে বলে উঠি, “কি করব বল!” আসলে, কিছু ‘করতে’ হবে না, ‘ছেড়ে’ দিতে হবে। কিন্তু আমরা তো ছাড়তে প্রস্তুত নই।
সুখের সন্ধানে আমরাই তৈরি করেছি নিজেদের জীবনের এই তীব্র গতিবেগ। এই গতিই এখন আমাদের বদ্ধ করেছে এবং এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে ঘূর্ণিঝড়ের মত তা আমাদের জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে।
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন যে এই গতিময়তা রয়েছেই। কিন্তু তা হলেও তিনি জানাচ্ছেন যে অন্য একটি পথও রয়েছে, আর তা হল ‘ধর্মের’ পথ। এই ‘ধর্ম’ শব্দটি নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝি আছে। ধর্ম হল Basically সেই পথ, যা স্থিরতার দিকে নিয়ে যায়।
ব্যক্তিত্ব রয়েছে এবং তা গড়ে উঠেছে নিজস্ব প্রবণতা অনুযায়ী সৃষ্টি করা গতিবেগের উপর। কিন্তু মন যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে আমরা যেভাবে (প্রকৃত ‘আমি’ থেকে) দূরে চলে এসেছিলাম, সেভাবেই আবার ফিরে যেতে পারি।
শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, অর্জুন ক্ষত্রিয়, তাই তাঁর যুদ্ধ করার প্রবণতা রয়েছে আর অর্জুন পাল্টাতে পারবেন না। সুতরাং অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে গেলে বা ত্যাগ করে চলে গেলেও তাঁর সমস্যার সমাধান হবে না।
আমাদের কোন ‘বিশেষ’ পদ্ধতির প্রয়োজন নেই। জপ এবং মন্ত্রপাঠ মনকে নিয়ন্ত্রণে আনার উপায়। যে মুহূর্তে আমরা বুঝতে পারব যে আমার প্রকৃত স্বরূপ হল নিশ্চল, নিষ্কম্প স্থিরতা, তখন আমরা কাজের পারে যাবার জন্য আরও বেশী কাজ খুঁজব না। বরং নিজস্ব প্রবণতা অনুযায়ী ফিরে যাবার পথ খোঁজার চেষ্টা করব।
আমাদের শান্ত, সচেতন হতে হবে। গতিময়তা কমিয়ে ফিরে যাওয়ার পথ ধরতে হবে আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট অনুযায়ী। যা কিছু কুড়িয়ে ছিলাম, তা ঝেড়ে ফেলতে হবে। বুঝতে হবে যে আমরা প্রচুর ‘আবর্জনা’ সংগ্রহ করেছি, তাই পালাবার পথ নয়, চাই সব ছেড়ে দেওয়া।
এখন প্রশ্ন, আমরা কি পারব ছাড়তে?
আমরা কীভাবে ছাড়তে পারি? নিজেদের সুখি করার জন্যই তো গতিবেগ সৃষ্টি করেছিলাম আমরা। তবে নিজেদের জন্য তা ছেড়ে দিতেও পারব নিশ্চই। সান্ত্বনা ভিক্ষা করতে পারি না আমরা।
ঈশ্বর নিশ্চলতার মধ্যেই অবস্থান করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দেখিয়েছেন, নিজের স্বরূপে ফিরে যাও, যেখানে শুধু স্থিরতা, সৌন্দর্য আর মহানন্দ। এর জন্য আমাদের জীবনযাত্রায় কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই। আমাদের শুধু বুঝতে হবে জীবনের লক্ষ্য কি; মনের গতিবেগ বুঝতে হবে এবং প্রথমেই ধারণা করতে হবে যে আমাদের সত্ত্বা দেহাতীত।
যদি আমরা ঝড়ের গতিবেগ বেছে নিই, তাহলেও অসুবিধা নেই। তাও আমাদের সামনেই রয়েছে। কিন্তু তাহলে নালিশ জানানো চলবে না। এই ‘ছেড়ে দেওয়া’ কিন্তু অত্যন্ত সচেতনভাবে করতে হবে।
এখনও আমরা ছাড়ি তবে তা অবচেতন ও অচেতনভাবে কারণ যখন জীবনে দুঃখ-দুর্দশা আসে, তখনই আমরা ছেড়ে দিতে চাই, তার আগে নয়। স্থিরতা হচ্ছে মনের খাদ্য। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটা নিজেকে খুঁজে নিতে হবে। আমাদের মনোভাব ও মনোযোগ সেই পথ দেখিয়ে দেবে।
……………………………
প্রব্রাজিকা বিবেকপ্রাণা The Path Of Knowledge-এর অনুবাদ।
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে: ভারতের সাধক-সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত -প্রণয় সেন