-মূর্শেদূল মেরাজ
এখানে সকলেই যে শুধু জ্ঞান নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নয়। অনেকে নানান ধান্দাতেও আছে। কেউ হয়তো কথার ফাঁদে ফেলে দুই/এক কাপ চায়ের সাথে গোটা কয়েক বিস্কুট খেয়ে নিয়ে, দামী সিগারেট ধরিয়ে বিলটা আপনার তালিকায় ধরিয়ে দিয়ে হন হন করে হেঁটে যাবে।
কেউবা কয়েক কথার পর একটা দু:খের গল্প বলে কিছু সাহায্য-সহযোগিতা চেয়ে বসবে। অনেকে এতো কিছুর ধার ধারে না। সোজা এসে বলবে, এতো টাকা দে। এ রকম নানান কিসিমের মানুষের সাথেও আলাপ হয়েছে-পরিচয় হয়েছে।
এসব আমি ভালোই জানি-বুঝি। তাদের সাথে কি করে ডিল করতে হয় তাও যে একেবারে বুঝি না তা নয়। তবে আমি চেষ্টা করেছি সবকিছুকেই নমনীয়তার সাথে দেখতে। মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি বলা যায়। এ রকমটা সেই কত দিন আগে বলেছিল জীবন দা’। সে ভাবেই ভাববার-দেখবার-বুঝবার চেষ্টা করছি মাত্র।
তবে সকল ক্ষেত্রেই যে পারছি তা তো নয়। মানুষের সাথে কথা বলার একই সাথে নিজের সাথে বোঝাপড়া করে নিয়ে তারপর উত্তর দেয়াটা, আমি সারাজীবন করেছি চালাকি করে জয়ী হবার জন্যই। ক্লাইন্ট, বস বা বৌ সামনে যেই থাকুক না কেনো, সব সময়ই মনের গোপন ঘরে একটা তীব্র ইচ্ছা বিরাজ করেই; যে করেই হোক জিতে প্রমাণ করতে হবেই, আমিও পারি!
আর বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন-পরিজন-পাড়া-প্রতিবেশী হলে তো কথাই নেই, প্রয়োজনে গল্পের গরু গাছে তুলে হলেও কোনো মতেই হারা যাবে না এমন মানুষিতাই আমি বহন করে চলেছি আজন্ম। আর আমি ভাবতাম এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ পথ। আমার শিক্ষা, তা পারিপার্শ্বিক বা প্রাতিষ্ঠানিক হোক তা আমাকে এভাবেই শিখেয়েছে। জিততে হবে… নইলে পিছিয়ে পরতে হবে।
‘ভয়ের আগেই জয়’, ‘জয়ী হও প্রমাণ করো’ এই টাইপের কত পণ্যের ক্যাম্পেনিং করেছি তার হিসেব নাই। জীবনের অনেকগুলো বসন্ত পারি দিয়ে আজ আমি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি নিজে হেরে অন্যকে জয়ী করার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই।
জানি আমার মতো কর্পোরেট মানুষের মুখে এসব কথা ঠিক মানাচ্ছে না। আমার এই লেখা যদি আমার পরিচিতজনদের চোখে পড়ে তাহলে খবরই আছে। যাক সে সব কথা। হাতে সময় নেই একটু পরেই বের হতে হবে। তার আগে গতকালের কিছু কথা বলে নেই এই অবসরে।
সারা দুপুর গড়াগড়ি করে শেষ বিকেলে যখন সাঁইজির ধামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম তখন হোটেলের কাউন্টারের ছেলেটা বললো, স্যার! চিন্তা কইরেন না সারারাতই খোলা থাকবে। রাতে যখনি ফিরেন কিছু লাগলে বা গেট যদি কেউ বন্ধ করে দেয় তাহলে ‘আনিস’ বইলে ডাক দিবেন।
হোটেলের সামনে ফুরফুরা মেজাজ নিয়ে রিকশার জন্য অপক্ষা করছি। এমন সময় এক লোক হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলো, কোনো টিভি চ্যানেল ভাই?
-মানে?
-মানে আবার কি? লালনে আসছেন না? তা টিভি চ্যানেল থেকে আসছেন নাকি পত্রিকা? ফটোগ্রাফার?
-না সেসব কিছুই না। এমনি দেখতে আসছি।
-বলেন কি? কাজ না থাকলে ভদ্রলোক এসব দেখতে আসে নাকি? আমরা তো কুষ্টিয়ায় থাকি। কই আমরা তো জীবনে গেলাম না। ছি… পারেনও আপনেরা।
সুন্দর একটা মন নিয়ে পথে নেমেছিলাম। ভদ্রলোকের কথায় মনটা খারাপ করে রিকশায় উঠলাম। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার আর রুচি হয়নি। তিনি অবশ্য অনেক কিছুই বলেছেন। সেসব যত দ্রুত সম্ভব ভুলে যেতে পারলেই ভালো।
তারচেয়ে ভালো হয় যদি রাসু পাগলাকে খুঁজে পাই। সে অবশ্য বলেছিল তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। তবে রাজঘাট নাইলে শ্মশানের দিকটায় খোঁজ নিতে, সেখানে তাকে পাওয়া গেলেও যেতে পারে।
লোকজন আসতে শুরু করেছে তবে এখনো ভিড় জমে উঠেনি। মঞ্চের আয়োজন শুরু না হওয়ায় এ দিকাটায় বেশ ফাঁকাই বলা যায়। মঞ্চের পাশেই একটা চায়ের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসে চা-বিস্কুট খাচ্ছি এমন সময় বিশালদেহী মাথায় পাগড়ী পরা এক ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখ করে করমর্দনের জন্য এক হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলো।
অল্পকথায় আলাপ জমে গেলো ভদ্রলোকের সাথে। বেশ আলাপি মানুষ। কোনোভাবেই আমাকে কোনো বিল দিতে দিলেন না। এটা খান ওটা খান বলতে বলতে মেলা, ধাম, মঞ্চের আশপাশে এমন এমন জায়গা ঘুরে দেখালেন যা গতকাল দেখা হয়নি।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি আমাকে বহুদিন ধরেই চেনেন। আমিও মনে মনে সার্চ করতে লাগলাম তাকে চিনি কিনা সেটা পরখ করে দেখবার জন্য। অনেকের সাথে মিল মনে হলেও মুখভর্তি দাড়িওয়ালা আলখেল্লা পড়া এই ভদ্রলোককে আগে কোথাও দেখেছি বলে তো মনে পরলো না।
কিছু মানুষ আছেন না। যাদের দেখলেই পরিচিত পরিচিত মনে হয়। এই ভদ্রলোকের চেহারা অনেকটা সেই টাইপের। আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই বললেন আরে ভাই বসেন বসেন। আপনি কি ঢাকা থেকে আসছেন? দেখলাম কালকেও। তাই পরিচয় হতে আসলাম।
-ও। আমি ভাবছিলাম আপনি আমার পূর্ব পরিচিত কিনা।
-আমি কুষ্টিয়া জেলা সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল। লালন একাডেমীর আজীবন সদস্য। সব অনুষ্ঠানেই আসি। আপনি? আমরাই তো মিটিং-টিটিং করে সব ঠিক করি। দেখেন না এবার কতো ভালো ব্যবস্থা করা হয়েছে।
-আমি অগ্নি। ঢাকা থেকে এসেছি। চা খান?
-আরে বলেন কি? আপনি তো আমাদের মেহমান। আপনি কি কি খাবেন বলেন।
অল্পকথায় আলাপ জমে গেলো ভদ্রলোকের সাথে। বেশ আলাপি মানুষ। কোনোভাবেই আমাকে কোনো বিল দিতে দিলেন না। এটা খান ওটা খান বলতে বলতে মেলা, ধাম, মঞ্চের আশপাশে এমন এমন জায়গা ঘুরে দেখালেন যা গতকাল দেখা হয়নি।
লালন, লালন আখড়া, ধাম, স্মরণোৎসব ইত্যাদি নিয়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হলো। এবার স্মারণিকাতে তার লেখা ছাপা হয়েছে। কোন কোন টিভি চ্যানেলে তার স্বাক্ষাৎকার নিয়েছে। সেখানে তিনি কি কি বলেছেন। লালন একাডেমীর সাথে দহরম মহরম কেমন ইত্যাদি শুনতে কিছুটা সময় ভালো লাগলেও অল্প সময়েই বিরক্তি ধরে গেলো।
কিছুতেই যখন তিনি ছাড়ছেন না তখন কৌশলে মেলার মানুষের সাথে মিশে গিয়ে শেষ পালিয়ে বাঁচলাম। এরপর সাক্ষাৎ হলো বয়স্ক এক ভদ্রলোকের সাথে। ভদ্রলোকের নামটা মনে নেই। তিনি নারী-পুরুষের জটিল কিছু সমীকরণ নিয়ে অবলীলায় আলোচনা করে গেলেন। আশপাশের অনেকেই তাতে যোগও দিলো। মনে হলো ছেলে-বুড়ো সকলেই এসব বিষয়ে অবগত। সকলেই যথেষ্ট জ্ঞান রাখে।
এক এক করে কত মানুষের সাথেই কথা হলো। কুশল বিনিময় হলো। একা একা সময় কাটালাম কিছুটা সময়। ভিড় বাড়তে লাগলো। এটা সেটা খেতে খেতে যখন সন্ধ্যা লাগলো তখন আমি ধামের মধ্য ঘুরছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম সকলে পরিপাটি হচ্ছে; যেন কোথাও যাবে। বসবার জায়গা গুছিয়ে নিচ্ছে। চুল বেঁধে, দাড়িতে গিট দিয়ে পা গুটিয়ে বসে অপেক্ষা করছে।
একসময় সকলে দেখলাম কয়েকটা করে চাল মুখে দিয়ে পানি খাচ্ছে। একজনকে জিজ্ঞাস করতে জানতে পারলাম একে বলে চাল জল কর্ম। এই চাল-জল কেনো করে জানতে চাইলে পাশের একজন গর্বের সথে বললো- এটাই নিয়ম। লালনের নিয়ম।
এ এক অপূর্ব-অপার্থিব দৃশ্য। ভালোবাস-সম্মান-বিশ্বাসের এমন সম্পর্কই তো মানুষ মানুষের কাছে আশা করে। সম্পর্কগুলো তো এমনই হওয়ার কথা। এই সমতার স্বপ্নই তো দেখে মুক্তিকামী মানুষেরা। হায় কোথায় পরে আছে সমতা আর আমরা কোথায় খুঁজি।
তার দিক থেকে সাধুদের দিকে মুখ ফেরাতেই দেখি এক একটা ধ্বনি দিয়ে সকলে সেজদায়। এই প্রকৃয়া চললো অনেকটা সময় ধরে। সম্মিলিত ভক্তিপর্ব শেষ হওয়ার পর সাধুরা সঙ্গীনিদের আর সঙ্গীনিরা সাধুদের ভক্তি দিলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম নারী পুরুষের সমতা।
হায়রে আমরা সভ্য সমজে নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে কত লড়াই করছি। মারদাঙ্গা ভাষণ দিয়ে মাঠ গরম করছি। বিদেশ থেকে টাকা এনে এজিও নাম দিয়ে কত অপচয়-অবচয় করছি। আর লোকো বলে যে সংস্কৃতিকে আমরা পহেলা বৈখাখের জন্য সারা বছর শিকায় তুলে রাখি সেই লোকো সংস্কৃতিই যে আসলে মূল সংস্কৃতি সেটা শিক্ষিত সমাজ জানেই না???
আসলে জানতে তো মহাবিপদ। তাহলে তো আমাদের মতো মার্কেটিং-এর লোকজনের কাজকাম আর কিছুই থাকবে না। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো টাকা ঢালবে না।
অবাক হয়ে ঘুরে ঘুরে বারবার দেখতে লাগলাম সঙ্গীটি যেমন নতশিরে তার সঙ্গীনিকে ভক্তি করছে; ঠিক তেমনি করে সঙ্গীনিটিও তার সঙ্গীকে নতশিরে ভক্তি দিচ্ছে।
এ এক অপূর্ব-অপার্থিব দৃশ্য। ভালোবাস-সম্মান-বিশ্বাসের এমন সম্পর্কই তো মানুষ মানুষের কাছে আশা করে। সম্পর্কগুলো তো এমনই হওয়ার কথা। এই সমতার স্বপ্নই তো দেখে মুক্তিকামী মানুষেরা। হায় কোথায় পরে আছে সমতা আর আমরা কোথায় খুঁজি।
খেয়াল করলাম বজ্রাসনে বসে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ এক সাধু হাতের ইশায়ায় তার সামনে বসতে বলছে। হয়তো আমার অবাক করা চাহনিই সাধুকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করেছে।
একটু ভয় ও উত্তেজনা নিয়ে সাধুর আসনের সামনে বিছানো সাদা কাঁথার উপর বসে পরলাম।
-বাপ আরাম করে বসো। মঞ্চে গান শুরু হইতে দেরি আছে। বসো কথা বলি।
সাধুর আশপাশের লোকজন ভক্তিপর্ব শেষে সম্ভবত হাঁটাহাঁঁটি করতে গেছে। একটু ফাঁকাই পাওয়া গেলো। সাধু পাশের থালা থেকে একটা বাতাসা তুলে আমার হাতে দিয়ে বললেন- তা বাজান আগেও আইসেছো নাকি এইবারই আইসলে?
-এই প্রথম।
-তা একাই আইসেছো? নাকি লোকজন আছে?
-একাই এসেছি।
-বাহ্। বেশ বেশ। আসতেও একা যাইতেও একা। মনের জায়গায় একাই যাওয়া ভালো বুইঝেছো। তা বাজান গান করো?
-না। গান করতে পারি না।
-হুমম তাও ভালো।
-এতে ভালো কি…
-সবাই গাইলে কি আর হইবে। তাহইলে তো গান ঠিক মতো গাইলো কিনা সেই আলোচনাতেই সার হইবে। গানের ভেদ বোঝারও তো মানুষ প্রয়োজন। তাই না বাজান?
সাধুটিকে আমার মনে ধরে গেলো। কথা শেষ করে একটা হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকেন কিছু সময়। বিষয়টা দেখবার মতো। বাচ্চাদের মতো চোখ-মুখ তথা সর্বাঙ্গ দিয়ে কাউকে উজার করে এমনভাবে হাসতে বহুদিন দেখিনি। জানা গেলো প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন। তিনি আর তার সাধনসঙ্গীনি সাথে একজন ভক্তছেলে। বয়স ছিয়াশি।
নিজের করে পাওয়ার যে বাসনা তা থেকে বের হওয়া কষ্টকর। এজন্যই হয়তো মানুষের সাথে সম্পর্ক পাতিয়ে নিজের একাকীত্বই ভুলে থাকতে চায়। কি জানি। আমার তো তাই মনে হচ্ছে।
বয়সটা ঠিক মেলানো যায় না। দিব্বি শহুরে ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের মানুষের সাথে মিলিয়ে দেয়া যায়। দারুণ প্রাণ উচ্ছ্বল এই মানুষটির চোখে সব কিছুতেই ভালো। আশপাশে যে যাই করছে তা দেখেই হাসেন। তবে হাসিতে শব্দ নাই। দেহ কাঁপিয়ে হাসে শব্দ ছাড়া। বিষয়টা ইন্টারেস্টিং।
সাধুর সঙ্গীনিটি ফিরে এসে সাধুর পাশে আসনের উপরে বসতে সাধু হেঁসে বলো- এ তোমার মা।
সঙ্গীনির দিকে তাকিয়ে বলো- এ ছেইলে ঢাকা শহর থেইকে আইসেছে।
‘মা’ শুনেই মনটা ভরে গেলো। আহ্ মানুষের সাথে এভাবেও পরিচয় হওয়া যায়? জেনো কত জনম পর পুত্রের সাথে দেখা হয়েছে এমন আবেগ নিয়ে দু হাত তুলে ভক্তি দিয়ে তিনি বললেন- বাজান ভালো আছো তো?
মনে মনে ঠিক করে নিলাম সাধুটিকে বাজান আর উনার সঙ্গীনিকে মা বলেই ডাকবো। মনটা বেশ ফুরফুরা হয়ে উঠলো। এখন আর ঢাকা থেকে এতো দূরের কুষ্টিয়া শহরে নিজেকে এতিম মনে হচ্ছে না। আসলে পরিবার একটা অন্য ব্যাপার। মানুষ এই জন্যই মনে হয় দলগতভাবে বসবাস করে।
নিজের করে পাওয়ার যে বাসনা তা থেকে বের হওয়া কষ্টকর। এজন্যই হয়তো মানুষের সাথে সম্পর্ক পাতিয়ে নিজের একাকীত্বই ভুলে থাকতে চায়। কি জানি। আমার তো তাই মনে হচ্ছে।
-বাজান দুপুরে সেবা হইছে?
চিন্তার জগৎ থেকে হঠাৎ মায়ের কথাটা শুনে বাস্তবে ফিরে এসে হকচকিয়ে বলে ফেললাম- কি?
-দুপুরে খইয়েছো?
-জ্বি মা… খেয়েছি।
বাজান লাইন কইরা বসেন। এখন মুড়ি সেবা দিবো সেটা নিইয়ে নেন -এ কথা বলে বাজান তার পাশে একটু জায়গা করে দিলো। আমি টুপ করে সেখানে ঢুকে বসে পরলাম। সাধুর পাশে বসে পরতে পেরে বেশ লাগছে। সাঁইজির রওজার পাশে অডিটোরিয়ামের নিজে খিলকাধারী সাধুদের সাথে একত্রে বসতে পরার ব্যাপারটা সত্যিই মনে রাখবার মতো। গতবছর কর্পোরেট জগতের মার্কেটিং-এর জন্য এওয়ার্ড পেয়েও এতো আনন্দ হয়নি।
মুড়ি সেবা হয়ে যাওয়ার পর বাজানের ভক্ত ছেলে কোথা থেকে কৌটায় করে দুধ চা নিয়ে এলো। সাধুদের নিজেদের থালা-কাপ সবই তারা বহন করে। এর বিশেষত্ব যাই হোক না কেনো। অন্যের ব্যবহৃত পাত্রে খাবার খেলে যে সংক্রামক ব্যাধির আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে সেটা এই ব্যবস্থায় অনেকটাই নিরাপদ।
লোক বাড়ছে। ভিড় জমাট বাঁধছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে, বেশিভাগ লোক মজা দেখতে এসেছে তারা ভিড় ঠেলে ঠেলে মজা খুঁজে বেড়াচ্ছে। বসে থাকা সাধুগুরুদের তাচ্ছিল্যের চোখে তাকাচ্ছে। কেউ কেউ নানান সব মন্তব্যও করছে। অনেকে মোবাইলে ভিডিও করতে করতে গায়ের উপরও চলে আসছে।
এদের বেশিভাগই উঠতি বয়সের ছেলেপিলে। এদের আচরণ, অঙ্গভঙ্গী, তাকানোর দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা নিম্নমুখি। সাধুরা অবশ্য এ সবে অভ্যস্থই মনে হলো। তাদের কোনো বিকার নেই। তারা নিজেদের মতো আছে বেশ। আমরা মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। তারপরও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলাম।
মনের মানুষ হইলো। যারা দেহ বুইজ্জ্যা মনের পথ ধইরা আত্মার সন্ধানে চলে। আর আত্মার পথ ধইরা পরত্মায় যাইতে চায়। আর দেহের মানুষ হইলো যারা ইন্দ্রিয় দিয়ে সব কিছু বুইঝবার চায়। এই দেহের চিন্তা নিয়া যারা ঘুরতেছে তাদের বেশিভাগের চোখেই কামের নেশা।
-বাজান ফকির হওয়া কি সহজ কাজ? নিইজ বাপ-মা, পাড়া-প্রতিবেশী এমন কি নিইজ ছেইলে-মেয়েই মানতে চায় না। আর সমাজ।
বাজান সম্ভবত আমার মনের ভাব বুঝেই বোধ হয় কথাগুলো বললেন। তবে একথা বলার সময়ও তার মুখে হাসি। আমার মনটা আবারো ভালো হয়ে গেলো। সত্যি বলছি, মনে হচ্ছিল- এতো এতো মেডিটেশনের কোর্স, ভালো থাকার কত কত ফর্মুলা, মটিভেশনাল স্পীচ সবই আসলে অর্থহীন; এমন একটা হাসির সামনে।
লোকজন বাড়ছে তো বাড়ছেই। গায়ে গায়ে মানুষের ভিড়। তারপরও লোক ঢুকছে ধামে। মূল মঞ্চে আলোচনা চললে, তা এখানে বসেও শোনা যাচ্ছে। তবে সে সবে কান নাই করো। ধামের বিভিন্ন অংশেও গান হচ্ছে। অডিটোরিয়ামের সিঁড়ির পাশটায় বহুলোকজন চিৎকার করে গান করছে। কোথাও কোথাও কেবল বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শোনা যাচ্ছে, গানের গলা এসে পৌঁছাচ্ছে না। তুলনামূলকভাবে এ পাশটা একটু নিরবই বলা যায়।
-আচ্ছা বাজান, আমি তো জানতাম সাধুরা নিরবতা পছন্দ করে। তারা সাধনার জন্য কেউ জঙ্গলে, কেউ পাহাড়ে কেউ নদীর পারে, কেউবা শ্মানানে চলে যায়। তাহলে এতো লোকজন-এতো ভিড়েএতো চিৎকারের মাঝে ভালো লাগে?
-বাজান। এইটা তো হইলো মেলা। মেলায় তো লোকজন আসবেই। লোকজন না হইলে কি মেলা জইম্বে? সাঁইজি তো আপনার বা আমার একার না। সাঁইজি তো সক্কোলের। সবাই তো তার দর্শনে আসিবেই। এইটা হইলো দোলের সাধুসঙ্গ। সাঁইজি নিজে এই সাধুসঙ্গ করতেন। তয় বাজান অহন আর সাধুসঙ্গ নাই। হইয়া গেছে মেলা। এই মেলায় মনের মানুষের বদলে দেহের মানুষই বেশি।
-দেহের মানুষ মানে?
-মনের মানুষ হইলো। যারা দেহ বুইজ্জ্যা মনের পথ ধইরা আত্মার সন্ধানে চলে। আর আত্মার পথ ধইরা পরত্মায় যাইতে চায়। আর দেহের মানুষ হইলো যারা ইন্দ্রিয় দিয়ে সব কিছু বুইঝবার চায়। এই দেহের চিন্তা নিয়া যারা ঘুরতেছে তাদের বেশিভাগের চোখেই কামের নেশা।
হেরা খালি চায় আর চায়। চাওনের তো শেষ নাই বাজান। আর চাইতে গিয়া তাল সামলাইতে পারে না। তাই অন্যরে মন্দ বইল্যা। কটু কথা বইল্ল্যা সুখ পায়। মানুষের বিপদে আনন্দ পায়। মানুষরে বিপদে ফেইল্যা নিজের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে চায়। এরা তো অবুঝ। এদের জন্যই তো নবী বলছেন, এদের জ্ঞান দাও প্রভু; এদের ক্ষমা করো।
-বাহ্ ভালো বলেছেন তো।
-বাজান যে জানে সে তো সহজ মানুষ হইয়ে যায়। তার আর লোভ থাকে না। কাম থাকে না। উত্তেজনা থাকে না। অন্যের বিষয়ে নাক গলানোতে মন থাকে না। সে তখন একের সাধনে ব্যস্ত থাকে। পরমরে খোঁজে নিজের মাঝে। নিজেরে বুইঝে পরমে ডুব দেয়। সাঁইজি বলছেন-
মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে।
সেকি অন্য তত্ত্ব মানে।।
মাটির ঢিবি কাঠের ছবি
ভূত ভবিষ্যৎ দেবাদেবী,
ভোলে না সে এসব রূপী
মানুষ ভজে দিব্যজ্ঞানে।।
জোরোই সরোই লোলা ঝোলা
পেঁচাপেঁচী আলাভোলা,
তাতে নয় সে ভোলনেওয়ালা
যে জন মানুষ রতন চেনে।।
ফেয়োফেপি ফ্যাকসা যারা
ভাকা ভোকায় ভোলে তারা,
লালন তেমনি চটামারা
ঠিক দাঁড়ায় না একখানে।।
-বুঝলেন বাজান?
-সত্যি কথা গানের কয়েকটা শব্দ ছাড়া বিশেষ কিছুই বুঝি নাই। কিন্তু ভাব পুরোটাই বুঝতে পারছি। আপনি যা বলছেন তাই ঠিক বাজান। আসলেই তাই। যে জানে সে নিরব থাকে। আসলেই তাই। আসলেই তাই…
(চলবে…)
<<লালন বলে কুল পাবি না: এক ।। লালন বলে কুল পাবি না: তিন>>
.…………………………………………..
স্থিরচিত্র কৃতজ্ঞতা: হাবিবুল হাসিব
.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট
সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট