লাহিড়ী মহাশয়ের অপর একটি শিষ্য, শ্রদ্ধেয় কালীকুমার রায় মহাশয় গুরুর সঙ্গে তাঁর জীবনযাপনের বহু কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনী আমায় শুনিয়েছিলেন। কালীবাবু বললেন, কাশীর বাড়িতে আমি প্রায়ই কয়েকসপ্তাহ ধরে লাহিড়ী মহাশয়ের অতিথি হয়ে থাকতাম।
দেখতাম, বহু সাধুসন্ত, দণ্ডী স্বামীরা (দণ্ডীরা এক সন্ন্যাস সম্প্রদায়, ব্রহ্ম দণ্ডের প্রতীকস্বরূপ তাঁরা দণ্ড (বাঁশের তৈরি) ধারণ করে থাকেন। মানব শরীরে এটাই মেরুদণ্ডের প্রতীক। মেরুদণ্ডের সাতটি চক্র ভেদই হচ্ছে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পথ)।
রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যে তাঁর চরণতলে এসে সমবেত হতেন। কখনো কখনো ধ্যানযোগ বা দার্শনিকতত্ত্ব সম্বন্ধেও আলোচনা হত। ঊষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই পূজনীয় অতিথিবর্গ সব একে একে প্রস্থান করতেন। তাঁর বাড়িতে থাকার সময় দেখেছিলাম, লাহিড়ী মহাশয় ঘুমোবার জন্যে একবারও শুতেন না, বা চোখের পাতা বোজাতেন না।
কালীবাবু বলতে লাগলেন, গুরুদেবের সঙ্গে প্রথম প্রথম সঙ্গ করবার সময় আমার মনিবের কাছে থেকে বিস্তর বাঁধাবিপত্তি সহ্য করতে হয়েছিল। তিনি ভীষণ বিষয়সর্বস্ব ছিলেন। টিটকারি দিয়ে শ্লেষপূর্ণস্বরে বলতেন, আমার কর্মচারীদের ভেতর ধর্ম ধর্ম করে পাগল কোনো লোক আমি চাই না আর।
আমি যদি তোমার সেই বুজরুক গুরুটিকে একবার দেখতে পাই তো তাহলে তাঁকে এমন গুটিকতক কথা শুনিয়ে দেব যে, বহুদিন তাঁর তা মনে থাকবে। কিন্তু এইরকম করে ভয় দেখালেও আমার রোজকার যাওয়া-আসা কিছুমাত্র কমলো না। রোজ সন্ধ্যায় আমি গুরুর কাছে যেতাম।
একদিন সন্ধ্যায় আমার মনিবটি আমায় অনুসরণ করে এসে লাহিড়ী মহাশয়ের বৈঠকখানায় উদ্ধতভাবে সবেগে ঢুকে পরলেন। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম যে, এইবার দেখা হলে হয় তাহলে যেমনটি সেদিন বলেছিলেন তেমনি দারুণ বচন শুনিয়ে দেবেন।
ঘরে তখন গুটি বারো শিষ্য বসে। যাক্! প্রভু যেমনি ঘরের মধ্যে গুছিয়েটুছিয়ে বেশ সুস্থির হয়ে বসলেন, অমনি লাহিড়ী মহাশয়ও শুরু করলেন। তাঁর সেই সব শিষ্যদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, দেখ, তোমরা সবাই একটা ছবি দেখতে চাও তো বলো?
মাসতিনেক ধরে তো আমার মনিবটা বাসনা সংবরণ করে রইলেন, কিন্তু তারপরই আবার সেই স্ত্রীলোকটির সঙ্গে তার পূর্ব সম্বন্ধ স্থাপিত হল। মাস দুই পরেই তিনি মারা গেলেন। এইবার বুঝতে পারলাম, আমার মনিবের দীক্ষার অসম্ভাব্যতার বিষয়ে কেনো গুরুদেব হেঁয়ালিতে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
আমরা যখন ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম, তখন তিনি ঘরটি অন্ধকার করে বললেন, আচ্ছা! তোমরা একজনের পিছনে একজন এমনি করে চক্রাকারে গোল হয়ে বসো, আর প্রত্যেকেই তার সামনের লোকের চোখের উপর হাত দিয়ে টিপে বন্ধ করে ধর।
আশ্চর্য! আমার মনিবটি কিঞ্চিৎ অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুরুদেবের নির্দেশ পালন করে গেলেন। মিনিটকতক পরে লাহিড়ী মহাশয় জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কি দেখছি তা তাঁকে বলতে। আমি বললাম, মহাশয়! একটি অতি সুন্দরী স্ত্রীলোক দেখা যাচ্ছে, পরণে তার লালপেড়ে শাড়ি, একটা কঁচু গাছের কাছে দাঁড়িয়ে। অন্যান্য শিষ্যরাও সব একই বর্ণনা দিল। গুরুদেব আবার মনিবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, স্ত্রীলোকটিকে চেনো না কি?
লোকটির মনে তখন এক অদ্ভুত ভাবের ঝড় উঠেছে, সামলাতে পারছেন না; শেষ অবধি বলেই ফেললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, চিনি বইকি, কি বলব বলুন; ঘরে সুন্দরী সাধ্বী-স্ত্রী থাকতেও আমি স্ত্রীলোকটির পিছনে বোকার মতো টাকা খরচ করছি। যে মতলব করে আমি এখানে এসেছিলাম, তার জন্যে মনে মনে আমি বাস্তবিক বড়ই লজ্জিত।
আমি কি আমায় ক্ষমা করে আপনার শিষ্য করে নেবেন? যদি তুমি অন্ততঃ মাসছয়েক খুব সৎভাবে জীবনযাপন করতে পার, তবেই তোমায় আমি গ্রহণ করব, তারপর যেন একটু হেঁয়ালিতেই বললেন, তা না হলে তোমায় দীক্ষা দেবার কোনো প্রয়োজনই হবে না।
মাসতিনেক ধরে তো আমার মনিবটা বাসনা সংবরণ করে রইলেন, কিন্তু তারপরই আবার সেই স্ত্রীলোকটির সঙ্গে তার পূর্ব সম্বন্ধ স্থাপিত হল। মাস দুই পরেই তিনি মারা গেলেন। এইবার বুঝতে পারলাম, আমার মনিবের দীক্ষার অসম্ভাব্যতার বিষয়ে কেনো গুরুদেব হেঁয়ালিতে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
………………………………………
সূত্র:
যোগী-কথামৃত (Autobiography of a Yogi)
**শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ বিরচিত পূজনীয় ও পরমারাধ্য আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের শ্রীকরকমলে অর্পিত।
**মৎপ্রণীত ইংরাজী ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ্ এ যোগী’র বঙ্গানুবাদে শ্রীমান ইন্দ্রনাথ শেঠের স্বেচ্ছা প্রণোদিত প্রয়াস ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ ও আশির্বাদ জানাই। -শ্রী শ্রীপরমহংস যোগানন্দ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন