ভবঘুরেকথা

-কাজী দীন মুহম্মদ

সাংখ্যমতে প্রকৃত ও পুরুষ অনাদি ও নিত্য। প্রকৃতি জড়, কিন্তু পুরুষ চেতন। প্রকৃতি বিষয় পুরুষ বিষয়ী অর্থাৎ প্রকৃতি কর্ম, পুরুষ কর্তা।

হার্বাট স্পেনসরের মতে, বস্তুর উৎপত্তি ও বিনাশ নাই, অবস্থান্তর আছে। স্যার উইলিয়াম ব্রুকস্ বলেন, সমস্ত মৌল উপাদান বা পদার্থ এক চরম উপাদান বা পদার্থের বিশেষ অবস্থায় বিশেষ সংঘাতজনিত বিকার মাত্র। এ চরম উপাদান ও মৌল পদার্থই প্রকৃতি।

সাংখ্যমতে প্রকৃতি ও পুরুষ চরম দ্বৈতরূপ। গীতার সাংখ্যোক্ত এ-প্রকৃতি ও পুরুষকে পরম পুরুষের দুটি সত্ত্বা বা (aspect) বলে স্বীকার করা হয়েছে। গীতার মতে পরম পুরুষই চরমতত্ত্ব। সাংখ্যোক্ত প্রকৃতি ও পুরুষ চরম নয়। জীব ও জড় পরম পুরুষের বিভাব মাত্র। প্রকৃতি ও পুরুষ -জীব ও জড় এ দুয়ের সমস্বয়ে যে একত্বে উপনীত হওয়া যায়, সাংখ্যে তার আভাস না থাকলেও গীতায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

প্রখ্যাত দার্শনিক ম্যাক্সমুলার তার ‘ইন্ডিয়ান ফিলসফি’ নামক গ্রন্থে এ কথারই স্বীকৃতি দান করেছেন। তিনি বলেন, It was true that Sankhya Philosophy was assused of atheism but that atheism war very different from what we ment by it. It wat the megation of the necessity of admitting an active or limited personal God.’১

পরবর্তীকালে পতঞ্জলি যে তত্ত্ব প্রকাশ ও প্রচার করেন, তাতে ঈশ্বরকে সাংখ্যোক্ত পুরুষ বলে স্বীকার করা হয় নাই ; তাতে প্রকৃত প্রস্তাবে যে ঈশ্বরতত্ত্ব ব্যাখাত হয়েছে তাকে ‘ঈশ্বর-সাংখ্য’ বলা যেতে পারে।

বেদান্তেও গীতার মতের সমর্থন পাওয়া যায়, সাংখ্যের দ্বৈতবাদের স্বীকৃতি সেখানে অনুপস্থিত। বেদান্তের মতে, ব্রহ্মই একমেবাদ্বিতীয়ম, ব্রহ্মই চরম ; এ বিশ্বে বিভিন্ন ভূতে বিকশিত স্বয়ম্ভু (আল্লাহ) ভিন্ন আর কিছুরই অস্তিত্বের স্বীকার করা যায় না।

প্রকৃতি ছাড়া আরো একটা উপাদান বা ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। তার নাম শক্তি- Power, Force বা energy। এ force আবার দু’রকমে প্রকাশ পায়। এক প্রকার হলো জৈবশক্তি বা Physical force এবং দ্বিতীয় প্রকার হলো জীবশক্তি বা Psychic force।

জৈবশক্তি বা Physical force-কে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে- তাপ বা heart, আলো বা light, বিদ্যুৎ বা electricity, আকর্ষণ বা megnetism. জীবশক্তি বা psychic force-কে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে- জীবশক্তি psychic force এবেং প্রাণশক্তি বা vital force.

ভারতীয় দর্শন এ মৌল উপাদানগুলোকে ভূত নামে আখ্যাত করেছে। উপনিষদের পঞ্চভূত- ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম উপরোক্ত মৌল উপাদানগুলোরই নামান্তর মাত্র। জয়থুস্ত্রবাদীদের মতে এগুলোই আবার আব, আতশ, খাক ও বাদ-এ চার উপাদানে রূপ পেয়েছে।

অদ্বৈত মতে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাদের মতে জীবই ব্রহ্ম, তবে আমাদের কাছে জীব ও ব্রহ্মের যে বিভিন্ন রূপ প্রতীয়মান হয়, তা বস্তুত সত্য নয়। তা মায়া মাত্র। জীব ও ব্রহ্ম যে বিভিন্ন এ তত্ত্বজ্ঞান দৃঢ় হলেই অবিদ্যা বা মোহের নিবৃত্তি ঘটে। তাই অদ্বৈত মতে জীব ও ব্রহ্মজ্ঞানের ঐক্য জ্ঞানই মুক্তির উপায়।

গৌতম বুদ্ধ জীব ও ব্রহ্ম জ্ঞানের এ ঐক্যবোধের সীমান্তে এসে সর্বজ্ঞানের বিসর্জন দেওয়ার প্রত্যয়েই নির্বাণের পথ খুঁজেছেন।

বিশিষ্ট অদ্বৈত মতে আরো একটু এগিয়ে এসে বলছে- পরম পুরুষ থেকেই জীবের উৎপত্তি, তাতেই তার স্থিতি এবং তাতেই তার লয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ‘মিনহা খালাকনাকুম, ফিহা নুয়িদুকুম ও মিনহা নুখরেজুকুম, তারাতান উখরা।’ অর্থাৎ তা থেকেই তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব এবং তা থেকেই তোদের আবার বের করব।

বিশিষ্ট অদ্বৈত মতে পুরুষ ও প্রকৃতি উভয়ের মধ্যেই পরমপুরুষ বা পরমেশ্বর অন্তর্যামীরূপে বিরাজমান। অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের মধ্যে পরমপুরুষের বিকাশ মাত্র। তাই প্রকৃতি ও পুরুষ এ দুটি পরমপুরুষের প্রকার, বিভাগ রূপভেদ মাত্র।

চিৎ ও জড় তাঁরই নজীররূপে তাঁরই রূপ প্রকাশ মাত্র। তিনি আত্মায় আত্মার অন্তরে অবস্থিত। আত্মা তাকে জ্ঞাত নহে, আত্মা তার শরীর। তিনি আত্মায় থেকে আত্মারই অন্তর্যামী। বিশিষ্ট অদ্বৈত মতে, ব্রহ্মা যখন অত্যন্ত ব্যস্ত, তখন জীব কোন মতেই ব্রহ্মাংশ বা খণ্ড ব্রহ্ম হতে পারে না। জীব ব্রহ্মের বিভূতি।

এঁদের মতে পরমপুরুষ বা মুক্তপুরুষ কোনমতেই ব্রহ্মের স্বরপ ঐক্য লাভ করতে পারেন না। এ তার স্বভাব বা জাতেই নাই। পুরুষ ও প্রকৃতি ব্রহ্মের সঙ্গে একীভূত হন না। অর্থাৎ এটা তার ‘সিফাত’ মাত্র। অদ্বৈতবাদীর মতে মোহমুক্ত জীব ব্রহ্মের সহিত একত্বপ্রাপ্ত হয়। দ্বৈতবাদের মুক্তি ঠিক এরূপ নহে। এখানেই দ্বৈত ও অদ্বৈতবাদের পার্থক্য।

শংকরের মতে নির্গুণ ব্রহ্মই সত্য, সগুণ ব্রহ্ম সত্য নহে। অর্থাৎ যা ঘটে তা সব সত্য নয়। মায়াবাদীরদ মত অনুরূপ।

(চলবে…)

………………………..
আরো পড়ুন:
সূফীবাদের গোড়ার কথা: এক
সূফীবাদের গোড়ার কথা: দুই
সূফীবাদের গোড়ার কথা: তিন
সূফীবাদের গোড়ার কথা: চার
সূফীবাদের গোড়ার কথা: পাঁচ
সূফীবাদের গোড়ার কথা: ছয়
সূফীবাদের গোড়ার কথা: সাত
সূফীবাদের গোড়ার কথা: আট
সূফীবাদের গোড়ার কথা: নয়

……..
১. Maxmuller, Indian Philosophy, page 895

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!