১.
শ্রীরামকৃষ্ণকে মানুষ ভগবান বা ঈশ্বর ভেবে যত না শ্রদ্ধা-ভক্তি করে তার থেকে বেশি শ্রদ্ধা করে তাঁকে অত্যন্ত আপনজন ও পরমাত্মীয় ভেবে। ঠাকুর বা দেবতারূপে তিনি যত কাছে আসেন, তার থেকে আরো বেশি কাছে আসেন আমাদের একান্ত কাছের মানুষ হিসেবে। ছবির মাধ্যমে আজ তাঁর ঘরে ঘরে উপস্থিতি। সর্বত্রই তিনি এখন শ্রদ্ধার আসনটি অলঙ্কৃত করছেন। শুধু ছবিতে নয়, কথাতেও তিনি স্থান করে নিয়েছেন মানুষের মন-মন্দিরে। তাঁর জীবন-দর্শন পথহারা পথিকের পথপ্রদর্শক। গৃহী-ত্যাগী নির্বিশেষে সকলের দৈনন্দিন জীবনে তাঁর জীবনবাণী আজ অপরিহার্য। এর কারণ, তাঁর বাণীগুলি যুক্তিসিদ্ধ ও জীবন থেকে উঠে আসা তরতাজা। কখনো মনে হয় না তাঁর কথা অলিক ও অসম্ভব বলে। পরন্তু, সে কথা সহজ-সরল, প্রাঞ্জল ও প্রাণবন্ত রূপ নেয়।
২.
‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ই এর জীবন্ত উপমা। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন-বাণী কথামৃত। যার ছত্রে ছত্রে রয়েছে জীবন থেকে উঠে আসা সারল্য ভাবের প্রামাণ্য নিদর্শন। সমস্ত শ্রেণীর মানুষের পাঠোপযোগী। সহজ বাংলায় রচিত। সকল সমস্যার সহজ সমাধান সব জীবন-জিজ্ঞাসার উত্তর। এর চাহিদা কী রকম, তা বইমেলায় যথেষ্ট লক্ষণীয়। পাঠক মাত্রের মন ছুঁয়ে যায় ক্ষুধা মেটায়। ঐশ্বরিক ভাবের আবেশ আসে মনে। প্রাণে আসে দিব্য-ভাবের নির্মলানন্দ। অজান্তে ব্রহ্মানন্দে মন উদ্বেলিত হয়। এই মন-এর স্বরূপ কী, এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ‘মন যে রঙে ছোপাবে সেই রঙে ছুপবে। যেমন ধোপাঘরের কাপড়। লালে ছোপাও লাল, নীলে ছোপাও নীল, সবুজে ছোপাও সবুজ।’ মানুষ মনকে যে রঙে রাঙাবে সে রঙেই রঞ্জিত হবে। এ অনুভবী সিদ্ধান্ত তথা দর্শনকে অস্বীকার করতে পারি না, পরন্তু আকর্ষিত হই।
৩.
শ্রীরামকৃষ্ণের পূত-সান্নিধ্যে এলেই ঐশ্বরিক আকর্ষণ অনুভূত হয়। এমনই অনুভবের কথা লিখেছেন মুগ্ধ দর্শক মহেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে স্বামীজির মেজভাই এভাবে, ‘দক্ষিণেশ্বর থেকে এই যে লোকটি এসেছে, একেই কি বলে (রামকৃষ্ণ) পরমহংস? দেখিলাম, লোকটির চেহারাতে কোনও বৈশিষ্ট্য নাই, চেহারা সাধারণ পাড়াগেঁয়ে লোকের মতো।’ সেদিন কিশোর শ্রোতা মহেন্দ্রনাথ আরো দেখেছিলেন যে ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁর অভ্যস্ত ভাবেই কথা বলে চলেছেন, ভাবগম্ভীর পরিবেশ এবং সে কথার ভাবের মধ্যে ছিল গভীরতা। তবে তিনি সেই সব সরল কথা যেটুকু অনুধাবণ করতে পেরেছিলেন তা লিপিবদ্ধ করেছেন এ ভাবে, ‘এইমাত্র বিশেষভাবে বুঝিলাম যে, মনটাকে উপর হইতে নামাইয়া আনিয়া লোকটি কথা কহিতেছে এবং আমাদের মনকে যেন আঠা দিয়া জুরিয়া উপর দিকে লইয়া যাইতেছে। দেখিলাম যে, লোকটির প্রতি একটি টান আসিল। এ টান ভেতরের, লোকটির কাছে থাকিতেই ভাল লাগিতেছে। পরমহংস মশাই চলিয়া গেলেন, কিন্তু তাঁর প্রতি ভেতর হইতে একটি টান রহিয়া গেল, সেটা যে অন্য প্রকারের জিনিস, তাহা আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম।’
৪.
এই ভগবত্প্রেমে আবদ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং স্বামীজিও। শ্রীরামকৃষ্ণকে ভালবাসার মূর্ত প্রতীক বলে মনে করতেন। সে অনুভূতিকে তিনি ব্যক্ত করেছেন ৪টি অক্ষরে Love অর্থাত্ Love Personified মূর্তিমান প্রেম। তাঁর ভালবাসা পার্থিব সব ভালবাসাকে হার মানায়। মানুষকে যে মানুষ এত ভালবাসতে পারে তা শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকেই শিখেছিলেন স্বামীজি। সে ভালবাসায় ছিল আত্মিক যোগসূত্র। তাই প্রেমময় শ্রীরামকৃষ্ণের প্রকৃত পরিচয়টি দিয়েছেন স্বামীজি এভাবে, ‘রামকৃষ্ণ অবতার জগতের কল্যাণের জন্য এসেছিলেন। তাঁকে মানুষ বলো বা ঈশ্বর বলো বা অবতার বলো, আপনার আপনার ভাবে নাও। যে তাঁকে নমস্কার করবে সে সেই মুহূর্তে সোনা হয়ে যাবে।’ শ্রীরামকৃষ্ণ চুম্বকের উপমা দিতেন। বলতেন ‘চুম্বক যেমন লোহা টানে ভগবান তেমনই মানুষকে আকর্ষণ করেন।’ শ্রীরামকৃষ্ণও তেমনই আমাদের সবাইকে কাছে টানেন আকর্ষণী-শক্তিতে। তাঁর সান্নিধ্যে আসলে মানুষ অন্তরের টান অনুভব করেন। যে একবার এসেছে সে-ই ফেঁসেছে।
৫.
তাঁর অমৃত বাণী, ‘আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল, এ মত ভাল না। ঈশ্বর এক বই দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লা, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম। যেমন পুকুরে জল আছে, একঘাটের লোক বলছে জল, আর-একঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর-একঘাটের লোক বলছে পানি, হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, কিন্তু বস্তু এক। মত-পথ। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ, ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।
৬.
বেদ-পুরাণ-তন্ত্রে, প্রতিপাদ্য একই সচ্চিদানন্দ। বেদে সচ্চিদানন্দ (ব্রহ্ম)। পুরাণেও সচ্চিদানন্দ (কৃষ্ণ, রাম প্রভৃতি)। তন্ত্রেও সচ্চিদানন্দ (শিব)। সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম, সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণ, সচ্চিদানন্দ শিব।
৭.
তুমি রাত্রে আকাশে অনেক তারা দেখতে পাও কিন্তু যখন সূর্য ওঠে তখন সেই তাদের আর দেখা যায়না। ঠিক এইভাবেই, অজ্ঞানতার কারণে যদি তুমি ভগবানকে প্রাপ্ত করতে না পারো, তাহলে এর মানে এটা মোটেই নয় যে ভগবান নেই।
৮.
যিনি শ্যামা, তিনিই ব্রহ্ম। যাঁরই রূপ, তিনিই অরূপ। যিনি সগুণ, তিনিই নির্গুণ। ব্রহ্ম শক্তি, শক্তি ব্রহ্ম। অভেদ। সচ্চিদানন্দময় আর সচ্চিদানন্দময়ী।
৯.
নিজের বিচারগুলির উপর সৎ থাকো ও বুদ্ধিমান হও, নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করো, তাহলেই তুমি নিশ্চিত সফল হবে। একটি সৎ ও সরল মনের মাধ্যমে প্রার্থনা করো, তোমার প্রার্থনা নিশ্চই শোনা হবে।
১০.
যদি তুমি সত্যিকারেই পাগল হতে চাও, তাহলে সাংসারিক বস্তুর জন্য পাগল হয়না, বরং ভগবানের ভালোবাসায় পাগল হও।
১১.
অধম ভক্ত বলে, ঈশ্বর আছেন, ওই আকাশের ভিতর অনেক দূরে। মধ্যম ভক্ত বলে, ঈশ্বর সর্বভূতে চৈতন্যরূপে, প্রাণরূপে আছেন। উত্তম ভক্ত বলে, ঈশ্বরই নিজে সব হয়েছেন, যা কিছু দেখি ঈশ্বরের এক-একটি রূপ। তিনিই মায়া, জীব, জগৎ এই সব হয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কিছু নাই।
১২.
হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা, আর আমি অকর্তা, এইটি জ্ঞান। হে ইশ্বর, তোমার সমস্ত, দেহ, মন, গৃহ, পরিবার, জীব, জগৎ, এ-সব তোমার, আমার কিছু নয়, এইটির নাম জ্ঞান।
১৩.
যে অজ্ঞান সেই বলে, ঈশ্বর ‘সেথায় সেথায়’, অনেক দূরে। যে জ্ঞানী, সে জানে ঈশ্বর ‘হেথায় হেথায়’, অতি নিকটে, হৃদয়মধ্যে অন্তর্যামীরূপে, আবার নিজে এক-একটি রূপ ধরে রয়েছেন।
১৪.
মনটি দুধের মতো। সেই মনকে যদি সংসার-জলে রাখ, তাহলে দুধেজলে মিশে যাবে। তাই দুধকে নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। যখন নির্জনে সাধন করে মনরূপ দুধ থেকে জ্ঞান-ভক্তিরূপ মাখন তোলা হল, তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার-জলে রাখা যায়। সে মাখন কখনও সংসার-জলের সঙ্গে মিশে যাবে না, সংসার-জলের উপর নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে।
১৫.
হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে হাতে আঠা লাগে না। চোর চোর যদি খেল বুড়ি ছুঁয়ে ফেললে আর ভয় নাই। একবার পরশমণিকে ছুঁয়ে সোনা হও, সোনা হবার পর হাজার বৎসর যদি মাটিতে পোঁতা থাক, মাটি থেকে তোলবার সময় সেই সোনাই থাকবে।
১৬.
পরশমণির স্পর্শে লোহা সোনা হয়ে যায়। লোহার তরোয়াল সোনার তরোয়াল হয়ে যায়। তরোয়ালের আকার থাকে কারু অনিষ্ট করে না। সোনার তরোয়ালে মারা কাটা চলে না।
১৭.
তীর্থ, গলায় মালা, আচার – এ সব প্রথম প্রথম করতে হয়। বস্তুলাভ হলে ভগবানদর্শন হলে, বাহিরের আড়ম্বর ক্রমে কমে যায়, তখন তাঁর নাম নিয়ে থাকা আর স্মরণ-মনন।
১৮.
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরীন্দ্র প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি), আর তোমরা পরস্পর প্রণয় করে থাকবে – তবেই মঙ্গল হবে। আর আনন্দে থাকবে। যাত্রাওয়ালারা যদি একসুরে গায়, তবেই যাত্রাটি ভাল হয়, আর যারা শুনে, তাদেরও আহ্লাদ হয়।
১৯.
আমি ও আমার এই দুটি অজ্ঞান। ‘আমার বাড়ি’, ‘আমার টাকা’, ‘আমার বিদ্যা’, ‘আমার এই সব ঐশ্বর্য’ – এই যে ভাব এটি অজ্ঞান থেকে হয়। …মৃত্যুকে সর্বদা মনে রাখা উচিত। মরবার পর কিছুই থাকবে না। এখানে কতগুলো কর্ম করতে আসা। যেমন পাড়াগাঁয়ে বাড়ি – কলকাতায় কর্ম করতে আসা। বড় মানুষের বাগানের সরকার, বাগান যদি কেউ দেখতে আসে, তা বলে, “এ-বাগানটি আমাদের”, এ-পুকুর আমাদের পুকুর “। কিন্তু কোন দোষ দেখে বাবু যদি ছাড়িয়ে দেয়, তার আমকাঠের সিন্দুকটা লয়ে যাবার যোগ্যতা থাকে না; দারোয়ানকে দিয়ে সিন্দুকটা পাঠিয়ে দেয়।
২০.
সব পথ দিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়। সব ধর্মই সত্য। ছাদে উঠা নিয়ে বিষয়। তা তুমি পাকা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পার; কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পার; আবার দড়ি দিয়েও উঠতে পার। আবার একটি আছোলা বাঁশ দিয়েও উঠতে পার।
২১.
সূর্য যেমন পৃথিবীর চেয়ে অনেক গুন বড়, কিন্তু দূরত্বের জন্য সূর্যকে ছোট একটি তালার মতো দেখতে লাগে, সেই রকম পরমেশ্বরের অনন্ত মহিমা সত্বেও, আমরা তাঁর থেকে বহুদূরে বলে তাঁর যথার্থ মহিমা উপলব্ধি করতে পারি না।
২২.
মাইরি বলছি, যে আমার চিন্তা করবে সে আমার ঐশ্বর্য লাভ করবে, যেমন পিতার ঐশ্বর্য পুত্র লাভ করে। আমার ঐশ্বর্য জ্ঞানভক্তি, বিবেকবৈরাগ্য, শান্তিসুখ,ভাব মহাভাব, প্রেম সমাধি।আমার ধ্যান করলেই হবে। তোদের আর কিছু করতেই হবে না। আমি কে আর তোরা কে, এটা জানতে পারলেই হবে।
……………………………………………………….
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ( শ্রীম ) বিরচিত
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে
পুণঃপ্রচারে বিনীত, প্রণয় সেন