ফকির লালনের বাণী : প্রবর্তদেশ
৭৫১.
বিষয় ধনের ভরসা নাই
ধন বলতে ধন গুরু গোঁসাই,
যে ধনে দিয়ে দোহাই
ভব তুফান যাবে বেঁচে।
৭৫২.
পুত্র পরিবার বড় ধন
ভুলেছ এই ভাবের ভুবন,
মায়ায় ভুলে ওরে অবোধ মন
গুরু ধনকে ভাবলি মিছে।
৭৫৩.
কী ধনে কী গুণপনা
অন্তিমকালে যাবে জানা,
গুরু ধন এখন চিনলি না
নিদানে পস্তাবে পাছে।
৭৫৪.
অমূল ধন গুরু ধন রে
বুঝালে বুঝিস না হারে,
সিরাজ সাঁই কয় লালন তোরে
নিতান্ত পেঁচোয় পেয়েছে।
৭৫৫.
(মন রে) আত্মতত্ত্ব না জানিলে
ভজন হবে না পড়বি রে গোলে।
৭৫৬.
আগে জানো কানু উল্লাহ্
হক্বুল হক্ব আল্লাহ্
যারে মানুষ বলে।
৭৫৭.
পড়ে ভুত আর
হোসনে বার বার
একবার দেখ্ দিব্য নয়ন খুলে।
৭৫৮.
আপনি সাঁই ফকির
আপনি হয় ফিকির
ওসে লীলে ছলে।
৭৫৯.
আপনারে আপনি
ভুলে রব্বানি
আপনি ভাসে আপন প্রেম জলে।
৭৬০.
লা ইলাহা নফি
ইল্লাল্লাহ্ ইজবাতি
দেখবি প্রেম জাগলে।
৭৬১.
লালন ফকির কয়
যাবি মন কোথায়
আপনারে আজ আপনি ভুলে।
৭৬২.
পাবিরে মন স্বরূপের দ্বারে।
খুঁজে দেখ নারে মন
বরজাখ’পরে নিহার করে।
৭৬৩.
দেখ না মন ব্রহ্মাণ্ড ‘পরে
সদাই বসে বিরাজ করে,
অখণ্ড রূপ নিহার করে
থাকগে বসে নিরিখ ধরে।
৭৬৪.
লেখা আছে কুদরত কালাম
জানাই তারে হাজার সালাম।
৭৬৫.
লেখা নােই ভেদ সফিনায়
আলেক সাঁই রয় আলের, পরে।
৭৬৬.
ছাড়রে মন ছল চাতুরী
তাকুব্বরী গুণ জাহিরী,
লালন কয় আহা মরি
ডুব দিয়ে দেখ গভীর নীরে।
৭৬৭.
পড়ে ভূত আর হসনে মনরায়।
কোন হরফে কি ভেদ আছে
লেহাজ করে জানতে হয়।
৭৬৮.
আলেফ-হে-আর-মিম দালেতে
আহাম্মদ নাম লেখা যায়,
মিম হরফটি নফি করে
দেখনা খোদা কারে কয়।
৭৬৯.
আকার ছেড়ে নিরাকারে
ভজলিরে আঁধেলা প্রায়,
আহাদে আহাম্মদ হল
করলিনে তার পরিচয়।
৭৭০.
জাতে ছেফাত ছেফাতে জাত
দরবেশ সিরাজ সাঁই তাই জানতে পায়,
লালন বলে কাট মোল্লাজী
ভেদ না জেনে গোল বাধায়।
৭৭১.
কে বোঝে মাওলার আলেকবাজি
করছে রে কোরানের মানে যা আসে যার মনের বুঝি।
৭৭২.
একই কোরান পড়াশোনা
কেউ মৌলভি কেউ মাওলানা,
দাহেরা হয় কতজনা
সে মানেনা শরার কাজি।
৭৭৩.
রোজ কেয়ামত বলে সবাই
কেউ বলেনা তারিখ নির্ণয়,
হিসাব হবে কি হচ্ছে সদাই
কোন কথায় মন রাখি রাজি।
৭৭৪.
ম’লে জান ইল্লিন সিজ্জিন রয়
যতদিন রোজ হিসাব না হয়,
কেউ বলে জান ফিরে জন্মায়
তবে ইল্লিন সিজ্জিন কোথায় খুঁজ।
৭৭৫.
আর এক বিধান শুনিতে পাই
এক গোর মানুষের মউত নাই,
আ-মরি কি ভজন রে ভাই
বাঞ্ছে লালন কারে পুঁছি।
৭৭৬.
তুমি কার আজ কেবা তোমার এই সংসারে।
মিছে মায়ায় মজিয়ে মন কি কর রে।
৭৭৭.
এত পিরিত দন্তে জিহ্বায়
কায়দা পেলে সেও সাজা দেয়;
স্বল্পতে সব জানিতে
হয় ভাব-নাগরে।
৭৭৮.
সময়ে সকলি সখা
অসময়ে কেউ দেয় না দেখা,
যার পাপে সে ভোগে
একা চার যুগ রে।
৭৭৯.
আপনি যখন নাই আপনার
কারে বল আমার আমার,
সিরাজ সাঁই কয়
লালন তোমার জ্ঞান নাহি রে।
৭৮০.
হুজুরে কার হবেরে নিকাশ দেনা।
পঞ্চজন আছে ধড়ে
বেরাদার তাঁর ষোলজনা।
৭৮১.
ক্ষিতি জল বায়ু হুতাশনে
যার যার বস্তু সে সেখানে
মিশবে তাই।
৭৮২.
আকাশে মিশবে আকাশ
জানা গেলো পঞ্চবেনা।
৭৮৩.
মুন্সী ও মৌলভীর কাছে
জনমভর শুধাই সে
ঘোর গেলো না;
পরে নেয় পরের খবর
আপন খবর কেউ বলে না।
৭৮৪.
ধড়ে আত্মাকর্তা কারে বলি
কোন মোকাম তাঁর কোথা গলি
করে আওনাযাওনা;
সেই মোকামে আমি কোনজন
তাও লালননের ঠিক হলো না।
৭৮৫.
বিষয় বিষে চঞ্চলা মন দিবারজনী।
মনকে বোঝালে বুঝ মানে না ধর্মকাহিনী।
৭৮৬.
বিষয় ছাড়িয়ে কবে
মন আমার শান্ত হবে,
আমি কবে সে চরণ করিব শরণ
যাতে শীতল হবে তাপিত পরানী।
৭৮৭.
কোনদিন শ্মশানবাসী হবো
কী ধন সঙ্গে লয়ে যাবো,
কী করি কী কই, ভুতের বোঝা বই
একদিনও ভাবলাম না গুরুর বাণী।
৭৮৮.
অনিত্য দেহেতে বাসা
তাইতে এতো আসার আসা,
অধীন লালন বলে, দেহ নিত্য হলে
আর কতো কী করতাম না জানি।
৭৮৯.
মন বুঝি মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে।
জানেনা কাঞ্চন খবর
রংমহলের খবর নিচ্ছে।
৭৯০.
ঠিক পড়ে না কুড়ো কাঠা
ধূল ধরে সতেরো গণ্ডা।
৭৯১.
অকারণ খাঁটিয়ে মনটা
পাগলামি প্রকাশ করতেছে।
৭৯২.
যে জমির নাই আড়া দিঘালতা
কিরূপ কালি করে সেথা।
৭৯৩.
শুনি চৌদ্দ পোয়ার কথা
কুড়ো কাঠা কয় আন্দাজে।
৭৯৪.
কৃষ্ণদাস পণ্ডিত ভালো
কৃষ্ণ লীলার সীমা দিলো,
তাঁর পণ্ডিতি চূর্ণ হলো
টুনটুনি এক পাখির কাছে।
৭৯৫.
বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যাই
অমনি আমার মন মনুরায়,
লালন বলে কবে কোথায়
এমন পাগল কে দেখেছে।
৭৯৬.
আপন মনে যার গরল মাখা থাকে।
যেখানে যায় সুধার আশায়
তথায় গরলই দেখে।
৭৯৭.
কীর্তিকর্মার কীর্তি অথৈ
যে যা ভাবে তাই দেখতে পায়,
গরল বলে কারে দোষাই
ঠিক পড়ে না ঠিকে।
৭৯৮.
মনের গরল যাবে যখন
সুধাময় সব দেখবে তখন,
পরশিলে এড়াবি শমন
নইলে পড়বি পাকে।
৭৯৯.
রামদাস মুচির মন সরলে
চামকেটোয়ায় গঙ্গা মেলে,
সিরাজ সাঁই লালন কে বলে
আর কি বলবো তোকে।
৮০০.
অনুরাগ নইলে কি সাধন হয়।
সে তো শুধু মুখের কথা নয়।