-মূর্শেদূল মেরাজ
যদিও তাদের প্রেম পেতে হলে অল্প বিস্তর পাগল হতেই হয়। সাঁইজি তো বলেইছেন-
পাগল পায় পাগলের পারা
দুই নয়নে বহে ধারা,
যেন সুর ধ্বনির ধারা
লালন কয় ধারায় ধারা মিশে আছে।।
পাগল ভক্তদের নিয়ে লিখলে এই লেখা কোনোদিন শেষ হবে না। তাই তাদের নিয়ে অন্য কোনো লেখায় বিস্তারিত লেখা যাবে। আপাতত চিরচেনা বাক্যে এটুকু বলে রাখি ‘পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না’। পাগল ভক্তরা সামাজিক মর্যাদা চায় না। চায় না প্রতিপত্তি-অর্থকড়ি-সম্মান। তারা চায় কেবল একটু প্রেম। এর বেশি কিছু না।
এই একটু প্রেমের কাঙাল হয়েই তারা প্রেম বাগানে প্রেম বিলায়ে যায়। প্রেমের হাট বসায়। মনের মতো মানুষ হলেই সেই প্রেমের দুয়ারে পৌঁছাতে পারে। সকলকে তারা গ্রহণ করেও না। সকলেও তাদেরকে গ্রহণ করতে পারে না।
আরেক শ্রেণীর ভক্তিবাদী ভক্ত আছেন যারা ভক্তি ভক্তি ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এদেরকে ভক্তিবাদী শ্রেণীতে ফেলা যায় না কোনো মতেই। তারপরও যেহেতু ভক্তি দিয়েই তারা নিজেদের প্রমাণ করার চেষ্টা করে তাই তাদেরও এই তালিকাতেই রাখতে হলো।
তারা ভক্তিতে নুয়ে পরার অভিনয় করে যায়। কিন্তু নিজ পরিবেশে আপন চরিত্রে ফিরে যায়। তখন তাদের প্রকৃত চেহারা প্রকাশ পায়। সাধারণত এরা অন্যের সমালোচনা করে জীবন কাটিয়ে দেয়।
কৌশলী ভক্তিবাদী ভক্ত। এই শ্রেণীর ভক্তিবাদী ভক্তরা সময় সময় ভক্তি প্রদর্শন করে। বিনীত ভাব দেখায়। যার সামনে ভক্তিভাব প্রদর্শন করলে আখেরে সুবিধা হবে তাদের সামনে নম নম করে। কিন্তু আড়ালে রুদ্র স্বভাবই পোষন করে।
অন্যান্য ভক্ত
এছাড়াও আরো কিছু প্রকারের ভক্ত দেয়া যায় সাধুর হাটে। যাদের বাতিল শ্রেণী বলা যেতে পারে। এদের কিছু কিছু প্রকারের কথা উপরোক্ত তিন প্রকারের মধ্যে গুটি কয়েক আলোচনা করা হয়েছে। তারপরও আরো কিছু আছে যাদের কোনো প্রকারেই ফেলা যায় না। বা তাদের ভক্ত বলাটাও কষ্টকর।
এই শ্রেণীর মধ্যে অন্যতম হলো অসন্তুষ্ট শ্রেণীর ভক্ত। তারা সর্বক্ষণ নানা কুতর্কে মেতে থাকে। এই কুতর্কের অন্যতম বিষয় হলো তুলনা করা। এটা খারাপ ওটা খারাপ। আমি এই করেছি সেই করেছি। এসব বলে বলে লোক ভাড়ি করে পরিবেশ নষ্ট করা এদের অন্যতম কাজ।
কামুক ভক্ত। এই শ্রেণীর ভক্তের কাজ হলো সর্বক্ষণ কাম আর কামনায় নিজে ডুবে থাকা। পাশাপাশি চারপাশের মানুষকে কামের বাসনা চাঙ্গা করে রাখা।
নেশারু ভক্ত। সাধনের জন্য সাধন পর্বে অনেকে নেশা করে থাকেন। সেটা ভিন্ন বিষয় হতে পারে। কিন্তু এক শ্রেণীর নেশারু দেখা যায় সাধুর বাজারে। যারা শুধু নেশা করার জন্যই এই বাজারে বিচরণ করে। তাদের সর্বক্ষণ নজর থাকে নেশার দিকে। অর্থের দিকে। বৃত্তশালীদের দিকে।
ধান্দাবাজ ভক্ত। এই শ্রেণীর ভক্তের সংখ্যাও কম নয়। তারা মধুর মধুর কথা বলে আগত লোকজনের কাছ থেকে এটা ওটা খাওয়া থেকে শুরু করে চরমতম ধান্দা করতেও ছাড় দেয় না। যেখানে কিঞ্চিৎ পরিমাণ সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে সেখানেই তারা ঘোরাঘুরি করে।
নৈরাস্যবাদী ভক্ত। এই শ্রেণীর ভক্তরা সর্বক্ষণ আমার এটা হচ্ছে না ওটা হচ্ছে না। আমি কেনো পাচ্ছি না। ইত্যাদি বলে বলে নেকি কান্না করে বেড়ায়।
অভিযোগী ভক্ত। এই শ্রেণীর ভক্তরা সর্বক্ষণ অভিযোগ করে বেড়ায়। সকল কিছুতেই তাদের অভিযোগ। অনেকটা বিয়ে বাড়ির দুলাভাই-খালু-ফুফাদের চরিত্রের মানুষ তারা। মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তারা সর্বক্ষণ অভিযোগের আলাপ চালিয়ে যায়।
তারা কেউ কেউ কেবল অভিযোগ করে বিরত থাকে তাই নয়। রীতিমতো আন্দোলনের ঘোষণা পর্যন্ত দিয়ে দেয়। যদিও শেষ বিচারে তারা কিছুই করে না।
কল্পনাবিলাসী ভক্ত। এরা মূলত্ আলস্য শ্রেণীর ভক্ত। তারা নানান পরিকল্পনার কথা শুনিয়ে বেড়ায় সাধুর হাটবাজারে। কিন্তু সেসব যে বাস্তবতার মুখ দেখবে না তা তাদের সাথে প্রথম আলাপে ঠিক ধরা যায় না।
ত্যাগী ভক্ত। ত্যাগী ভক্তদের সংখ্যা কম হলেও আছে। তারা সকল সময়ই ছাড়ের মানুসিকতায় থাকে। অন্যের উপকার হবে কিসে তাতেই তাদের সন্তুষ্টি। নিজের টুকুও তারা অন্যকে দিয়ে খুশি থাকে। অন্যে না পেলেই বরঞ্চ তারা খারাপ থাকে।
সাজুনে ভক্ত। এরা সব সময় বেশভূষায় থাকে। পারলে প্রতি সঙ্গেই তারা নিত্য নতুন চকচকে-কচকচে পোশাক পরে উপস্থিত হয়। সাধুর পোশাক পরে এরা সাধু সাজার অভিনয়ে ব্যস্ত তাকে।
অহংকারী ভক্ত। এরা প্রায় সকল জায়গাতেই যায়। কিন্তু কারো সাথে তেমন কথাবার্তা বলে না। এমনকি দৃষ্টি বিনিময়ও করে না। বিশেষ ভাব নিয়ে থাকে। যেনো কোনো কিছুই তোয়াক্ত করে না। চারপাশে সব কিছু নোংরা এমন একটা ভাব করে।
তবে নিরব থাকলেই বা একা থাকলেই সকলে অহংকারী নয়। অহংকারী ভক্তদের দেখলেই চেনা যায়। তাদের আচরণে তা স্পষ্ট হয়।
শিল্পী-লেখক-গবেষক-সাংবাদিক ভক্ত। এরা পেশায় পৃথক পৃথক হলেও তাদের নিয়ে বিস্তারিত আর বলছি না। তাদের সম্পর্কে অল্পবিস্তর ধারণ সকলেরই আছে।
সাধক ভক্ত। এরা মূলত সাধন বুঝবার জন্য ভাবজগতে ঘুরে বেড়ায়। এরা করো ক্ষতিও করে না। কারো বিশেষ উপকার যে করতে পারে তাও না। তারা নিজেদের সাধনার জন্য যা যা প্রয়োজন তা করে বেড়ায়।
ভোগী ভক্ত। এরা ভোগবাদী। ভোগ ভিন্ন তাদের কোনো চিন্তা-চেতনা নাই। ভাববাদের সাথে এদের চারিত্রিক গুণাবলী না মিললেও তারা ভাবজগতে ঘুরে বেড়ায়। আর ভাববাদের সর্বনাশ করে ছাড়ে।
ত্যাগী ভক্ত। ত্যাগী ভক্তদের সংখ্যা কম হলেও আছে। তারা সকল সময়ই ছাড়ের মানুসিকতায় থাকে। অন্যের উপকার হবে কিসে তাতেই তাদের সন্তুষ্টি। নিজের টুকুও তারা অন্যকে দিয়ে খুশি থাকে। অন্যে না পেলেই বরঞ্চ তারা খারাপ থাকে।
গুণী ভক্ত। এরা মূলত দৃষ্টি দেয় শুদ্ধ ভাববাদকে কি করে এগিয়ে নেয়া যায় সেই দিকে। সেই লক্ষে তারা কাজ করে যায়। সকল সময় তারা সফল হয় তা নয়। কিন্তু তাদের চেষ্টার কমতি থাকে না।
একদিন সীতা মা হনুমানের ভক্তি দেখে খুশি হয়ে একটি মালা দিয়েছিলেন। হনুমান মালাটি নিয়ে একটি একটি করে মালার সব পুঁথি খুলে ফেললো। সীতা এই দৃশ্য দেখে জিজ্ঞাসা করলে, সে এ কি করছে? উত্তরে হনুমান বলল, এই পুঁথির মধ্যে তার প্রভু শ্রী রাম ও মাতা সীতার কোন চিহ্ন নেই তাই সে এই মালা গ্রহণ করতে পারবে না।
মানী ভক্ত। সামাজিক অবস্থান তৈরি করার লক্ষ্যে কিছু লোকজন সাধুরবাজার যাতায়াত করে। তারা হচ্ছেন এই শ্রেণীর। ভাববাদকে তারা পুরোপুরি ধারণ না করলেও ভাববাদের প্রচার প্রসারে তারা ভূমিকা রাখে। আর এই ভূমিকার পেছনে তাদের সামাজিক মর্যাদার বৃদ্ধির বিষয়টি বিশেষ নজরে থাকে।
উদ্দ্যামী-উদ্যোগী ভক্ত। এরা মূলত কখন কোন কাজ করা প্রয়োজন। কাজকে কি করে এগিয়ে নেয়া যায় তা নিয়ে মশগুল থাকে। নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে সাধুরবাজারকে জমজমাট রাখে।
কুলীন ভক্ত। যাদের প্রচুর অর্থ আছে তারা সেই অর্থ প্রদর্শনের জন্য সাধুরবাজারে আসেন। দামী পোশাক, দামী গাড়ি, সুন্দরী নারী নিয়ে তাদের চলাচল। অর্থকড়ি-বৃত্ত-সম্পত্তির আলাপ করে তারা সকলকে ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে দেয় এসব তাদের ঢেড় আছে।
কাঙ্গাল ভক্ত। এরা সর্বত্রই থাকে। এদের কাজ হলো সারাক্ষণ দু:খের কাহিনী শোনাবে। এটা ওটা কাজ করে দেবে। শেষে হাত পাতবে।
কাণ্ডারী ভক্ত। সাধুর হাটবাজারে এই প্রকারের ভক্তরা দুই কুল রক্ষা করে চলে। তারা গুরু, আখড়া, আশ্রম, উৎসব, ভক্ত, অনুরাগী সকলের সাথে মেলবন্ধানের চেষ্টায় রত থাকে তারা।
মুশকিল আসান ভক্ত। এদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে এরা থাকে। এদের কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। কোনো কিছুর বিনিময়ে বা বিনিময় ছাড়াও এরা চাহিবা মাত্র সকল কিছু হাজির করে দিতে সিদ্ধ হস্ত।
জগতে ভক্তিবাদী ভক্তের কাহিনীর শেষ নেই। তারপরও ভক্তিবাদী ভক্তের কথা বললে ‘রাম ভক্ত হনুমান’এর কথা আসবেই আসবে। তার ভক্তির কাহিনীর শেষ নেই। সেসব প্রায় সকলরেই জানা তারপরও ছোট্ট একটা কাহিনী উল্লেখ করছি-
একদিন সীতা মা হনুমানের ভক্তি দেখে খুশি হয়ে একটি মালা দিয়েছিলেন। হনুমান মালাটি নিয়ে একটি একটি করে মালার সব পুঁথি খুলে ফেললো। সীতা এই দৃশ্য দেখে জিজ্ঞাসা করলে, সে এ কি করছে? উত্তরে হনুমান বলল, এই পুঁথির মধ্যে তার প্রভু শ্রী রাম ও মাতা সীতার কোন চিহ্ন নেই তাই সে এই মালা গ্রহণ করতে পারবে না।
তখন সীতা মা প্রশ্ন করলেন হনুমানকে তুমি যেই দেহখানা ধারণ করে আছো এতেও তো রামচন্দ্রের কোন চিহ্নও নেই, তাহলে তুমি কেন এই দেহখানা পরিত্যাগ করছ না। উত্তরে হনুমান বলল, এই নশ্বর দেহে যদি প্রভুর কোন চিহ্ন না থাকতো তাহলে আমি এই দেহ পরিত্যাগ অবশ্যই করতাম।
(চলবে…)
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………….
আরো পড়ুন:
ভক্তের প্রকার: প্রথম কিস্তি
ভক্তের প্রকার: দ্বিতীয় কিস্তি
ভক্তের প্রকার: তৃতীয় কিস্তি
ভক্তের প্রকার: চতুর্থ কিস্তি
ভক্তের প্রকার: পঞ্চম কিস্তি