ভবঘুরেকথা
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা

-মূর্শেদূল মেরাজ

সভ্যতা সকল সময়ই তার নিজস্ব একটা গল্প বলে বেড়ায়। আর সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করবার জন্য প্রতিনিয়ত এমন সব পরিবেশ-পরিস্থিতি আমাদের চারপাশে নির্মাণ করে। যেন আমরা তাকে অস্বীকার করতে না পারি। অবিশ্বাস করতে না পারি। অনাস্থা না আনতে পারি।

আর সেই গল্পটা বিশ্বাস করে তার পেছনে আমরা হাঁটতে শুরু করি শৈশব থেকেই। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তার দেখানো পথে আমাদের এই নিরন্তন হেঁটে চলা চলতে থাকে আজন্ম। এই মন্ত্রমুগ্ধতাকে কেন্দ্র করে আমাদের পায়ে সুকৌশলে পড়িয়ে দেয়া হয় অদৃশ্য এক ষড়যন্ত্রের বেড়ি।

যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে যেমন প্রাপ্ত হই। তেমনি নিজেরাও আনন্দ নিয়ে নিজেই পরি। আবর তেমনি দিয়ে যাই পরবর্তী প্রজন্মকেও। মনে যাতে কোনো প্রকার প্রশ্নের উদয় না হয়। যাতে কোনো প্রশ্নই করতে না পারি। তার জন্য নানাবিধ মন ভোলানো বিজ্ঞাপনে মুড়ে রাখা হয় আমাদের জীবনকে। আমাদের চিন্তা চেতনাকে।

যদি কোনো অজ্ঞাত কারণবশত: আমরা এতো কিছুর পরও প্রশ্ন করেই ফেলি। বিপ্লব-বিদ্রোহ-সংগ্রামের মতো অপরাধ সংগঠিত করে ফেলি বা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো কথা কল্পনার মধ্যেও আনি। তা প্রতিহত করার জন্যেও কি করা হবে, সেই গল্পটাও আগেই ভেবে রাখে সভ্যতা।

ফলশ্রুতিতে বড় হতে হতে আমরা সেই সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। যা আমাদের দেখানো হয় পরিকল্পিত ভাবে। অথচ সেসব দেখে ভাবতে থাকি সেই স্বপ্নের ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের নিজেদের কথাটাই বলছি। সে স্বপ্ন আমার একান্ত নিজের আবিষ্কার! নিজের সৃষ্টি! নিজের শিল্প!

সভ্যতা আসলে বেশিভাগ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যবহার করে। তার নিজের ছকে বাঁধা স্বপ্নটাকে আমাদের দিয়েই বাস্তবায়ন করিয়ে নেয়ার জন্য। প্রশ্ন উঠতে পারে সভ্যতা কি কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি মহলের খেয়াল? নাকি সময়ের প্রেক্ষাপটে ঘটে যাওয়া ঘটনার ক্রমবিকাশ??

অল্পকথায় বলে নিতে হয়। সভ্যতার রচয়িতা থাকে। থাকে ঝান্ডাধারীও। সেখানেও আছে রাজনীতি। সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতি। সেখানেও ক্ষমতার দখলের খাবলাখাবলি চলে খুব গোপনে। যা প্রকাশ্যে নয়। খেলাটা হয় স্নায়ু টু স্নায়ু।

সভ্যতার পূর্ব লিখিত সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সভ্যতার ঝান্ডাধারীরা অতি কৌশলে তাদের মতবাদ নিরলস ভাবে প্রচার করে চলে। আমরা নানা ভাবে প্রচারিত সেই সব বিজ্ঞাপনের মায়াজালে আবদ্ধ থাকি আজন্ম। জন্মের পর থেকেই বা জন্মের পূর্ব থেকেই আমরা সেই সব বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পরে যাই।

ফলশ্রুতিতে বড় হতে হতে আমরা সেই সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। যা আমাদের দেখানো হয় পরিকল্পিত ভাবে। অথচ সেসব দেখে ভাবতে থাকি সেই স্বপ্নের ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের নিজেদের কথাটাই বলছি। সে স্বপ্ন আমার একান্ত নিজের আবিষ্কার! নিজের সৃষ্টি! নিজের শিল্প!

পরিতাপের বিষয় হলো আমাদেরকে দিয়ে কি কি ভাবানো হবে। তার চিত্রনাট্যটাও সূত্রধরেরা নিজেরা আগেই লিপিবদ্ধ করে রাখে। আর তা আমাদেরকে দিয়ে কেবল বাস্তবায়ন করিয়ে নেয়া হয় মাত্র। এখানে আমরা সেই চিত্রনাট্যের এক্সট্রা অভিনেতা মাত্র। যারা চলচ্চিত্রে থাকে বটে কিন্তু তাদের নাম কেউ জানে না।

যাকে আমরা বাস্তবতা বলে চিহ্নিত করি। আর এই বাস্তবতার গল্পটাই জনসম্মুখে বাস্তবায়ন করা হয়। সেটাইকে লোকে এখন বলে সভ্যতা। এই গল্পের বাইরের পরিবেশ-পরিস্থিতি-গণমানুষকে বলা হয় সভ্যতা বিচ্ছিন্ন মানুষ বা জনপদ।

আমাদের মধ্যে বেশিভাগ মানুষ ভাবে স্রষ্টাই কেবলমাত্র এই খেলাটা আমাদের সাথে খেলে থাকে। যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমরা অনেকেই জানতেই পারি না। বা মানতে চাই না। ঠিক একই খেলার অগনতি স্তর ধারিত্রীতেই সংগঠিত হয় প্রতিনিয়ত। যা সংগঠিত করে এই সমাজের, এই বিশ্বেরই কিছু লোকজন।

আরো মজার বিষয় হলো আমরা কেউ জানি না আমরা কে কোন চরিত্রে অভিনয় করে; কার পারপাস সার্ভ করছি। এই চলমান চলচ্চিত্রের এক একটা অংশ হলেও আমরা এতোই সামান্য চরিত্রে এক একজন অভিনয় করি যে। জানতেই পারি না এই নির্মাণের নির্মাতা কে বা কারা। বা তাদের অস্তিত্ব আদৌ আছে কিনা।

যারা এর মূল সূত্রধর তারা দৃশ্যমান বাস্তবতার অন্তরালে থেকে একই সাথে এতোগুলো গল্প পরিচালনা করতে থাকে যে। কোনটা যে কোন গল্প! কোন গল্পটা কার সাথে যুক্ত! কোন গল্পটা হাজার বছর ধরে চলছে! কোন গল্পটা লক্ষ বছর ধরে চলছে বা তার আগে থেকে!

আর কোন গল্পটা আজ এখন থেকে শুরু হচ্ছে। বা এক মুর্হূত পর থেকে কোন গল্পটা শুরু হবে! এভাবে গল্পের গোলকধাঁধার যোগসূত্র আসলে কি? সাধারণে কেউ তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। সর্বত্র খেলা চলছে। লীলা চলছে। এর মাঝে দৃশ্যমান অগণিত গল্পের সমাহারে একটা সম্মিলিত গল্প চলছে।

যাকে আমরা বাস্তবতা বলে চিহ্নিত করি। আর এই বাস্তবতার গল্পটাই জনসম্মুখে বাস্তবায়ন করা হয়। সেটাইকে লোকে এখন বলে সভ্যতা। এই গল্পের বাইরের পরিবেশ-পরিস্থিতি-গণমানুষকে বলা হয় সভ্যতা বিচ্ছিন্ন মানুষ বা জনপদ।

সভ্যতার পূর্ব লিখিত গল্পটা আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব পরিবার-পরিবেশ-পারিপার্শ্বিক অবস্থা-শিক্ষা-বিনোদন অর্থাৎ সকল কিছুর মধ্য দিয়ে আমাদের দিয়ে করিয়ে নেয়। তাহলে তাদের বিনা পুঁজিতে বড় বড় কাজ করিয়ে নিতে সুবিধা হয়। নইলে একই কাজ করতে তাদের বহু অর্থ ব্যয় করতে হতো।

আর যদি আমাদের মধ্যে কেউ সত্যি সত্যি সেই চিত্রনাট্যের বাইরে কিছু বলেও ফেলি। তাতেও সভ্যতার সূত্রধরেরা ফাঁদ পেতে থাকে, তার থেকেও কি করে ফায়দা লুটে নেয়া যায় সেই নেশায়।

না মেনে নিলেও অলিখিত ভাবে প্রায় প্রত্যেক রাষ্ট্রেই তার নাগরিকদের এক ধরণের শ্রেণীবিন্যাস করে থাকে। কোনো কোনো রাষ্ট্র তা করে নাগরিকের মেধার ভিত্তিতে, কোনো কোন রাষ্ট্র করে প্রভার-প্রতিপত্তির ভিত্তিতে, অনেকে করে অর্থের ভিত্তিতে, অনেকে করে ঐতিহ্য-ঐতিহাসিকতার ভিত্তিতে।

সভ্যতা সেই বিরোধকে প্রকাশ্য বিরোধীতা করলেও। তলে তলে তার পেছনেও যে পুঁজি খাটছে তার জোগানও আদৌতে তারাই দিয়ে থাকে। সূত্রধরেরাই বহু দূর থেকে খেলে যায় খেলা। সভ্যতার সূত্রধরেরা গল্পের প্রায় প্রতিটা ব্যাতিক্রমী চরিত্রকে আলাদা আলাদা ভাগে চিহ্নিত করে পর্যবেক্ষণে রাখে।

অবশ্য বিশেষ চরিত্র হয়ে উঠতে পারলে। প্রথমে তাকে পূর্ব লিখিত গল্পের ভেতরেই কৌশলে টেনে নেয়ার চেষ্টা করে। যা বেশিভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করে। মানুষ তার ষড়রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মায়া, মোহ ও মাৎসর্যেই আটকে থাকে। তাই তাকে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।

তারপরও কিছু মানুষ সেই জালে ধরা পরে না। যদিও তাদের জন্যও থাকে নানামুখি ব্যবস্থা।

প্রত্যেক রাষ্ট্র বা ধর্মই এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। যাতে তার নাগরিকদের একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে বেঁধে রাখতে পারে। এরজন্য ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের রাষ্ট্র তার নিজস্ব বিধিবিধান প্রস্তুত করে। আর এই বিধিবিধান মেনে চললে তাকে সু-নাগরিক। আর এর ব্যাতিক্রমী হলে তারা রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয়।

না মেনে নিলেও অলিখিত ভাবে প্রায় প্রত্যেক রাষ্ট্রেই তার নাগরিকদের এক ধরণের শ্রেণীবিন্যাস করে থাকে। কোনো কোনো রাষ্ট্র তা করে নাগরিকের মেধার ভিত্তিতে, কোনো কোন রাষ্ট্র করে প্রভার-প্রতিপত্তির ভিত্তিতে, অনেকে করে অর্থের ভিত্তিতে, অনেকে করে ঐতিহ্য-ঐতিহাসিকতার ভিত্তিতে।

এমন নানারূপে নানাভাবে রাষ্ট্রের নাগরিকরা অদৃশ্য-অলিখিত ভাবে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ হয়ে বিভিন্ন সুবিধা বা অসুবিধা ভোগ করে বা করতে বাধ্য হয়। সে হিসেবেই চলে রাষ্ট্র। তবে রাষ্ট্র যখন জনতার মাঝে সমতার বদলে কোনো কোনো শ্রেণীকে বিশেষ সুবিধা দিতে যায়।

তখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানাবিধ মতামত প্রকাশ পেতে শুরু করে। কোনো কোনো রাষ্ট্র তা বিবেচনায় নিয়ে আইনকানুন-নিয়মনীতি শিথিল করে জনতাকে সুবিধা দেয়ার উদ্যোগ নেয়। আবার কোনো কোনো রাষ্ট্র জনতার উপর চালায় নির্যাতন-দমন-পীড়ন।

বেশিভাগই অন্যের দেখাদেখি বা বয়সকালের উৎসুকতা থেকে প্রথা ভাঙার খেলায় মেতে উঠে। সকলেই জীবনের একটা সময় পার করে যখন প্রথা ভাঙতে চরম আনন্দ লাভ করে। রাষ্ট্রও সেই বয়সটাকে বিবেচনা করেই আইন প্রণয়ন করে থাকে।

সকল রাষ্ট্রই চায় এমন সব নাগরিক-জনতা বা প্রজা। যারা রাষ্ট্রের সকল নিয়মকানুন বিনা আপত্তিতে মেনে চলবে। বাধ্য শিশুর মতো সকল জায়েজ নাজায়েজ কাজ আদেশের আগেই করে ফেলবে।

কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। রাষ্ট্রে যেমন বাধ্য সন্তান থাকে। তেমনি থাকে অবাধ্য সন্তান। যারা নিয়মের ধার ধারে না। রাষ্ট্রের নিয়ম থোরাই আমলে নেয় তারা। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী হিসেবে গণ্য হয়। তবে সকলেই যে জেনে শুনে বুঝে প্রচলিত সমাজের নিয়ম ভাঙতে চায় তাও নয়।

বেশিভাগই অন্যের দেখাদেখি বা বয়সকালের উৎসুকতা থেকে প্রথা ভাঙার খেলায় মেতে উঠে। সকলেই জীবনের একটা সময় পার করে যখন প্রথা ভাঙতে চরম আনন্দ লাভ করে। রাষ্ট্রও সেই বয়সটাকে বিবেচনা করেই আইন প্রণয়ন করে থাকে।

তবে যারা প্রথা ভাঙ্গে তাদের বড় একটা অংশ নিজেরাই জানে না কেনো প্রথা ভাঙছে। অনেকেই নিছক আনন্দের জন্য এ কাজটি করে থাকে। তবে সমাজের একটি বড় অংশ বেশ সচেতন ভাবে প্রথা ভাঙার কাজটি করে। যাদের চিহ্নিত করা যেতে প্রগতিশীল, সুশীল, সচেতন, উত্তরাধুনিক ইত্যাদি ইত্যাদি নামে।

বোঝার সুবিধার্থে তাদের মধ্যে মোটা দাগে দুইটি ভাগে ভাগ করে নিলে আলোচনায় সুবিধে হয়। এক- দার্শনিক আর দুই- শিল্পী। এখানে দার্শনিক বলতে যারা রাষ্ট্র-সমাজ-জীবন পরিচালনার নতুন পথ প্রবর্তন বা নতুন পথের বিষয়ে দিশা দেখায় তাদের বোঝানো যেতে পারে। অর্থাৎ শিল্পীর বাইরের সকল সচেতন সমাজ।

আর শিল্পী হিসেবে তাদের চিহ্নিত করা যেতে পারে। যারা সমাজ সচেতনতার পাশাপাশি তা শৈল্পিক ও নান্দনিকভাবে উপস্থিত করে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। এই ভাগ কেবল বিশাল জনতার চিন্তা-চেতনাকে ভাগ করে নেয়া; বুঝবার সুবিধার জন্য মাত্র। এর বেশি কিছু নয়।

শিল্পী বলতে সকল ধারার সৃষ্টিশীল মানুষকে বোঝানো যেতে পারে। যারা মূলত দার্শনিকদের নতুন মত-পথকে তাদের শিল্পের ভেতর দিয়ে বহু মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেয়। সেটা হতে পারে লিখে, বলে বা চিত্রায়িত করে। বা অন্য যে কোনো শিল্প মাধ্যমে।

(চলবে…)

অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব দুই>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………….
আরো পড়ুন-
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব এক
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব দুই
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব তিন
অল্পকথায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্পকথা: পর্ব চার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!