ভবঘুরেকথা
মাওলা আলী সূফী সুফি

-কাজী দীন মুহম্মদ

বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ, গীতা ইত্যাদির মতের সঙ্গে কিঞ্চিৎ মিল দেখা যায় বলেই ইসলামী তাসাউফে এ ধারাণাকে বিশিষ্ট উদ্বৈতবাদ বা গীতার অনুকরণ মনে করা ভুল হবে।

রসুল সর্বশেষ নবী। তার পরেও মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়নি, এমন নয়। কিন্তু তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হজরতের সমান হতে পারেনি। তা কেউ দাবীও করেননি। প্রাচীন ধর্মমতসমূহ যেমন, খৃষ্টান, ইহুদী, বৌদ্ধ এসব ধর্মেরও তৎকালীন সম্পূর্ণতা ছিল।

কিন্তু কালের গতিতে বিশ্বের সব কিছুকে নিয়ে যতদিন কেয়ামত না হয় ততদিনের জন্য সব দেশের ও সবকালের মতামত মনুষের উন্নতি অবনতি, স্বাভাবিক জীবন যাপন সম্বন্ধে ইসলামের নির্দেশ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাকে অনায়াসে সম্পূর্ণাঙ্গ জীবনপদ্ধতি বলা চলে।

দীন মানে যদি জীবনপদ্ধতিই হয়, সত্যিকার জীবন যাপন প্রণালীই হয়, তবে সে জীবন পদ্ধতির চরম বিাকাশ পরিব্যাপ্তি ও প্রসার ইসলাম এনে দিয়েছে। মানবতার স্বাভাবিক পরিশীলন পরিবর্ধন প্রাকৃতিক নিয়ম- হককুল্লাহর পরিপোষক নির্দেশ ইসলামী বিধানে রয়েছে।

এ জন্যই কোরানে অন্যান্য ধর্ম বিধানের স্বীকৃতি রয়েছে এবং পরিশেষে বলা হয়েছে- ‘আলইয়াওমা আকমালতু লাকুম দীনাকুম ওয়া আতমামতু আলায়কুম নেয়মাতী ওয়ারাদিইতু লাকুমুল ইসলামা দীনা।’ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম, আর ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম মনোনীত করলাম।

এ বিশেষ পথে ক্রমবিকাশ কয়েকটি স্তরের মধ্যস্থতায় সম্ভব, তাই শরিয়তের পরে তরিকত, হকিকত এবং শেষ পর্যায়ে মারিফাত এভাবে নির্দেশ করা হয়েছে। মারিফাত শব্দের অর্থ জ্ঞান, জানা ; যে জানায় বিশ্বকে জেনে নিজের মধ্যে বিশ্বকে পুরে নিজেকে জানার মাধ্যমে পরম প্রতিপালক স্রস্টাকে জানা যায়।

প্রাচীন ধর্মমতসমূহেও জীবনের সমাধান রয়েছে। কিন্তু তা বিশুদ্ধ চরম বা perfect নয়। কৃষ্ণ বুদ্ধ ঈসা (আ) মুসা (আ) এদের পরে এদের সমগ্র গুণাবলী নিয়ে হজরত মুহম্মদের (দ) জন্ম।

হজরত আবু বকর (রা), হজরত ওমর (রা), হজরত ওসমান (রা), হজরত আলী (রা) এবং পরবর্তীকালে ইমামগণ হজরতের নূর থেকেই আলো পেয়েছেন ও তারই ব্যাখ্যাত জীবন ব্যবস্থার ব্যাখ্যা করেছেন। শংকর, নানক, কবির আকবর, চৈতন্য, রামমোহন, রামকৃষ্ণ- এরাতো আরো পরের, পরবর্তী ব্যাখ্যাতা মাত্র।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, রসুলের পরে আর নবী বা রসুল কি আর আসবেই না? তবে মানুষ ধর্ম লাভ করবে কি করে? এক একজন নবীর যে প্রভাব, ধর্ম-জীবন গঠনের পক্ষে যার একান্ত প্রয়োজন তা কি করে সম্ভব হবে? প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামই প্রকৃত শেষ ধর্ম যার পরে আর ধর্মমত সংস্কারের প্রয়োজন হলেও নবী বা রসুলের প্রয়োজন হবে না।

ইসলামের দুটি দিক বা ভাগ রয়েছে-এক, বহিরঙ্গ বা ব্যবহারিক দিক বা শরিয়ত। সর্ব সাধারণোপযোগী তার সংজ্ঞা। অপর অন্তরঙ্গ বা মা’রিফাত বিশেষ অনুশীলনী নির্ভর বিশেষোপযোগী তার সূত্র। সাধারণ পন্থায় সম্যক শান্তিলাভ, আত্মোৎকর্ষ এবং আত্মোৎসর্গ সম্ভবপর নয় বলেই মারিফাত বা বিশেষ পন্থার প্রয়োজনীয়তা।

এ বিশেষ পথে ক্রমবিকাশ কয়েকটি স্তরের মধ্যস্থতায় সম্ভব, তাই শরিয়তের পরে তরিকত, হকিকত এবং শেষ পর্যায়ে মারিফাত এভাবে নির্দেশ করা হয়েছে। মারিফাত শব্দের অর্থ জ্ঞান, জানা ; যে জানায় বিশ্বকে জেনে নিজের মধ্যে বিশ্বকে পুরে নিজেকে জানার মাধ্যমে পরম প্রতিপালক স্রস্টাকে জানা যায়।

এই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান এবং সব জ্ঞানের পরিণত রূপ এবং এই জানা প্রকৃত জানা বলেই সুফিমতে একেই মারিফাত বলা হয়।

হালাল এবং হারাম স্পষ্ট আদেশ এবং নিষেধ। সুতরাং এ দুটো মাহকামেরই অন্তর্গত। আর মিছালও মূলত: রূপক, সুতরাং মোতাশাবেহ্। কোরানকে অর্থাৎ কোরানের হুকুমকে ব্যাখ্যা করার জন্যে হাদিসের প্রয়োজন। সুতরাং এ সবই হাদিসের বিষয়বস্তু এবং হাদিসেই এ সবের মূল ব্যাখ্যা বা সম্প্রসারণ।

অনেকের ধারণা সুফিবাদ ইরান থেকে আরবে আমদানী হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখিয়েছি কি করে প্রকৃত ইসলাম তথা সুফিবাদও হজরত রসুলুল্লাহ থেকেই বিশ্বে প্রসারলাভ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে সুফিবাদের ব্যাখ্যা ও অনুশীলনী হজরতের বহু পরে ইরানের স্বর্ণযুগে তথায় পরিশীলিত হয়েছিল।

আর পারস্য সাহিত্য এবং ইরানী সুফিবাদের প্রভাবে প্রভাবিত অলি-আউলিয়াদের মাধ্যমে এ বিশেষ প্রক্রিয়া আমাদের দেশে প্রচারিত হয়। পারস্য সাহিত্যের ভাবধারার শ্রেষ্ঠ সম্পদ এই সাফিবাদে অভিব্যক্তি লাভ করেছে। ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসি, সাদী, জামি, রুমি-সকলেই এ সত্যের পথিক, সাধক, ভাবুক এবং সুফিবাদের প্রত্যক্ষ অনুশীলনকারী।

এ কথা আগেই বলা হয়েছে যে, ইসলামী মতে সুফি নিজেকে প্রেমিক এবং স্রষ্টাকে প্রেমময় মনে করেন এবং সে ভাবে রূপকের ব্যবহারিক স্বরূপে তা অভিব্যক্ত করেন। ভারতীয় বাবধারায় ভাগবতের অনুসারী বৈষ্ণব অনুরূপভাবেই ভগবানকে প্রেমময় প্রেমিক এবং নিজেকে প্রেমিকার আসনে বসিয়ে ধ্যান করেন।

এ দু ধারায় পার্থক্য বিস্তর। এ পার্থক্য কেবল প্রকিয়ার পার্থক্র নয়-বিশ্বাস এবং প্রবণতার পার্থক্যও। শরিয়ত কোরান-হাদিসের জাহেরি শিক্ষা। পাঁচ রকমে শরিয়তকে আলেকগণ ব্যাখ্যা করেছেন- হালাল- বৈধ, হারাম- নিষিদ্ধ, মাহকাম- স্পষ্ট, মোতাশাবেহ-রূপক, মিছাল- দৃষ্টান্ত।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে ‘হারফে মোকাত্তেয়াত’ মানে সংকেত অক্ষর, যেমন আলিফ-লাম-মিম ইয়াসিন ইত্যাদি মোতাশাবেহ থেকে আলাদা নয়।

হালাল এবং হারাম স্পষ্ট আদেশ এবং নিষেধ। সুতরাং এ দুটো মাহকামেরই অন্তর্গত। আর মিছালও মূলত: রূপক, সুতরাং মোতাশাবেহ্। কোরানকে অর্থাৎ কোরানের হুকুমকে ব্যাখ্যা করার জন্যে হাদিসের প্রয়োজন। সুতরাং এ সবই হাদিসের বিষয়বস্তু এবং হাদিসেই এ সবের মূল ব্যাখ্যা বা সম্প্রসারণ।

(চলবে…)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………..
আরো পড়ুন:
সূফীবাদের গোড়ার কথা: এক
সূফীবাদের গোড়ার কথা: দুই
সূফীবাদের গোড়ার কথা: তিন
সূফীবাদের গোড়ার কথা: চার
সূফীবাদের গোড়ার কথা: পাঁচ
সূফীবাদের গোড়ার কথা: ছয়
সূফীবাদের গোড়ার কথা: সাত
সূফীবাদের গোড়ার কথা: আট

সূফীবাদের গোড়ার কথা: নয়

…….
১. Maxmuller, Indian Philosophy, page 895
২. ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহি- আল কোরান।
৩. ওয়া ইজা আরাদা শাইয়ান আঁইয়াকুলা-লাহু কুন ফাইয়াকুন- আল কোরান।
৪. রবীন্দ্রনাথ।
৫. lower self এবং higher self কথাগুলো পাশ্চাত্য দর্শনের। আমাদের বিবেচনায় এ দুটোও প্রমাদপূর্ণ। কারণ self, self-ই। এর lower এবং higher নাই। যা আছে তা aspect এর বিভিন্নতা।
৬. আল-হাদিস
৭. আল কোরান।
৮. আনাল হক: আমিই সত্য; অহং ব্রহ্মাষ্মি : আমিই ব্রহ্ম; সো অহং : সেই আমি, আমিই সে।
৯. যুগে যুগে সম্ভবামি: গীতা।
১০. ইনি ৮৩০ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
১১. ইনি ৮৬০ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!