ফকির লালনের বাণী : প্রবর্তদেশ
১১০১.
রূপ দর্শন দর্পণের ঘরে
হলাম আমি পারা হারা।
১১০২.
মন ভবে এসে হয়েছি এক মায়ার ঢেঁকি।
পরের বানা বানতে বানতে
নিজের ঘরে নাই খোরাকি।
১১০৩.
দিনে দিনে কামশক্তি বেড়ে যায়
কামিনীর কাঞ্চন লুটে পিতৃধন খুয়ায়।
১১০৪.
আবার কাঞ্চন কুলাই ঝেড়ে পাচড়ে
চাল নেই শুধু তুষ দেখি।
১১০৫.
আমি ঢেঁকি ছিলাম ষোল পোয়া
ভবে এসে কর্মদোষে হই চৌদ্দ পোয়া।
১১০৬.
আমি যদি হতাম পনের পোয়া
শমনকে দিতাম ফাঁকি।
১১০৭.
পাপ-ঢেঁকি যদিও স্বর্গে যায়
তিন বেলা তার ভানা কুটা লাথি না এড়ায়।
১১০৮.
সামান্যে কে সে ধন পাবে।
দীনের অধীন হয়ে
চরণ সাধিতে হবে।
১১০৯.
গুরুপদে কি না হল
কত বাদশার বাদশাহী গেল।
১১১০.
কুলবতীর কুল গেল
কালারে ভেবে।
১১১২.
কত কত মনি-ঋষি
যুগ যুগান্তর বনবাসি,
চরণ পাব বলে কালো শশী
বসিয়ে তপে।
১১১৩.
গুরুপদে কত জনা
বিনামূল্যে হয়ে কেনা,
করে গুরুর দাস্য পনা
সে ধনের লোভে।
১১১৪.
চরণ ধনের যার আশা
অন্য ধনের নাই লালসা,
লালন ভেঁড়ে বুদ্ধি নাশা
দোভাসা ভাবে।
১১১৫.
বিনা কার্যে ধন উপার্জন কে করিতে পারে।
গুরু গত না হলে প্রেমের প্রেমিক
না হলে সে ধন পায় না রে।
১১১৬.
একই ইস্কুলে দশজনা পড়ে
গুরুমনের এই বাসনা, সব সমান করে।
১১১৭.
কেউ পিছে এসে আগে গেল
পরীক্ষায় চিনা যায় তারে।
১১১৮.
বাংলা কিতাব কতই জনে পড়ে
আরবি ফারসি নাগরি বুলি কে বুঝিতে পারে,
আবার শিখবি যদি নাগরি বুলি
বাংলা নেও গা পাশ করে।
১১১৯.
বিষম্বর বিষ পান করে
তাড়কায় করে বাছা হজম কাকে কি পারে,
ফকির লালন বলে রসিক হলে
বিষ খেয়ে হজম করে।
১১২০.
থাক না মন একান্ত হয়ে
গুরু গোঁসাইর বাগ লয়ে।
১১২১.
চাতকের প্রাণ যদি যায় তবু কি অন্য জল খায়
উর্ধ্ব মুখে থাকে সদায় নবঘন জল চেয়ে
তমনি মতন হলে সাধন সিদ্ধি হবে এই দেহে ।
১১২২.
এক নিরিখ দেখ ধনি সূর্যগত কমলিনী
দিনে বিকশিত তমনি নিশীথে মুদিত রহে
এমনি যেন ভক্তের লক্ষণ একরূপে বাঁধে হিয়ে ।
১১২৩.
বহু বেদ পড়াশুনা শুনিতে পাইরে মনা
সদা শিব যোগী সেনা কিঞ্চিত ধ্যান করিয়ে
শ্মাশানে-মশানে থাকে কিঞ্চিতের লাগিয়ে ।
১১২৪.
গুরু ছেড়ে গৌর ভজি তাতে নরকে মজি
দেখনা মন পুঁতি পাঁজি সত্য কি মিথ্যা কহে
মন তোরে বুঝাবো কত ফকির লালন কয় দিন যায় বয়ে ।
১১২৫.
কেন ডুবলিনে মন রে গুরুর চরণে।
পিছে কাল শমন বাঁধবে কোন দিনে।
১১২৬.
নিদ্রা বশে নিশি গেল
বৃথা কাজে দিন ফুরাল
চেয়ে দেখলিনে।
১১২৭.
আমার পুত্র আমার যারা
সেংগে কেউ যাবে না তারা
ম’লে শশ্মাণে।
১১২৮.
আসতে একা যেতে একা
তা কি জানিস নে।
১১২৯.
এখনো তোর আছে সময়
সাধলে কিছু ফল পাওয়া যায়
যদি লয় মনে।
১১৩০.
সেই প্রেম গুরু জানাও আমায়।
যাতে মনের কৈতবাদি ঘুঁচে যায়।
১১৩১.
এ দাসেরে নিদয় হয়ো না
দাও কিঞ্চিত প্রেম উপাসনা।
১১৩২.
ব্রজের জলদ কালো গৌরাঙ্গ হলো
কোন প্রেম সাধনে বাকা শ্যামরায়।
১১৩৩.
পুরুষ কোন দিন সহজ ঘটে
শুনলে মনের শঙ্কা যায় মিটে।
১১৩৪.
তবে তো জানি সে প্রেম করণি
সহজে সহজে লেনাদেনা হয়।
১১৩৫.
কোন প্রেমে বশ গোপীর দ্বারে
কোন প্রেমে শ্যাম রাধার পায় ধরে।
১১৩৬.
বল বল তাই ও গুরু গোঁসাই
দ্বীনের আধীন লালন বিনয় করে কয়।
১১৩৭.
মূলের ঠিক না পেলে
সাধন হয় কিসে,
কেও বলেরে শ্রীকৃষ্ণ মূল
আবার কেউ বলে মূলব্রক্ষ সে।
১১৩৮.
ব্রহ্ম ঈশ্বরে দ্বৈত লেখা যায়
সাজবস্ত্র উঁচানিচা কে কয়।
১১৩৯.
কোথা যাই কিবা করি
বোলে বেড়াই গোলে হরি,
লালন কয় জানতে নারি
তাইতে বেড়ায় মন ভেসে।
১১৪০.
মলে ঈশ্বর প্রাপ্ত হবে কেন বলে।
সেই যে কথার পাই নে বিচার
কারো কাছে শুধালে।
১১৪১.
মলে যদি হয় ঈশ্বরপ্রাপ্ত
সাধু অসাধু সমন্ত,
তবে কেনে তপজপ এত
করবে জলে স্থলে।
১১৪২.
যে পঞ্চে পঞ্চভূত হয়
ম’লে তা যদি তাতে মিশায়,
ঈশ্বর অংশ ঈশ্বরে যায়
স্বর্গ-নরক কার মেলে।
১১৪৩.
জীবের এই শরীরে
ঈশ্বর অংশ বলি কারে,
লালন বলে চিনলে তাঁরে
মরার ফল তাজায় ফলে।
১১৪৪.
যে পরশে পরশে পরশ তারে চিনে নে না।
সামান্য পরশের গুণ লোহার কাছে গেল জানা।
১১৪৫.
পরশমণি স্বরূপ গোসাই
যে পরশের তুলনা নাই।
১১৪৬.
পরশিবে যে-জন তাই
ঘুচিবে জঠর যন্ত্রণা।
১১৪৭.
কুমীরেতে পরকে যেমন
ধরায় সে আপন বরণ,
স্বপরশে জানি রে মন
এমনি যেন পরশনা।
১১৪৮.
ব্রজের ওই জলদ কালো
যে পরশে পরশ হলো,
লালন বলে মন রে চলো
জানিতে সেই উপাসনা।
১১৪৯.
যাঁরে ভাবলে পাপীর পাপ হরে ।
দিবানিশি ডাকো তাঁরে।
১১৫০.
গুরুর নাম সুধাসিন্ধু
পান করো তাঁহার বিন্দু।