-মূর্শেদূল মেরাজ
এবং সময় সুযোগ মতো অজ্ঞাতে থেকে তার মতের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাকে মদদ জোগায়। তার মূল গতিপথ পরিবর্তন করার খেলায় মেতে উঠে। ধীরে ধীরে তার মূল ভিত্তি-কাঠামো-বিশ্বাস থেকে তাকে কেবল উপাসনা-আনুষ্ঠানিকতায় নিয়ে যায়।
আর সেই মত-পথের যে অংশটি এই কাজটি করতে যখন যখন এগিয়ে আসে। তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সূত্রধরদের খেলনায় পরিণত হয়। তখন তাকে নিয়ে খেলতে অনেক বেশি সুবিধা হয়। একসময় সেই অংশটাই সংখ্যা গড়িষ্ঠতা লাভ করে।
তারাই এক সময় দাবী করতে শুরু করে তারাই সেই মত-পথের একমাত্র উত্তরাধিকারী। এভাবে যখন মূল ভিত্তি বা বিশ্বাসে জল ঢুকে যায়। তখনই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব জয়ী হয়। হেরে যায় সেই সব পরিবর্তনের চিন্তা-চেতনা। হেরে যায় মূল সত্য। বাস্তবায়ন হয় পূর্ব লিখিত চিত্রনাট্য।
এভাবেই ধর্ম-দর্শন-মতবাদের মূল তত্ত্ব বা মূল সৌন্দর্য হারিয়ে তাতে কেবল আনুষ্ঠানিকতা টুকু টিকে থাকে। মানুষ একসময় সেটিকেই মূল ধর্ম মানতে শুরু করে। আর তা রক্ষার জন্যই হাতিয়ার তুলে নেয় হাতে। রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়।
আমাদের চিন্তা-চেতনাকে গভীরে যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আর আমরা তা না বুঝে সেই জাল ছিন্ন করার চেয়ে সেই জালকে ভালোভাবে জড়িয়ে নেয়াকেই বেশিভাগ সময় স্বাধীনতা মনে করি। স্বাধীনতার নামে আমরা যে সূত্রধরদের কাছে চিরকালীন বন্দিত্ব স্বীকার করে নিচ্ছি।
কিন্তু তারা জানতেও পারে না যে তত্ত্ব এর মাঝে লুকায়িত আছে। তা তারা আবিষ্কারই করে নাই। আবিষ্কারের কথা ভাবতেও যায় নাই। কারণ সে পথ তারা বহু আগেই বন্ধ করে দিয়েছে এই ভেবে যে। যা আবিস্কারের তা আবিষ্কার হয়ে গেছে।
‘অর্থ সূত্রধরেরা’ পূর্ব থেকেই সকল শব্দের অর্থ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আর ভাবের অর্থ যখন নির্দিষ্ট থাকে। তখন তার মাঝে ডুবে গভীরতায় যেমন যাওয়া যায় না। তেমনি ভাবকে ভাবময় করা যায় না। আর এই কাজটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অন্যতম অংশ। অর্থাৎ অর্থের নির্দিষ্টতা।
বিশেষ করে ভাববাদের অর্থ নির্দিষ্টতা। এই রহস্যময় জগতের কোনো কিছুর অর্থই নির্দিষ্ট হয়ে থাকতে পারে না চিরকাল। কারণ জ্ঞানের গভীরতা ও সময়ের পালাবদলের সাথে সাথে অর্থ পাল্টাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এখানেই খুব কৌশলে তার খেলাটি খেলে।
আমাদের চিন্তা-চেতনাকে গভীরে যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আর আমরা তা না বুঝে সেই জাল ছিন্ন করার চেয়ে সেই জালকে ভালোভাবে জড়িয়ে নেয়াকেই বেশিভাগ সময় স্বাধীনতা মনে করি। স্বাধীনতার নামে আমরা যে সূত্রধরদের কাছে চিরকালীন বন্দিত্ব স্বীকার করে নিচ্ছি।
সেই ভাবনাটা ভাববার মতো কাণ্ডজ্ঞানও আর অবশিষ্ট থাকে না।
দেশী সংস্কৃতি বিরাজ করলে উন্নত বিশ্বের বাণিজ্যটা ঠিকঠাক মত হয় না। তাই তাদের দ্বারা আমরা স্বাধীনতার নামে ব্যবহৃত হই প্রথা ভাঙায়। নতুন সংস্কৃতি প্রবেশ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে বিজয়ীর বেশে বুক ফুলিয়ে পথে হাঁটি। আদতে সূত্রধরদের কাছে এসব দেশী-বিদেশী সংস্কৃতির কোনো মূল্য নেই।
তারা ফায়দাটা লুটে নিতে, যে সংস্কৃতি প্রবেশ করলে বাণিজ্য ভালো হবে। সেটাকেই তাতিয়ে তুলে। সেটার এমন সব বিজ্ঞাপন করা হয়। যাতে আমরা মোহিত হয়ে যাই। এই বিজ্ঞাপন কেবল বিলবোর্ড, ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা প্রিন্টেট মিডিয়ার পণ্যের বিজ্ঞাপনে সীমাবন্ধ থাকে না।
এই বিজ্ঞাপনের ব্যাপ্তি থাকে সর্বত্র। অর্থাৎ যে সংস্কৃতিতে ব্যবসাটা প্রবেশ করানো দরকার। তার জন্য লেখানো হয় শত-সহস্র-লক্ষ-কোটি গ্রন্থ। গাওয়ানো হয় গান। নির্মাণ করা হয় সুর-তার-নৃত্য-গীতি। চিত্রায়িত করা হয় চলচ্চিত্র। তুলে ধরা হয় চিত্রকর্ম।
একথা শুনে আমরা জোড়ে জোড়ে তালি বাজিয়ে তাদের সমর্থন করে প্রভুদের খুশি করতে চাই। প্রমাণ করতে চাই আমরা সেই বাতিলের দলে নই। আমরা সেসব করবো না। আমরা তাদের পায়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে মৃদু স্বরে ঘেউ ঘেউ করবো তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য।
অর্থাৎ বহুবছর ধরে শিল্পকে ষড়যন্ত্রতত্ত্বকারীরা ব্যবহার করে সু-কৌশলে। আর অনেকক্ষেত্রেই আমরা ভাবি আমরা প্রথা ভাঙছি। নিজের কথা বলছি। আমাদের স্বাধীনতার কথা বলছি। আমাদের মুক্তির কথা বলছি। কিন্তু বুঝতেই পারি না। এই গল্পের চিত্রনাট্য আগে থেকেই লিখে রেখেছেন তারা।
আমরা কেবল তাদের হাতের খেলার পুতুলের মতো তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি জীবন-যৌবন দিয়ে। আদতে আমরা কেবল সংখ্যা। এরবেশি কিছু নই। আমাদের মধ্যে তারা আইডল হয়। যারা সূত্রধরদের পারপাস সার্ভ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি করতে পারে নিজেকে।
আর যারা নিজেদের বিক্রি করে না। বা বিক্রি করতে চায় না। বা বিক্রি করতে পারে না। তারা আমাদের কাছে হয় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের পাত্র। সমাজের বাতিল শ্রেণী। সমাজ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, আরে রাখুন মশাই এরা বিক্রি হবে কি করে। বিক্রি হওয়ার যোগ্যতাই তো তাদের নেই।
একথা শুনে আমরা জোড়ে জোড়ে তালি বাজিয়ে তাদের সমর্থন করে প্রভুদের খুশি করতে চাই। প্রমাণ করতে চাই আমরা সেই বাতিলের দলে নই। আমরা সেসব করবো না। আমরা তাদের পায়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে মৃদু স্বরে ঘেউ ঘেউ করবো তাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য।
দুই দুইটা বিশ্ব যুদ্ধের পরও যখন আগ্রাসী, সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদীদের দম্ভ কমছিল না। মধ্যবিত্ত যখন ক্রমশ নিম্নবিত্তের কাতারে নামছিল। নিম্নবিত্ত যখন মৃত্যুর দিন গুনছিল। চাকরি যখন সোনার হরিণ। খাবার যখন বিলাস। সুখ যখন পূর্ণিমার চাঁদ।
মানুষ যখন চরম হতাশায় নিমজ্জিত। তখন যুব সমাজ সমাজের মুখে, সভ্যতার মুখে, নিজ পুঁজিপতি পরিবারের মুখে চপেটাঘাত করার জন্য। এমন এক বেশ নিলো। এমন এক জীবনকে ধারণ করলো। যা দেখে সকলে লজ্জা পায়। কিন্তু নিজ সন্তান বলে ব্যবস্থাও না নিতে পারে।
এমনি সব পালাপরিক্রমায় জন্ম নেয় এক আন্দোলন। ইতিহাসে তার নাম ‘হিপ্পি আন্দোলন’। বিচিত্র পোশাক, আজব বেশভূষা, প্রথাগত সমাজের চোখে উদ্ভট জীবন যাপনের জন্য তারা দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল তাদের বার্তা। তাদের প্রতিবাদ। প্রতিরোধ।
দামী দামী গাড়ি দিয়ে যখন তাদের পরিবারের সদস্যরা চলাচল করতো। তখন পথের পাশে তাকিয়ে দেখতো। তাদের পরিবারের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সন্তানেরা পথের ধারে আস্তানা গেড়েছে। তারা চুল কাটে না। সামাজিক পোশাক পরে না। সামাজিক নিয়ম কানুন মানে না।
সভ্যতাকে তারা অস্বীকার করে। তারা সম্পর্ককে ভেঙে দিয়ে, সমাজকে ভেঙে দিয়ে, সংসারকে ভেঙে দিয়ে, ক্রমাগত বাড়তে থাকা চাহিদার স্রোতকে থামিয়ে দিয়ে সভ্যতাকে এক চটেপাঘাত করতে উদ্যত।
ক্রমশ তাদের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসতে শুরু করলো নানা প্রতিভা। কথা-কাব্য-সুর-সংগীততে তারা দর্শনের দিকে নিতে শুরু করার প্রক্কালে সভ্যতা নড়েচড়ে বসলো। হাসিমুখে খেলতে শুরু করলো নতুন ষড়যন্ত্র। আদি ষড়যন্ত্র। প্রতিভাবান প্রতিবাদকে ডুবিয়ে দেয়া হলো নেশার সমুদ্রে।
ষড়যন্ত্রের লীলায় হিপ্পিরা যখন নেশায় ডুবে গেলো। তখন তাদের প্রতিবাদ চুলোয় উঠিয়ে পুঁজিবাদের কাছে হাত পাততে বাধ্য হলো। অনেকে নেশায় চূড় হয়ে গেলো। অনেকে মেনে নিতে না পেরে ছেড়ে চলে গেলো। তাদের অনেকেই পরবর্তীতে নিজেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ পুঁজিপতি হলো।
তারাই পৃথিবীর যুব সমাজকে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠলো। তারাই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে এগিয়ে নিতে কাজে লেগে গেলো। এটাই সূত্রধরদের খেলা। যার জন্য প্রতিবাদ করা হয়। যারা তা করে। তাদের দিয়েই তা প্রতিহত করে সূত্রধরেরা। এখানে কেবলই লোভের খেলা। ষড়রিপুর খেলা।
আর এমন এক জীবনের বিজ্ঞাপন করে বেড়ায়। যা দেখে নতুন শিল্পী-দার্শনিকরা আকৃষ্ট হয়; তেমন একটা জীবনের। যে জীবন যাপন করার জন্য তাকে হতে হয় ষড়যন্ত্রতত্ত্বকারীদের দালাল। পরিশেষে বলা যায়, এই খেলার সকল সুতাই তাদের হাতে। যারা সভ্যতা নিয়ন্ত্রণ করে।
সেই ষড়রিপুকে জাগিয়ে দিতে পারলেই প্রতিবাদ ফুৎকারে উড়ে যায়। লোভের জোয়াল কাঁধে নিয়ে মানুষ সভ্যতার রচিত গল্পে যথাযথ অভিনয় শুরু করে দেয়।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো শিল্পীরা যে প্রতিবাদের স্বপ্ন দেখে। মানুষের পক্ষে, প্রকৃতির পক্ষে, ব্রহ্মাণ্ডের পক্ষে লড়ে যাওয়ার জন্য শিল্পী হয়ে উঠে। সেই ষড়রিপু জাগ্রত করার জন্য যে সকল উপাদান প্রস্তুত করা প্রয়োজন পরে ষড়যন্ত্রতত্ত্বকারীদের তার জোগান কিন্তু শিল্পী সমাজই দেয়।
তারাই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে যায়; বেশিভাগ সময় নিজের অজ্ঞাতে। যদিও তারা ভাবে তারা প্রথা ভেঙে মানুষের মুক্তির পক্ষে লড়ছে। তাদের উদ্দেশ্যটা সৎ হলেও আদতে প্রথা ভাঙলে নতুন ব্যবসার বাজার তৈরি হয়।
আর নতুন বাজার তৈরি হলে বাণিজ্যটা কারা করে নিবে তা সকলেই জানে। তাই দূরদর্শী ব্যবসায়ীরা আগে ভাগেই সেই সব প্রথা ভাঙ্গার খেলায় গোপনে পুঁজির জোগান দিয়ে যায়।
শিল্পী-দার্শনিকরা প্রথা ভাঙার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সৃষ্টি করে যায়। কিন্তু ফায়দাটা লোটে পুঁজিপুতি, সাম্রাজ্যবাদী, আগ্রাসী শ্রেণীই। আর সুবিধাবাদি শিল্পী-দার্শনিকরা পা চেটে চেটে তার ছিটেফোঁটা আদায় করে নেয়।
আর এমন এক জীবনের বিজ্ঞাপন করে বেড়ায়। যা দেখে নতুন শিল্পী-দার্শনিকরা আকৃষ্ট হয়; তেমন একটা জীবনের। যে জীবন যাপন করার জন্য তাকে হতে হয় ষড়যন্ত্রতত্ত্বকারীদের দালাল। পরিশেষে বলা যায়, এই খেলার সকল সুতাই তাদের হাতে। যারা সভ্যতা নিয়ন্ত্রণ করে।
তারপরও এরই মাঝে একজন ফকির লালনের মতো কেউ কেউ জন্মায়। যারা মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। বলে-
সামান্যে কি তার মর্ম জানা যায়।
হৃদকমলে ভাব দাঁড়ালে
অজান খবর আপনি হয়।।
দুগ্ধে জলে মিশাইলে
বেছে খায় রাজহংস হলে,
কারো সাধ যদি হয় সাধন বলে
হয় সে রাজহংসের ন্যায়।।
মানুষে মানুষের বিহার
মানুষ ভজলে দৃষ্ট হয় তার,
সে কি বেড়ায় দেশ দেশান্তর
পীড়েই পেড়োর খবর পায়।।
পাথরেতে অগ্নি থাকে
বের করতে হয় ঠুকনি ঠুকে,
দরবেশ সিরাজ সাঁই দেয় তেমনি শিক্ষে
লালন ভেঁড়ো সং নাচায়।।
কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে থাকে না। তারা লালনকেও নেশা আর নারীতে বেঁধে ফেলার ষড়যন্ত্র করে। আর এর ফাঁদে জড়িয়ে পরে শিষ্য বাড়ানোর প্রতিযোগীতায় মত্ত্ব লোভী সাধকরা। তারা বলে নেশা আর নারী হলেই সাধন হয়। ভজন হয়। লালনকে জানা যায়। ব্রহ্মাণ্ডকে জানা যায়।
এভাবেই জয়ী হয় ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। বিজয়ীর হাসি হাসে ষড়যন্ত্রতত্ত্বীরা। আর হেরে যায় একজন ফকির লালন। হেরে যায় তাঁর মতাদর্শ। এই লেখা এই পর্যন্তই থাক। অন্য কোনো লেখায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বীদের নিয়েও কয়েক কথা লেখা যাবে। জয়গুরু।।
(সমাপ্ত)
<<অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব এক
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………….
আরো পড়ুন-
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব এক
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব দুই
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব তিন
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব চার