-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
-গান গাওয়ার সময় আপনি কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজান না? বাউল শিল্পীদের তো দেখি প্রায় সবাই কিছু না কিছু বাজিয়ে গায়।
-না বাপ! কোনো যন্ত্রই তেমন বাজাইতে পারি না, সুর তালে কানা বলতে পারেন; তবে মনে ভাব উদয় হইলে গাই… কি হয় তা জানি না… তাও গাই… যন্ত্র কাছে থাকলে দুই-একটা টোকা দেই এই আর কি… আসলে আমি কি আর গাই… তিনি গাওয়ায় তাই গাই আর কি…
-আপনারে মতো মানুষকে দেখলেই একটা প্রশ্ন আমার মাথায় আসে। এই যে আপনারা কিছুই করেন না। খালি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ান। তা আপনাদের চলে কি করে? অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে?
-আপনার কি মনে হয় বাপ?
-আমার কি মনে হয় সেটা বড় কথা না। আপনি কি তাদের দলে কি না সেটা জানতে চাইছি। যদি কিছুই না করেন তাহলে খাওয়া-দাওয়া করেন কোথা থেকে?
-আমি কি খাই আর বাপ, তিনি খাওয়াইলে খাই, না খাওয়াইলে খাই না, তবে তিনি না খাওয়াইয়া রাখেন নাই আজ অবদি; যেদিন থেইক্ক্যা তারে চিনার চেষ্টায় আছি…
-তা… আপনার তিনি টা কে?
-তার কথা কি আর ভাষায় বলা যায় বাপ?
-হেয়ালি না করে বলেন, পরিষ্কার করে বলেন।
-বাপ এই দুনিয়াটাই হইলো হেয়ালির জায়গা। এখানে সহজ করে কইলে কেউ কিচ্ছু বোঝে না। এই ধরেন বাতাস বইতেছে, এতো সহজ স্বরূপে যে আছে তারে কি দেখা যায়?
-আবার হেয়ালি করছেন, পরিষ্কার করে বলেন আপনার তিনি টা কে? লালন সাঁইজি?
-তিনি হইলো পরম… পরমের অনুসন্ধান বাপ… সবই পরমের স্বপ্ন… সেই স্বপ্নে আমরা বিরাজ করি…
-এসব করে কি হয় সেটা বলবেন পরিস্কার করে বলবেন কি? দিন শেষে হিসেব কষলে কি প্রাপ্তি আছে আপনার? আমার থাকার জন্য বিশাল-আরামদায়ক ফ্ল্যাট আছে, চলবার জন্য দামী গাড়ি আছে, সংসার আছে, স্ত্রী আছে কন্যা আছে ব্যাংকে টাকা আছে, বড় চাকুরি আছে, মানুষ আমাকে সম্মান দেয়, সমাজে প্রভাব আছে, গ্রামে গেলে মানুষের লাইন লেগে যায় দেখা করবার জন্য, বন্ধুরা আমার সাফল্য দেখে গোপনে হিংসা করে, আপনার ভাগ্যে কি জুটলো? এই ঝোলা আর আলখেল্লা? আর অপমান?
-বাপ যার মানের লোভ আছে তারই অপমান বোধ আছে। যে মান-সম্মানের আশা করে না তার অপমানের ভাবও নাই।
-কি বলতে চান আপনি? এসব আপনার মন চায় না? আয়েশ করে একবেলা দামী বিছানায় ঘুমাতে মন চায় না? দামী হোটেলে ভালো ভালো খাবার খেতে মন চায় না? দেশ বিদেশে ঘুরতে মন চায় না? জীবন দা’ কোনো প্রকার চালাকি করবেন না এড়িয়ে যেতে চাইবেন না সোজাসুজি বলেন… ভাবের কথা বইলেন না বাস্তব কথা বলেন…
-বাপ দুনিয়াটাই তো ভাবের, এর মধ্যে অভাবের কথা কেমনে বলি কন?
-দুনিয়াটা ভাবের না জীবন দা’, এটা কঠিন বাস্তবতার সময়, আজ যদি চাকরি চলে যায় ফ্ল্যাট-গাড়ির ইনস্টলমেন্ট, মেয়ের স্কুলের খরচ, টিউশন ফি কোথা থেকে আসবে? আকাশ থেকে পরবে?
-বাপ সেই রকম কর্ম করলে আকাশ থেকেই পরতে কতক্ষণ? কিন্তু সে বড়ই ঊর্ধ্বের কথা অল্প জ্ঞানে ধরবো না…
-কি বললেন অল্প জ্ঞান? আপনি জানেন দেশের বাইরের অন্যতম এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আমার ঝুলিতে? আর কতো যে অর্জন আমার আছে তা আপনাকে বলে শেষ করা যাবে না। তারপরও বলছেন আমার অল্প জ্ঞান?
-বাপ এতো সাফল্যের পরও আপনি এতো অস্থির কেন? যে সাফল্য আপনারে স্থির করতে পারে নাই। কেবল চাহিদাই বাড়াইছে জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে সেই সাফল্য কি আপনি চাইছিলেন বাপজি? এটাকে কি সাফল্য বলে?
-সাফল্য না?
-আদৌ সাফল্য?
-তাহলে আপনার মতে সাফল্য কি?
– বাপ! আপনি আপনার কামনা এতো বড় করে ফেলেছেন যে সাফল্য ছোট্ট হয়ে গেছে। যদি কামনা ছোট্ট হতো কম হতো তাহলে সাফল্য গুলো বড় হয়ে দেখা দিতো। জীবন সুন্দর হতো। শান্ত হতো। কিন্তু কামনার তালিকা বিশাল করে সাফল্য খুঁজতে গেলে গোলেমালে পরতেই হবে বাপ।
অগ্নির সব হিসেব যেন উলোটপালোট হয়ে যেতে লাগলো। জীবন যেনো রিক্যাপ হয়ে চোখের সামনে ভিজুয়্যাল হতে লাগলো। জীবন দা’র কথা কিন্তু মিথ্যা নয়। আসলে সেও মাঝে মাঝে ভেবেছে আসলে কিসের পিছনে ছুঁটছে। তারপর এসবে বেশি পাত্তা দেয়নি। লেগে গেছে প্রতিদিনকার জীবনে। নিজেকে সামলে নিয়ে অগ্নি বললো-
-আপনি আবারো আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন মূল প্রশ্ন থেকে সরে আসাছেন…
-কি যে বলেন বাপ। মূল থেকে সরে আসা কি এতোই সোজা কথা? আবার এই কথাও সত্য যে মূলে থাকােও এতো সহজ না। তবে এই কথা ঠিক আমিও একসময় ভাবতাম এইসবই মূল প্রশ্ন। আসলে এগুলো কোনো প্রাশ্নই না।
-এ্যায়! এগুলো কোনো প্রশ্নই না? কি বলছেন এসব? তা…তাহলে আপনার মতে মূল প্রশ্ন কি?
-মূল প্রশ্ন হইলো ‘আমি কে’ ‘এই জীবনের মূল উদ্দেশ্য কি’? এসব আগে জানতে হয়। বাকি সব স্থূলব্যাপার। বাপ আর এই জ্ঞান বুঝতে হলে আধ্যাত্ম জ্ঞানের ভেদ বুঝতে হলে আধ্যাত্মবাদে গভীরতায় ডুবতে হবে।
-আপনি ধর্মের কথা বলছেন, তাই তো?
-না বাপ! আপনেরা শিক্ষিতলোকরা ধর্ম আর অধ্যাত্মবাদকে এক করে ফেলছেন। এটা ঠিক না। আধ্যত্মবাদ হলো জ্ঞান। যাকে বলে স্পিরিচ্যুয়াল সাইন্স।
-বাহ্! সাইন্স। বিজ্ঞানকে ঢুকিয়ে দিলেন? ভাউতাবাজি আর কি। বিজ্ঞান হয়ে গেল অলৌকিক? নাহ্!
-বাপ! আগেই বলছিলাম এ অল্পজ্ঞানে ধরবো না।
-দেখেন জীবন দা’ বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না। বিজ্ঞান শব্দটা জুড়ে দিলেই ব্যবসা ভালো হয় তাইনা? অবশ্য আপনাকে দোষ দিয়ে লাভ কি, আমরাও তাই, এই তো কোম্পানির প্রোডাক্টের গায়ে লিখে দিয়েছে হার্বাল কিন্তু আমরা সকলেই জানি এগুলো শতভাগ কেমিক্যাল দিয়ে প্রস্তুত।
কেউ দেখতে যাবে না কি দিয়ে তৈরি যেহেতু দেশের স্বনামধন্য মডেল-অভিনেতা-শিল্পী-খেলোয়াড়েরা রংঢং করে বলবে এগুলো হার্বাল; মানুষজন দেদার্সে বিশ্বাস করে ব্যবহার করবে। মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক না বিজ্ঞাপনের এই সব বাণীর কেনো দায়িত্বই দেখা যাবে শিল্পীরা নিজ ঘাড়ে নিবে না; তারা এটাকে স্রেফ অভিনয় হিসেবেই নেয়, পয়সা পেলেই তারা পণ্যের হয়ে কথা বলে।
এতে মানুষের কতো ক্ষতি হচ্ছে তাদের ভাববার সময় কই। দুই-একজন ব্যাতিক্রম আছে বটে তবে তাদের সংখ্যা আজকাল এতোই কম যে প্রায় দেখাই যায় না বলা চলে।
ব্রহ্মাণ্ডের সকল তত্ত্বও যদি কোনো বইতে লেখা থাকে তাতে আপনার কোনো কাজে আসবো না; যদি না আপনার তা জানার ইচ্ছা থাকে; আর যদি ইচ্ছা থাকেও কিন্তু যদি আপনি সেই বইতে কি লেখা আছে তা পড়তে না পারেন বা আপনি হয়তো সেই বইয়ের ভাষাই বোঝেন না। তাহলে সেই জ্ঞানে কি লাভ হইবো আপনার, আপনিই বলেন?
সেই সব বাজারে বিজ্ঞাপনের মতো আপনিও ‘বিজ্ঞান’ শব্দ জুড়ে দিয়ে বিশাল আলখেল্লা পরে মডেল সেজে মার্কেটিং করছেন। জীবন দা’ এসব অন্য কাউকে খাওয়াতে পারবেন, আমি নিজে মার্কেটিং-এর লোক।
একটা বিশাল কোম্পানির মার্কেটিং সেক্টর চালাই প্রতিদিন কত মানুষকে ফেস করতে হয় তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আমার সাথে এসব ভণ্ডামী চলবে না। হাসবেন না জীবন দা’, গা জ্বলে যাচ্ছে বলেন সোজাসুজি বলেন।
সে কি আমার কবার কথা
আপন বেগে আপনি মরি।
গৌর এসে হৃদে বসে
করলো আমার মনচুরি।।
কিবা গৌর রূপ লম্পটে
ধৈর্যের ডুরি দেয় গো কেটে।
লজ্জা ভয় সব যায় গো ছুটে
যখন ঐ রূপ মনে করি।।
ঘুমের ঘোরে দেখলাম যারে
চেতন হয়ে পাইনে তারে।
লুকাইলে কোন শহরে
নব রসের রাসবিহারী।।
মেঘে যেমন চাতকেরে
দেখা দিয়ে ফাঁকে ফেরে।
লালন বলে তাই আমারে
করলো গৌর বরাবরই।।
গান শুনতে শুনতে উত্তেজিত অগ্নিই মুগ্ধ হতে হতে বলে উঠলো-
-অসাধারণ জীবন দা’; গানের কিছুই বুঝি না কিন্তু সত্যিই অসাধারণ গাইলেন। মনটা ভরে গেলে। কিন্তু সত্যি করে যদি বলতে হয় গানের কিছু পরিচিত শব্দ ছাড়া কিছুই বুঝতে পারি নি। একটু বুঝিয়ে বলবেন? লালন ফকির কি বলতে চেয়েছে?
-বাপ! সাঁইজি কি বলতে চাইছেন; কি বোঝাতে চাইছে সেটা কোনো ঘটনা না, সেটা কোনো বিষয়ও না। আপনার জ্ঞানে কি বুঝতে পারতেছেন সেটাই বিষয়।
ব্রহ্মাণ্ডের সকল তত্ত্বও যদি কোনো বইতে লেখা থাকে তাতে আপনার কোনো কাজে আসবো না; যদি না আপনার তা জানার ইচ্ছা থাকে; আর যদি ইচ্ছা থাকেও কিন্তু যদি আপনি সেই বইতে কি লেখা আছে তা পড়তে না পারেন বা আপনি হয়তো সেই বইয়ের ভাষাই বোঝেন না। তাহলে সেই জ্ঞানে কি লাভ হইবো আপনার, আপনিই বলেন?
-আপনি তো আমার চেয়েও এক কাঠি উপরে। এতোদিন আমি ভাবতাম কথার মারপ্যাঁচে আমার সাথে কেউ পারে না। কিন্তু আপনি আমাকে বারবার বিভ্রান্ত করে ফেলছেন হেয়ালি করে।
-বাপ! আমি কি ভুল কিছু বলছি? যদি বলে থাকি অপরাধ নিবেন না। মূর্খ-সূক্ষ মানুষ।
টাই খুলে উপরের বোতামটা আলগা করে দিয়ে অগ্নি বেঞ্চিতে গা এলিয়ে দিলো। সকাল থেকে মনটা অস্থির ছিল, তারপর খারাপ, আর এখন বেশ কিছুটা উদাস উদাস ভাব আসছে। জীবন দা’কে বিশ্বাস করা ঠিক হবে কিনা সেটা এখনো সে বুঝতে পারছে না।
জীবনে সে বহু ধান্দাবাজ দেখেছে। এদের বুঝতে হলে অনেকভাবে বাজিয়ে দেখতে হয়। সহজে কাউকে মাথায় নিয়ে নাচার মতো মানুষ নয় এই শর্মা। উদাস ভাবটাকে মাথা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজেকে কিছুটা তৈরি করে নিয়ে বললো-
-আপনার কথা মিথ্যা নয়, ভাষা না বুঝলে বা বোঝার ক্ষমতা না থাকলে বা বলতে গেলে পড়ার ইচ্ছা না থাকলে বইয়ের মধ্যে যে জ্ঞানই থাকুক তাতে কারো কোনো কাজে লাগে না। কিন্তু তাহলে কি আপনি বলতে চাইছেন আপনার মতো ভেক না ধরলে এই গানের অর্থ জানা যাবে না?
-বাপ! ভেক তো ধরা যায় না ভেক হয়ে যায়। থাক সে কথা। আর বাপ যদি কোনো কিছুকে সত্যি সত্যি জানতে হয় তাহলে প্রথম কথা হইলো আগে ঠিক করতে হইবো আসলেই জানতে চান কিনা।
যদি ঠিকঠিক জানতে চান সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়। তারপর তাতে ডুব দিতে হয়। আপনি আগে ভাইব্ব্যা দেখেন সত্যই জানতে চান নাকি এমনি এমনি কৌতুহল? যারা সত্য সত্য জানতে চায়, তাদের জন্য সাঁইজি বলছেন–
ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়।
আকাশ-পাতাল খুঁজিস যারে এই দেহে সে রয়।।
শুনতে পাই চার কারের আগে
আশ্রয় করেছিল রাগে,
সে বেশে অটলরূপ ঝেঁপে
মানুষ-লীলা জগতে দেখায়।।
লামে আলেফ লুকায় যেমন
মানুষে সাই আছে তেমন,
তা নইলে কি সব নূরীতন
আদম-তনে সেজদা জানায়।।
আহাতে আহাম্মদ হ’ল
মানুষে সাই জন্ম নিল,
লালন মহা ফ্যারে প’লো
সিরাজ সাইর অন্ত না পাওয়ায়।।
(চলবে…)
<<লালন বলে কুল পাবি না: এক ।। লালন বলে কুল পাবি না: তিন>>
.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট
সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট
3 Comments