ভবঘুরেকথা
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা

-মূর্শেদূল মেরাজ

মজার বা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই প্রথা ভাঙার বিষয়টিও সভ্যতা-রাষ্ট্র-সমাজ ভালো করেই জানে। এবং অনেকাংশ সভ্যতা-রাষ্ট্র-সমাজ নিজেই এই প্রথা ভাঙা গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে অতি গোপনে। দূর থেকে তার গতিবিধি লক্ষ করবার জন্য। তারা কতদূর যেতে পারে তা দেখবার জন্য।

তাদের কতদূর যেতে দেয়া হবে তাও তাদের পরিকল্পনার মধ্যেই থাকে। তারা প্রথার কতটা ভাঙবে তাও তারা আগে ভাগেই জানে। তারপরও কিছু মানুষ তাদের সেই কাঠামোগত পরিকল্পনাকেও ভেঙে ফেলে। যদিও তারজন্যও রাষ্ট্রের থাকে নিজস্ব প্রস্তুতি।

এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন। একটি হলো প্রথা ভাঙা কতটা জরুরী? আর, প্রথা যারা ভাঙছে বা ভাঙার কথা জাগ্রত করে তারা কোন দলে? তারা কি চায়? দার্শনিকরা কাদের স্বার্থে নতুন দর্শন প্রকাশ করে? শিল্পীরা কাদের স্বার্থে সেই দর্শনকে ছড়িয়ে বেড়ায়?

মোদ্দা কথা হচ্ছে রাষ্ট্রকে তার প্রথা সংরক্ষণ করতে কারা মদদ দেয়? আর রাষ্ট্রের প্রথা যারা ভাঙতে চায় তাদের মদদ কে দেয়? অর্থাৎ সকল কিছুর কলকাঠি কে বা কারা নাড়ে? সুতোটা আসলে কার হাতে?? শেষ বিচারে জয় হয় কার? আর কে হারে? শেষ হাসিটা কে হাসে??

এর বিশ্লেষণ বিভিন্ন মহল বিভিন্ন ভাবে দিবে। অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হবে। যেহেতু এরূপ জ্ঞানগর্ভ বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই। তারপরও এই বিষয় নিয়ে দু-চার কথা যখন লিখতে বসেছি। তাই খুবই সহজ করে অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী দিয়েই এই লীলাখেলার চলচ্চিত্রটা বুঝবার চেষ্টা করি। সেটিই বরং ভালো।

একে বুঝতে গেলে দুটি পদ্ধতি হতে পারে। এক হলো রাষ্ট্র বা ধর্মকে বোঝা। তারপর নতুন দর্শন সৃষ্টির বিষয়টি বোঝা। তারপর শিল্পীদের শিল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে বোঝা। আরেকটা পদ্ধতি হলো এর উল্টো। অর্থাৎ শিল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্যের পেছনে দৌড়ে এর সূত্রধরকে ধরা যায় কিনা সেই চেষ্টা করা।

নাকি মানুষ যখন রাষ্ট্র-নগর প্রতিষ্ঠা করেছে তারপর এই সূত্রধরেরা তাদের সুতার বিস্তার ঘটিয়েছে? নাকি আরো আরো আগের কথা? রাষ্ট্রই কি নেই সূত্রধর?? নাকি সূত্রধরেরাই রাষ্ট্র চালায়??? নাকি ছোট রাষ্ট্রের সূত্রধর বড় রাষ্ট্র? আর বড় রাষ্ট্রের সূত্রধর আরো বড় কেউ??

দ্বিতীয় প্রকৃয়াটা একটু জটিল তবে অসম্ভব নয় বলে আপাতত মনে হচ্ছে। তবে চলুন বুঝতে শুরু করি শিল্পীর মাথায় শিল্পের জন্ম কি করে হয় তাকে খণ্ডন করা যায় কিনা।

শিল্পের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করলে এ লেখা আদৌ শেষ হবে না। তাই সে চেষ্টা না করাই ভালো। আদ্দিকালের কোনো গুহার একটা বাইসনের চিত্রের বর্ণনা দিতে গেলেও গোটা দুয়েক আরব্য রজনীতে গিয়ে ঠেকবে। তাই সে পথেও এগুনো ঠিক হবে না।

তার আগে আরো গুটি কয়েক প্রশ্ন সাজানো যাক। যাতে এগুনো একটু সহজ হয়। যেমন- এই সূত্রধরেরা কারা? তাদের কি স্বার্থ? তারা কি আদি কাল থেকেই ছিল? যখন মানুষ আগুন জ্বালাতে শেখেনি? তখনো ছিল?

নাকি মানুষ যখন রাষ্ট্র-নগর প্রতিষ্ঠা করেছে তারপর এই সূত্রধরেরা তাদের সুতার বিস্তার ঘটিয়েছে? নাকি আরো আরো আগের কথা? রাষ্ট্রই কি নেই সূত্রধর?? নাকি সূত্রধরেরাই রাষ্ট্র চালায়??? নাকি ছোট রাষ্ট্রের সূত্রধর বড় রাষ্ট্র? আর বড় রাষ্ট্রের সূত্রধর আরো বড় কেউ??

আবার এভাবেও ভাবা যায়- ষড়যন্ত্রতত্ত্বের অস্তিত্ব বলে কি আদৌ কিছু আছে?? নাকি এসব কেবলই কল্পনা মাত্র???

সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন হলো- সূত্রধর বলে কি আদৌ কেউ বা কারা আছে? আসলেই কি সকল কিছুই একটা কন্সপিরেসি? ষড়যন্ত্র? আমরা কি ষড়যন্ত্রতত্ত্বের মাঝেই বিরাজ করছি? ষড়যন্ত্রতত্ত্বই কি সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার নিজস্ব বলয়ে?

এখানে খুব খেয়াল করে বুঝতে হবে যে, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এমনি এক জাল। যে তাকে ঘিরে থাকা সমস্ত কিছুকেই আশ্রয় দেয়-প্রশ্রয় দেয়। তারপর তাকে ঘিরে নিত্যনতুন ষড়যন্ত্রের জন্ম দেয়। ধরা যাক, একটা মহান দর্শন প্রবর্তিত হলো বা একটা মহান শিল্প সৃষ্টি হলো যা পুরোপুরি সূত্রধরদের চ্যালেঞ্জ করে বসলো।

আমরাও কি এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের অংশ? নাকি আমরাই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের রচয়িতা?? নাকি আমরাই টিকিয়ে রাখছি বা এগিয়ে নিয়ে চলেছি ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে???

এখানে আরেকটা প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বুঝতে গেলে কি বুঝতে হবে ‘তত্ত্ব’ কি? তত্ত্ব জানলে তবেই কি বোঝা যাবে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব কি? তত্ত্বের পেছনে আসলে কি ষড়যন্ত্র হচ্ছে তবেই কি তা পরিষ্কার হবে???

এই আলোচনায় সবচেয়ে বড় পরিতাপের বিষয় হলো, এই সূত্রধরেরা এতোটাই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর যে তারা আড়ালে থেকে যে ষড়যন্ত্র করে তা বাস্তবায়নে অনেকক্ষেত্রেই অন্যান্যরা না জেনেই কাজ করে যায়। যারা জেনে করে তারাও ততটুকুই জানে যতটা তাদের জানানো হয় মাত্র।

এই সূত্রধরেরা রাষ্ট্র, দার্শনিক ও শিল্পী সকল মহলেই তাদের পোষ্য যেমন ছড়িয়ে রাখে। আবার যারা তাদের বিপরীতে কাজ করে তাদেরও বেশিভাগক্ষেত্রে তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। যারা বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর হয়ে জীবন উৎসর্গ করছে তাদেরও অনেক ক্ষেত্রে।

যে শিল্পীকুল সচেতনতা-প্রগতীশীলতা-আধুনিকতার জন্য পরিবার-পরিজন-সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম-দর্শনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়ে যাচ্ছে। তারাও শেষ বিচারে সেই সূত্রধরদেরই গিনিপিগের বেশি কিছু হতে পারে না বেশিভাগ ক্ষেত্রে।

প্রত্যেকেই এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ফাঁদে পরে? প্রত্যেকেই কি তবে এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের সৃষ্টি? এ প্রশ্ন আসতেই পারে।

এখানে খুব খেয়াল করে বুঝতে হবে যে, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এমনি এক জাল। যে তাকে ঘিরে থাকা সমস্ত কিছুকেই আশ্রয় দেয়-প্রশ্রয় দেয়। তারপর তাকে ঘিরে নিত্যনতুন ষড়যন্ত্রের জন্ম দেয়। ধরা যাক, একটা মহান দর্শন প্রবর্তিত হলো বা একটা মহান শিল্প সৃষ্টি হলো যা পুরোপুরি সূত্রধরদের চ্যালেঞ্জ করে বসলো।

যা সূত্রধরেরা ভাবতেই পারেনি। এরূপ ঘটনায় রাষ্ট্র-ধর্ম, সুশীল-প্রগতীশীল-বিপ্লবী তৎক্ষণাত প্রতিকৃয়া দেয়। কিন্তু সূত্রধরেরা অসীম ধৈর্য্য নিয়ে তা কেবল পর্যবেক্ষণ করে মাত্র। কোনো প্রতিক্রিয়া দেয় না তৎক্ষণাত। তারা ক্রোধের বদলে অট্টহাসিতে ফেটে পরে।

উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়ে উৎসাহী হয়ে উঠে, নতুন ষড়যন্ত্রতত্ত্বের জন্ম দেয়া যাবে এই ভেবে হাসে। প্রস্তুত হয় নতুন ছকের খেলা। তাই মহান দর্শন বা সৃষ্টিও তার গণ্ডি পেরুতে পারে না বেশি সময় ধরে। দু:খজনক হলেও এটাই সত্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সূত্রধরেরা কার পক্ষে? আর দার্শনিক-শিল্পীরা কার পক্ষে?? কাদের পক্ষে???

এই দালালদের মধ্যেও অনেক শ্রেণীভেদ বা স্তরভেদ আছে। এদের প্রথম বা প্রধান শ্রেণী সূত্রধরদের সংযোগকারীদের সরাসরি সংযোগে থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণীরা প্রথম শ্রেণীর দালালদের সংযোগে থাকে। এভাবে দালালের স্তর পৃথিবী জুড়ে মাকড়শার জ্বালের বিস্তার করে নিজ নিজ কক্ষপথে কাজ করে যায়।

এর উত্তর সরলভাবে বলতে গেলে বলতে হয়। সূত্রধরেরা সকল সময়ই ক্ষমতার পক্ষে, প্রভাবের পক্ষে, প্রতিপত্তির পক্ষে। তারা নির্দিষ্ট কোনো তত্ত্বের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। তারা কেবল ক্ষমতার পক্ষে।

আর তা টিকিয়ে রাখতে তারা যে তত্ত্ব দেয়। তা সকল সময় মানুষের পক্ষে বা সুন্দর পৃথিবীর পক্ষে হয় তা নয়। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই তা মানুষ ও প্রকৃতি বা পৃথিবীর বিপক্ষেই হয়। আবার এর বিপরীতও যে হয় না; তাও নয়। আসলে হাজার হাজার বছরের একটা খেলার কয়েক দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো সিদ্ধান্তে আসা কঠিন।

অন্যদিকে একটা সুন্দর মানবিক-প্রাকৃতিক-নান্দনিক পৃথিবী গঠনে প্রকৃত দার্শনিক ও শিল্পীরা লড়ে যায়। জীবনের সকল সুখ-ঐশ্বর্যকে উপেক্ষা করে মানুষের পক্ষে, মানুবিকতার পক্ষে, সুন্দর বসতের পক্ষে, সহজের পক্ষে, সরল্যের পক্ষে একা হলেও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

অবশ্য দার্শনিক ও শিল্পীদের মধ্যে বড় একটা অংশ সূত্রধরের দালাল হিসেবে সমাজে কাজ করে থাকে। যদিও তাদের নিরানব্বই দশমিক নয় নয় নয় নয় ভাগই সরাসরি সূত্রধরদের সঙ্গে সংযোগ করে উঠতে পারে না। কিন্তু তারা বহু হাত বদলে নিজেদের ফায়দা ঠিক বুঝে পায়।

এই দালালদের মধ্যেও অনেক শ্রেণীভেদ বা স্তরভেদ আছে। এদের প্রথম বা প্রধান শ্রেণী সূত্রধরদের সংযোগকারীদের সরাসরি সংযোগে থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণীরা প্রথম শ্রেণীর দালালদের সংযোগে থাকে। এভাবে দালালের স্তর পৃথিবী জুড়ে মাকড়শার জ্বালের বিস্তার করে নিজ নিজ কক্ষপথে কাজ করে যায়।

তার আগের ইতিহাসের বেশিভাগ জুড়েই আছে দখল-জরবদখলের খেলা। যার যত শক্তি-প্রতিপত্তি সে তত বিস্তার করবে এমনি ছিল অবস্থা। পৃথিবী জুড়ে বসেছিল পশ্চিমা জানোয়ারদের কলোনী বাণিজ্য। এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকা চুষে নিয়ে তারা তাদের সাম্রাজ্য গড়ে আজ সভ্য হয়ে বসে আছে।

এই জালের চক্র চলতে থাকে পরম্পরায়। আর এসব দালালের ফাঁদে পড়ে বহু গুণী দার্শনিক ও শিল্পী নিজের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সূত্রধরদের স্বার্থসিদ্ধি করে যায়।

অন্যদিকে আরেকদল দার্শনিক ও শিল্পী প্রকৃত শিল্প-দর্শন সৃষ্টির উল্লাসে মত্ত থাকে। তারা প্রকৃতপক্ষেই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মানুষের পক্ষে-জীবের পক্ষে-সত্যের পক্ষে-ব্রহ্মাণ্ডের পক্ষে তাদের বার্তা প্রকাশ করার স্বপ্ন দেখে।

একটা উজ্জ্বল-আলোকিত তত্ত্বকে কি করে সূত্রধররা গিলে খায় তার উদাহরণ জগতজুড়ে বিরাজিত। সবই দৃশ্যমান। সব নিয়ে তো আর আলোচনা সম্ভব নয়। আবার সব কিছু নিয়ে কথা বলতে গেল মূল বিষয় থেকেই সরে যেতে হবে। যেহেতু প্রথমেই বলেছি আলোচনা হবে সহজভাবে তাই সহজ একটা উদাহরণে যাই।

গত শতকের সাফল্যের ঘটনা খুঁজতে গেলে হয়তো বলতে হবে মানুষের প্রথম চাঁদে অবহরণের ঘটনা। আর সবচেয়ে বড় ঘটনা বলতে গেলে বলতে হবে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাকে। হিরোশিমা-নাগাশাকির সেই মর্মান্তিক ঘটনার কথা।

তার আগের ইতিহাসের বেশিভাগ জুড়েই আছে দখল-জরবদখলের খেলা। যার যত শক্তি-প্রতিপত্তি সে তত বিস্তার করবে এমনি ছিল অবস্থা। পৃথিবী জুড়ে বসেছিল পশ্চিমা জানোয়ারদের কলোনী বাণিজ্য। এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকা চুষে নিয়ে তারা তাদের সাম্রাজ্য গড়ে আজ সভ্য হয়ে বসে আছে।

(চলবে…)

অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব তিন>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………….
আরো পড়ুন-
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব এক
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব দুই
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব তিন
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব চার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!