-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
ফকির লালন সাঁইজির পদটা শুনে কিছুটা স্থির হলেও জীবন দা’র ছুড়ে দেয়া প্রশ্নটা অগ্নি হজম করতে পারছিল না কিছুতেই। যেন গান শেষের অপেক্ষাতেই ছিল। গানটা শেষ করে জীবন দা’ চোখ খুলতেই অগ্নি বলে উঠলো- যদি বলি সত্যি সত্যি জানতে চাই তাহলে কি করবেন আপনি? ক্লাস নিতে শুরু করবেন? তা বেতন কত দিতে হবে আমাকে জীবন দা’?
-বাপ! এটা পরমের জ্ঞান; এই জ্ঞান সকলরে দেয়া যেমন যায় না তেমন এই জ্ঞান সকলে নিতেও পারে না। এই জ্ঞান দান করার জন্য আগে পাত্র তৈরি করতে হয়। আর পাত্র তৈরি হলেই এই জ্ঞান দান করা যায়। আর বেতনের কথা বলতেছেন বাপ।
এই জ্ঞান তো আমার জ্ঞান না; এটা এই ভারতীয় উপমহাদেশে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসতেছে গুরু শিষ্য পরম্পরায়। ব্রহ্মাণ্ডের সকল মানুষের জন্যই এই জ্ঞান। যে এই জ্ঞান ধারনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে সে দর্শন পায় এই জ্ঞানের। আর যে পারে না-সে পায় না।
হাতে তুইলা দিলেও নিতে পারে না। এরজন্য দরকার ব্যাপক ধৈর্য্য আর সাধনা করার মন ও ইচ্ছা। সকলে কি আর পারে?
-আরে জীবন দা’ আবারো তেনা প্যাঁচানো শুরু করলেন? এই বললেন জানতে চাই কিনা। সেটা ঠিক করে বলতে। যখন বলছি জানতে চাই তখন ধানাই-ফাইন শুরু করে দিলেন। আরে ঝেড়ে কাশেন, কত টাকা দিলে বলতে শুরু করবেন?
-বাপ! সব কিছু কি আর টেকা-পয়সা দিয়া কেনা যায়? এই জ্ঞান দানের একটা নিয়ম অবশ্য আছে। এই জ্ঞান অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা যায় না। এটা পরমের জ্ঞান, এই জ্ঞান বিক্রির জিনিস না; এই জ্ঞান উপযুক্ত পাত্রে দান করতে হয় বিক্রি করার কোনো নিয়ম নাই।
আর যে জ্ঞান দানের উপযুক্ত হয় সেও ফলের আশায় তা করতে পারে না। আবার যে এই জ্ঞান গ্রহণ করার উপযুক্ত হয়, তারও এই জ্ঞান বিনামূল্যে নিতে হয় না।
-মানে!! যে দিবে সে ফ্রিতে দিবে? কিন্তু যে নিবে সে ফ্রিতে নিবে না?
-হ্যাঁ বাপ! এটাই নিয়ম।
-এ কেমন নিয়ম? তাহলে কিভাবে কি? এভাবে তো এই জ্ঞান কেউ নিতেই পারবে না।
-বাপ! আগেই তো বলছি এই জ্ঞান সকলের জন্য না। যারা নিজেকে তৈরি করবে তারা নিতে পারবে। বাকিদের কোনো কাজে আসবে না। বাপ! এভাবেই তো হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসতেছে। জ্ঞানও ফুরায় নাই ছাত্রও ফুরায় নাই।
-ওহ্! তাহলে আপনি দুই একটা উদাহরণ দেন তো কোন্ ছাত্র কি দিয়েছে… আপনি আপনার গুরুকে কি দিয়েছেন?
-বাপ! আপনি কি আসলেই জানতে চান নাকি হাতে সময় আছে বলে কথার কথা বলে যাচ্ছেন?
-দেখেন জীবন দা’ মিথ্যা বলবো না, সকাল থেকে মেজাজটা খিঁচে ছিল, আপনার সাথে কথা বলতে বলতে মনটা শান্ত হয়েছে। তাই সত্যি কথাই বলছি আপাতত টাইম পাসই করছি। আমি ব্যাপক ব্যস্ত মানুষ; ফোন বন্ধ করে আছি বলে আপনার সাথে কথা বলার ফুসরত পাচ্ছি।
ফোন অন করলেই আমি ভিন্ন মানুষ হয়ে যাব। জগতের সকল জাগতিক কর্ম আমাকে ঘিরে ধরবে। এই সব জ্ঞান নিয়ে তো আর আমার জীবন চলবে না। আমাকে আমার নিজস্ব জগত তৈরি করতে ব্যস্ত থাকতে হয়। সেটাতেই আমি অভ্যস্থ। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে আপনার কথা শুনে ইন্টারেস্টও ফিল করছি।
তবে এই ইন্টারেস্ট কতসময় পর্যন্ত চলবে তা জানি না। ধরে নেন যতক্ষণ আলোচনা চলবে ততক্ষণই। আমার হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে ততক্ষণ আলোচনা চলতে পারে।
-আপনার কথা শুনে ভালো লাগলো বাপ। সত্য স্বীকার করছেন। সকলের এই গুণ থাকে না।
বেশ ফুরফুরা মেজাজে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে থেমে গেল অগ্নি।
-এখানে কি সিগারেট খাওয়া যায়?
-নিয়ম তো নাই। তাও মানুষজন খায়। আপনার মতো ভদ্রলোক খাইলে কেউ হয়তো মানাও করতে আসবে না। কিন্তু আপনি এই নির্মল পরিবেশটাকে নষ্ট করবেন কিনা সেটা আপনার বিবেচনা। মানুষ সৃষ্টি সেরা জীব এই কারণে না, যে সে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই কারণে যে তার বিবেচনা শক্তি আছে।
-তার মানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেতে মানা করছেন?
-আমি কিছুই বলছি না বাপ। তা চলেন বাইরে থেকে চা খেয়ে আসি আপনি না হয় ঐখানেই একটা সিগারেট খেলেন।
-আপনি সিগারেট খান?
-আগে খেতাম এখন খাই না
-কেনো শরীরের ক্ষতি হয় তাই?
-শরীরে তো ক্ষতি হয়ই কিন্তু সেটা মূল কারণ না; মূল কারণ হলো মনে ক্ষতি হয়।
-মানে?
-চিন্তায় সমস্যা হলে উপায় না খুঁজে সিগারেটে আশ্রয় নিতাম সেটাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সেটা ঠিক না, চিন্তার উপর ভরসা কমে যায়। নিজের উপর আস্থা থাকে না। চলেন বাপ। চা খায়া আসি।
উঠতে উঠতে অগ্নি বললো, তা এখান থেকে উঠে গেলে তো এই বেঞ্চিটা পাওয়া যাবে না, বসার জায়গা জন্য জায়গাটা ভালো ছিল।
-বাপ! কিছুই সাথে কইরা নিয়া আসেন নাই; আবার কিছু সাথে নিয়াও যাইবেন না; তাই এইসব বিষয়ের উপর মায়া করতে নাই তাতেই অশান্তি বাড়ে; চিত্ত চঞ্চল হয়।
-তারমানে আপনি কি বলতে চান মানুষের আসক্তি থাকা ঠিক না?
-যা কিছু অস্থায়ী তার উপর আসক্তির ফল ভয়াবহ বাপ।
-একটু পরিস্কার করে বলবেন কি?
জীনব দা’ মৃদু হেসে হাঁটতে হাঁটতে গেয়ে উঠলেন-
দেখিলাম এ সংসার ভোজবাজি প্রকার
দেখিতে দেখিতে অমনি কে বা কোথা যায়।
মিছে এ ঘরবাড়ি মিছে ধন টাকাকড়ি
মিছে দৌঁড়াদৌড়ি করি কার মায়ায়।।
কীর্তিকর্মার কীর্তি কে বুঝতে পারে
সে বা জীবকে কোথায় লয়ে যায় ধরে।
এ কথা আর শুধাব কারে
নিগুঢ়তত্ত্ব অর্থ কে বলবে আমায়।।
যে করে এই লীলে তারে চিনলাম না
আমি আমি বলি, আমি কোনজনা।
মরি কি আজব কারখানা
গুনে পড়ে কিছু ঠাহর নাহি পাই।।
ভয় ঘোঁচে না আমার দিবারজনী
কার সাথে কোন দেশে যাবো না জানি।
সিরাজ সাঁই কয় বিষম কারগুণই
পাগল হয় রে লালন যথায় বুঝতে চায়।।
পার্কের বাইরের চায়ের দোকানটা বিশাল এক গাছের নিচে আর রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা আড়ালে। চারপাশে কলাপাতা টাইপের কিছু গাছ বড় হয়ে যাওয়ার দোকানের বেঞ্চিতে বসলে রাস্তা আর তেমন দেখা যায় না। এখনো সেই জ্যাম লেগেই আছে; যে গাড়ি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এখনো মনে হচ্ছে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
সব গাড়িরই ইঞ্জিন বন্ধ। হেলপার কন্ডাকটাররা রাস্তায় বসে গল্প করছে। কিছু সাহসী মানুষ এই গরমকে উপেক্ষা করে বীর বদনে সাই সাই করে ফুটপাত ধরে এগিয়ে চলছে। তাদের দাড়াঁনোর সময় নেই। অগ্নি সিগারেট ধরিয়ে একপাশে বসেছে মুখোমুখি বেঞ্চিতে জীবন দা’। দোকানে আর কোনো লোকজন নাই।
দোকানি ধোয়া উঠা দুই কাপ রং চা দিয়ে গেছে। জীবন দা’ পায়ের উপর হালকা হালকা তাল দিয়ে চুক চুক করে যেন জগতের সবচেয়ে স্বাধের চা পান করছে। অগ্নি এক চুমুক খেয়ে আর মুখে দিতে পারেনি সেই চা। সে একটা দুধ চায়ের অর্ডার দিয়ে জীবন দার দিকে তাকিয়ে বললো
-এমন বিশাদ চা কি করে এতো মজা করে খাচ্ছেন? আমাকে দেখাচ্ছেন কি করে নির্মোহ থাকতে হয়? ভালোই সাইক্লোজিক্যাল গেম খেলা শুরু করেছেন আমার সাথে। আমিও সম্মোহিত হয়ে আপনার পিছু পিছু চলছি। আচ্ছা কেনো চলছি বলেন তো? আপনার উদ্দেশ্যই বা কি? আমার উদ্দেশ্যই বা কি?
– বাপ! পতঙ্গ জানে আলোতে গেলে তার মৃত্যু তাও কি সে নিজেকে আটকাতে পারে? সামলে নিতে পারে? সে আলোতে যায় মৃত্যু আছে জেনেও!
-মানে কি? মৃত্যু!! এসব কি বলছেন আপনি!!!
-এক মানুষ না মরলে আরেক মানুষ জন্মায় না বাপ। শরীর পুরাতন হইলে শরীর মরে নতুন শরীরের আশায়। আর মন মরলে নতুন মন জন্মায় নতুন মানুষ হয়।
-মানে কি? আমি কিছুই বুঝছি না… কি বলতে চাচ্ছেন?
-মানুষের মন যখন বিক্ষিপ্ত হয় তখন সে নতুন কিছু খোঁজে। পুরানোতে থাকতে থাকতে যখন ক্লান্ত হয়ে উঠে বিরক্ত হয়ে ওঠে তখন সে নতুনের খোঁজে বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আর এই বিক্ষিপ্ততাই নতুনের দিশা দেয়।
অবশ্য বেশিভাগ মানুষ এই সুযোগ হেলায় নষ্ট করে মন খারাপ করে বসে বসে কেবল ভাবে আর মন খারাপ করে। তবে যারা আলোর দিকে হাঁটতে শুরু করে সূর্যের প্রথম কিরণ তার গায়েই লাগে। সূর্যের কিরণে কি আছেন জানেন তো বাপ ভিটামিন ডি।
-তা এই ভিটামিন ডি কি করে পথ দেখায়? হা হা হা…
-সূর্য হইলো এই ধারীত্রি শক্তির উৎস। তার থেকেই তো শক্তি নিতে হয়, প্রেরণা নিতে হয়, নতুনভাবে চলার উদ্দাম তো তার কাছ থেকেই আসে বাপ।
-বাহ্ ভালো বলেছেন তো। একটা কথা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে আপনি কথা বেশ গুছিয়ে এবং মিলিয়ে মিলিয়ে বলেন। বেশ্ বলেন তারপর?
-তারপর কি বাপ। আপনি জানতে চাইছিলেন না গুরুদক্ষিণা কি হইতে পারে?
-হ্যাঁ কথার মারপ্যাঁচে তো তা ভুলিয়েই দিয়েছিলেন। বলেন বলেন আপনার অনেক সময় নিচ্ছি তার একটা বিনিময় হওয়া দরকার নইলে নিজে স্বস্তি পাব না।
-বাপ এই জ্ঞান প্রাপ্ত হইতে হইলে কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য অবশ্য পালনীয়। প্রথম হইলো অল্প জ্ঞান গ্রহণের পরপরই তা পেয়ে গেছি ভেবে বিলাতে না শুরু করা। পাত্র তৈরি না করে যে কাউকে এই জ্ঞানের কথা বললে তা সে নিতে পারে না। আর অপাত্রে এ জ্ঞান গেলে সর্বনাশ।
তাই এই জ্ঞান নিজে পূর্ণভাবে বোঝার বা অনুধাবন করার পর উপযুক্ত পাত্র খুঁজে বা পাত্র তৈরি তা দান করতে হয় পূর্ণভক্তিতে। এভাবেই এই জ্ঞান তার আপন যাত্রা অব্যাহত রাখে। আমি যতটুকু পাইছি তা আমাকে দিয়া যাইতে হইবো। আবার আমার থেকে যে পাইবো তাকেও কাউকে না কাউকে দিয়া যাইতে হইবো।
অবশ্য এই নিজেকে জানার সাধনা প্রত্যেককেই গোড়া থেকে বা বলতে গেলে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। তবে গুরুর জ্ঞানের অভিজ্ঞতার কথা শুনলে নতুন সাধকের অনেক কাজে লাগে। মন বিক্ষিপ্ত কম হয়। তাই গুরুশিষ্য পরম্পরা।
কেউ কেউ গুরুর আদেশের অপেক্ষায় থাকে কখন গুরু কি বলবে তা পালন করবে বলে। অনেকে গুরুর মুখ থেকে আদেশ বাণী বের হওয়ার আগেই তা পালনে ব্যাতীব্যস্ত থাকে। কেউ গুরুর আহার-ভোজনের দিকে নজর রাখে। কেউ গুরুর সাথে ভাবের কথা বলে গুরুরে উৎফুল্ল রাখে।
-বাহ্ এটাও ভালো বলেছেন। আমার পছন্দ হয়েছে। আসলেই প্রত্যেকদিন কত মানুষকে ট্রেনিং দেই। ট্রেনিং দেয়ার সময়ই বুঝি এরা কেউ শিখতে আসেনি এসেছে সার্টিফিকেট নিতে। বা বড় কোম্পানি থেকে শিখছে এই ভাব নিতে আসে। প্রকৃত শিখতে আসে খুবই কম সংখ্যক লোক।
যারা প্রকৃত শিখতে আসে তাদের শিখিয়েও মজা। আপনার এই কথাগুলিও কি জটিলভাবে জেনেছি এতোদিন অথচ আপনি কি সাবলীল সহজ সরল করে বললেন। আসলেই সহজ। মানা কঠিন কিন্তু এতে জটিলতা নেই। আমি মুগ্ধ। কিন্তু আপনি এখনো গুরু দক্ষিণার কথা বললেন না।
-বাপ! গুরুর কাছ থেকে জ্ঞান নিতে চাইলে গুরুর দাস হইতে হয়। আর দাস কি মনিবরে বেতন দেয় বাপ! জ্ঞান প্রাপ্তির জন্য দাস হয়ে গুরুরে পরম ভক্তিতে সেবা দিতে হয়। যে যেমনে পারে। এই ধরেন একজনের কোনো অর্থবিত্ত নাই তাই বইলা কি সে জ্ঞান পাবে না? সেও পাবে কিন্তু সেও মনে মনে ভাবে আমি কি দেই গুরুরে আমার তো কিচ্ছু নাই।
তখন সে গুরুরে ভক্তিভরে কায়িক শ্রম দেয়। গুরুর দেখভাল করে। এটা সেটা করে দেয়। কেউ কেউ গুরুর আদেশের অপেক্ষায় থাকে কখন গুরু কি বলবে তা পালন করবে বলে। অনেকে গুরুর মুখ থেকে আদেশ বাণী বের হওয়ার আগেই তা পালনে ব্যাতীব্যস্ত থাকে। কেউ গুরুর আহার-ভোজনের দিকে নজর রাখে।
কেউ গুরুর সাথে ভাবের কথা বলে গুরুরে উৎফুল্ল রাখে। কেউ সে সব কারণে গুরুর সাধনায় বিঘ্ন হতে পারে তার নিবারনের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে। কারণ গুরু যত মুক্ত থাকবো ততই গুরু সাধনায় ডুব দিতে পারবে। আর ততই জ্ঞান শুদ্ধ থেকে শুদ্ধ হবে। আর সেই শুদ্ধ জ্ঞান গুরু অকাতরে বিলাতেও পারবে।
কিন্তু গুরু কারো কৃপা নিতে নারাজ। তাই গুরু কখনোই ভক্তরে বলতে পারে না বাপ তুই এই জ্ঞানের বিনিময়ে এইটা দিও বা ঐটা দিও। ভক্তরেই খুঁজে নিতে হয় গুরুর কি প্রয়োজন। আর সেই ভক্তই তো শিষ্য হয় সে গুরুর মনের খবর লয়। সাঁইজি বলছেন-
যে জন শিষ্য হয়, গুরুর মনের খবর লয়।
এক হাতে যদি বাজতো তালি
তবে দুই হাত কেন লাগায়।।
গুরু-শিষ্য এমনি ধারা
চাঁদের কোলে থাকে তারা
খাঁচা বাঁশে ঘুণে জ্বরা
গুরু না চিনলে ঘটে তাই।।
গুরু লোভী শিষ্য কামী
প্রেম করা তার সেচা পানি
উলুখড়ে জ্বলছে অগ্নি
জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়।।
গুরু-শিষ্যে প্রেম করা
মুঠের মধ্যে ছায়া ধরা
সিরাজ সাঁই কয়, লালন তেরা
এমনই প্রেম করা চাই।।
-“গুরু-শিষ্য এমনি ধারা, চাঁদের কোলে থাকে তারা” লাইনখানা কিন্তু খাসা জীবন দা। কিন্তু আমি কিছুতেই ক্লিয়ার হলাম না আপনাকে কি দেবো। আপনার প্রয়োজন কি সেটা জানতে গেলে আপনাকে আরো জানতে হবে। যাক সেটা পরে হবে; তা দুপুর তো হতে চললো আজ দুপুরে খাবেন কি? আপনার খাবারের বন্দোবস্ত কি? কোথায় খান?
-বাপ! আমি তাঁর রাস্তায় আছি তিনি খাওয়ালে খাই না খাওয়ালেই খাই না।
এখন তো বাড়িতে মেহমান আসলে শরীর জ্বলে যায়। মুখে বলতে পারি না কিন্তু না যাওয়া পর্যন্ত মেজাজ বারোটা বেজে থাকে। আর অনাকাঙ্খিত অতিথি হলে তো কথাই নাই। আপনাকে বিশ্বাস করে একটা কথা বলছি জীবন দা’ আজকাল বাবা-মা হুটহাট করে ফ্ল্যাটে চলে আসলেও মেজাজ খারাপ হয়।
-জীবন দা’ মেজাজটা যথেষ্ঠ ভালো আছে এখন এটাকে আবার খিঁচকে দিবেন না প্লিজ। আবার আপনি সেই ভাবের কথা শুরু করছেন। আরে এ সংসারে কাজ না করলে কেউ কাউকে খাওয়ায় না। কারো জন্য রেধে কেউ অপেক্ষা করে না। এককালে শুনেছি আমাদের গ্রামের বাড়িতে বৈঠকখানা ঘর ছিল।
অজানা অতিথিদের জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হতো তারপর রাতের রান্না বসানো হতো। তারপরও যদি অগুন্তুক অতিথি চলে আসতো তাও তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। থাকার আয়োজন চলতো। কিন্তু সেসব পাঠ কবে চুকে বুকে গেছে। এখন তো বাড়িতে মেহমান আসলে শরীর জ্বলে যায়।
মুখে বলতে পারি না কিন্তু না যাওয়া পর্যন্ত মেজাজ বারোটা বেজে থাকে। আর অনাকাঙ্খিত অতিথি হলে তো কথাই নাই। আপনাকে বিশ্বাস করে একটা কথা বলছি জীবন দা’ আজকাল বাবা-মা হুটহাট করে ফ্ল্যাটে চলে আসলেও মেজাজ খারাপ হয়। এসেই ব্যক্তিগত জীবনে ঢু মারতে শুরু করে। নেহায়াৎ বাবা-মা তাই কিছু বলতে পারি না। তবে বাবা মা তো ঠিকই বুঝে নেয়।
দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরিয়ে জীবন দা’র দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা উদাস কণ্ঠে বললো, -তা আজ সকালে কে খাওয়ালো আপনাকে?
চায়ের দোকানিকে দেখিয়ে জীবন দা’ বললো, -এই বাপ সকালে সেবা দিয়েছে।
পান খাওয়া লাল মুখে থুতনীতে এক গোছা দাঁড়ি, ছিপছিপে গড়নের লম্বা দোকানির দিতে তাকিয়ে অগ্নি বললো- মামা আপনি জীবন দা’কে খাইয়েছেন?
দোকানি পিচ করে একগাদা পিক ফেলে বাম হাত উল্টা পিঠ দিয়ে মুখ মুছে ফিক করে একটা হাসি দিয়া বললো, আমি কি আর খাওয়ানের মালিক স্যার? যার খাওয়ানের তিনি খাওয়ান আমি তো উছিলা মাত্র। বাপজি এই দিকে আসলে আমার দোকানে একটু বসে পার্কে বইসা গান বাদ্য করে মনটা ভইরা যায়।
পরানটা ঠাণ্ডা হয়। আমি গরিব মানুষ বাপজির সেবা তো করতে পারি না। আল্লাহ তো আমারে সেই তৌফিক দেয় নাই। আমি যা পারি তাই সেবা দেই। দোয়া করবেন ভাইজান চিরদিন যেন সেবা করতে পারি।
-আজকে হলো কি? সব দার্শনিকের সাথে দেখা হচ্ছে একের পর এক। জীবন দা’ আপনি কি আপনার চারপাশের সব মানুষরে দার্শনিক বানানোর কাজে হাত দিয়েছেন নাকি? লেখক হুমায়ুন আহমেদের নাম শুনেছেন? তিনি হলুদ পাঞ্জাবী পরা এক ক্যারেক্টার বানিয়েছিল যে মানুষকে বিভ্রান্ত করে বেড়াতো। আপনি কি সেই দলের লোক নাকি জীবন দা’?
-বাপ! দলাদলিতে আমি নাই। আমার গুরু বলতেন যা কিছু অর্জন করবা তা জমায়া রাখবা না। সবকিছুই উপযুক্ত পাত্রে দান করে দিবা। আমি গুরুর আদেশ মাথায় নিয়া ঘুইরা বেড়াইতেছি। এরবেশি তো কিছু জানি না।
-জীবন দা’ আপনি অদ্ভুত মানুষ। আপনি কি তা এখনো আমার কাছে পরিস্কার না। আপনার উদ্দেশ্য কি তাও আমি জানি না। তবে প্রতিদিন আমি যে সব মানুষের সাথে সময় শেয়ার করি তারা প্রত্যেকেই আমার মতো মুখোশ পরা। মুখে এক কথা আর অন্তরে আরেক কথা।
তার আগে আরেকটা গান শোনান আমি আরেকটা চা খাবো। চা’টা সত্যই দারুণ হয়েছে। বহুদিন এতো সস্তা দোকানে চাই খাইনি। তাই হয়তো এর স্বাদ ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি গান ধরেন জীবন দা’।
ঘর-পরিবার-পরিজন-অফিস-বন্ধু-বান্ধব-পরিচিত-অপরিচিত সবাই একই রকম। কারো কাছে যেয়েই নিজেকে পূর্ণ প্রকাশ করতে পারি না। সকলেই মুখোশ আটা। যদিও আপনিও একটা মুখোশ পরে আছেন; তবে আপনার মুখোশটা আমাদের মতো সস্তা বা খেলো নয় এটুকু বুঝতে পারছি।
আপনি যদি ভণ্ড হন তাও আপনি অনেক বড় মাপের ভণ্ড। আর যদি সত্যি সত্যি আপনার মধ্যে শুদ্ধতার চর্চা থাকে। আপনি যা বলছেন তা যদি সত্যি সত্যি বিশ্বাস থেকে বলে থাকেন তাহলে আপনার কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।
একটু থেমে সিগারেটের ফিল্টারের কাছাকাছি চলে আসা আগুনটাকে উস্কে দিয়ে কোষে একটা টান দিয়ে অগ্নি বলতে লাগলো, -প্রতিদিন প্রতিবেলা আপনাকে কে খাওয়ায় আমি জানি না। তবে আজ আমি আপনাকে দুপুরে খাওয়াতে চাই। না আসলে আপনার সাথে আমিও দুপুরে খেতে চাই।
সেটা আমার পছন্দের কোনো হোটেলে নয়। আপনি যেখানে খেতে চাইবেন সেখানেই খাওয়া হবে। দেখি আপনার সাঁইজি আজ আপনাকে কোথায় খাওয়ায়। আপনাকে খাওয়ানোর জন্যই আমি এসেছি নাকি আমার সাথে খাবেন বলে আপনি এসেছেন সে ভাবের হিসেব পরে হবে।
তার আগে আরেকটা গান শোনান আমি আরেকটা চা খাবো। চা’টা সত্যই দারুণ হয়েছে। বহুদিন এতো সস্তা দোকানে চাই খাইনি। তাই হয়তো এর স্বাদ ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি গান ধরেন জীবন দা’।
-বাপ! হঠাৎ করে বললে গান মনে আসে না। তবে সাঁইজির গান কিন্তু আসলে গান না; এ হলো জ্ঞান। এই দুনিয়াদারী সবই খেলা-সবই লীলা। এই জ্ঞানের লীলায় একবার ডুবে গেলে বাপ তখন আর জাত-কুল-মানের ভয় থাকে না। কেবল আনন্দ আর আনন্দ। তবে এই লীলায় ডুবতে জানতে হয়। তার লীলা বোঝা সহজ না বাপজি। সাঁইজি নিজেই বলছেন-
সাঁইর লীলা বুঝবি ক্ষ্যাপা কেমন করে।
লীলা যার নাইরে সীমা
কোন সময় কোন রূপ ধরে।।
আপনি ঘরা আপনি ঘরি
আপনি করে রসের চুরি, ঘরে ঘরে,
আপনি করেন মেজেষ্টারী
আপনি পায়ে বেড়ী পড়ে।।
গঙ্গায় গেলে গঙ্গা জল হয়
গর্তে গেলে কূপজল কয়, বেদ বিচারে
তেমনি সাঁইয়ের বিভিন্ন নয়
জানায় পাত্র অনুসারে।।
একটি নদী অনন্ত ধারা
তুমি আমি নাম বেওয়া, ভবের পরে
সিরাজ সাঁই কয় অবোধ লালন
জানলে ধাঁধা যেত দূরে।।
(চলবে…)
<<লালন বলে কুল পাবি না: দুই ।। লালন বলে কুল পাবি না: চার>>
……………………..
স্থিরচিত্র কৃতজ্ঞতা : সুমন কুমার সাহা
.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট
সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট