ভবঘুরেকথা
১০ মহররম বিশ্ব শহীদ দিবস কারবালা

-ড. হাসান রাজা

আত্মত্যাগী বিশ্বপ্রাণ : হজরত মাওলা হোসাইন (আ)

মানবধর্ম প্রেমময় মুহাম্মদী ইসলামের ইতিহাসে ১০ মহররম পবিত্র আশুরা তথা বিশ্বজনীন ইসলামের মহামানবিক জীবনদর্শনে নবুয়তের পরবর্তি সময়ে আল্লাহ্ মনোনীত মাওলাইয়াতের বাস্তবায়নে মুসলমান নামধারী মুনাফেক এজিদ বাহিনীর বিপরীতে-

প্রকৃত ইসলামের সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কারবালার মরুপ্রান্তরে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স)-এর দৌহিত্র নয়ণের মণি হজরত মাওলা হোসাইন (আ), তাঁর পবিত্র পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথীসহ সত্য অনুসারী ৭২জন সদস্যের শাহাদতবরণ মানবসভ্যতার ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগের মহিমায় চিরভাস্বর।

আল্লাহ্ মনোনীত মুহাম্মদী ইসলামের মহামানবিক সুশাসনের বিপরীতে স্বৈরাচারী ক্ষমতালিপ্সু উমাইয়া-আব্বাসীয় রাজশক্তির হীন গোত্রীয় ষড়যন্ত্রের নীলনকশার বাস্তবায়ক মুনাফেক এজিদের নেতৃত্ত্বে কারবালা প্রান্তরে নবীবংশের উপর যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালান হয় তা বিশ্ব ইতিহাসের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মহামানবিক দৃষ্টান্ত।

এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কাছে বিশ্ব শহীদ দিবসের মর্যাদায় চির স্মরণীয়। যা জাতিসংঘের অনুমোদনের অপেক্ষা রাখে না। এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে বিশ্বশান্তি, সত্য ও ন্যায়ের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত, আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহ্ মনোনীত মহামানবিক জীবন ব্যবস্থার সর্বোত্তম আদর্শের প্রতিফলন।

১০ মহররম পবিত্র আশুরা তাই মহান রব্বুল আলামীনের মনোনীত দ্বীন-ই-ইসলামের সর্বোত্তম আদর্শের বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত নবীর নিকটবর্তী পবিত্র বংশধর আহলে বাইত-এর অনুসারী আত্মদর্শী তরিকার পথে প্রকৃত মুহাম্মদী ধর্ম প্রচারে নিবেদিত অলি-আল্লাহ্, পীর-মুর্শেদ, সাধু-গুরু, সুফি-দরবেশদের আধ্যাত্মিক জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত দিন।

কারবালার নৃশংস ঘটনা সত্য ও মিথ্যার, মুমিন ও মুনাফিকের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের একটি প্রামাণ্য দলিল। যারা হজরত মাওলা হোসাইনের (আ) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং তাঁর নিরীহ পরিবার-পরিজনসহ তাঁকে জবাই করেছিল তারা কেউই মুসলমান ছিল না, তারা সবাই ছিল মুনাফেক।

পবিত্র কোরানে এই আহলে বাইত সম্পর্কে মহান রব্বুল আলামীন সুরা শূরার ২৩নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন- ‘উহাই সেই সুসংবাদ যাহা আল্লাহ্ তাঁহার বিশ্বাসকারী এবং সৎকর্মশীল দাসগণকে দিয়া থাকেন। বল, আমি ইহার উপর (অর্থাৎ নবুয়তের কর্তব্য পালনের উপরে) নিকটবর্তীগণের (আহলে বাইতগণের) মধ্যে মোয়াদ্দাত (পরম ভালবাসা) ব্যতীত অন্য কোনও পারিশ্রমিক চাই না।

হজরত মাওলা হোসাইন (আ)-কে জবাইয়ের মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতা দখল করেছিল ঠিকই। কিন্তু আল্লাহ্ মনোনীত দ্বীন-ই-ইসলাম থেকে তারা চিরতরে বহিষ্কৃতও হয়েছিল। সেইসব মুনাফেকদের বংশধরেরাই আজও পবিত্র ইসলামের নামে সারাবিশ্বে মানুষ হত্যাসহ নানা ফিতনা ফ্যাসাদে লিপ্ত।

একদিকে মুহাম্মদী ইসলামের প্রেমময় মহামানবিক আত্মদর্শী জীবনদর্শন অন্যদিকে তরবারিবাজ স্বৈরাচারী ক্ষমতালিপ্সু সাম্রাজ্যবাদীদের মদদপুষ্ট রাজতান্ত্রিক ইসলামের প্রচার-প্রসার। সারা মুসলিম জাহানে আল্লাহ্ মনোনীত হজরত মুহাম্মদ (স)-এর রেসালাত ও বেলায়েতের অধিকারী একমাত্র যোগ্য প্রতিনিধি মাওলার মুমেনীনরূপে হজরত মাওলা আলী (আ)-কে অস্বীকার।

ইমামতের বিরূদ্ধে ক্ষমতার লোভে মুসলমান নামধারী মুনাফেক এজিদ বাহিনীর মুমিনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ। এসবই আল্লাহ্ মনোনীত পবিত্র মুহাম্মদী ইসলামের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে।

মানবজীবনে আল্লাহ্ মনোনীত মুহাম্মদী ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে বিশ্ববাসীকে আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি মহামানবিক সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আত্ম উৎসর্গের এই অভূতপূর্ব ঘটনা বিশ্বমানবের আধ্যাত্মিক জীবনভাবনার সর্বোত্তম অনুসরণীয় আদর্শ।

হজরত মাওলা হোসাইন (আ) শুধু বিশ্ব মুসলিমের আধ্যাত্মিক নেতাই নন। তিনি ছিলেন শাহানশাহে দোজাহান মাওলানা মুহাম্মদ (স)-এর নাতি ও পাক পাঞ্জাতনের পবিত্র নূরের বংশধর আহলে বাইত।

পবিত্র কোরানে এই আহলে বাইত সম্পর্কে মহান রব্বুল আলামীন সুরা শূরার ২৩নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন- ‘উহাই সেই সুসংবাদ যাহা আল্লাহ্ তাঁহার বিশ্বাসকারী এবং সৎকর্মশীল দাসগণকে দিয়া থাকেন। বল, আমি ইহার উপর (অর্থাৎ নবুয়তের কর্তব্য পালনের উপরে) নিকটবর্তীগণের (আহলে বাইতগণের) মধ্যে মোয়াদ্দাত (পরম ভালবাসা) ব্যতীত অন্য কোনও পারিশ্রমিক চাই না।

এবং যে একটি ভাল গুণ অর্জন করে আমরা তাহার জন্য উহাতে (অর্থাৎ গুণের মধ্যে) বৃদ্ধি করিয়া দিই একটি ভাল গুণ। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ হইলেন একজন ক্ষমাশীল কৃতজ্ঞ।’

সুতরাং হজরত মুহাম্মদ (স)-এর নিকটবর্তী আহলে বাইতরূপে হজরত মাওলা হোসাইন (আ)-এর স্মরণ এবং সংযোগ প্রকৃত মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয় আল্লাহ্ মনোনীত ইবাদতের অংশ।

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স) ঘোষণা করেছেন-

‘আল্ হোসাইন মিন্নি ওয়া আনা মিনাল হোসাইন।’

অর্থাৎ হোসাইন আমা হতে এবং আমি হোসাইন হতে।

হোসাইন তিঁনি যিনি কারবালার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি শিখাসম উত্তপ্ত মরুতে ঘুমাচ্ছেন। ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থেকেও যিনি সত্য ও ন্যায়কে বিসর্জন দেননি। যিনি নিজ রক্তে পৃথিবীর যাবতীয় পাপরাশিকে বিধৌত করেছেন।

নিজ দেহ মোবারকের শেষ রক্তবিন্দু ও অনু-পরমাণু কারবালার ধুলিকণায় মিশিয়ে দিয়ে, মুহাম্মাদুর রাসুলুলল্লাহ্ (স)-এর দ্বীনকে, উম্মতকে দুনিয়ার বুকে, আখেরাতের বুকে ত্যাগের মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট হলেন হোসাইন, দো’জাহানের বাদশাহ্ হলেন হোসাইন, আল্লাহ্ ধর্ম হলেন হোসাইন, ধর্মের আশ্রয়দাতা হলেন হোসাইন; দিলেন মাথা, না দিলেন হাত, ইয়াজিদের হাতে। সত্য তো ইহাই যে লা- ইলাহার সমস্ত স্তম্ভ হলেন হোসাইন।

সর্বশোকে কাতর থেকেও যিনি রোদন করেন নি। সর্বাপেক্ষা অত্যাচারিত, জর্জরিত, ব্যথিত, বেদনাহত হয়েও যিনি অভিশাপ দেন নি। সবকিছুকে হারিয়েও যিনি কিছুই হারান নি।

অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম ও কুফুরীর বিরুদ্ধে কেয়ামত পর্যন্ত সংগ্রামের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক- বিশ্বের মজলুম ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তিদাতা, প্রিয় নবিজী (স)-এর নয়নমণি। বিশ্বের সকল শহীদদের সম্রাট। বাদশাহর বাদশাহ।

আলী মোকামের মালিক হজরত মাওলা হোসাইন (আ) ইব্নে হজরত মাওলা আলী (আ)। যাঁর পবিত্র চরণে নিজেকে সমর্পণ করে আতায়ে রাসুল হিন্দোল অলি গরীবে নওয়াজ শাহেনশাহ্ খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতী আল্ হাসান ওয়া হোসাইনি আজমেরী (র) ঘোষণা করেছেন-

‘শাহ্ আস্ত হোসাইন, বাদশাহ্ আস্ত হোসাইন, দ্বীন আস্ত হোসাইন, দ্বীন পানাহ্ আস্ত হোসাইন; সারদাদ ওয়া নাদাদ দাস্ত দার দাস্ত ইয়াজিদ, হাক্কাকে বেনায়ে লা ইলাহ আস্ত হোসাইন।’

অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট হলেন হোসাইন, দো’জাহানের বাদশাহ্ হলেন হোসাইন, আল্লাহ্ ধর্ম হলেন হোসাইন, ধর্মের আশ্রয়দাতা হলেন হোসাইন; দিলেন মাথা, না দিলেন হাত, ইয়াজিদের হাতে। সত্য তো ইহাই যে লা- ইলাহার সমস্ত স্তম্ভ হলেন হোসাইন।

তিনি আরো বলেন-

‘জানে মান নেছারম বানায়ে হোসাইন, মনোম গোলামে, গোলেমানে হোসাইন।’

অর্থাৎ ‘আমি আমাকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিয়েছি ইমাম হোসাইনের পদতলে। আমি তো কেবল তাঁরই গোলাম, যে হয়েছে হোসাইনের গোলাম।’

সুতরাং আল্লাহ্ ইবাদত সালাত প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে নবীজী (স)-এর পবিত্র আহলে বাইতগণের প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করা অবশ্যই কর্তব্য।

তাই প্রকৃত মুসলমানেরা নবীর আহলে বাইতের প্রতি ভক্তি ও সমর্পণের নিদর্শন স্বরূপ পাঠ করেন-

‘আল্লাহুম্মা ছল্লে আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলে মুহাম্মদ।’

অর্থাৎ আল্লাহ্তায়ালা ফেরেস্তাগণসহ মুহাম্মদ এবং মুহাম্মদের বংশধরের উপর সালাত (সংযোগ) ও সমর্পণ করেন।

তাই আসুন, প্রেমময় মুহাম্মদী ইসলামের অনুসারীগণ, বিশ্ব মুসলিম জাহানে ১০ মহররম পবিত্র আশুরা তথা মিথ্যার বিরুদ্ধে চির সত্য প্রতিষ্ঠায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (স)-এর কলিজার টুকরা পবিত্র আহলে বাইত হজরত মাওলা হোসাইন (আ), তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথীসহ ৭২ জনের শাহাদত বরণকে বিশ্ব শহীদ দিবস হিসাবে উদযাপন করে আমাদের জীবনে মহান রব্বুল আলামীন আল্লাহ্পাকের মনোনীত পবিত্র ইবাদতকে সার্থক করে তুলি।

(চলবে…)

<<ঈদ-ই-রিসালাত ।। ১০ মহররম বিশ্ব শহীদ দিবস: পর্ব-২>>

…………………………
লেখক : ড. হাসান রাজা
লেখক ও গবেষক
রাজশাহী
ই-মেইল : hassa-raja_raj@yahoo.com

…………………………
আরো পড়ুন:
১০ মহররম বিশ্ব শহীদ দিবস: পর্ব-১
১০ মহররম বিশ্ব শহীদ দিবস: পর্ব-২
কারবালার আগে
কারবালায় মাওলা ইমাম হুসাইনের শেষ প্রশ্ন
কারবালায় ইমাম কাসেম (আ) মর্মান্তিক ইতিহাস
কারবালায় আব্বাস আলমদারের মাজারে অলৌকিক পানি
ঈদ-ই-রিসালাত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!