ভবঘুরেকথা

-কাজী দীন মুহম্মদ

রামানুজের মতে একমাত্র সগুণ ব্রহ্মই সত্য; নির্গুণ ব্রহ্ম অসত্য। অদ্বৈতবাদীরা ব্রহ্মকে নিগুর্ণ, নির্বিশেষ ও অলংকারহীন মনে করেন। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীরা ব্রহ্মকে সগুণ, সবিশেষ ও অলংকারহীন মনে করেন। বিশিষ্ট্যদ্বৈতবাদীরা ব্রহ্মকে সগুণ, সবিশেষ ও সালঙ্কার বলে বিশ্বাস করেন। এদের মতে পরমপুরুষ ব্রহ্ম প্রেমময়, দয়াময় ও শক্তিময়।

গীতাও এ মতের সমর্থন ও পোষণ করে। অদ্বৈতবাদীর মত দ্বৈতভেদ বা প্রকৃতিভেদ মায়া বা কল্পনা মাত্র। বিশিষ্ট্যদ্বৈতবাদীর মতে জগতে যে বিভিন্ন বৈচিত্র্যের লীলা প্রত্যক্ষ হয়, তা ব্রহ্ম বা পরমপুরুষেরই প্রকার বা বিধা (aspect)। বিধার মাধ্যমে প্রকৃতির কাছে স্পষ্ট প্রকাশিত বলেই তার নাম বিধি। আর যে ভাবে বিভাবিত হয়, বা যে নিয়মে নিয়ন্ত্রিত হয় তার নাম বিধান বা নিয়ম। সেমেটিক শাস্ত্রে যাকে বল ‘আল-হুকুম’।

গীতার মতে প্রকৃতিও পুরুষ, জড় ও চিৎ উভয়ই পরমাত্মার বা ব্রহ্মের প্রকার বা বিধা। এ দুয়েরই সংযোগে সমস্ত ভূতের (elements) উৎপত্তি। যা নিহিত বা বিলীন (potent) তার প্রকাশই সৃষ্টি (emergence)। এ বিশ্বে নিষ্প্রাণ উপাদান (dad matter)-এর অস্তিত্ব নেই।

সব কিছুই বা সব ভূতই তার জীবনে বা বিধায় উজ্জীবিত ও তার নূরে বা ভাতিত আলোকিত ভাস্কর চিন্ময়। ব্রহ্ম থেকেই সকল বস্তুর উৎপত্তি, তাতেই তাদের জীবন এবং পরিশেষে তাতেই সব বিলীন হবে।

এ জগত মায়া বা কল্পনা নয়, অলীক নয়, জগতে যা কিছু আছে, তা হয় প্রকৃতি না হয় পুরুষ। প্রকৃতি ও পুরুষ যখন পরম ব্রহ্মেরই বিধা বা প্রকার, তখন এক ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুর অস্তিত্ব খোঁজা নিরর্থক। তিনি এক, অদ্বিতীয়, তাঁর মতো কেউ নাই তাকে ছাড়া বহু নাই।

self নয়। অন্য কথায় এগুলো চিনমাত্র নয়, চিদাভাস মাত্র।৫ চিদাভাস যখন আত্মায় বিলীন হয়, কেবলমাত্র তখনই বলতে পারে সো অহং- তিনিই আমি এবং অহং ব্রহ্মাম্মি -আমিই ব্রহ্ম।

তিনিই বহু বিধায় বিকশিত। তাই তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। তিনি ইচ্ছাময়। যখন তিনি বহু হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন, ইরাদা করেন, তখনই তিনি ‘বহুস্যাম’- ‘আমি বহু হব’ বলে বিধায় বিভাত হন।

সেমিটিক মতে আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, অভাবশূন্য, তিনি জনকও নহেন, প্রজাতও নহেন, তার সমকক্ষ সম জাতের সমবিধান কিছু নাই, তিনি একক। আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর আলো, অর্থাৎ তার আলোতেই সৃষ্টি- দৃষ্টিগোচর বিভাত। বিধান বিহিত বা নির্দেশনা তারই।২

তিনি ইচ্ছাময়, সর্বশক্তিমান। যখনই তিনি কোন কিছুর ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি বলেন, ‘হও’ আর অমনি হয়ে যায়।৩ অর্থাৎ এ পরিদৃশ্যমান জগৎ তারই ইচ্ছায় সৃষ্টি তারই ইচ্ছার বিধা। তার ইচ্ছার উপর কারো ইচ্ছা কার্যকরী হওয়ার নয়। সাধারণ ভাষায় খোদার উপর কারো খোদকারীর অবকাশ নাই।

আত্মা বা রূহের বিনাশ বা মৃত্যু নাই। শরীরের বিনাশে আত্মার বিনাশ হয় না। যেমন কোন দৃশ্য যা আমি দেখেছি, আমার মনে অঙ্কিত হয়ে রয়েছে, সে দৃশ্যের আবির্ভাব আর ঘটবে না, কিন্তু আমার কাছে তার ছবি চিরন্তরন স্বাক্ষর রেখে গেছে। ‘সে নবজগতে কাল-স্রোত নাই, পরিবর্তন নাই।’

আত্মা নিত্য শাশ্বত। সাধারণত: চিদাভাসই, যাক brain consciousness বলা হয়। আমাদের নিকট আত্মা বলে প্রতীয়মান হয়। আরও একটু এগিয়ে গেলে, আমার মন বা mind প্রজ্ঞা বা intellect এবং ইচ্ছা বা will-কেই আত্মা বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এদের কোনটিই আত্মা নয়। এগুলো অপরাপর বিধামাত্র।

শয়তানের তাণ্ডবলীলায় ধরিত্রী য়তন টলটলায়মান, তখন তা রক্ষার উদ্দেশ্যে ভগবান নিজেই কৃষ্ণরূপ ধরে ধরায় নেমে আসেন। তার মানবীয় লীলা তাই ভগবত লীলারই নামান্তর। তার জীবলীলা একটা প্রতীকি মাত্র। তিনি স্বয়ং ভগবান, স্রষ্টা এবং পালনকর্তা অর্থাৎ ভর্তা। ষোড়শ সহস্র গোপিনী সৃষ্টি।

এসবগুলোকে মিলিয়ে নিম্নস্তরের ‘আত্মা’ বা lowe self বলা চলে। এগুলো কিছুতেই ঊর্ধ্বস্তরের আত্মা বা higherself নয়। অন্য কথায় এগুলো চিনমাত্র নয়, চিদাভাস মাত্র।৫ চিদাভাস যখন আত্মায় বিলীন হয়, কেবলমাত্র তখনই বলতে পারে সো অহং- তিনিই আমি এবং অহং ব্রহ্মাম্মি -আমিই ব্রহ্ম।

কথাটা রূপকে এ ভাবে বলা যায়- শিশিরবিন্দু সমুদ্র নহে, কিন্তু সমুদ্রের আভাস এতে আছে। এ শিশির বিন্দুকে চিদাভাস বা lower self বলে মনে করে নিলে এবং সমুদ্রকে চিন্ময় বা higher self মনে করে নিলে, শিশিরবিন্দু যখন সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়, তখনই সে বলতে পারে, ‘সমুদ্রই আমি, আমিই সমুদ্র।’

অর্থাৎ লীন অবস্থায় ‘তিনি’ ও ‘আমি’ ‘সো’ এবং ‘অহং’ সমুদ্র ও শিশিরের পার্থক্য জ্ঞান লুপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক। যখন আলাদা সত্তা নেই তখন আলাদা করে বলব কি করে।

এ যেন অনেকটা শরবতের মতো। চিনি ও পানি যখন মিশে গেছে, তখন পানি এবং চিনি প্রত্যেকের পক্ষে যেমন শরবতই আমি এবং আমিই মরবত বলায় অসঙ্গতি দেখি না, তেমনি সত্যই আমি, আমিই সত্য ‘আনাল হক’ বলাও সঙ্গতি লক্ষ্য করি।

ভাগবসে এ ‘অহং’-কে প্রভাবে দেখা হয়েছে- ভগবান চিৎ ও কর্মময়। তার ইচ্ছা রূপ পরিগ্রহ করে জগতে অবতীর্ণ হন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য-সৃষ্টির জন্য তার অংশাবতার। তাই তিনি বলেন- যুগে যুগে সম্ভবামি। তাই দেখি কৃষ্ণ ভগবানেরই স্বরূপ, তারই অংশ।

শয়তানের তাণ্ডবলীলায় ধরিত্রী য়তন টলটলায়মান, তখন তা রক্ষার উদ্দেশ্যে ভগবান নিজেই কৃষ্ণরূপ ধরে ধরায় নেমে আসেন। তার মানবীয় লীলা তাই ভগবত লীলারই নামান্তর। তার জীবলীলা একটা প্রতীকি মাত্র। তিনি স্বয়ং ভগবান, স্রষ্টা এবং পালনকর্তা অর্থাৎ ভর্তা। ষোড়শ সহস্র গোপিনী সৃষ্টি।

সৃষ্টির মধ্যে নানাভাবে, নানা বিধায় বিভাসিত তিনি পুত্র-বন্ধু-সভা হিসেবে কেলী করছেন। তারই ইচ্ছায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াই সৃষ্টির কাজ আর তাই সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভগবতের পরমেশ্বরের বিষ্ণু অবতার পরিকল্পে অংশাবতার হিসেবে কৃষ্ণকে ভগবান জ্ঞানে সাধনা-ভজনা করা তাই এক শ্রেণীর লোকের ধর্মমতে পরিণত হলো।

(চলবে…)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………..
আরো পড়ুন:
সূফীবাদের গোড়ার কথা: এক
সূফীবাদের গোড়ার কথা: দুই
সূফীবাদের গোড়ার কথা: তিন
সূফীবাদের গোড়ার কথা: চার
সূফীবাদের গোড়ার কথা: পাঁচ
সূফীবাদের গোড়ার কথা: ছয়
সূফীবাদের গোড়ার কথা: সাত
সূফীবাদের গোড়ার কথা: আট

সূফীবাদের গোড়ার কথা: নয়

……..
২. ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহি- আল কোরান।
৩. ওয়া ইজা আরাদা শাইয়ান আঁইয়াকুলা-লাহু কুন ফাইয়াকুন- আল কোরান।
৪. রবীন্দ্রনাথ।
৫. lower self এবং higher self কথাগুলো পাশ্চাত্য দর্শনের। আমাদের বিবেচনায় এ দুটোও প্রমাদপূর্ণ। কারণ self, self-ই। এর lower এবং higher নাই। যা আছে তা aspect এর বিভিন্নতা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!