ভবঘুরেকথা

-কাজী দীন মুহম্মদ

উভয়ের মূল উৎস সেই একমেবইদ্বতীয়ম বা পরম পুরুষ। জড় বা প্রকৃতি চিৎ বা আত্মার বিধা বা প্রকার নয়, বরং চিৎ বাতেন (গুপ্ত) এবং প্রকৃতি বা জড় তার বহি:প্রকাশ বা জাহেরী রূপ মাত্র। কোরান বলে, ‘হুয়াল আউয়ালূ ওয়াল আখেরু, হুয়াজ্জাহেরু ওয়াল বাতেনু’ : তিনিই আদি ও তিনিই অন্ত এবং তিনিই ব্যক্ত ও তিনিই অব্যক্ত (গুপ্ত ও প্রকাশিত)।৭

সেরূপ মানুষের আত্মা বাতেন, মানবদেহ আত্মার বহি:প্রকাশ- জাহের। পরমাত্মা ও মানবাত্মায় এবং সৃষ্টি ও মানবদেহে সাদৃশ্য আছে বলেই আত্মা ও পরমাত্মার মিলন সম্ভবপর। হজরত রসুলে করীম (সা) বলেন, ‘কুল্লু শায়য়িন ইয়ারজেউ ইলা আসলিহি।

প্রত্যেক বস্তুই তার মৌল সত্তায় ফিরে যায়। কোরান বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন। আমাদের সকলের আগমন আল্লাহ থেকে আল্লাহরই জন্য এবং তার দিকে, তাতেই প্রত্যাবৃত্ত হতে হবে। এ প্রত্যাবর্তন স্বীয় উৎস বা আসলের দিকেই প্রত্যাবর্তন।

আল্লাহ থেকে যে নূরে মুহম্মদীর প্রকাশ সে নূরে মুহম্মদীরই প্রকাশ সর্বত্র। হজরত মুহাম্মদ (সা) এ নূরুল্লাহ, নূরে মুহম্মদী রূপে বিশেষ বিকাশ লাভ করেছিল বলে বিশ্বের আদর্শ এবং শেষ পয়গশ্বর হতে পেরেছিলেন। এ নূরে মুহম্মদীই আউলিয়া আবদালের মধ্যেও বিকাশ লাভ করে।

তাই তারাও আল্লাহর দীদার বা সাক্ষাৎকার প্রাপ্ত হন এবং মিলন লাভ করেন। কিন্তু কেবলমাত্র সাক্ষাৎলাভ বা মিলনেই তিনি আল্লাহ হয়ে যান না, বরং তিনি আল্লাহতে বিলীন হওয়ার আনন্দে বিহ্বল হন। কিন্তু দেহের পার্থক্য এবং মৃত্যুর পরেও অবয়ব বা অস্তিত্বের পার্থক্য (separate entity) একেবারে ঘুচবার নয়।

তাই, তাকে বিচ্ছেদ অনুভব করতে হয়্ অথচ তাও যে বিরাটের অন্তের কৎচিৎ বিভাব, স্বভাব, প্রকৃতি, গুণ, জ্ঞান ও শক্তিলাভে পরিপুষ্ট সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তাই বলে তা কোন ক্রমেই গীতায় ব্যাখ্যাত বিরাট বা অসীমরে অবতার বা যুগে যুগে জন্মলাভ নয়।

তার ধারণা হতে পারে সে একটি ক্ষুদ্র অগ্নিশিখা, এক বিরাট অগ্নিকুণ্ডে নিপতিত হলো। তাতে পরিণামে সেই অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো।৮ কিন্তু তার জ্ঞান ও গুণ, ‘জাত ও সিফাত’ কখনই অনুরূপ বিরাট বা পূর্ণ হতে পারে না। বিরাটের যে স্তরে সে একীভূত হলো সে গণ্ডি অতিক্রম করা সহজসাধ্য নয়। যদি বা যুক্তির খাতিরে মেনে নেওয়াও

যায় যে, তা হয়ত সাধ্যের অতীত নয়। কিন্তু বিরাটের সর্বত্র, সব রহস্যের অন্ত:প্রদেশে সে ছড়িয়ে পড়তে, পৌছে যেতে পারে কি না, তা আদৌ সম্ভবপর কিনা সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। মিলনের অবস্থা একটা আত্মহারা আত্মলয়ের অবস্থা।

সুফীদের পরিভাষা একে ফানা ফিল্লাহ বা আল্লাহতে আত্মলীন হওয়া এবং বাকা বিল্লাহ বা আল্লাহর মধ্যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অর্থাৎ তার অস্তিত্বে নিজের অস্তিত্ব লোপ করা, বলা যায়। এ এক অভূতপূর্ব অবস্থা। কিন্তু তাকে তো ভৌতিক দেহের চেতন লোকে বা জাগতিক কার্যকলাপে ফিরে আসতে হয়।

তাই, তাকে বিচ্ছেদ অনুভব করতে হয়্ অথচ তাও যে বিরাটের অন্তের কৎচিৎ বিভাব, স্বভাব, প্রকৃতি, গুণ, জ্ঞান ও শক্তিলাভে পরিপুষ্ট সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তাই বলে তা কোন ক্রমেই গীতায় ব্যাখ্যাত বিরাট বা অসীমরে অবতার বা যুগে যুগে জন্মলাভ নয়।৯

তুলনায় আল্লাহ ও বান্দার সম্পর্ক, রসুল ও নূরে মুহম্মদীর সম্পর্ক, খালেক ও মাখলুকের সম্পর্ক এবং এর যোক্তিকতা অত্যন্ত স্পষ্ট। অবম্য মোতাজিলা, আল আশআরি, বাতেনিয়া প্রভৃতি মুসলিম স্বাধীন চিন্দাবিদদের মতবাদের সূক্ষ্ম তার্কিকতায় আমরা প্রবেশ করছি না।

তাই তার পক্ষে কারো পিতা হওয়া বা পুত্র হওয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন সিদ্ধ নয়।

তিনি সসীম মানবীয় কার্যকলাপের বাইরে অসীম। সসীম অসীম থেকে কিঞ্চিৎ জ্ঞান, গুণ, সান্নিধ্য, শক্তিলাভে সমর্থ। বৌদ্ধের নির্বাণ বা শূন্যবাদও এ সথ্যের আলোকে শূন্যেই মিলিয়ে যায়। ইসলাম এভাবে প্রাচীন ও আধুনিক সব ধর্মের গোঁড়ামি, গোঁজামিল ও অস্পষ্টতাই দূরীভূত করেছে।

হজরত রসুলে করীমের (সা) আগে নূরে মুহম্মদী এবং তার জ্ঞানের, মারিফাতের এরূপ চরম বিকাশ লাভ ঘটেনি বলে ধর্মে অপূর্ণতা ছিল, অস্পষ্টতা ছিল, এবং সর্ব যুগে সর্ব দেশে এ অস্পষ্ট বিকাশই ধর্মকে পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত রেখেছিল। ইসলাম নানা প্রদীপের মিটি মিটি আলোর প্রভাবে এক নিমেষে সূর্যোদয়ের মত স্পষ্ট, সুষ্ঠু ও সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তুলল।

কোরান বলছে: ‘ফিৎরাতুল্লাহিল্লাতি ফাতারান্নাসা আলাইহা’ -আল্লাহ তায়ালার প্রকৃতিই সে প্রকৃতি যা দিয়ে মানব প্রকৃতি সৃষ্টি করা হয়েছে। হজরত বলেছেন- তাখাল্লাকু বি আখলাকিল্লাহে’ -আল্লাহর গুণে বিভূষিত হও। সুতরাং ইসলামী তাসাউওফ হিন্দু দর্শনের নানা মুনীর নানা মত নয়, এবং তা কোন ধর্মশাস্ত্র থেকে ধার করাও হয়নি।

অথবা এ ধারণা হজরত মুহম্মদ (সা)-এর পর প্রক্ষিপ্ত বা অূপ্রবিষ্ট হয়নি। হজরত নিজে যে ঘোষণা করেছেন: ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’ -যে নিজেকে চিনেছে, সে তার প্রভুকে চিনেছে। এতেই বোঝা যায় যে, হিন্দু দর্শন, তাকে বিবৃত পুরুষ প্রকৃতি, সো অহং, অহং ব্রাহ্মাস্মি -এ সব মতবাদ এবং ইসলাম দর্শন, আল্লাহ, নূরে মুহম্মদী, আনাল হক -মতবাদ এক নয়।

তুলনায় আল্লাহ ও বান্দার সম্পর্ক, রসুল ও নূরে মুহম্মদীর সম্পর্ক, খালেক ও মাখলুকের সম্পর্ক এবং এর যোক্তিকতা অত্যন্ত স্পষ্ট। অবম্য মোতাজিলা, আল আশআরি, বাতেনিয়া প্রভৃতি মুসলিম স্বাধীন চিন্দাবিদদের মতবাদের সূক্ষ্ম তার্কিকতায় আমরা প্রবেশ করছি না।

এতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ধর্মীয় ধারণায় পুরুষ ও প্রকৃত ভাবধারা ক্রমে পুষ্ট এবং আবর্জনা ও প্রক্ষেপ রহিত হয়ে হয়ে পৃথিবীর শেষ ধর্ম ইসলামে এসে পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাঙ্গসুন্দর রূপ লাভ করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে পৃথিবলি সর্বকালের সর্বধর্মের সমন্বিত নিযৃাস ইসলামে এসে রূপ ধারণ করেছে।

(চলবে…)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………..
আরো পড়ুন:
সূফীবাদের গোড়ার কথা: এক
সূফীবাদের গোড়ার কথা: দুই
সূফীবাদের গোড়ার কথা: তিন
সূফীবাদের গোড়ার কথা: চার
সূফীবাদের গোড়ার কথা: পাঁচ
সূফীবাদের গোড়ার কথা: ছয়
সূফীবাদের গোড়ার কথা: সাত
সূফীবাদের গোড়ার কথা: আট

সূফীবাদের গোড়ার কথা: নয়

……..
১. Maxmuller, Indian Philosophy, page 895
২. ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহি- আল কোরান।
৩. ওয়া ইজা আরাদা শাইয়ান আঁইয়াকুলা-লাহু কুন ফাইয়াকুন- আল কোরান।
৪. রবীন্দ্রনাথ।
৫. lower self এবং higher self কথাগুলো পাশ্চাত্য দর্শনের। আমাদের বিবেচনায় এ দুটোও প্রমাদপূর্ণ। কারণ self, self-ই। এর lower এবং higher নাই। যা আছে তা aspect এর বিভিন্নতা।
৬. আল-হাদিস
৭. আল কোরান।
৮. আনাল হক: আমিই সত্য; অহং ব্রহ্মাষ্মি : আমিই ব্রহ্ম; সো অহং : সেই আমি, আমিই সে।
৯. যুগে যুগে সম্ভবামি: গীতা।
১০. ইনি ৮৩০ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
১১. ইনি ৮৬০ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!