ভবঘুরেকথা
লালন বলে কুল পাবি না

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

-বাপ! মনে রাখবেন কোনো মত-পথ-আদর্শই মানুষের অকল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। কোনোটাই সেই অর্থে মন্দ না। লোভী-কামুক মানুষ তা মন্দ করে তোলে। আমরা কোনো আদর্শ-মত-পথ থেকে কিভাবে শিক্ষা নিচ্ছি-কি শিক্ষা নিচ্ছি তা নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তি চরিত্রের উপর; ব্যক্তি মানষিকতার উপর।

কোনো মত-পথ-আদর্শ যতটাই মহান হোক না কেনো। সেই মত গ্রহণ করে ব্যক্তি বা সাধক যদি স্থির হতে না পারে। যদি লোভ-মোহ-আসক্তিতে লিপ্ত হয়ে যায় তাহলে সেই পথ আর মহান থাকে না বাপ। সেই মত-পথের সাধকই মহান হতে পারে যিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করে না। সকল জীবকে নিয়ে ভাবে।

যেখানে জ্ঞানকে কোনো গণ্ডির মাঝে আবদ্ধ করা হয় না। জ্ঞানের জন্য দ্বার প্রসস্থ থাকে। সাধক প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে পারে। তাহলে জানবেন সেই ব্যক্তিই জ্ঞানী। ভারী ভারী কথা বললেই কেউ জ্ঞানী হয় না। যে প্রচুর তথাকথিত জ্ঞান অর্জন করেছে কিন্তু নিজের কাম-ক্রোধ-দ্বেষ-রাগ-ঘুম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সে প্রকৃত জ্ঞানী নয় সাধন মার্গে। সে জ্ঞানীর অভিনয় করে মাত্র।

আপনি এইরূপ অভিনেতা হয়েও সুখে-দু:খে জীবন কাটাইতেই পারেন। তাতে আপত্তি নাই কারো। তাতেই জাগতিক সুখ বাপ। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান করতে গেলে অনেককিছু ছাড়তে হয়। জাগতিক সুখ-দু:খকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হয়।

সবার আগে দেখবার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হওয়া জরুরী। দেখবার দৃষ্টি তৈরি না হলে জগতের সবকিছুই লোভনীয় রূপে ধরা দেয়। জগতের সকল কিছু নজরে আসলেই ভেতরে পাওয়ার লোভ তৈরি হয়। ভেতরের সুপ্ত বাসনাগুলো কামনায় রূপ নেয়। আর তা নিজের করে পেতে ইচ্ছা জাগ্রত হয়। তা না পেলে দু:খের সঞ্চার হয়।

আর সত্য দেখবার দৃষ্টি তৈরি হলে সকল কিছু আনন্দ রূপে প্রকাশ পায়। তখন গাছে ফুল দেখলে তা ছিঁড়ে ঘরে আনতে মন চায় না। তার প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে মন চায়। সব কিছু নিজের করে পাওয়ার ক্ষুদ্র কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে সবের মাঝে লীন বা বিলীন করে দেয়াতে আনন্দ খোঁজে সাধক। এতে পরম আনন্দ বাপ, সবার মাঝে নিজেকে দেখতে পারার অনন্দের কোনো সীমা নেই।

কিন্তু জল থেকে কচুরিপানা নিজের ঘরের ফুলদানীতে রাখলে দেখতে হয়তো সুন্দর লাগে। কিন্তু যে জলাশয়ের ফুল দেখে আনন্দ নিতে জানে তার জন্য তো গোটা ব্রহ্মাণ্ডই তার ঘর। সকল মানুষই তার পরিজন।

তার অনন্দ আটকায় কে বাপ। সকলেই তার আপন। আনন্দ যখন ধরা দেয় বাপ তখন জগত আনন্দময় হয়ে যায়। তখন আর জাগতিক অপ্রাপ্তি মনে দু:খ-কষ্ট সৃষ্টি করে না। সাঁইজি বলছেন

জগত মুক্তিতে ভোলালেন সাঁই,
ভক্তি দাও হে যাতে চরণ পাই ।।

ভক্তিপদ বঞ্চিত করে,
মুক্তিপদ দিচ্ছ সবারে,
যাতে জীব ব্রক্ষ্রান্ড ঘুরে,
কান্ড তোমার দেখতে পাই ।।

রাঙা চরণ দেখব বলে,
বাঞ্চা সদাই হৃদ কমলে,
তোমার নামের মিঠায় মন মজেছে,
রুপ কেমন তাই দেখতে চাই ।
জগত মুক্তিতে ভোলালেন সাঁই ।।

চরণের ঐ যোগ্য মন নয়,
তথাপি ঐ রাঙা চরণ চায়,
লালন বলে হে দয়াময়,
দয়া কর আজ আমায় ।।
জগত মুক্তিতে ভোলালেন সাঁই ।।

-জীবন দা “আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে” কামিনী রায়ের এই লাইনগুলো পরীক্ষা পাসের জন্য বহুবার পড়েছি কিন্তু এর মর্ম বুঝতে পারি নাই কখনো।

এ কেবলই ছিল পরীক্ষা পাসের জন্য। স্কুল-বাড়ি-পিতামাতা বা গৃহশিক্ষক বা কোচিং সেন্টার-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব জায়গাতেই পাঠ্যপুস্তক থেকে যা শিখানো হয়েছে সবই পরীক্ষা পাস বা চাকুরি পাবার জন্য।

একবার আবৃত্তির ওয়ার্কশপ করেছিলাম। সুন্দরভাবে কথা বলা শিখবার জন্য যাতে ক্লাইন্টকে ভালোভাবে পটাতে পারি। সেখানেও শিখিয়েছিল কি করে সকলকে টপকে প্রথম হতে হয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় হলে কোনো দাম নেই। হতে হবে প্রথম। আর এই প্রথম হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে জীবনের এতোটা পথ চলে এসেছি। আজ আমার প্রাপ্তি যে কম তা কিন্তু নয় জীবন দা।

দামী গাড়ি চালাই, অভিজাত ফ্ল্যাটে থাকি, নামী-দামী মানুষের সাথে উঠাবসা করি। মানুষজন স্যার স্যার করে। কিন্তু কোথায় যেন একটা কমতি থেকে গেছে। আজ সারাদিন আপনার সাথে কথা বলে সেই কমতিটা পুনরায় জানান দিল। আপনি ইচ্ছে করে উস্কে দিলেন কিনা জানি না। তবে ঘুমন্ত বাসনাগুলো আবার যেন জেগে উঠল।

সেই সব আদর্শবাদী ফটোগ্রাফাররাও যারা কিনা সামাজিক সংস্কারে ভূমিকা রাখতে চায়। নারীর মর্যাদার জন্য বড় বড় কথা বলে। নিজে বৈষম্য মানে না। অনেক আদর্শের কথা বলে। নারীকে যৌনবস্তু নয় নারী ভাববার জন্য ফেসবুকে বাণী দেয়।

আদর্শ আর কর্ম আমরা আলাদা করে ফেলেছি বহুদিন। আমরা এখন সমাজে প্রচলন করেছি যে, কর্ম হবে কর্মের সময় আর সন্ধ্যায়-রাতে বা ছুটির দিনে আড্ডার টেবিলে আদর্শ নিয়ে আলোচনা।

আমরা ভেবেই নিয়েছি আদর্শ কেবল আড্ডার বিষয়; সময় কাটানোর বিষয়। এর বেশি কিছু নয়। এটা অন্যরা পালন করবে। আমাদের মতো স্মার্ট জেনারেশন আদর্শকে ভাবি পিছিয়ে পড়া জেনারেশনের সংস্কার।

আমরা অন্যকে উপদেশ দিতে পারি কিন্তু নিজেরা জীবনে তা গ্রহণ করতে চাই না। চরম দুর্নীতিবাজ লোককেও দেখেছি অন্যের সমালোচনা করছে, বলছে সমাজে অধপতনের কারণ দুর্নীতি।

তারমানে সে জানে সে দুর্নীতি করছে, যার কারণে সমাজ ভেঙ্গে পরছে। কিন্তু সে নিজের দুর্নীতিকে দেখতে পারছে না। আসলেই দৃষ্টি তৈরি হওয়া জরুরী জীবন দা। সবার আগে দৃষ্টিভঙ্গি যথাযথ হওয়া উচিত। আপনার কথায় আমি একমত।

মার্কেটিংএ কাজ করি তো দাদা। মিডিয়ার প্রচুর লোককে ডিল করতে হয়। আমার কাছের কয়েকজন বন্ধু আছে ফটোগ্রাফার; বর্তমান সময়ে বেশ সুনাম করেছে তারা নিজের পেশায়।

সেই সব আদর্শবাদী ফটোগ্রাফাররাও যারা কিনা সামাজিক সংস্কারে ভূমিকা রাখতে চায়। নারীর মর্যাদার জন্য বড় বড় কথা বলে। নিজে বৈষম্য মানে না। অনেক আদর্শের কথা বলে। নারীকে যৌনবস্তু নয় নারী ভাববার জন্য ফেসবুকে বাণী দেয়।

কিন্তু দিন শেষে যখন নারীর ছবি তোলে তখন সে নারীর যৌনাতাকেই পুঁজি করে। ছবিতে যৌন সুরসুরি দিয়েই বিক্রি বাড়াতে চায়। তারাও উকিলদের মতোই বলে এটা তো পেশা; তাই করতে হয়।

হয়তো তাদের কথা ঠিক এ ছাড়া হয়তো উপায় নেই। একটা সভ্যতার মুখোশ পরে থাকে সবসময়। যা বিশ্বাস করে তা দিয়ে শিল্প করে না, আবার যে সকল শিল্প করে তা বিশ্বাস থেকে করে না।

আমি সেই সব বন্ধুদের দোষ দিচ্ছি না জীবন দা’। তাদেরকে চিহ্নিত করেও কথা বলছি না। আমিও তো তদের থেকে আলাদা কেউ না। আমিও তাদেরই একজন। তাদের কথা বললাম এই কারণে তাদের আমি প্রতিদিন দেখি খুব কাছ থেকে। আমিও প্রতিদিন যা করে বেড়াই তা কি আমি সত্যি বিশ্বাস করি?

বড় বড় ক্লাইন্টদের আরাম আয়েশের জন্য যে সব যোগান দিতে হয় তা কি আমার আদর্শের সাথে যায়? বা কাজ পাওয়ার জন্য ছোট ছোট সংস্থাগুলো আমাকে যে সকল সুবিধাদি দেয়। তা কি আমার আদর্শের সাথে যায়? বড় গোলমেলে জীবন দা’ বড় গোলমেলে। সংসার চালাতে কত কিছু করতে হয় আপনি বুঝবেন না। আপনি বুঝবেন না। আপনি তো সংসার করলেন না। কি করে বুঝবেন।

-হুমম! বাপ ঠিকই বলছেন। আমি বুঝবো কেমনে? আসলেই তাই। তবে ছোট্ট একটা পার্থক্য আছে। আপনার সংসার আপনার বৌ-বাচ্চা নিয়ে। তা আরেকটু বড় হলে তার সাথে যুক্ত হয় আপনার বাবা-মা, ভাই-বোন। আরো একটু বড় হলে তাতে যুক্ত হয় মায়ের পরিবার-বাবার পরিবার-বৌয়ের পরিবার-বন্ধুবান্ধব-সহকর্মী।

এখন মনটা এতো উদাস হয়েছে যে মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আরেকটা ইচ্ছে মনে আসছে তবে সেটা করা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। বলেন তো কি ইচ্ছা? দেখি আপনি মনের কথা বুঝতে পারেন কিনা।

এই নিয়েই তো আপনাদের জগত। তাই না? আমাদের জগতটা বাপ তারচেয়েও আরো একটু বড়। এই বড় হতে হতে যে দিন ব্রহ্মাণ্ডের সকল জীবত-মৃত-অনাগত জীবকে নিয়ে নিজের পরিবার ভাবতে পারবো সেদিন আবার বুঝবো সংসার কারে বলে।

-আপনার সাথে কথায় পারবো না জীবন দা। আর সত্যি বলছি এখন আর আপনার সাথে পেরে উঠার জন্য তর্কও জুড়ে দিতে চাই না। আপনার সকল কিছুতেই যে আমি সম্মত তা নয়। অনেক অনেক প্রশ্ন আছে কিন্তু তারপরও আমি মুগ্ধ আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় এটুকুই বলতে পারি।

সত্যিই অনেক অনেক দিন এমন সময় কাটাইনি। বা বলতে পারি শেষ কবে এমন সময় কাটিয়েছি এখন তা মনেও পরছি না। অনেক দিন মনে থাকবে এই দিনের কথা। আজকের তারিখটাও স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার কাছে।

জীবন দা’ এখন তো প্রায় সন্ধ্যা হতে চলল। রাস্তার জ্যামও মনে হচ্ছে কমেছে অনেকটা। এবার যেতে হবে জীবন দা। সত্যি বলতে কি যেতে ইচ্ছেও করছে না। আরো সময় থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। অফিস ফাঁকি দিয়েছি সেটা কাল কিভাবে সামাল দিব সেটা ভাবছি। সারাদিন ফোন বদ্ধ ছিল কেনো সেটার উত্তর দেয়ার জন্য রাশি রাশি মিথ্যা বলতে হবে।

আমি আমার ডিপার্টমেন্টের প্রধান তাই দায়িত্বও অনেক বেশি জীবন দা। আমাকেও জবাব দিতে হয়। তারপরও অফিস সামলে নেয়া যাবে। কিন্তু ঘরে অশান্তি হলে মহা যন্ত্রণা হবে।

মেয়েটার কথাও মনে পরছে। আমার মেয়ের কথা তো বলাই হলো না আপনাকে। ওর নাম পৃথিলা। বয়স ৮ বছর। আমাকে ছাড়া রাতের খাবার খেতে চায় না। যদিও আমি বেশিভাগ সময়ই গভীর রাতে বাড়ি ফিরি।

এখন মনটা এতো উদাস হয়েছে যে মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আরেকটা ইচ্ছে মনে আসছে তবে সেটা করা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। বলেন তো কি ইচ্ছা? দেখি আপনি মনের কথা বুঝতে পারেন কিনা।

-নাহ্ বাপ! আমি মনের কথা পড়তে পারি না। আপনিই বলেন।

-ইচ্ছে করছে আপনাকে সাথে করে নিয়ে যাই বাসায়। তবে সেটা করা ঠিক হবে না। আপনার নাম্বার তো থাকল। জীবন দা’ আমি সিরাজ মিঞাকে ফোন করে আপনার খবর নিব।

আপনার কথা মতো যদি সত্যি সত্যি ৭দিন বা ১৫দিন পরও তীব্র ইচ্ছাটা থাকে নিজেকে জানার। তাহলে আমি আপনার সাথে দেখা করব। আর আমার কার্ড তো থাকল আপনার কাছে; কখনো মনে পরলে ফোন দিবেন।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অগ্নি জীবন দা’র দিকে তাকিয়ে বললো, জীবন দা’ আরেকটা কথা; আগেই বলে নিচ্ছি আপনি কিছু মনে করবেন না। কি করে কথাটা বলবো নিজেই বুঝতে পারছি না। তাও বলছি আমি আপনাকে কিছু টাকা দিতে চাই আপনি অবশ্যই তা নিবেন। ঠিক আছে?

-বাপ! টাকাপয়সার দরকার সকলেরই আছে। তবে তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাখতে নাই। এখন আমার তো টাকার প্রয়োজন নাই বাপ। মাঘ মাসের পূর্ণিমা রাতে আমি একটা সাধুসঙ্গ করি যদি সম্ভব হয় আসবেন। দানের টাকায় সেই সাধুসঙ্গ হয় বাপ। আপনি যদি কিছু দিতে চান তখন দিবেন। এখন লাগবে না বাপ।

-জীবন দা! আপনি আসলেই অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। এক দিনে আপনাকে বোঝা অসম্ভব। আজ আমাকে বিদায় দেন। আমার কথায় মনে কিছু নিবেন না। যদি মনে কষ্ট পেয়ে থাকেন তাহলে ক্ষমাপ্রার্থী।

জীবন দা’র কথাগুলো সিরিয়াসলি ভাবা কি ঠিক হবে? নাকি সব ভুলে স্বাভাবিকের প্রতিদিনকার জীবনে ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। আজকের দিনটার কথা কি কারো সাথে শেয়ার করা ঠিক হবে? নাকি একটা দু:স্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবে সে। কিছুই বুঝতে পারছে না অগ্নি। নিজেকে স্বান্তনা দিল এসব ভাবলে চলবে কেন?

উবারের গাড়ি ছুটে চলছে উত্তর ঢাকার দিকে। রাস্তার জ্যামে নিজের গাড়িটা আর এদিকে আনে নি অগ্নি। ভাড়া গাড়ির ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে বসেও যেন ঘামছে সে। আজ যা ঘটে গেল তা কি বাস্তবে ঘটল? নাকি স্বপ্ন?

যদি স্বপ্ন হয় তাহলে কি তা এখনো চলছে? কিছুই বুঝতে পারছে না সে। শেষ কবে এমন বহেমিয়ানা করেছে? কাজের প্রয়োজনে দেশ বিদেশে প্রচুর জায়গায় যেতে হয়।

সেখানে গেলে অবসরে ঘুরে বেড়াতেও দ্বিধা করে না সে। অবসর মানেই দামী ক্লাব-বার-খেলার মাঠ-রিসোর্ট-সুইমিংপুল। এর বাইরে কি ভেবেছে সে কখনো? ফাইভ স্টার হোটেল, অভিজাত ক্লাব, দামী দামী খাবার, দামী দামী পোশাক, মূল কথা লোক দেখানোর জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুই ছিল তার অর্জনের মূল লক্ষ্য।

এসবেই সুখ এটাই সে জেনেছে। এখনো সে এটাই জানে ও মানে। কিন্তু আজ জীবন দা’ কোথায় জানি এই প্রচলিত বিশ্বাসে একটা সূক্ষ্ম চির ধরিয়ে দিল। যে বুক টান টান করে আলখেল্লা পরা লোকটার সাথে পাল্লা দিতে গিয়েছিল সেই লোকটাই এতোটা নির্লিপ্ত থেকে তাকে কোথায় যেন একটা আঁচড় কেটে দিল।

জীবন দা’র কথাগুলো সিরিয়াসলি ভাবা কি ঠিক হবে? নাকি সব ভুলে স্বাভাবিকের প্রতিদিনকার জীবনে ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। আজকের দিনটার কথা কি কারো সাথে শেয়ার করা ঠিক হবে? নাকি একটা দু:স্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবে সে। কিছুই বুঝতে পারছে না অগ্নি। নিজেকে স্বান্তনা দিল এসব ভাবলে চলবে কেন?

তাকে এখন অনেক অর্জন করতে হবে। পরিবারের জন্য অনেক অর্থ উপার্যন করতে হবে। তাদের লাইফ সিকিউর করতে হবে। পৃথিলাকে পড়াশোনা করানোর জন্য বিদেশে পাঠাতে হবে। এই শীতে বৌ বাচ্চা নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে যেতে হবে। ঊর্মির সব বান্ধবীরা ইউরোপ ট্যুর করে ফেলেছে। এই বছর না যেতে পারলে সে পার্টিতে মুখ দেখাতে পারবে না।

সামনে বছর ফ্ল্যাটের ইনটিরিয়র পরিবর্তন করতে হবে। গাজিপুরের দিকে যে জমিটা কিনেছে সেটাতে একটা বাংলো বাড়ি বানাতে হবে। টেকনাফে একটা রিসোর্ট করার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা।

অবশ্য সেন্ট মার্টিনে করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু বর্তমানে সেখানে জমি কেনা বেশ ঝামেলার হয়ে গেছে। কতকিছু করতে হবে এখন জীবন দা’র কথা ভেবে কাজ নেই। তারচেয়ে বরং শেষ বয়সে ভাবা যাবে সেটাই ভালো।

যে আমি সকালবেলা বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম সেই আমি কি বাড়ি ফিরছি? নাকি এই আমি ভিন্ন আমি? আর সকালের আমি ভিন্ন আমি ছিলাম? এই আমির ভেতর যে ঘুমিয়ে ছিল সে আজ জাগতে শুরু করেছে? নাকি আগেও জেগেছিল? কিন্তু এতোটা সময় জেগে থাকতে পারেনি এটা সত্য।

গাড়ির কাঁচ নামিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে স্বস্ত্বির নি:শ্বাস ফেলল অগ্নি। মোবাইল খুলে মেইল চেক করতে শুরু করল। ডুবে গেলো কাজের ভুবনে। ততক্ষণে বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। ঢাকা শহর এখন অল্প জলেই ডুবে যায়। আজও হয়তো যাবে।

জ্যাম ঠেলে গাড়ি ছুটে চলছে। সকলেরই তাড়া বাড়ি ফেরার, তাই মানছে না কেউ নিয়ম। সারাদিনের জ্যামের পর জ্যাম কিছুটা কমে আসলেও বৃষ্টিতে তা আবার বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। সব কয়টা গাড়িই তীব্র হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে। এতো তাড়াহুড়ার মাঝে কেবল অগ্নিরই যেন কোনো তাড়া নেই কোথাও যাবার।

কি মনে হতে মোবাইল অন করে ইউটিউবে যেয়ে লালন গান সার্চ করতে শুরু করল। ঠিক তখনই মনে পরলো ইস্ জীবন দা’র কথাগুলো রেকর্ড করা উচিত ছিল। বড্ড মিস হয়ে গেল। কত কিছু বলেছিল সব কি আর মনে রাখা সম্ভব? ইস্ রেকর্ড করলে পরে শোনা যেত। বারবার শোনা যেত।

তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে লালন গান শুনতে শুরু করল, “বাড়ির কাছে আরশী নগর, সেথা পড়শী বসত করে”। শুনছে কিন্তু বুঝতে কি পারছে? তবে এটা ঠিক যে বুঝতে না পারলেও ভাবনাটা গভীর হচ্ছে।

তৎক্ষনাৎ খেয়াল হল সে না এসব ভোলার চেষ্টা করছে? ভিউ গ্লাসে নিজেকে দেখে নিজের উপরই একটু হাসলো অগ্নি। তারপর গানে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করল। বিজ্ঞানের উন্নতিতে কতই না সহজ হয়েছে জীবন।

আগের দিন হলে এখন খুঁজে খুঁজে ক্যাসেট কিনতে হত। তারপর গাড়িতে ক্যাসেট বা সিডি প্লেয়ার ঠিক আছে কিনা তা দেখতে হত। নইলে বাড়ি গিয়ে তারপর শুনতে হত। আর এখন কত সহজ; অনলাইনে গান শুনা যায়। যেটা খুশি। ইচ্ছে মতো গান। রেডিওর মতো না, যে যে গান শুনাবে তাই শুনতে হবে। এসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে গভীর ভাবনায় ডুবে গেল।

যে আমি সকালবেলা বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম সেই আমি কি বাড়ি ফিরছি? নাকি এই আমি ভিন্ন আমি? আর সকালের আমি ভিন্ন আমি ছিলাম? এই আমির ভেতর যে ঘুমিয়ে ছিল সে আজ জাগতে শুরু করেছে? নাকি আগেও জেগেছিল? কিন্তু এতোটা সময় জেগে থাকতে পারেনি এটা সত্য।

এই নতুন আমি কি নতুন করে বাঁচার প্রেরণা দিচ্ছে? ভিন্নভাবে বাঁচবার প্রেরণা? জীবনকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার প্রেরণা? এই আমি কোন্ আমি? যে আমি সব কিছু উলোটপালোট করে দিচ্ছে? কোন আমি টা আসল? যে আমি প্রতিদিনকার জীবনযাপন করি? নাকি এই আমি যে আমিটা জানতে চায় আমি কে? বিধি এ কোন কঠিন পরীক্ষায় ফেললে আমায়?

ইচ্ছে করছে গাড়িটা ঘুরিয়ে আবার পার্কে যেয়ে জীবন দা’কে খুঁজে বের করি। তাকেই প্রশ্নটা করি? কে আমি? আমি জানতে চাই জীবন দা। আমার আর কোনো কনফিউশন নাই আমি সত্যি সত্যি জানতে চাই ‘আমি কে’…। অগ্নি ইচ্ছে হল গাড়ির কাচের বাইরে মুখ বের করে চিৎকার করে বলে ‘আমি কে’?

একটা পরিচিত গানের কথা মনে পরে গেল। গানটা অনেক অনেকবার শুনেছে। কিন্তু মনে হতে লাগলো আজ এই মুর্হূতে সে তার অর্থ খুঁজে পেল। প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা শব্দের অর্থ যেন ভিন্নভাবে ধরা দিচ্ছে তার মনে। আবিস্কারের স্বপ্নে মহিত হয়ে উঠল। প্লে লিস্ট থেকে সেই গানটা বাজিয়ে দিয়ে তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলো-

তোমার ঘরে বাস করে কারা
ও মন জান না,
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা,
মন জান না
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।।

এক জনায় ছবি আঁকে এক মনে,
আরেক জনায় বসে বসে রংমাখে
ও আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে
কোন জনা, কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।।

এক জনায় সুর তোলে এক তারে,
আরেক জন মন্দিরাতে তাল তোলে
ও আবার বেসুরো সুর ধরে দেখো
কোন জনা, কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।।

রস খাইয়া হইয়া মাতল, ঐ দেখো
হাত ফসকে যায় ঘোড়ার লাগাম
সেই লাগাম খানা ধরে দেখো
কোন জনা, কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।।

(চলবে…)

<<লালন বলে কুল পাবি না: এক

.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই

লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Imrul Hasan , মঙ্গলবার ৬ অক্টোবর ২০২০ @ ১১:০৯ অপরাহ্ণ

    লেখাটা দারুন লাগছে- অনেকটা মোহাচ্ছন্নতা কাজ করছে নিজের ভেতরে। আধ্যাত্বিক ব্যাপার-গুলো বরাবরই আমাকে টানে। জানার আগ্রহ- আছে মুক্তির আগ্রহ। সঠিক-টাই বুঝতে চাই।

    (লেখাটা এর আগে সেইভ করে রেখেছিলাম। কিন্তু- পড়া হয়ে উঠছিল নাহ। মিঠুর সাথে কথা বলতে গিয়ে পরপর দুই দিন ও এই লেখাটার কথা আমাকে বলল। ওর ভাষায়ঃ ‘এটা মেরাজ ভাইয়ের খুবই স্পেশাল একটা লেখা’। তো, আজকে চোখের সামনে লেখাটাকে আবারও পেয়ে এই অংশটা পড়ে ফেললাম। দ্বিতীয় অংশটাও এখনি পড়ে ফেলবো- ইনশাআল্লাহ।)

    • ভবঘুরে , বুধবার ৭ অক্টোবর ২০২০ @ ৪:০৮ পূর্বাহ্ণ

      অনেক ধন্যবাদ ভাই
      আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য
      প্রেম ও ভক্তি নিবেন
      জয়গুরু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!