ভবঘুরেকথা
সৃষ্টিতত্ত্ব রহস্য ব্রহ্মাণ্ড জগৎ মহাজগত মহাবিশ্ব

হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত এক হাদীছে হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টির অব্যবহিত পরের একটি বর্ণনা রহিয়াছে এইভাবে। নবী করীম (স) বলেন-

“আল্লাহ তাআলা আদমকে সৃষ্টি করিলেন। তাঁহার দৈর্ঘ্য ছিল ষাট হাত। আল্লাহ তাআলা বলিলেন:যাও, ঐ যে ফেরেশতাগণ বসিয়া রহিয়াছে উহাদেরকে সালাম দাও। তাহারা কী জবাব দেয় তাহা শুনিবে। কেননা, উহাই হইবে তোমার ও তোমার সন্তানদের অভিবাদন।

তিনি গিয়া বলিলেন, আস্সালামু আলায়কুম। জবাবে তাহারা বলিলেন, আসোলামু আলায়কা ওয়া রাহমাতুল্লাহ। তাঁহারা রহমতুল্লাহ শব্দটি যোগ করিলেন। তারপর যাহারাই জান্নাতে প্রবেশ করিবে, তাহারা তাহারই আকৃতির হইবে।

অতঃপর মানুষের আকৃতি খর্ব হইতে হইতে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হইয়াছে।” (আল-আদাবুল মুফরাদ, ৪৪৭ নং অধ্যায়, হাদীছ নং ৯৭৮, পৃ. ২৫৪; ১৯৭৬ সালে তাশখন্দে মুদ্রিত, ইফা মুদ্রিত মকৃত অনুবাদ, ২খ, পৃ. ৪৯১-৪৮২; বুখারী ২৩, পৃ. ১১৯-২০; কিতাবুল ইসতিযান, বাব-বাদউস সালাম; মুসলিম, কিতাবুল জান্নাত ও সিফাতু নাঈমিহা ওয়া আহলিহা)

আদম (আ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব

আল্লাহ তাআলা নূরের তৈরী ফেরেশতা ও আগুনের তৈরী জিন্ন জাতির উপর কেন আদমকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করিলেন, কিভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দান করিলেন, কেনই-বা মানবজাতির মধ্যে অশান্তি সৃষ্টিকারী রক্তপাতকারী থাকা সত্ত্বেও এই কাদামাটির সৃষ্টি মানুষকেই খলীফা (প্রতিনিধি) বানাইয়া দুনিয়ায় পাঠাইবার জন্য বাছিয়া লইলেন, তাহার কারণও বর্ণিত হইয়াছে আল-কুরআনে। আল্লাহ তাআলা বলেন।

“আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তৎপর সে সমুদয় ফেরেশতাদের সম্মুখে প্রকাশ করিলেন এবং বলিলেন, এই সমুদয়ের না আমাকে বলিয়া দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” (২: ৩১)

ফেরেশতাগণের জ্ঞানভাণ্ডারে সে জ্ঞান ছিল না। তাই তাহাদের পক্ষে তাহা বলা সম্ভবত হয় নাই। তাহারা লা জবাব হইয়া গেলেন। তাঁহাদের তখনকার অবস্থা এইভাবে বিবৃত হইয়াছে-

“তাহারা বলিল, আপনি মহান, পবিত্র! আপনি আমাদেরকে যাহা শিক্ষা দিয়াছেন তাহা ছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞানই নাই। আপনিই জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময় “ (২: ৩১)

যখন যে গুণের প্রতি তিনি নিবিষ্ট হইতেন, মুহূর্তেই তাহা তাহার সত্তায় পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হইত। উদাহরণস্বরূপ যখন তাহার উপর,(আল-আওয়ালু) গুণবাচক পবিত্র নামটির বিভাসন ঘটিল তখন প্রতিটি বস্তু তাঁহার মানসপটে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।

সুতরাং ফেরেশতাকুলের উপর আদম (আ)-এর সুস্পষ্ট প্রাধান্য সূচিত হইল। শুধু বস্তুসমূহের নামই আল্লাহ তাআলা আদম (আ)-কে শিক্ষা দিয়াছিলেন এমন নহে। আল্লামা রাগিব আল ইসফাহানীর ভাষায়? “নামকের পরিচয় চিত্র অন্তরে ও মস্তিষ্কে ধারণ ব্যতীত নামের পরিচয় অর্জন সম্ভব নহে।” (আল-মুফদারাত ফী গারীবিল কুরআন, পৃ: ২৪৪)

মওলানা আশরফ আলী থানবী (র) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর বাহ্যিক পরিচয় ও লক্ষণাদি এবং এইগুলির বৈশিষ্ট্যাবলী তাঁহাকে ব্যাপকভাবে শিক্ষা দিয়াছেন।” (দ্র. তাফসীরে বয়ানুল কুরআন, সূরা বাকারার ৩১তম আয়াত)

অন্যান্য বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থেও অনুরূপ ব্যাখ্যা রহিয়াছে। আল্লামা কুরতুবী বলেন, “আরবী ভাষায় যাত, নাক্স, আইব্‌ন ও ইসম শব্দগুলি সমার্থক”। তাফসীরে কাশশাফে আছে, “আল্লাহ তাআলা আদমকে ঐ সমস্ত নামের নামকসমূহের জ্ঞান দান করিলেন।”

বায়যাবী বলেন, “তিনি তাঁহাকে বস্তুসমূহের নাম, সত্তা, গুণাবলী, ধর্ম, সেই সাথে যাবতীয় জ্ঞানের সূত্র ও নীতিমালা এবং প্রযুক্তির নিয়মকানুন ও এই গুলির উপকরণাদির ব্যবহার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়াছেন।” ইমাম রাযী (র) তাফসীরে কাবীরে লিখেন,

“আল্লাহ তাআলা তাহাকে প্রতিটি বস্তুর বিবরণ, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যর জ্ঞান দান করিলেন।”

আল্লামা মাযহারী তাবীল হিসাবে তাঁহার নিজস্ব একটি মত প্রকাশ করিয়াছেন। উক্ত আয়াতে উল্লিখিত (নামসমূহ) শব্দের দ্বারা আল্লাহর সত্তা ও গুণবাচক নামসমূহ বুঝান হইয়াছে। এইগুলির সংক্ষিপ্ত ও সামগ্রিক ইলম তিনি পাইয়া গিয়াছিলেন এবং প্রতিটি গুণের সহিত এমন পরিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হইয়া গিয়াছিল যে,

যখন যে গুণের প্রতি তিনি নিবিষ্ট হইতেন, মুহূর্তেই তাহা তাহার সত্তায় পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হইত। উদাহরণস্বরূপ যখন তাহার উপর,(আল-আওয়ালু) গুণবাচক পবিত্র নামটির বিভাসন ঘটিল তখন প্রতিটি বস্তু তাঁহার মানসপটে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।

অনুরূপভাবে (আল-আখিরু) নামটির বিভাসনের প্রসঙ্গও অনুরূপ (দ্র. তাফসীরে মাজেদী, সূরা বাকারার ৩১ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়)

সাম্প্রতিক কালের মিসরীয় তাফসীর (আরবী) ফী যিলালিল কুরআন-এর লেখক সায়্যিদ কুতব শহীদ এই নামসমূহ শব্দের একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়াছেন এইভাবে-

মানুষের জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব

“এ পর্যায়ে আমরা যেন অন্তর্চক্ষু দিয়া দেখতে পাচ্ছি যে, যা ফেরেশতারা দেখেছিলেন, খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণকালে যে গুপ্ত রত্নভাণ্ডার আল্লাহ্ মানুষকে দিয়েছিলেন তার কিছুটা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। সে জিনিসটা হচ্ছে নাম দ্বারা নির্দিষ্ট জিনিসকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা।

ব্যক্তি ও বন্ধুর নামকরণের ক্ষমতা এবং সেই নামকে ঐ ব্যক্তি বা বস্তুর সংকেত চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়া। পৃথিবীতে মানুষের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা, মানুষ এভাবে নামকে জিনিসের সঙ্কেত হিসাবে ব্যবহার করতে না পারলে কিরূপ জটিলতা দেখা দিত তা কল্পনা করলেই এই ক্ষমতার মূল্য কত তা আমরা বুঝতে পারি।

পারস্পরিক লেনদেন ও মনোভাব ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে কী দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, তা একটু চিন্তা করলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। একটি জিনিস সম্পর্কে দুজনে আলোচনা করতে চাইলে ঐ জিনিসটা হাযির করতে হতো। নচেৎ পুরো কথাটাই দুর্বোধ্য থেকে যেতো।

মনে করুন একটা পাহাড় সম্পর্কে কথা বলতে হলে বক্তা ও শ্রোতাকে সশরীরে সোজাসুজি পাহাড়ের কাছে চলে যেতে হতো। কোন ব্যক্তি সম্বন্ধে কথা বলতে হলে সেই ব্যক্তিকে সশরীরে হাজির করে নিতে হতো। এভাবে এ সমস্যা এত কঠিন আকার ধারণ করতো যে,

আল্লাহ মানুষকে নাম ব্যবহারের ক্ষমতা না দিলে তাদের গোটা জীবনটাই দুর্বিসহ হয়ে উঠতো।” (ফী যিলালিল কুরআন, ১খ, পৃ. ১০৫-১০৬, বাংলা অনু., সূরা বাকারা ৩০-৩৩ আয়াতের ব্যাখ্যায়)

সুতরাং হযরত আদমের জ্ঞান কেবল বস্তুসমূহের নামের জ্ঞান ছিল না, ছিল ব্যাপক জ্ঞান-যাহা এই মহাবিশ্বে আল্লাহর প্রতিনিধিরূপে দায়িত্ব পালনের জন্য অপরিহার্য ছিল (দ্র. তফসীরে উসমানী, ১খ, ২৪-২৫)

ফেরেশতাগণের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি ও উহার স্বীকারোক্তি

আদমকে দুনিয়াতে আল্লাহ্ তাআলা খলীফারূপে কেন প্রেরণ করা হইবে এবং ফেরেশতাগণই বা কী করিয়া আদম সন্তানের দুর্বলতা উপলব্ধি করিলেন, তাহার একটি বর্ণনা দিয়াছেন মওলানা হিফযুর রহমান। তিনি বলেন,

“এটা মনে করা ভুল যে, এ স্থলে ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা এ উদ্দেশ্যে ছিল যে, তারা আল্লাহর সাথে বাদানুবাদ করতে বা তাঁর সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিদ্রান্বেষণ করতে চেয়েছিলেন, বরং তাঁরা আদম সৃষ্টির তাৎপর্য এবং তাকে খলীফা বানানোর রহস্য কি তা জানতে চেয়েছিলেন।

যা হোক, আল্লাহ্ তাআলা তাদের এরূপ বাকভঙ্গির উপর তাদেরকে সাবধান করে দেন। অতঃপর তাদের সেই জিজ্ঞাসার, যার মধ্যে আদমকে হেয় প্রতিপন্ন করার আভাস ছিল, উত্তর এমনভাবে দেন যাতে ফেরেশতারা শুধু আদমের শ্রেষ্ঠত্বই স্বীকার করেনি, বরং নিজেদের দুর্বলতা ও পশ্চাৎপদতা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করেছিল।

কিন্তু যে ইবলীস আদম সৃষ্টির সূচনা হইতেই প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিতেছিল, আদম অবয়বে পদাঘাত করিয়া যে তাহার বিদ্বেষ চরিতার্থ করিত, তাহার সম্মুখে ঐ মহা সত্যটি উঘাটিত হইল না। তাই ফেরেশতাগণ যেখানে আল্লাহর আদেশ পাওয়ামাত্র সিজদায় পড়িয়া গেলেন, ইবলীস তখন অন্য পথ ধরিল। তাহার জন্য অন্য পরিণতি অপেক্ষা করিতেছিল।

যেহেতু মহা প্রজ্ঞাশীল আল্লাহর নৈকট্যে তারা ছিলেন তাই তৎক্ষণাৎ বুঝে নিলেন যে, আল্লাহর প্রশ্নের উদ্দেশ্য তাদেরকে পরীক্ষা করা নয়, বরং এই মর্মে সতর্ক করে দেওয়া যে, আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা আল্লাহর পবিত্রতা মাহাত্ম্য বর্ণনার আধিক্যের উপর নয়, ইলম-এর উপর নির্ভর করে।

কেননা বিশ্ব পরিচালনা ইম ব্যতীত সম্ভব নয়। অতএব যখন আল্লাহ্ তাআলা আদমকে পরিপূর্ণ ইম-এর অধিকারী করেছেন তখন নিঃসন্দেহে তিনিই দুনিয়ার প্রতিনিধিত্বের অধিক যোগ্য। আর প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ্ তাআলা ফেরেশতাদের উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তাতে তারা দুনিয়ায় সমস্ত কামনা-বাসনা ও রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত।

তাই এ সমস্ত ব্যাপারে তাদের কোন ধারণাই নেই, আর আদমকে যেহেতু এ সমস্ত ব্যাপারে মুখোমুখি হতে হবে তাই এ সমস্ত বিষয়ে জ্ঞানলাভ করা তার জন্যে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। মহাজ্ঞানী আল্লাহ্ তাআলা প্রকৃতই তাঁকে ঐ সমস্ত জিনিসের জ্ঞান দান করেছিলেন এবং তার জন্য যা কিছু জানার প্রয়োজন ছিল সবকিছুই তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

“মোটকথা হযরত আদম (আ)-কে জ্ঞান নামক গুণ দ্বারা গুণান্বিত করায় ফেরেশতারা বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর খিলাফতের যোগ্যতাকে স্বীকার করে নিতে। তারা একথা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, যদি আমাদেরকে আল্লাহর খলীফা করা হতো তাহলে বিশ্বসৃষ্টির যাবতীয় রহস্য থেকে আমরা মূর্খই রয়ে যেতাম এবং আল্লাহ্ তাআলা সৃষ্টির পরতে পরতে যে সমস্ত জ্ঞান সন্নিবেশিত করেছেন তা অনবহিত রয়ে যেতাম।

এ জন্যে যে, না আমাদের পানাহারের প্রয়োজন আছে, সে জন্য জমির নীচে সংরক্ষিত রিযিক ও ধনভাণ্ডারের অন্বেষণ করব, না আমাদের ডুবে যাওয়ার আশংকা আছে যে, সে জন্য বিভিন্ন প্রকারের নৌযান উদ্ভাবন করব এবং না আমাদের রোগ-ব্যাধির আশঙ্কা আছে যে, সে জন্য বিভিন্ন প্রকারের ঔষধের বৈশিষ্ট্য ও রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, প্রাকৃতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, মহাকাশ সম্পর্কিত জ্ঞান, চিকিৎসা বিদ্যা, বস্তুগত জ্ঞান প্রভৃতি অগণিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করব।

এটা শুধু মহান সৃষ্টি মানবের জন্যেই সাজে যে, তারা পৃথিবীতে “আল্লাহর প্রতিনিধি হবে এবং ঐ সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রহস্যাদি আয়ত্ত করে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবে।” (কাসাসুল কুরআন, ১খ, ইফা প্রকাশিত পৃ. ১৮-২১, সংক্ষেপিত ও ঈষৎ সম্পাদিত)

কিন্তু যে ইবলীস আদম সৃষ্টির সূচনা হইতেই প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিতেছিল, আদম অবয়বে পদাঘাত করিয়া যে তাহার বিদ্বেষ চরিতার্থ করিত, তাহার সম্মুখে ঐ মহা সত্যটি উঘাটিত হইল না। তাই ফেরেশতাগণ যেখানে আল্লাহর আদেশ পাওয়ামাত্র সিজদায় পড়িয়া গেলেন, ইবলীস তখন অন্য পথ ধরিল। তাহার জন্য অন্য পরিণতি অপেক্ষা করিতেছিল।

আল-কুরআনের ভাষায়- “যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বলিলাম, আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করিল, সে অমান্য করিল ও অহঙ্কার করিল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হইল।” (২:৩৪)

ইবশীসের দম্ভ ও তাহার পরিণতি

আল্লাহ তাআলা যাহির-বাতিন অস্তর-বাহির সবকিছু অবগত থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববাসীর জ্ঞাতার্থে ইবলীসকে তাহার নির্দেশ পালন না করার কারণ জিজ্ঞাসা করেন এবং তাহার ঔদ্ধত্যপূর্ণ কূটতর্ক ও ইহার পরিণতিতে করুণ পরিণতির কথাও আসমানী কিতাবসমূহে বর্ণনা করেন। আল-কুরআনের ভাষায়?

“তিনি বলিলেন, আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কী তোমাকে নিবৃত্ত করিল যে, তুমি সিজদা করিলে না? সে বলিল, আমি তাহার তুলনায় শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ্ আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করিয়াছেন এবং তাহাকে কদম দ্বারা সৃষ্টি করিয়াছেন।

তিনি বলিলেন, এই স্থান হইতে নামিয়া যাও, এখানে থাকিয়া অহঙ্কার করিবে ইহা হইতে পারে না। সুতরাং বাহির হইয়া যাও, তুমি অধমদের অন্তর্ভুক্ত।” (৭:১২-১৩)

“তখন ফেরেশতাগণ সকলে একত্রে সিজদা করিল, ইবলীস ব্যতীত। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হইতে অস্বীকার করিল। আল্লাহ্ বলিলেন, “হে ইবলীস! তোমার কি হইল যে, তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হইলে না? সে বলিল, আপনি গন্ধযুক্ত কর্দমের শুষ্ক ঠঠনে মৃত্তিকা হইতে যে মানুষ সৃষ্টি করিয়াছেন,

আমি তাহাকে সিজদা করিবার নহি। তিনি বলিলেন, তবে তুমি এখান হইতে বাহির হইয়া যাও; কারণ তুমি তো অভিশপ্ত এবং কর্মফল দিবস পর্যন্ত অবশ্যই তোমার প্রতি রহিল লানত।” (১৫:৩০-৩৪)

এইভাবে মহান আল্লাহ্ তাআলার একটি আদেশ অমান্য করায় আসমানে-যমীনে আযাষীলের দীর্ঘকালের ইবাদত-বন্দেগী ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল।

শয়তানের অবকাশ প্রার্থনা ও দম্ভোক্তি

“সে (ইবলীস) বলিল, পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন। তিনি বলিলেন, যাহাদিগকে অবকাশ দেওয়া হইয়াছে তুমি অবশ্যই তাহাদের অন্তর্ভুক্ত হইলে। সে বলিল, আপনি আমাকে শাস্তি দান করিলেন, এইজন্য আমিও আপনার সরল পথে মানুষের জন্য নিশ্চয়ই ওঁৎ পাতিয়া থাকিব।

অতঃপর আমি তাহাদের নিকট আসিবই তাহাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ, দক্ষিণ ও বাম দিক হইতে এবং আপনি তাহাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাইবেন না। তিনি বলিলেন, এই স্থান হইতে ধিকৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় বাহির হইয়া যাও। মানুষের মধ্যে যাহারা তোমার অনুসরণ করিবে নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করিবই।” (৭:১৪-১৮)

কুরআন শরীফের অন্যত্র ঐ একই ঘটনার বিবরণ আসিয়াছে ভিন্নশব্দে-

“তিনি বলিলেন, হে ইবলীস! আমি যাহাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করিলাম তাহার প্রতি সিজদাবনত হইতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করিলে, না তুমি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সে বলিল, আমি উহা হইতে শ্রেষ্ঠ; আপনি আমাকে আগুন হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং উহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন কর্দম হইতে।

তিনি বলিলেন, তুমি এখান হইতে বাহির হইয়া যাও, নিশ্চয় তুমি বিতাড়িত এবং তোমার উপর লানত স্থায়ী হইবে, কর্মফল দিবস পর্যন্ত। সে বলিল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে অবকাশ দিন উথান দিবস পর্যন্ত। তিনি বলিলেন,

“তুমি অবকাশ-প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হইলে অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত? সে বলিল, ‘আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি উহাদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করিব, তবে উহাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে নহে।’

তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে? হাওয়া বলিলেন, আমি নারী। আদম বলিলেন, তুমি কেন সৃষ্টি হইয়াছ? হাওয়া বলিলেন, যাহাতে আপনি আমার সহিত বসবাস করেন এবং শান্তি লাভ করেন। ফেরেশতাগণ তখন আদমের বিদ্যার দৌড় কি পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে দেখার উদ্দেশ্যে আদমকে প্রশ্ন করিলেন, এর নাম কি হে আদম?

তিনি বলিলেন, “তবে ইহাই সত্য, আর আমি সত্যই বলি, তোমার দ্বারা ও তোমার অনুসারীদের দ্বারা আমি জাহান্নাম পূর্ণ করিবই।” (৩৮:৭৫-৮৫)

কুরআন শরীফের অন্যত্র শয়তানের দম্ভোক্তিটি বিবৃত হইয়াছে এইভাবে-

“সে বলিল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করিলেন, তজ্জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপকর্মটি অবশ্যই শোভন করিয়া তুলিব এবং আমি উহাদের সকলকেই বিপথগামী করিব, তবে উহাদের মধ্যে আপনার নির্বাচিত বান্দাগণ ব্যতীত।” (১৫:৩৯-৪০)

তাহারই বিভ্রান্তকরণের কৌশল কত ব্যাপক হইবে, তাহার বর্ণনা রহিয়াছে সূরা আরাফের ১৪ হইতে ১৮ নং আয়াতে।

আল্লাহ তাআলা ও পূণ্যবান আদম সন্তানদের ব্যাপারে তাহার গভীর আস্থার কথা উল্লেখ করিয়া শয়তানের অনুসারীদের কঠোর পরিণতির কথা বর্ণনা করেন এই ভাবে-

“বিভ্রান্তদের মধ্যে যাহারা তোমার অনুসরণ করিবে, তাহারা ব্যতীত আমার বান্দাদের উপর তোমার কোনই ক্ষমতা থাকিবে না। অবশ্যই জাহান্নাম তাহাদের সকলেরই প্রতিশ্রুত স্থান, উহার সাতটি দরজা আছে, প্রত্যেক দরজার জন্য পৃথক পৃথক শ্ৰেণী আছে।” (১৫:৪২-৪৫) হাওয়া (আ)-এর সৃষ্টি ও বেহেশতে বসবাসের আদেশ

আল্লাহ্ তাআলা বলেন- “এবং আমি বলিলাম, হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেথা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে আহার কর ….।” (২:৩৫)

এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা ইবন কাছীর (র) বলেন, “আয়াতের বিন্যাস হইতে বুঝা যায়, হাওয়া (আ) আদম (আ)-এর জান্নাতে প্রবেশের পূর্বেই সৃষ্টি হইয়াছেন। কিন্তু কেহ কেহ বলেন, হাওয়ার সৃষ্টি হইয়াছে আদম (আ)-এর জান্নাতে প্রবেশের পর, যেমনটি সুদ্দী হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রা) ও সাহাবীগণের অনেকের বরাতে বর্ণনা করেন।

এই বর্ণনায় বলা হয়:ইবলীস জান্নাত হইতে বহিষ্কৃত হয় এবং আদম (আ)-কে জান্নাতে বসবাস করিতে দেওয়া হয়। তিনি তখন জান্নাতে একাকী ঘোরাফেরা করিতেন, তাঁহার সাথে বসবাসের জন্য তাহার স্ত্রী ছিলেন না। একবার তিনি ঘুম হইতে উঠিয়া দেখিলেন, তাঁহার শিয়রে একজন নারী উপস্থিত, যাহাকে আল্লাহ্ তাআলা তাঁহার বাম পাজর হইতে সৃষ্টি করিয়াছিলেন।

তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে? হাওয়া বলিলেন, আমি নারী। আদম বলিলেন, তুমি কেন সৃষ্টি হইয়াছ? হাওয়া বলিলেন, যাহাতে আপনি আমার সহিত বসবাস করেন এবং শান্তি লাভ করেন। ফেরেশতাগণ তখন আদমের বিদ্যার দৌড় কি পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে দেখার উদ্দেশ্যে আদমকে প্রশ্ন করিলেন, এর নাম কি হে আদম?

জবাবে আদম বলিলেন, হাওয়া। ফেরেশতাগণ বলিলেন, তাহার হাওয়া নামকরণের কারণ কি? আদম (আ) বলিলেন, সে এ বা জীবিত বস্তু হইতে নির্গত হইয়াছে বলিয়া তাহার নামকরণ করা হইয়াছে।” (মুখতসর তাফসীরে ইব্‌ন কাছীর, ১খ, ৫৪, মুহাম্মদ আলী সাব্‌নী সম্পা.)

…………………………
সীরাত বিশ্বকোষ থেকে

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………..
আরও পড়ুন-
মহাবিশ্বের উৎপত্তি : প্রথম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি : দ্বিতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : প্রথম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : দ্বিতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : তৃতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : চতুর্থ কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : পঞ্চম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : ষষ্ঠ কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : সপ্তম কিস্তি
সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে প্লাতনের মতবাদ
মহাবিশ্বের সৃষ্টি কাহিনী
পবিত্র কোরানে সৃষ্টিতত্ত্ব
আরশ ও কুরসী সৃষ্টির বিবরণ
সাত যমীন প্রসঙ্গ
সাগর ও নদ-নদী
পরিচ্ছেদ : আকাশমণ্ডলী
ফেরেশতা সৃষ্টি ও তাঁদের গুণাবলীর আলোচনা
পরিচ্ছেদ : ফেরেশতাগণ
জিন সৃষ্টি ও শয়তানের কাহিনী
সীরাত বিশ্বকোষে বিশ্ব সৃষ্টির বিবরণ
আদম (আ) পৃথিবীর আদি মানব
আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য
আদম (আ)-এর সালাম
আদম (আ)-এর অধস্তন বংশধরগণ
হাদীসে আদম (আ)-এর সৃষ্টি প্রসঙ্গ
আদম (আ)-এর সৃষ্টি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!