-জগদীশচন্দ্র রায়
কৃষিকার্যে কভু কেহ করিও না হেলা।
মদ গাঁজা খেয়ো নারে ছাড় জুয়া খেলা।।
(গুরুচাঁদ চরিত পৃ: ৫২৯)
তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে বৈদিকবাদী শোষণযন্ত্রের মাধ্যমে যাদেরকে সামাজিক, আর্থিক প্রগতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে অন্ধ ধর্মীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল; গুরুচাঁদ ঠাকুর তাদের প্রগতির উদ্দেশ্যে বলেছেন, কৃষিকাজ অর্থাৎ ফসল ফলানো হচ্ছে প্রধান কাজ।
সেই কাজে কোনো অবহেলা করা উচিত নয়। আর সমাজের প্রগতির ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হচ্ছে নেশা। সেই নেশাগুলো হচ্ছে মদ, গাঁজা আর জুয়া খেলা। এই নেশা থেকে তিনি সকলকে দূরে থাকতে বলেছেন। কারণ এই নেশার কবলে যে একবার পড়বে, তার জীবন সমূলে নষ্ট হয়ে যাবে।
গুরুচাঁদ ঠাকুর ব্যক্তিজীবন, পরিবার, সমাজকে কলুষমুক্ত করতে তৎকালীন বৈদিক সামাজিক বিধানের বিরুদ্ধে জনআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তার মধ্যে ছিল বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিদ্রোহ।
বাল্যকালে পুত্র কন্যা বিয়া নাহি দিবে।
পথ ঘাট ঘর দ্বার পবিত্র রাখিবে।।
(গুরুচাঁদ চরিত্র পৃ-৫২৯)
তৎকালীন বৈদিক সমাজ ব্যবস্থায় ছেলে মেয়েদের অল্প বয়সে বিবাহ দেবার প্রবণতা ছিল। বাল্যকালে অর্থাৎ ৮-১২ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের সমাজ, পরিবার বা জীবনযাত্রা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু ঐ বয়সে বিবাহ দেওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হত।
যার প্রধান সমস্যা ছিল শারীরিক ও মানসিক অপূর্ণতা। আর এই বয়সে বিবাহের ফলে তারা শিক্ষা নামক জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত হত। যেটা পরবর্তীকালে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের উপর ভীষণ খারাপ প্রভাব ফেলত।
তবে তৎকালীন সময়ে ছেলেদের অপেক্ষা মেয়েরা বাল্য বিবাহের শিকার হত বেশি। নাবালিকাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হত। এর ফলে ঐ নাবালিকা বধূর জীবনে যে সব সমস্যা হত সে বিষয়ের প্রতি কিছুটা আলোকপাত করছি-
১. নাবালিকা বধূ বয়স্ক পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ত। বয়:সন্ধির উপযুক্ত সময় না হওয়ার পূর্বেই বধূ হয়ে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য হওয়ার ফলে তাদের অনেকক্ষেত্রে গর্ভধারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেত।
এর ফলে অনেক বাল্যবিবাহিত বধূকে নি:সন্তান জীবন কাটাতে হত। যেটা অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণিত সত্য। আর এর পরিণতি স্বরূপ তাদের স্বামীরা পুনরায় বিবাহ করত। তখন ঐ বাল্যবিবাহের বলি বধূর জীবন হয়ে উঠত আরো দুর্বিষহ।
একজন সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুচাঁদ ঠাকুর বুঝেছিলেন, উপরে বর্ণিত এই ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধির মূল কারণ হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বিশেষ করে নাবালিকাদের বিবাহ। তাই এই সমাজ ও পরিবার কল্যাণের দূত বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।
২. বাল্যবিবাহের শিকার যেসব রমণীরা স্বল্প বয়সে মা হত, তাদের অধিকাংশ সন্তান জন্মের আগে বা পরে মাতা যেত। তাই দেখা গেছে এই রমণীগণ ১৫-১৬টি সন্তানের জন্ম দিলেও ৪-৫টি সন্তানের বেশি বেঁচে থাকতো না। তবে ব্যতিক্রম খুব কম ছিল। শুধু সন্তান নয়, সন্তান প্রসবকালেও অনেক বধূর মৃত্যু হত।
৩. তৃতীয় সমস্যাটি ছিল ভয়ঙ্কর। একটা বিরাট অংশের নাবালিকা বধূর স্বামীরা হত বয়স্ক বা অতি বয়স্ক। ফলে ঐ নাবালিকা বধূরা যখন পূর্ণবয়স্কা হত তখন তাদের স্বামীরা ততদিনে অক্কা পেত। ওই পূর্ণবয়স্কা বিধবার সব ধরণেল আশা-আকাঙ্খা রয়ে যেত অপূর্ণ।
যার পরিণতি স্বরূপ বহু রমণী বিপথগামী হত স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। কখনো পুরুষতান্ত্রিক বৈদিকবাদী সমাজের রিপু আশ্রিত পুরুষের অনৈতিক কামানার শিকার হতে হত। আবার কখনো ঐ বিধবা রমণীরা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার জমিদার বা বিত্তশালী ব্যক্তিদের রক্ষিতা নামে আশ্রিতা হতে বাধ্য হত।
কেউ কেউ আবার বৈদিক মন্দিরে সেবাদাসী হতে বাধ্য হত। তাদের নিয়ে মনোরঞ্জন করত মন্দিরের পূজারী, সমাজপতি বা ভণ্ড সাধুরা।
একটি বড় অংশের এই পূর্ণ বয়স্কা বিধবাদের আশ্রয় হত নিষিদ্ধ পল্লীতে। তৎকালীন সমাজের নিষিদ্ধ পল্লীর প্রায় সমস্ত রমণীগণ ছিল বাল্যবিবাহের শিকার। আর এরা বেশিরভাগ ছিল কায়স্থ ও ব্রাহ্মণ পরিবারের। যারা কৌলীন্য প্রথার শিকার হয়ে ছিল। (তথ্য: অন্বেষণ, প্রথম খণ্ড, শিপ্রা বিশ্বাস, পৃ-২০৯)
একজন সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুচাঁদ ঠাকুর বুঝেছিলেন, উপরে বর্ণিত এই ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধির মূল কারণ হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বিশেষ করে নাবালিকাদের বিবাহ। তাই এই সমাজ ও পরিবার কল্যাণের দূত বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।
তিনি এ বিষয়ে সমস্ত সম্প্রদায়কে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। যার ফলে আমরা দেখতে পাই, মতুয়া তথা হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের দর্শন ও আদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যে বিধবার সংখ্যা সব থেকে কম। তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই থেমে থাকেন নি। যে সব বাল্য বিবাহিত ও প্রাপ্তবয়সে বিবাহিত মহিলারা বিধবা হয়েছেন তাদের পুনর্বিবাহের ব্যবস্থাও করেন।
এই সমাজবিজ্ঞানীর আর একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে-
‘পথ ঘাট ঘর দ্বার পবিত্র রাখিবে।’
এখানে ‘পথ ঘাট’-এর অর্থ কিন্তু শুধুমাত্র যাতায়াতের রাস্তা নয়। প্রথম লাইন ‘বাল্যকালে পুত্র কন্যা বিয়া নাহি দিবে’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যদি বিচার করি তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে, এই ‘পথ ঘাট’ এর অর্থ হচ্ছে, সামাজিক ক্ষেত্র।
‘ঘর দ্বার’-এর ঘর মানে পারিবারিক ক্ষেত্র। অর্থাৎ সামাজিক ক্ষেত্রে ও পারিবারিক ক্ষেত্রের সুস্থতা এবং পবিত্রতার অতন্ত্র প্রহরী হচ্ছে বধূরূপী রমণী বা নারী। তাই বাল্যবিবাহ বন্ধ হলে পূর্ণ বয়সকালে বিধবা হবার সম্ভাবনা খুবই কম হবে।
কিন্তু মতুয়া সমাজসহ সব পিছিয়ে রাখা মূলনিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলা সহ ভারতবর্ষে বৈদিক চক্রান্ত ভেদ করে আলো দেখানোর অন্যতম দিশা হচ্ছে, হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের বৈপ্লবিক ও সমাজ সংস্কারমূলক অবৈদিক মতুয়া দর্শন।
তবেই পথ-ঘাট-ঘর-সমাজ ও পরিবার থেকে ব্যভিচার মুক্ত হয়ে পবিত্র ও সুস্থ জীবন যাপন করতে পারবে। এটাই গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভাবনার অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা ও উপদেশ।
পক্ষান্তরে আমরা যদি বৈদিকবাদের দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাবো- নারীকে ‘নরকের দ্বার’ বলে অপমানিত করা হয়েছে। দু:খের কথা এটাই, এখনও আমরা হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের নারীমুক্তির সংগ্রামকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পেরে বৈদিকতার জালে ফেঁসে আছি।
তাই এই বৈদিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সঠিক মতুয়া দর্শনকে নিজেদের জীবনে কমের মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে হবে।
গুরুচাঁদ ঠাকুর যে বৈদিক বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, তার পরিণতিতে পরবর্তীকালে ভারত সরকার তাঁর (গুরুচাঁদ ঠাকুর) এই সমাজ শিক্ষার প্রতি মান্যতা দিয়ে নূনতম মেয়েদের ১৮ বছর এবং পুরুষের ২১ বছর বয়সে বিবাহের আইন করেন।
যদিও বাংলার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় এখনো অনেক বাল্যবিবাহ ঘটছে। বাংলায় এর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট কম। তার নেপথ্য কারণ হচ্ছে, মতুয়া দর্শনের রূপকার গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম।
যদিও গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই সমাজ সংস্কারের দূরদর্শিতা ও সংগ্রামে ইতিহাস শাসকবর্গ মানুষকে জানাতেই চায় না। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজ সংস্কার ও বিপ্লবী মতুয়া দর্শনকে তারা প্রকাশের আলোয় আনতে চায় না।
কিন্তু মতুয়া সমাজসহ সব পিছিয়ে রাখা মূলনিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলা সহ ভারতবর্ষে বৈদিক চক্রান্ত ভেদ করে আলো দেখানোর অন্যতম দিশা হচ্ছে, হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের বৈপ্লবিক ও সমাজ সংস্কারমূলক অবৈদিক মতুয়া দর্শন।
সমগ্র মানব সমাজকে সুস্থ ও সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অন্যতম দিশা-দর্শন অবৈদিক মতুয়া দর্শন।
রাস্তা ঘাট পায়খানা কর বন্দোবস্ত।
এ সব জিনিষ কিন্তু লাগিবে প্রশস্ত।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৫৬৯)
আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসে স্বচ্ছ ভারতের শ্লোগান শুনতে পাচ্ছি। যার বাস্তবায়ন কতটা সেটা প্রশ্নাতীত। আর প্রায় ১০০ বছর পূর্বে গুরুচাঁদ ঠাকুর সমাজ শিক্ষার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন যে, প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত সন্তানদের যেন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা না হয়।
বাল্যবিবাহকে তিনি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছেন। আর প্রতি পরিবারকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার কথা বলেছেন। ঘরে ঘরে শৌচালয় বানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, ঘরে ঘরে শৌচালয় থাকলে কেউ আর মাঠে ঘাটে বা রাস্তার পাশে শৌচকর্ম করবে না।
এসব জায়গায় শৌচকর্ম করলে বিভিন্নভাবে সংক্রামণ জাতীয় রোগ হওয়ার অতি সম্ভাবনা থাকে। সে জন্যই তিনি পথ ঘাট ঘরকে পবিত্র করে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরো নির্দেশ দিয়েছেন, রাস্তা ঘাট পায়খানা শুধু তৈরি করলেই হবে না। সেগুলো কিন্তু প্রশস্ত হতে হবে। অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর হতে হবে।
……………………………
স্থিরচিত্র: ফয়েজ আহমেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন
তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর
……………………………
আরো পড়ুন:
মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া
বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বর্ণবাদীদের গাত্রদাহ
ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
বিধবাবিবাহের প্রচলন ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
……………………………
গুরুচাদ ঠাকুরের সমাজসংস্কার ও মুক্তির দিশা