-আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসি
আল্লাহ তা’আলা বলেন- স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি। তারা বলল, আপনি কি, সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস তুতি ও পবির্ততা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, আমি যা জানি তোমরা জান না।
এবং তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সে সমুদয় ফেরেশতার সম্মুখে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, তোমরা আমাকে এ সবের নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তারা বলল, আপনি মহান, পবিত্র।
আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞানই নেই। বস্তৃত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়।
তিনি বললেন, হে আদম! তাদেরকে এ সকল নাম বলে দাও। যখন সে তাদেরকে এ সকল নাম বলে দিল, তিনি বললেন, আমি কি তােমাদেরকে বলিনি যে, আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যা ব্যক্ত কর বা গোপন রােখ আমি তাও জানি?
আর যখন ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল, সে অমান্য করল ও অহংকার করল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
এবং আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবতী হয়ে না। হলে তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু শয়তান সেখান থেকে তাদের পদস্থলন ঘটালো এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করল।
আমি বললাম, তোমরা একে অন্যের শক্ররূপে নেমে যাও, পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল। তারপর আদম তার প্রতিপালকের নিকট থেকে কিছু বাণী প্রাপ্ত হলো। আল্লাহ তার প্রতি ক্ষমা পরবশ হলেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
আমি বললাম, তোমরা সকলেই এ স্থান থেকে নেমে যাও। পরে যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সৎপথের কোন নির্দেশ আসবে, তখন যারা আমার সৎপথের অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।
যারা কুফরী করে ও আমার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে তারাই জাহান্নামী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন- আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্তের ন্যায়। আল্লাহ তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন; তারপর তাকে বলেছিলেন, হও; ফলে সে হয়ে যায়। (৩ ৪ ৫৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন- হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দু’জন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন।
এবং আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাঞো কর এবং সতর্ক থাক আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে। আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। (৪ : ১)
যেমন অন্য আয়াতে বলেন- হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি। বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকী। আল্লাহ সব কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন। (৪৯ : ১৩)
বললেন, আমি কি তােমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবতী হতে নিষেধ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্ৰু? তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছি, তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর; তা হলে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন- তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়। (৭ : ১৮৯)
অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেন- আমিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করি, তারপর রূপদান করি, তারপর ফেরেশতাদের আদমকে সিজদা করতে বলি, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করে। যারা সিজদা করল, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হলো না।
তিনি বললেন, আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন সিজদা করা থেকে কিসে তোমাকে বারণ করল? সে বলল, আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ; আমাকে তুমি আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছ। আর তাকে সৃষ্টি করেছ কাদা মাটি দিয়ে। তিনি বললেন, এখান থেকে তুমি নেমে যাও, এখানে থেকে তুমি অহংকার করবে তা হতে পারে না। সুতরাং তুমি বের হয়ে যাও, তুমি অধমদের অন্তর্ভুক্ত।
সে বলল, পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে তুমি অবকাশ দাও। তিনি বললেন, যাদেরকে অবকাশ দেয়া হয়েছে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হলে। ইবলীস বলল, তুমি আমাকে শাস্তি দান করলে, তাই আমিও নিঃসন্দেহে তোমার সরল পথে মানুষের জন্য ওঁৎ পেতে থাকব।
তারপর আমি তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ, ডান ও বাম দিক থেকে তাদের নিকট আসবই এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবে না।
তিনি বললেন, এখান থেকে তুমি ধিককৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় বের হয়ে যাও; মানুষের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবই।
আর বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যা এবং যেখানে ইচ্ছা আহার কর কিন্তু এ গাছের নিকটবতী হয়ে না। অন্যথায় তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
তারপর তাদের গোপন করে রাখা লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, পাছে তোমরা ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা তোমরা চিরস্থায়ী হও-এ জন্য তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন। এবং সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল, আমি তোমাদের হিতাকাজক্ষীদের একজন।
এভাবে সে প্রবঞ্চনা দ্বারা তাদেরকে অধঃপতিত করল। তারপর যখন তারা সে বৃক্ষফল আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেদেরকে ঢাকতে লাগল। তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে।
বললেন, আমি কি তােমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবতী হতে নিষেধ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্ৰু? তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছি, তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর; তা হলে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো।
তিনি বললেন, তােমরা একে অন্যের শত্রুরূপে নেমে দাও এবং পৃথিবীতে কিছু দিনের জন্যে তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল। তিনি বললেন, সেখানেই তোমরা জীবন যাপন করবে এবং সেখানেই তোমাদের মৃত্যু হবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের বের করে আনা হয়।
যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন- এ (মাটি) থেকে তােমাদের সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদের ফিরিয়ে দেব এবং সেখান থেকেই পুনরায় তোমাদেরকে বের করে আনব। (২০ : ৫৫)
অর্থাৎ- আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি। ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে এবং তার পূর্বে সৃষ্টি করেছি। জিন জাতিকে অতি উষ্ণ বায়ুর উত্তাপ থেকে। স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।
যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব; তখন তোমরা তার সামনে সিজদায় পড়ে যেয়াে। তখন ফেরেশতাগণ সকলেই সিজদা করল। কিন্তু ইবলীস সিজদা করল না। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল।
আল্লাহ বললেন, যাও তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে; জাহান্নামই হবে তোমাদের সকলের শাস্তি- পূর্ণ শাস্তি। তোমার আহবানে ওদের মধ্যকার যাদেরকে পার পদস্থলিত কর, তুমি তোমার আশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তাদেরকে আক্রমণ করা এবং তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যাও আর তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দাও।
আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! কি ব্যাপার তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলে না যে! সে বলল, আমি এমন মানুষকে সিজদা করবার নই, যাকে আপনি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ বললেন, তবে তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। কারণ তুমি বিতাড়িত এবং কিয়ামত পর্যন্ত তোমার প্রতি রইল লা’নত।
সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেন, যাও অবধারিত সময় আসা পর্যন্ত তোমাকে অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করা হলো।
সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে পথভ্রষ্ট করলেন, সে জন্য আমি পৃথিবীতে পাপকর্মকে মানুষের সামনে শোভন করে উপস্থাপন করব এবং আপনার মনোনীত বান্দাদের ব্যতীত তাদের সকলকেই আমি বিপথগামী করে ছাড়ব।
আল্লাহ বললেন, এ হলো আমার নিকট পৌছুবার সোজা পথ। বিভ্রান্তদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে; তারা ব্যতীত আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা থাকবে না। তোমার অনুসারীদের সকলেরই নির্ধারিত স্থান হবে জাহান্নাম। যার সাতটি দরজা আছে। প্রত্যেক দরজার জন্য আছে পৃথক পৃথক দল। (১৫ : ২৬-৪৪)
অর্থাৎ- স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল। সে বলল, যাকে আপনি কাদা মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, আমি কি তাকে সিজদা করব?
সে আরো বলল, বলুন, ওকে যে আপনি আমার উপর উচ্চ মর্যাদা দান করলেন, তা কেন? আপনি যদি কিয়ামত পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দেন; তবে অল্প কয়েকজন ব্যতীত তার বংশধরকে আমি আমার কর্তৃত্বাধীন করে ফেলব।
আল্লাহ বললেন, যাও তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে; জাহান্নামই হবে তোমাদের সকলের শাস্তি- পূর্ণ শাস্তি। তোমার আহবানে ওদের মধ্যকার যাদেরকে পার পদস্থলিত কর, তুমি তোমার আশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তাদেরকে আক্রমণ করা এবং তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যাও আর তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দাও।
শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়; তা ছলনা মাত্র। আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কর্মবিধায়ক হিসাবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট। (১৭ : ৬১-৬৫)
অর্থাৎ- আর স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত তারা সকলেই সিজদা করল।
সে জিনদের একজন, সে তার প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল, তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করছি? অথচ তারা তোমাদের শক্ৰ। জালিমদের এ বিনিময় কত নিকৃষ্ট! (১৮ : ৫০)
তিনি বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? সে বলল, আমি তার থেকে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদা মাটি থেকে।
অর্থাৎ- আমি তো ইতিপূর্বে আদমের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল, আমি তাকে সংকল্পে দৃঢ় পাইনি। স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, আদমের প্রতি সিজদা কর; তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল; সে অমান্য করল।
তারপর আমি বললাম, হে আদম! এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু; সুতরাং সে যেন কিছুতেই …তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে না দেয়, দিলে তোমরা দুঃখ পাবে। তোমার জন্য এ-ই। রইল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্ত হবে না ও নগ্নও হবে না এবং তথায় পিপাসার্ত হবে না এবং রৌদ্রক্লিষ্টও হবে না।
তারপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। সে বলল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ গাছের কথা ও অক্ষয় রাজ্যের কথা? তারপর তারা তা থেকে ভক্ষণ করল; তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা জান্নাতের গাছের পাতা দিয়ে নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল।
আদম তার প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করল, ফলে সে ভ্রমে পতিত হলো। এরপর তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হলেন ও তাকে পথ-নির্দেশ করলেন।
তিনি বললেন, তোমরা একই সাথে জান্নাত থেকে নেমে যাও, তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্ৰু। পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সৎ পথের নির্দেশ আসলে যে আমার অনুসরণ করবে, সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।
যে আমার স্মরণে বিমুখ তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন উখিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন তুমি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উখিত করলে? আমি তো চক্ষুন্মান ছিলাম।
তিনি বলবেন, এরূপই আমার নিদর্শনাবলী তোমার নিকট এসেছিল, কিন্তু তুমি তা তুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তুমিও বিস্মৃত হলে। (২০ : ১১৫-১২৬)
অর্থাৎ- বল, এ এক মহা সংবাদ, যা থেকে তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ; উৰ্ধৰ্ব্বলোকে তাদের বাদানুবাদ সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান ছিল না। আমার কাছে তো এ ওহী এসেছে যে, আমি একজন স্পষ্ট সতর্ককারী।
স্মরণ করা, তােমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বলেছিলেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি। কাদা মাটি থেকে, যখন আমি তাকে সুষম করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো। তখন ইবলীস ব্যতীত ফেরেশতারা সকলেই সিজদাবনত হলো। সে অহংকার করল এবং কাফিরদের অর্ন্তভুক্ত হলো।
তিনি বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? সে বলল, আমি তার থেকে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদা মাটি থেকে।
তিনি বললেন, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, নিশ্চয়ই তুমি বিতাড়িত এবং তোমার উপর আমার লা’নত স্থায়ী হবে কর্মফল দিবস পর্যন্ত। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন।
তিনি বললেন, তুমি অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হলে অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত। সে বলল, আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি তাদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করব, তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদের নয়।
তারা দুজন তা জানতে পেরেছিলেন তাদের উপরস্থ শাজাল নামক এক ফেরেশতা থেকে। ইব্ন আবু হাতিম (র) আবু জাফর বাকির (র) সূত্রে এটা বৰ্ণনা করেন। কেউ কেউ বলেন, তাদের একথা জানা ছিল যে, মাটি থেকে সৃষ্ট জীবের স্বভাব এরূপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
তিনি বললেন, তবে এটাই সত্য; আর আমি সত্যই বলি- তোমার দ্বারা ও তোমার অনুসারীদের দ্বারা আমি জাহান্নাম পূর্ণ করবই। বল, এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। এতো বিশ্ব জগতের জন্য উপদেশ মাত্র। এর সংবাদ তোমরা অবশ্যই জানবে কিছুকাল পরে। (৩৮ : ৬৭-৮৮)
এ হলো কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের আলোকে আদম (আ)-এর সৃষ্টির বিবরণ। আমি তাফসীরে এসব বিষয়ে আলোচনা করেছি। এখানে আমি উপরোক্ত আয়াতসমূহের সারমর্ম এবং এসব আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীসসমূহ উল্লেখ করেছি। আল্লাহই তওফীক দাতা। आझाशू’ठा’आना জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি ‘…’
অর্থাৎ- ‘পৃথিবীতে আমি প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি’ (২ : ৩০)
এ ঘোষণায় আল্লাহ তা’আলা আদম ও তার এমন বংশধরদের সৃষ্টি করার সংকল্প ব্যক্তি করেছেন; যারা একে অপরের প্রতিনিধিত্ব করবে। যেমন এক আয়াতে তিনি বলেন- ‘তিনিই তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি বানিয়েছেন। (৬ : ১৬৫)
যাহোক, এ ঘোষণা দ্বারা আল্লাহ তা’আলা সংকল্প ব্যক্ত করণার্থে ফেরেশতাদেরকে আদম (আ) ও তাঁর বংশধরদের সৃষ্টি করার কথা জানিয়ে দেন। যেমন বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আগাম সংবাদ দেওয়া হয়ে থাকে। ঘোষণা শুনে ফেরেশতাগণ… সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে সেখানে অশান্তি ঘটাবে এবং রক্তপাত করবে?’
উল্লেখ্য যে, ফেরেশতাগণ বিষয়টির তাৎপর্য জানা এবং তার রহস্য সম্পর্কে অবগতি লাভ করার উদ্দেশ্যে এ কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আপত্তি তোলা, আদম সন্তানদের অমর্যাদা বা তাদের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। যেমন কোন কোন অজ্ঞ মুফাসসির ধারণা করেছেন।
তারা বলেছিলেন, আপনি কি পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী ও রক্তপাতকারী কাউকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন? এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেন, আদমের পূর্বে যে জিন ও বিন জাতির বসবাস ছিল; তাদের কার্যকলাপ- দেখে ফেরেশতাগণ জানতে পেরেছিলেন যে, আগামীতেও এমন অঘটন ঘটবে। এটা কাতাদার অভিমত।
আব্দুল্লাহ ইব্ন উমর (রা) বলেন- আদম (আ)-এর পূর্বে জিন জাতি দু’হাজার বছর বসবাস করে। তারা রক্তপাতে লিপ্ত হলে আল্লাহ তা’আলা তাদের কাছে এক ফেরেশতা বাহিনী প্রেরণ করেন। তারা তাদেরকে বিভিন্ন দ্বীপে তাড়িয়ে দেন।
ইব্ন আব্বাস (রা) থেকেও এরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। হাসান (র) থেকে বর্ণিত যে, ফেরেশতাগণের প্রতি এ তথ্য ইলহাম করা হয়েছিল। কেউ বলেন, লাওহে মাহফুজ থেকে তারা এ ব্যাপারে অবগত হয়েছিলেন। কেউ বলেন, মারত ও হারূন্ত তাদেরকে তা অবগত করেছিলেন।
তারা দুজন তা জানতে পেরেছিলেন তাদের উপরস্থ শাজাল নামক এক ফেরেশতা থেকে। ইব্ন আবু হাতিম (র) আবু জাফর বাকির (র) সূত্রে এটা বৰ্ণনা করেন। কেউ কেউ বলেন, তাদের একথা জানা ছিল যে, মাটি থেকে সৃষ্ট জীবের স্বভাব এরূপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
-আমরা সর্বদা আপনার ইবাদত করি। আমাদের মধ্যকার কেউ আপনার আবাধ্যতা করে না। এখন যদি এদেরকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য এই হয় যে, তারা আপনার ইবাদত করবে; তবে আমরাই তো রাত-দিন অবিশ্রান্তভাবে একাজে নিয়ােজিত রয়েছি।
হাসান বসরী (র) বলেন, আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-কে সৃষ্টি করতে চাইলে জ্ঞানী প্রতিপন্ন হবো। তাই এভাবে তাদেরকে পরীক্ষা করা হয়। যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’ বলে এদিকেই ইংগিত করা হয়েছে। এ প্রসংগে আরো বিভিন্ন মুফাসসির বিভিন্ন মত ব্যক্তি করেছেন। আমি তাফসীরে তা বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
অর্থাৎ-এদেরকে সৃষ্টি করার মধ্যে যে কী সার্থকতা রয়েছে; তা আমি জানি-তোমরা জান না। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে এদেরই মধ্য থেকে বহু নবী-রাসূল, সিন্দীক ও শহীদের আবির্ভাব হবে। তারপর আল্লাহ তা’আলা ইলমের ক্ষেত্রে ফেরেশতাগণের উপর আদমের শ্রেষ্ঠত্বের কথা ব্যক্ত করে বলেন-
‘এবং তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন।’ ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, তাহলো, এসব নাম যদ্বারা মানুষ পরিচিতি লাভ করে থাকে। যেমন মানুষ, জীব, ভূমি, স্থলভাগ ও জলভাগ, পাহাড়-পবর্ত, উট-গাধা ইত্যাদি। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, আল্লাহ তা’আলা।
তাকে ডেগ-ডেকচি, থালা-বাসন থেকে আরম্ভ করে অধঃবায়ু নিৰ্গমনের নাম পর্যন্ত শিক্ষা দেন। মুজাহিদ (র) বলেন, আল্লাহ তাকে সকল জীব-জন্তু পশু-পক্ষী ও সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন।
সাঈদ ইব্ন জুবায়র (রা) এবং কাতাদা (র) প্রমুখও এরূপ বলেছেন। রাবী বলেন, আল্লাহ তা’আলা তাঁকে ফেরেশতাগণের নামসমূহ শিক্ষা দেন। আবদুর রহমান ইব্ন যায়ীদ (র) বলেন, আল্লাহ তাকে তার সন্তানদের নাম শিক্ষা দিয়েছেন।
তবে সঠিক কথা হলো, আল্লাহ তা’আলা। আদম (আ)-কে ছোট-বড় সকল বস্তু ও তার গুণাগুণ বা বৈশিষ্ট্যের নাম শিক্ষা দেন। ইব্ন আব্বাস (রা) এদিকে ইংগিত করেছেন।
ইমাম বুখারী (র) ও মুসলিম (র) এ প্রসংগে আনাস ইব্ন মালিক (রা), কাতাদা এবং সাঈদ ও হিশামের সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন : কিয়ামতের দিন মু’মিনগণ সমবেত হয়ে বলবে, আল্লাহর নিকট সুপারিশ করার জন্য আমরা যদি কারো কাছে আবেদন করতাম!
এই বলে তারা আদম (আ)-এর কাছে এসে বলবে, আপনি মানব জাতির পিতা। আল্লাহ। আপনাকে নিজ কুদরতী হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণকে আপনার সামনে সিজদাবনত করেছেন ও আপনাকে যাবতীয় বস্তুর নাম শিক্ষা ‘…’।
অর্থাৎ- ‘তারপর সেগুলো ফেরেশতাগণের সম্মুখে পেশ করলেন এবং বললেন, তোমরা আমাকে এ সবের নাম বলে দাও যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।’ (২ : ৩১)
হাসান বসরী (র) বলেন, আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-কে সৃষ্টি করতে চাইলে জ্ঞানী প্রতিপন্ন হবো। তাই এভাবে তাদেরকে পরীক্ষা করা হয়। যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’ বলে এদিকেই ইংগিত করা হয়েছে। এ প্রসংগে আরো বিভিন্ন মুফাসসির বিভিন্ন মত ব্যক্তি করেছেন। আমি তাফসীরে তা বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
অর্থাৎ-তারা (ফেরেশতারা) বলল, আপনি পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞানই নেই। বস্তৃত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়। (২ : ৩২)
যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, তিনি যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া তার জ্ঞানের কিছুই তারা ‘আয়ত্ত করতে পারে না।
অর্থাৎ- আল্লাহ বললেন, হে আদম! তাদেরকে এগুলোর নাম বলে দাও। যখন সে এ সকল নাম বলে দিল, তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তােমরা যা ব্যক্ত কর বা গোপন রােখ আমি তাও জানি? (২ : ৩৩)
অর্থাৎ আমি প্রকাশ্যটা যেমন জানি, গোপনাটাও ঠিক তেমনই জানি। কেউ কেউ বলেন, ‘তােমরা যা ব্যক্ত কর’ বলতে তাদের পূর্বেকার বক্তব্যকে বুঝানো হয়েছে আর ‘তোমরা যা গোপন রাখ’ দ্বারা ইবলীসের মনে গুপ্ত সে অহংকার ও …নিজেকে আদম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করাই বুঝানো হয়েছে।
ইবনে জারীর (র) এ দুটি রিওয়ায়েত বৰ্ণনা করেছেন। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ইবলীস নিজেকে তার ও আদমের মাঝে তুলনামূলক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে আদমের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করে। ফলে তার এবং সকল ফেরেশতার প্রতি সিজদার আদেশ থাকা সত্ত্বেও সে সিজদা করা থেকে বিরত থাকে।
সাঈদ ইব্ন জুবায়র, মুজাহিদ, সুদী যাহাহাক ও ছাওরী (র) এ কথা বলেছেন এবং ইব্ন জারীর (র) তা সমর্থন করেছেন।
আবুল ‘আলিয়া, রবী, হাসান ও কাতাদা (র) বলেন, দ্বারা ফেরেশতাদের বক্তব্য, ‘আমাদের রব যাকেই সৃষ্টি করুন না কেন আমরা তার চেয়ে বেশি জ্ঞানী এবং বেশি সম্মানিত-ই থাকব।’ এ বক্তব্যটির কথা বুঝানো হয়েছে। এবং এটা আদমের প্রতি আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত বিরাট বড় সম্মানের বহিঃপ্রকাশ যা তিনি তাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করে তাঁর মধ্যে রূহ সঞ্চার করার পর প্রদর্শন করেছিলেন। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন-
অর্থাৎ- ‘আমি যখন তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে রূহ সঞ্চার করব, তখন তােমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।’ (১৫ : ২৯)
মোটকথা, আদম (আ)-কে আল্লাহ তা’আলা চারটি মর্যাদা দান করেছেন : (১) তাকে নিজের পবিত্র হাতে সৃষ্টি করা, (২) তাঁর মধ্যে নিজের রূহ থেকে সঞ্চার করা, (৩) ফেরেশতাগণকে তাকে সিজদা করার আদেশ দান ও (৪) তাকে বস্তু নিচয়ের নাম শিক্ষা দান।
এ জন্যই উর্ধজগতে মূসা কালীম (আ) ও আদম (আ)-এর সাক্ষাৎ হলে বাদানুবাদ প্রসংগে মূসা (আ) তাকে বলেছিলেন : ‘আপনি মানব জাতির পিতা আদম (আ)। আল্লাহ আপনাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, আপনার মধ্যে তিনি নিজের রূহ থেকে সঞ্চার করেছেন,
তার ফেরেশতাগণকে তিনি আপনার সামনে সিজদাবনত করিয়েছেন এবং আপনাকে বস্তু নিচয়ের নাম শিক্ষা দিয়েছেন।’ কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে সমবেত লোকজন। এরূপ বলবে। এতদসংক্রান্ত আলোচনা পূর্বেও হয়েছে এবং একটু পরে আবারো আসবে ইনশাআল্লাহ।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন- তােমাদেরকে আমি সৃষ্টি করি, তারপর তােমাদের রূপ দান করি, তারপর ফেরেশতাদেরকে বলি, আদমকে সিজদা করা। ইবলীস ব্যতীত তারা সকলেই সিজদাবনত হয়। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলো না।
আল্লাহ বললেন, আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম। তখন কিসে তোমাকে সিজদা করতে বারণ করল? সে বলল, আমি তার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আমাকে তুমি সৃষ্টি করেছ আগুন দিয়ে আর তাকে সৃষ্টি করেছ কাদা মাটি দিয়ে। (৭ : ১১-১২)
হাসান বসরী (র) বলেন, ইবলীস এখানে যুক্তি প্রয়োগের আশ্রয় নিয়েছিল। আর সে-ই সর্বপ্রথম যুক্তি প্রয়োগকারী। মুহাম্মদ ইব্ন শিরীন (র) বলেন, সর্বপ্রথম যে যুক্তির অবতারণা করেছিল, সে হলো ইবলীস। আর যুক্তির উপর নির্ভর করেই সূর্য ও চন্দ্রের পূজা করা হয়ে থাকে।
ইবনে জারীর (র) এ দুটি রিওয়ায়েত বৰ্ণনা করেছেন। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ইবলীস নিজেকে তার ও আদমের মাঝে তুলনামূলক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে আদমের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করে। ফলে তার এবং সকল ফেরেশতার প্রতি সিজদার আদেশ থাকা সত্ত্বেও সে সিজদা করা থেকে বিরত থাকে।
কিন্তু এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যুক্তি যখন স্পষ্ট নির্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক হয়; তখন তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। তদুপরি ইবলীসের এ যুক্তিটিই মূলত ভ্রান্ত। কেননা মাটি আগুন অপেক্ষা বেশি উপকারী ও উত্তম। কারণ মাটির মধ্যে আছে গান্তীর্য, সহনশীলতা, কোমলতা ও উর্বরতা।
পক্ষান্তরে আগুনে আছে অস্থিরতা, অধীরতা, ঝোঁক প্রবণতা ও দহন প্রবণতা। তাছাড়া আপন কুদরতী হাতে সৃষ্টি করে ও নিজের রূহ থেকে সঞ্চার করে আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-কে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। আর এ কারণেই তাকে সিজদা করার জন্য আল্লাহ ফেরেশতাগণকে আদেশ করেছিলেন। যেমন, এক স্থানে আল্লাহ তা’আলা বলেন-
আল্লাহ বললেন, যাও তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, জাহান্নামই তোমাদের সকলের শাস্তি, পূর্ণ শাস্তি। তোমার আহবানে তুমি তাদের মধ্য থেকে যাকে পার পদস্থলিত কর, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা তাদেরকে আক্রমণ কর এবং তাদের ধনে ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যাও ও তাদের প্রতিশ্রুতি দাও।
অর্থাৎ- স্মরণ করা, তোমার প্রতিপালক যখন বললেন, আমি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করছি, যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব; তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।
তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল, সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল। আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! তোমার কি হলো যে, তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলে না?
ইবলীস বলল, আপনি ছাঁচে-ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি হতে যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন; তাকে আমি সিজদা করবার নই। আল্লাহ বললেন, তবে তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। কারণ তুমি বিতাড়িত এবং কর্মফল দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি রইল অভিশাপ। (১৫ : ২৮-৩৫)
আল্লাহ তা’আলার শুকনো থেকে ইবলীসের এ পরিণতির কারণ এই ছিল যে, একদিকে আদম (আ)-কে তুচ্ছ করায় এবং নিজেকে আদমের চাইতে মর্যাদাবান জ্ঞান করায় সে আদিম (আ)-এর ব্যাপারে আল্লাহর সুনির্দিষ্ট আদেশের বিরোধিতা এবং সত্যদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী হয়।
অপরদিকে সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে নিৰ্ম্মফল যুক্তি-তর্কের অবতারণা করে। বলা বাহুল্য যে, ইবলীস নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার অপচেষ্টা তার মূল অপরাধের চাইতেও জঘন্যতর ছিল। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন- স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর,
তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল। সে বলল, আমি কি তাকে সিজদা করব যাকে আপনি কাদা মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন?
সে বলেছিল, বলুন তো এ সে ব্যক্তি যাকে আপনি আমার উপর উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন? আপনি যদি কিয়ামত পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দেন, তবে অল্প কয়েকজন ব্যতীত তার বংশধরগণকে আমি আমার কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে আসবো।
আল্লাহ বললেন, যাও তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, জাহান্নামই তোমাদের সকলের শাস্তি, পূর্ণ শাস্তি। তোমার আহবানে তুমি তাদের মধ্য থেকে যাকে পার পদস্থলিত কর, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা তাদেরকে আক্রমণ কর এবং তাদের ধনে ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যাও ও তাদের প্রতিশ্রুতি দাও।
শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ছলনা মাত্র। আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট। (১৭ : ৫১-৫৪)
সূরা কাহফে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- স্মরণ কর, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল। সে জিনদের একজন ছিল। ফলে সে ইচ্ছাকৃতভাবে হঠকারিতা ও অহংকারবশত আল্লাহর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যায়। (১৮ : ৫০)
আগুনের সৃষ্ট হওয়ার কারণে তার স্বভাব এবং তার মন্দ উপাদানই তাকে এ অধঃপতনের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। ইবলীস যে আগুনের সৃষ্টি তা তার নিজের বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত।
সূরা সাদ-এ আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- স্মরণ করা, তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করছি। কাদা মাটি থেকে। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।
তাছাড়া সহীহ মুসলিমে আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : ‘ফেরেশতাগণকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে আর জিনদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে ধোঁয়াবিহীন অগ্নিশিখা হতে এবং আদমকে যা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে তা তাে তােমাদের কাছে বিবৃত হয়েছে।’
হাসান বসরী (র) বলেন- ইবলীস এক পলকের জন্যও ফেরেশতাগণের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। শাহর ইব্ন হাওশাব (র) বলেন, ইবলীস জিন দলভুক্ত ছিল। যখন তারা পৃথিবীতে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে, তখন আল্লাহ তা’আলা তাদের নিকট একটি ফেরেশতা বাহিনী প্রেরণ করেন।
ফেরেশতাগণ তাদের কতককে হত্যা করেন, কতককে বিভিন্ন দ্বীপে নির্বাসন দেন এবং কতককে বন্দী করেন। ইবলীস ছিল বন্দীদের একজন। ফেরেশতাগণ তাকে ধরে সঙ্গে করে আকাশে নিয়ে যান এবং সে সেখানেই রয়ে যায়। তারপর যখন ফেরেশতাগণকে সিজদার আদেশ করা হয় তখন ইবলীস সিজদা থেকে বিরত থাকে।
ইব্ন মাসউদ ও ইব্ন আব্বাস (রা)-সহ একদল সাহাবা এবং সাঈদ ইব্ন মুসায়াব (রা) প্রমুখ বলেন, ইবলীস সর্বনিম্ন আকাশের ফেরেশতাগণের নেতা ছিল। ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, তার নাম ছিল আযায়ীল। হারিস (র) থেকে বর্ণিত এক বর্ণনায় আছে যে, আবু কারদুস নাক্কাশ (র) বলেন, ইব্ন আব্বাস (রা) বলেছেন –
ইবলীস ফেরেশতাগণের একটি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদেরকে জিন বলা হতো। এরা জান্নাতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল। ইলম ও ইবাদতে ইবলীস ছিল এদের সকলের সেরা। তখন তার চারটি ডানাও ছিল। পরে তার রূপ বিকৃতি ঘটিয়ে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বিতাড়িত শয়তানে পরিণত করেন।
সূরা সাদ-এ আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- স্মরণ করা, তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করছি। কাদা মাটি থেকে। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।
তখন ফেরেশতারা সকলেই সিজদাবনত হলো-কেবল ইবলীস ব্যতীত, সে অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।
তিনি বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করলাম, তার প্রতি সিজদাবনত হতে তোমাকে কিসে বাধা দিলা? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? সে বলল, আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদা মাটি থেকে।
তিনি বললেন, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। নিশ্চয় তুমি বিতাড়িত এবং তোমার উপর আমার লা’নত স্থায়ী হবে কর্মফল দিবস পর্যন্ত।
সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে অবকাশ দিন পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। তিনি বললেন, তুমি অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো-অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত। সে বলল, আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি তাদের সকলকেই পথভ্ৰষ্ট করব। তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে নয়।
তুমি এখান থেকে নেমে যাও’ এবং ‘তুমি এখান থেকে বের الهبط منها হয়ে যাও’ ইবলীসের প্রতি আল্লাহ তা’আলার এ আদেশ প্রমাণ করে যে, ইবলীস আকাশে ছিল। পরে তাকে সেখান থেকে নেমে যাওয়ার এবং নিজের ইবাদত ও আনুগত্যে ফেরেশতাগণের সাদৃশ্য অবলম্বনের ফলে যে পদমর্যাদা সে লাভ করেছিল; তা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়।
তিনি বললেন, তবে এটাই সত্য আর আমি সত্যই বলি- তোমার দ্বারা ও তোমার অনুসারীদের দ্বারা আমি জাহান্নাম পূর্ণ করবই। (৩৮ : ৭১-৮৫)
সূরা আ’রাফে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- সে বলল, আপনি আমাকে উদভ্রান্ত করলেন, এ জন্য আমিও তোমার সরল পথে নিশ্চয় ওঁৎ পেতে বসে থাকব। তারপর আমি তাদের নিকট আসবই তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ, দক্ষিণ ও বাম দিক থেকে এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞরূপে পাবে না। (৭ : ১৬-১৭)
অর্থাৎ তোমার আমাকে উদভ্রান্ত করার ফলে আমি ঘাটে ঘাটে তাদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকব এবং তাদের কাছে তাদের সকল দিক থেকেই আসব। অতএব, ভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, আর যে তার অনুসরণ করবে। সে হলো হতভাগা।
ইমাম আহমদ (র) বর্ণনা করেন যে, সুবরা ইব্ন আবুল ফাকিহ (র) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, শয়তান আদম (আ)-এর সন্তানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য অলিতে-গলিতে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। ইবলীসের পরিচিতিতে আমি এ হাদীসটি উল্লেখ করেছি।
আদম (আ)-কে সিজদা করার জন্য আদিষ্ট ফেরেশতাগণের ব্যাপারে মুফাসসিরগণের মতভেদ রয়েছে যে, এ আদেশটি সকল ফেরেশতার জন্য নয়, কেবল পৃথিবীর ফেরেশতাগণের জন্য ছিল? জমহুর আলিমগণের মতে, সকল ফেরেশতার জন্যেই এ আদেশটি ছিল। যেমন কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের ব্যাপকতার দ্বারা বোঝা যায়। পক্ষান্তরে ইব্ন আব্বাস (রা)
থেকে যাহহাক (র)-এর সূত্রে ইব্ন জারীর শুধুমাত্র পৃথিবীর ফেরেশতাগণের আদিষ্ট হওয়ার কথা বর্ণনা করেন। তবে এ সনদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে এবং বর্ণনাটিতে অপরিচিতি জনিত দুর্বলতা রয়েছে। পরবর্তী যুগের আলিমগণের কেউ কেউ এ দ্বিতীয় অভিমতটি প্রাধান্য দিলেও বর্ণনাভঙ্গি অনুসারে প্রথমটিই অধিক গ্রহণযোগ্য।
এবং তিনি তার ফেরেশতাদেরকে তার সম্মুখে সিজদাবনত করান’ এ হাদীসটিও এর সপক্ষে প্রমাণ বহন করে। এ হাদীসটি ব্যাপক। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
তুমি এখান থেকে নেমে যাও’ এবং ‘তুমি এখান থেকে বের الهبط منها হয়ে যাও’ ইবলীসের প্রতি আল্লাহ তা’আলার এ আদেশ প্রমাণ করে যে, ইবলীস আকাশে ছিল। পরে তাকে সেখান থেকে নেমে যাওয়ার এবং নিজের ইবাদত ও আনুগত্যে ফেরেশতাগণের সাদৃশ্য অবলম্বনের ফলে যে পদমর্যাদা সে লাভ করেছিল; তা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়।
তারপর অহংকার, হিংসা ও তার রব-এর বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে তার সে পদমর্যাদা ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং ধিক্কৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় তাকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আ)-কে নিজ স্ত্রীসহ জান্নাতে বসবাস করার আদেশ দেন।
আল্লাহ তা’আলা তাকে আদম (আ)-এর পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করেন। দেখে আদম (আ) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে হে? তিনি বললেন- আমি একজন নারী। আদম (আ) বললেন, তোমাকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে?
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন-এবং আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবতী হয়ে না; হলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (২ : ৩৫)
সূরা আ’রাফে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, এ স্থান থেকে তুমি ধিককৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় বের হয়ে যাও। মানুষের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবই।
আর হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা! আহার কর; কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবতী হয়াে না, হলে তােমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেন- স্মরণ করা, যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, আদমের প্রতি সিজদাবনত হও; তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল, সে অমান্য করল। তারপর আমি বললাম, হে আদম! এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু।
সুতরাং সে যেন কিছুতেই তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে না দেয়, দিলে তোমরা দুঃখ পাবে। তোমার জন্য এ-ই রইল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্ত হবে না এবং নগ্নও হবে না; এবং সেথায় পিপাসার্ত হবে না এবং রৌদ্র-ক্লিষ্টও হবে না।
এ আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, হাওয়া (আ)-এর সৃষ্টি আদম (আ)-এর জান্নাতে প্রবেশের আগেই হয়েছিল। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর।’ ইসহাক ইব্ন বাশ্মশার (র) স্পষ্টরূপেই এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু সুদী আবু সালিহ ও আবু মালিকের সূত্রে ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে এবং মুররা-এর সূত্রে ইব্ন মাসউদ (রা) ও কতিপয় সাহাবা থেকে বর্ণনা করেন যে, তারা বলেন- আল্লাহ তা’আলা ইবলীসকে জান্নাত থেকে বের করে দেন। আদম (আ)-কে জান্নাতে বসবাস করতে দেন।
আদম (আ) তথায় নিঃসঙ্গ একাকী ঘুরে বেড়াতে থাকেন। সেখানে তাঁর স্ত্রী নেই, যার কাছে গিয়ে একটু শান্তি লাভ করা যায়। এক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। জাগ্রত হয়ে দেখতে পেলেন যে, তার শিয়রে একজন নারী উপবিষ্ট রয়েছেন।
আল্লাহ তা’আলা তাকে আদম (আ)-এর পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করেন। দেখে আদম (আ) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে হে? তিনি বললেন- আমি একজন নারী। আদম (আ) বললেন, তোমাকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে?
জবাবে তিনি বললেন, যাতে আপনি আমার কাছে শান্তি পান। তখন ফেরেশতাগণ আদম (আ)-এর জ্ঞানবত্তা যাচাই করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আদম! উনার নাম কি বলুন তো! আদম (আ) বললেন, হাওয়া। আবার তারা জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা হাওয়া নাম হলো কেন?
তার দানাগুলো ছিল মাখন অপেক্ষা নরম আর মধু অপেক্ষা মিষ্ট। ছাওরী আবু হাসীন ও আবু মালিক (র) সূত্রে বলেন : এ আয়াতে যে বৃক্ষের কথা বলা হয়েছে তাহলো, খেজুর গাছ। ইব্ন জুরায়জ মুজাহিদ (র) থেকে বর্ণনা করেন। যে, তাহলো ডুমুর গাছ।
আদম (আ) বললেন, কারণ তাঁকে ‘হাই’ (জীবন্ত সত্তা) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক (র) ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, হাওয়াকে আদম (আ)-এর বাম পাঁজরের সবচাইতে ছোট হাড় থেকে সৃষ্টি করা হযেছে। তখন আদম (আ) ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। পরে সে স্থানটি আবার গোশত দ্বারা পূরণ করে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন-
হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন এবং তাদের দু’জন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন। (৪ : ১)
অর্থাৎ-তিনিই তােমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়। তারপর যখন সে তার সঙ্গে সংগত হয়, তখন সে এক লঘু গৰ্ভধারণ করে এবং তা নিয়ে সে অনায়াসে চলাফেরা করে। (৭ : ১৮৯)
এ বিষয়ে ইনশাআল্লাহ পরে আরো আলোচনা করব।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : ‘মহিলাদের ব্যাপারে তোমরা আমার সদুপদেশ গ্রহণ করা। কেননা, নারীদেরকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের উপরের অংশটুকুই সর্বাধিক বঁকা।
যদি তুমি তা সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙ্গে ফেলবে এবং আপন অবস্থায় ছেড়ে দিলে তা বাঁকাই থেকে যাবে। অতএব, মহিলাদের ব্যাপারে তোমরা আমার সদুপদেশ গ্রহণ কর।’ পাঠটি ইমাম বুখারী (র)-এর।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণের মতভেদ রয়েছে। هذه الشجرة’ কেউ বলেন, গাছটি ছিল আঙুরের। ইব্ন আব্বাস (রা), সাঈদ ইব্ন জুবায়র, শাবী, জা’দা ইব্ন হুরায়রা, মুহাম্মদ ইব্ন কায়স ও সুদী (র) থেকে এরূপ বৰ্ণিত আছে।
ইব্ন আব্বাস, ইব্ন মাসউদ (রা) এবং আরো কতিপয় সাহাবা থেকে এক বর্ণনায় আছে যে, ইহুদীদের ধারণা হলো গাছটি ছিল গমের। ইব্ন আব্বাস (রা), হাসান বসরী (র), ওহাব ইব্ন মুনাবিবাহ, অতিয়্যা আওফী, আবু মালিক, মুহারি ইব্ন দিছার ও আবদুর রহমান ইব্ন আবু লায়লা থেকেও এ কথা বর্ণিত আছে। ওহাব (র) বলেন,
তার দানাগুলো ছিল মাখন অপেক্ষা নরম আর মধু অপেক্ষা মিষ্ট। ছাওরী আবু হাসীন ও আবু মালিক (র) সূত্রে বলেন : এ আয়াতে যে বৃক্ষের কথা বলা হয়েছে তাহলো, খেজুর গাছ। ইব্ন জুরায়জ মুজাহিদ (র) থেকে বর্ণনা করেন। যে, তাহলো ডুমুর গাছ।
কাতাদা এবং ইব্ন জুরায়জও এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আবুল আলিয়া বলেন, তা এমন একটি গাছ ছিল যে, তার ফল খেলেই পবিত্ৰতা নষ্ট হয়ে যেতো। কিন্তু জান্নাতে পবিত্ৰতা নষ্ট হওয়া অনুচিত।
তবে এ মতভেদগুলো পরস্পর কাছাকাছি। কিন্তু লক্ষণীয় হলো এই যে, আল্লাহ তা’আলা। নির্দিষ্ট করে এর নাম উল্লেখ করেননি। যদি এর উল্লেখ করার মধ্যে আমাদের কোন উপকার নিহিত থাকত; তাহলে আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই নির্দিষ্ট করে তার উল্লেখ করে দিতেন। পবিত্র কুরআনের আরো বহু ক্ষেত্রে এরূপ অস্পষ্ট রাখার নজীর রয়েছে।
তবে আদম (আ) যে জান্নাতে প্রবেশ করেছিলেন, তার অবস্থান আসমানে না। যমীনে; এ ব্যাপারে যে মতভেদ রয়েছে, তা বিস্তারিত আলোচনা ও নিম্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। জামহুর উলামার মতে তা হচ্ছে আসমানে অবিস্থিত জান্নাতুল মাওয়া।
আহলে কিতাদের হস্তস্থিত তাওরাতের পাঠেও এর স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। আবু মুহাম্মদ ইব্ন হাযম আল-মিলাল ও আননিহল গ্রন্থে এবং আবু মুহাম্মদ ইব্ন আতিয়্যা ও আবু ঈসা। রুম্মানী আপন আপন তাফসীরে এ বিষয়টির মতভেদের কথা উল্লেখ করেছেন।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং বিভিন্ন হাদীসে যার ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন- আমি বললাম, হে আদম! তুমি এবং তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর। এ আয়াতে ধু, কেৰ। এর আলিফ-লাম ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।
বরং তদ্দ্বারা সুনির্দিষ্ট একটি জান্নাতকে বুঝানো হয়েছে। তাহলো জান্নাতুল মাওয়া। আবার যেমন মূসা (আ) আদম (আ)-কে বলেছিলেন : কেন আপনি আমাদেরকে এবং নিজেকে জান্নাত থেকে বের করলেন? এটি একটি হাদীসের অংশ, এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, আবু হুরায়রা (রা) ও হুযায়ফা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ‘আল্লাহ তা’আলা মানব জাতিকে সমবেত করবেন। ফলে মুমিনগণ এমন সময়ে উঠে দাড়াবে, যখন জান্নাত তাদের নিকটে এসে যাবে।
তারা আদম (আ)-এর কাছে এসে বলবেন, হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্য আপনি জান্নাত খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করুন! তখন তিনি বলবেন, তোমাদের পিতার অপরাধই তো তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল!
‘…’ এ হাদীসাংশ শক্তভাবে প্রমাণ করে যে, আদম (আ) যে জান্নাতে বসবাস করেছিলেন, তা হলো জান্নাতুল মাওয়া। কিন্তু এ যুক্তিটিও বিতর্কের উর্ধে নয়।
অন্যরা বলেন, আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-কে যে জান্নাতে বসবাস করতে দিয়েছিলেন, তা ‘জান্নাতুল খুলদ’ তথা অনন্ত জান্নাত ছিল না। কারণ নির্দিষ্ট একটি গাছের ফল খেতে নিষেধ করে সেখানেও তার উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।
তিনি সেখানে নিদ্ৰাও যান, সেখান থেকে তাকে বহিষ্কারও করা হয় এবং ইবলীসও সেখানে তার নিকটে উপস্থিত হয়। এ সব কটি বিষয়ই তা যে জান্নাতুল মাওয়া ছিল না। তাই নির্দেশ করে। এ অভিমতটি উবাই ইব্ন কা’ব, আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা), ওহাব ইব্ন মুনাবিবাহ ও সুফিয়ান ইব্ন উয়ায়না (রা) থেকে বর্ণিত।
ইব্ন কুতীয়বা তার ‘আল-মা’আরিফ’ গ্রন্থে এবং কাষী মুনযির ইব্ন সাঈদ আল-বালুতী তার তাফসীরে এ অভিমতটির সমর্থন করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে একটি স্বতন্ত্র পুস্তকও রচনা করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (র) এবং তাঁর বিশিষ্ট শিষ্যবৃন্দ থেকেও এরূপ অভিমত উদ্ধৃত করেছেন।
আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইব্ন উমর আর-রায়ী ইব্ন খতীব। আর-রাই (র) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে আবুল কাসিম আল-বলখী ও আবু মুসলিম ইস্পাহানী (র) থেকে এবং কুরতুবী তার তাফসীরে ‘মুতাযিলা ও কাদরিয়্যা থেকে এ অভিমতটি উদ্ধৃত করেছেন।
আহলে কিতাদের হস্তস্থিত তাওরাতের পাঠেও এর স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। আবু মুহাম্মদ ইব্ন হাযম আল-মিলাল ও আননিহল গ্রন্থে এবং আবু মুহাম্মদ ইব্ন আতিয়্যা ও আবু ঈসা। রুম্মানী আপন আপন তাফসীরে এ বিষয়টির মতভেদের কথা উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয় অভিমতের সমর্থকগণ একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যার জবাব দেওয়া আবশ্যক। তারা বলেন, এটা নিঃসন্দেহ যে, সিজদা করা থেকে বিরত থাকার দরুন আল্লাহ তা’আলা। ইবলীসকে আপনি সান্নিধ্য থেকে বিতাড়িত করে দেন এবং তাকে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার ও নেমে যাওয়ার আদেশ প্রদান করেন।
জামহুর উলামার বর্ণনায় প্রথম অভিমতের সমর্থন পাওয়া যায়। কাষী মাওয়ারদী (র) তার তাফসীরে বলেন, আদম (আ) ও হাওয়া (আ) যে জান্নাতে বসবাস করেন, তার ব্যাপারে দু’টি অভিমত রয়েছে। প্রথমত, তা জান্নাতুল খুলদা।
দ্বিতীয় অভিমত হলো, তা স্বতন্ত্র এক জান্নাত যা আল্লাহ তা’আলা তাদের জন্য পরীক্ষা স্থল হিসাবে তৈরি করেন। এটা সে জান্নাতুল খুলদ নয়, যা আল্লাহ তা’আলা পুরস্কারের স্থান হিসেবে প্রস্তুত করে রেখেছেন।
এ দ্বিতীয় অভিমতের সমর্থকদের মধ্যে আবার মতভেদ রয়েছে। একদল বলেন, তার অবস্থান আসমানে। কারণ, আল্লাহ তা’আলা আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-কে জান্নাত থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন। এটা হাসানের অভিমত। অপর দল বলেন, তার অবস্থান ছিল পৃথিবীতে।
কেননা, আল্লাহ তা’আলা সে জান্নাতে বহু ফল-ফলাদির মাঝে বিশেষ একটি গাছ সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলেন। ইব্ন য়াহয়া-এর অভিমতও অনুরূপ। উল্লেখ্য যে, এ ঘটনাটি ঘটেছিল ইবলীসকে আদম (আ)-এর প্রতি সিজদাবনত হওয়ার আদেশ দেওয়ার পর।
তবে এসব অভিমতের কোনটা সঠিক তা মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
এ হলো কাষী মাওয়ারদির বক্তব্য। এতে তিনি তিনটি অভিমত উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর এ বক্তব্য থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মাস আলাটিতে তিনি নিজের কোন সিদ্ধান্ত প্রদান থেকে বিরত রয়েছেন। আবু আবদুল্লাহ রাষী (র) তার তাফসীরে এ মাস’আলা সম্পর্কে চারটি অভিমত বর্ণনা করেছেন।
কাষী মাওয়ারদির উপস্থাপিত তিনটি আর চতুর্থটি হলো এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। তাছাড়া তিনি আবু আলী জুবায়ী (র) থেকে এ অভিমত বর্ণনা করেন যে, আদম (আ) যে জান্নাতে বসবাস করেন, তার অবস্থান আসমানে। তবে তা ‘জান্নাতুল মাওয়া’ নয়।
দ্বিতীয় অভিমতের সমর্থকগণ একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যার জবাব দেওয়া আবশ্যক। তারা বলেন, এটা নিঃসন্দেহ যে, সিজদা করা থেকে বিরত থাকার দরুন আল্লাহ তা’আলা। ইবলীসকে আপনি সান্নিধ্য থেকে বিতাড়িত করে দেন এবং তাকে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার ও নেমে যাওয়ার আদেশ প্রদান করেন।
আর এ আদেশটি কোন শরিয়ী আদেশ ছিল না। যে, তার বিরুদ্ধাচরণের অবকাশ থাকবে বরং তা ছিল এমন অখণ্ডনীয় তকদীর সংক্রান্ত নির্দেশ যার বিরুদ্ধাচরণ বা প্রতিরোধের কোন অবকাশই থাকে না।
তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- এখন থেকে তুমি ধিক্কৃত ও বিতাড়িত অবস্থায় বের হয়ে যাও। (৭ : ১৮)
অর্থাৎ-এ স্থান থেকে তুমি নেমে যাও, এখানে থেকে তুমি অহংকার করবে, এ হতে পারে না। (৭ : ১৩)
অর্থাৎ-তুমি এখন থেকে বের হয়ে যাও, কারণ তুমি অভিশপ্ত। (১৫ : ৩৪)
এ আয়াতগুলোতে ৬৫- এর সর্বনামটি দ্বারা ‘…’। ((জান্নাত) কিংবা (আসমান) অথবা (আবাস স্থল) বুঝানো হয়েছে। তা যাই হোক, এটা জানা কথা যে, ইবলীসকে যে স্থান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল, সেখানে সামান্যতম সময়ের জন্যেও তার অবস্থান থাকার কথা নয়-স্থায়িভাবে বসবাস রূপেই হোক, আর কেবল পথ অতিক্রম রূপেই হোক।
তাঁরা বলেন যে, কুরআনের বাহ্যিক বৰ্ণনাভঙ্গী থেকে এটাও প্রমাণিত যে, ইবলীস আদম (আ)-কে এই বলে কুমন্ত্রণা দিয়েছিল যে- হে আদম! আমি কি তােমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা এবং অক্ষয় রাজ্যের কথা? (২০ : ১২০)
অর্থাৎ-আর সে বলল, পাছে তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা তোমরা স্থায়ী হও এ জন্যই তােমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন। সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলল, আমি তোমাদের হিতাকাজান্ধীদের একজন। এভাবে সে তাদেরকে প্রবঞ্চনা দ্বারা অধঃপতিত করল। (৭ : ২০-২২)
এ আয়াতগুলো স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, আদম (আ) ও হাওয়ার সঙ্গে তাদের জান্নাতে ইবলীস-এর সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাদের এ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে যে, নিয়মিত বসবাসের ভিত্তিতে না হলেও যাতায়াত ও আনাগোনার সুবাদে জান্নাতে আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-এর সঙ্গে ইবলীস-এর একত্রিত হওয়া বিচিত্র নয়।
অর্থাৎ- ‘আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম উদ্যান ওয়ালাদেরকে (৬৮ : ১৭) এ আয়াতেও বি,- বলতে সকল উদ্যানকে বুঝানো হয়নি। বরং তা এক বিশেষ উদ্যান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
কিংবা এও হতে পারে যে, জান্নাতের দরজায় দাড়িয়ে বা আকাশের নিচে থেকে ইবলীস তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিয়েছিল। তবে তিনটি জবাবের কোনটিই সন্দেহমুক্ত নয়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আদম (আ) যে জান্নাতে বসবাস করেন, তার অবস্থান পৃথিবীতে হওয়ার সপক্ষে যারা মতপোষণ করেন, তার দলিল নিমের হাদীস- তা হলো-
উবাই ইব্ন কা’ব (রা) সূত্রে আবদুল্লাহ ইব্ন ইমাম আহমদ যিব্রাদাতে বর্ণনা করেন যে, উবাই ইব্ন কা’ব (রা) বলেছেন, মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে আদম (আ)-এর জান্নাতের আঙ্গুর খাওয়ার আকাজক্ষা হলে তাঁর সন্তানরা আঙ্গুরের সন্ধানে বের হন। পথে তাদের সঙ্গে ফেরেশতাগণের সাক্ষাৎ ঘটে।
তারা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আদমের সন্তানরা! তোমরা যােচ্ছ কোথায়? তারা বললেন, আমাদের পিতা জান্নাতের এক ছড়া আঙ্গুর খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। ফেরেশতাগণ বললেন, ‘তোমরা ফিরে যাও, তোমরা তার জন্য যথেষ্ট করেছি, আর দরকার নেই।’
অগত্যা তারা আদম (আ)-এর নিকট ফিরে গেলেন। ফেরেশতাগণ আদম (আ)-এর রূহ কবয করে গোসল দিয়ে সুগন্ধি মাখিয়ে তাকে কাফন পরান। তারপর অন্যান্য ফেরেশতাকে নিয়ে জিবরাঈল (আ) তাঁর জানাযার নামায আদায় করে তাঁকে দাফন করেন।
এরপর তারা বলল, এ হলো তােমাদের মৃতদের ব্যাপারে তােমাদের করণীয় সুন্নত। সনদসহ হাদীসটি পরে আসছে এবং আদম (আ)-এর ওফাতের আলোচনায় পূর্ণ হাদীসটি উল্লেখ করা হবে।
এ হাদীসের ভিত্তিতে দ্বিতীয় অভিমতের সমর্থকগণ বলেন- আদম (আ) যে জান্নাতে বসবাস করেছিলেন, তাতে পৌছানো যদি সম্ভব না হতো, তাহলে আদম (আ)-এর সন্তানরা তাঁর অনুসন্ধানে বেরই হতেন না। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, সে জান্নাত ছিল পৃথিবীতে- আসমানে নয়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আসমানের জান্নাত বুঝানো হয়নি। বরং আদম (আ) আসমানে বক্তব্যের পূর্বাপর দৃষ্টি প্রতীয়মান হয় যে, তা ছিল দুনিয়াতে অবস্থিত। কেননা, আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে পৃথিবী থেকে। আর কোথাও এ কথার উল্লেখ পাওয়া যায় না যে, তাকে আসমানে তুলে নেয়া হয়েছিল। তাছাড়া তাকে সৃষ্টিই করা হয়েছে পৃথিবীতে থাকার জন্য।
আর আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাগণকে এ বলে তা জানিয়েও দিয়েছিলে যে, পৃথিবীতে আমি প্রতিনিধি বানাচ্ছি।’ এর خليفة সমর্থনে তাঁরা আরেকটি নজীর হিসাবে নিম্নোক্ত আয়াতটি পেশ করেন।
অর্থাৎ- ‘আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম উদ্যান ওয়ালাদেরকে (৬৮ : ১৭) এ আয়াতেও বি,- বলতে সকল উদ্যানকে বুঝানো হয়নি। বরং তা এক বিশেষ উদ্যান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
কিন্তু এটা সৰ্বজনবিদিত যে, বনী ইসরাঈলের বসবাস এ পৃথিবীতেই ছিল- আসমানে নয়। তারা আরো বলেন, যারা বর্তমানে জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, আমরা তাদের সে বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করছি না। তাদের বক্তব্য ও আমাদের এ অভিমতের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই।
তারা আরো বলেন, অবতরণ করার উল্লেখ আদম (আ)-এর আসমান থেকে নেমে আসার প্রমাণ বহন করে না। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন-
অর্থাৎ- ‘বলা হলো, হে নুহ! তুমি নেমে এসো আমার প্রদত্ত শান্তিসহ এবং তোমার প্রতি ও যে সমস্ত সম্প্রদায় তোমার সাথে আছে তাদের প্রতি কল্যাণসহ।’ (১১ : ১৮)
এখানে লক্ষণীয় যে, যখন ভূপৃষ্ঠ থেকে পানি শুকিয়ে যায় এবং নীেকাটি জুদী পর্বতে গিয়ে স্থির হয়, তখন নূহ (আ) ও তার অনুসারীদেরকে সেখান থেকে নেমে আসার আদেশ করা হয়।
অন্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- তােমরা নগরে অবতরণ করা, তােমরা যা চাও তা সেখানে আছে। (২ : ৬১)
অর্থাৎ- কতক পাথর এমনও আছে যা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ে। (২ : ৭৪) হাদীস ও অভিধানে এর অসংখ্য নজীর রয়েছে।
তারা আরো বলেন- এতে অসুবিধার কিছু নেই বরং এটাই বাস্তব যে, আল্লাহ তা’আলা। আদম (আ)-কে যে জান্নাতে থাকতে দিয়েছিলেন, তা ছিল সমগ্র ভূখণ্ড থেকে উচু বৃক্ষরাজি, ফল-ফলাদি, ছায়া, ভোগ-সামগ্রী ও সুখ সমৃদ্ধ একটি মনোরম উদ্যান। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা।
অর্থাৎ- সেখানে তোমার অভ্যন্তর ক্ষুধার জ্বালায় এবং বহির্দেহ রৌদ্রের দাহনে ক্লিষ্ট হবে ‘…’।
অর্থাৎ- তথায় তোমার ভেতরাংশ পিপাসার উষ্ণতা এবং বহিরাংশ সূর্যের তাপ স্পর্শ করবে:
পরস্পর সাযুজ্য থাকার কারণে আল্লাহ তা’আলা এ দু’আয়াতে ক্ষুধা ও বিবস্ত্রতাকে একসাথে – এবং পিপাসার উষ্ণতা ও সূর্যের দাহনকে একসাথে উল্লেখ করেছেন।
তারপর নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে ফেললে আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-কে দুঃখ-কষ্ট, পংকিলতা, শ্রম-সাধনা, বিপদাপদ; পরীক্ষা, অধিবাসীদের দীন-ধর্ম, স্বভাব-চরিত্র, কার্যকলাপ, কামনা-বাসনা ও উচ্চারণ আঙ্গুণগত বৈপরিত্যপূর্ণ পৃথিবীপৃষ্ঠে নামিয়ে দেন। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-
পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তােমাদের বসবাস ও জীবিকা রয়েছে। (২ : ৩৬) এতে একথা প্রমাণিত হয় না যে, তারা আগে আসমানে ছিল। যেমন এক আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-
এরপর আমি বনী-ইসরাঈলকে বললাম, তােমরা ভূ-পৃষ্ঠে বসবাস কর। এবং যখন কিয়ামতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে, তখন তোমাদের সকলকে আমি একত্র করে উপস্থিত ‘…’।
কিন্তু এটা সৰ্বজনবিদিত যে, বনী ইসরাঈলের বসবাস এ পৃথিবীতেই ছিল- আসমানে নয়। তারা আরো বলেন, যারা বর্তমানে জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, আমরা তাদের সে বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করছি না। তাদের বক্তব্য ও আমাদের এ অভিমতের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই।
এ জন্যই এ দ্বিতীয় মত পোষণকারী প্রাচীন কালের সকল আলিম এবং পরবর্তী যুগের অধিকাংশ আলিমের অভিমত বর্ণিত হয়েছে; তারা বর্তমানেও জান্নাত-জাহান্নামের অস্তিত্ব রয়েছে বলে স্বীকার করেন। যেমন কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বহু বিশুদ্ধ হাদীস তার প্রমাণ বহন করে।
হাদীসটি অন্যান্য সূত্রেও বর্ণিত আছে এবং ইমাম আবু দাউদ তায়ালিসীও তার মুসনাদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। গুনন্দুর বলেন, আমি শু’বাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কি সেই শাজারাতুল খুলদ? তিনি বললেন, না বর্ণনায় ‘তাহলো’ বাক্যাংশটি নেই।
যথাস্থানে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
অর্থাৎ- কিন্তু শয়তান তা থেকে তাদেরকে পদষ্মলন ঘটাল (অর্থাৎ বেহেশত থেকে) এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে তাদেরকে বহিষ্কৃত করল। (২ : ৩৬)
অর্থাৎ-জান্নাত থেকে এবং তারা যে সুখ-সম্ভোগ ও আমোদ-আহলাদে ছিলেন তা থেকে বের করে অশান্তি ও দুর্দশার জগতে নিয়ে আসলো। তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিয়ে এবং মোহে ফেলে শয়তান তাদের দুর্দশা ঘটায়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন :
অর্থাৎ-তারপর তাদের লজ্জাস্থান, যা গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, পাছে তোমরা উভয়ে ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা তোমরা স্থায়ী হও এ জন্যই তােমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তােমাদেরকে নিষেধ করেছেন।
সে তাদের উভয়ের কাছে শপথ করে বলল, আমি তোমাদের হিতাকাঙক্ষীদের একজন। (৭ : ২০-২১)
অর্থাৎ শয়তান তাদেরকে বলল যে, আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের এ বৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করার কারণ হলো তা খেলে তোমরা ফেরেশতা হয়ে যাবে কিংবা চিরস্থায়ী হয়ে যাবে। আর তাদেরকে এ ব্যাপারে শপথ করে বলল যে, নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের হিতকাজকীদের একজন। যেমন অন্য আয়াতের আল্লাহ তা’আলা বলেন :
অর্থাৎ- তারপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল; সে বলল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা ও অক্ষয় রাজ্যের কথা? (২০ : ১২০)
অর্থাৎ আমি কি তোমাকে এমন বৃক্ষের সন্ধান দেব, যার ফল খেলে তুমি স্থায়ী জীবন লাভ করবে, তুমি এখন যে সুখ-সম্ভোগ ও শান্তিতে আছ; চিরজীবন তা ভোগ করতে পারবে এবং তুমি এমন রাজত্ব লাভ করবে, যার কখনো বিনাশ ঘটবে না। ইবলীসের এ বক্তব্য ছিল সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক এবং বাস্তবতা বিবর্জিত।
আলোচ্য আয়াতে, এর মর্ম হচ্ছে যে, এর ফল ভক্ষণ করলে তুমি অনন্ত জীবন লাভ করবে। আবার তদ্বারা সে বৃক্ষত্ত উদ্দেশ্য হতে পারে, নিম্নোক্ত হাদীসে যার উল্লেখ রয়েছে। তাহলো-
ইমাম আহমদ (র) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ‘জান্নাতে এমন একটি বৃক্ষ আছে যে, আরোহী তার ছায়ায় একশ বছর ভ্রমণ করেও তা অতিক্রম করতে পারবে না। তাহলে ‘শাজারাতুল খুলদ’।
হাদীসটি অন্যান্য সূত্রেও বর্ণিত আছে এবং ইমাম আবু দাউদ তায়ালিসীও তার মুসনাদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। গুনন্দুর বলেন, আমি শু’বাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কি সেই শাজারাতুল খুলদ? তিনি বললেন, না বর্ণনায় ‘তাহলো’ বাক্যাংশটি নেই।
অর্থাৎ- এভাবে সে তাদেরকে প্রবঞ্চনা দ্বারা অধঃপতিত করল। তারপর যখন তারা সে বৃক্ষ-ফলের আস্বাদ গ্রহণ করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং উদ্যানপত্র দ্বারা তারা তাদেরকে আবৃত করতে লাগল। (৭ : ২২)
ইব্ন আবু হাতিম (র) বর্ণনা করেন যে, উৰাই ইব্ন কা’ব (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-কে দীর্ঘকায় এবং ঘন কেশবিশিষ্ট পুরুষরূপে সৃষ্টি করেন, যেন তিনি ছিলেন দীর্ঘ এক খেজুর গাছ। তারপর যখন তিনি বৃক্ষ-ফল আস্বাদন করেন, তখন দেহ থেকে তার পোশাক খসে পড়ে।
যেমন সূরা তা-হায় আল্লাহ তা’আলা বলেন- তারপর তারা তা থেকে ভক্ষণ করল; তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ল। (২০ : ১২১)
আদম (আ)-এর আগেই হাওয়া (আ) বৃক্ষ-ফল ভক্ষণ করেছিলেন এবং তিনিই আদম (আ)-কে তা খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। বুখারীর নিম্নোক্ত হাদীসটি এ অর্থেই নেওয়া হয়ে থাকে।
ইমাম বুখারী (র) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ‘বনী ইসরাঈলরা না হলে গোশত পচতো না। আর হাওয়া না হলে কোন নারী তার স্বামীর সঙ্গে খেয়ানত করত না।’ বুখারী ও মুসলিম, আহমদ ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আহলে কিতাবদের হাতে রক্ষিত তাওরাতে আছে যে, হাওয়া (আ)-কে বৃক্ষ-ফল খাওয়ার পথ দেখিয়েছিল একটি সাপ। সাপটি ছিল অত্যন্ত সুদর্শন ও বৃহদাকার। তার কথায় হাওয়া (আ) নিজেও তা খান এবং আদম (আ)-কেও তা খাওয়ান। এ প্রসঙ্গে ইবলীসের উল্লেখ নেই।
খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখ খুলে যায় এবং তাঁরা দু’জনে আঁচ করতে পারেন যে, তারা দু’জন বিবন্ত্র। ফলে তাঁরা ডুমুরের পাতা গায়ে জড়িয়ে নেন। তাওরাতে এও আছে যে, তারা বিবস্ত্রই ছিলেন। ওহাব ইব্ন মুনাবিবাহ (র) বলেন, আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-এর পোশাক ছিল তাদের উভয়ের লজ্জাস্থানের উপর একটি জ্যোতির আবরণ।
উল্লেখ্য যে, আহলে কিতাবদের হাতে রক্ষিত বর্তমান তাওরাতে একথাটি ভুল এবং বিকৃত এবং আরবী ভাষান্তরের প্রমাদ বিশেষ। কারণ, ভাষান্তর কর্মটি যার-তার পক্ষে সহজসাধ্য নয়। বিশেষ করে আরবী ভাষায় যার ভালো দক্ষতা নেই এবং মূল কিতাবের ভাব উদ্ধারে যিনি পটু নন, তার পক্ষে তো এ কাজটি অত্যন্ত দুরূহ।
এজন্যই আহিলে কিতাবদের তাওরাত আরবীকরণে শব্দ ও মর্মগত যথেষ্ট ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে। কুরআনে করীমের নিম্নোক্ত বর্ণনার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আদম ও হাওয়া (আ)-এর দেহে বস্ত্র ছিল।
অর্থাৎ- শয়তান তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থার্ন দেখাবার জন্য বিবস্ত্র করে। (৭ : ২৭) কুরআনের এ বক্তব্য তো আর অন্য কারো কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
ইব্ন আবু হাতিম (র) বর্ণনা করেন যে, উৰাই ইব্ন কা’ব (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-কে দীর্ঘকায় এবং ঘন কেশবিশিষ্ট পুরুষরূপে সৃষ্টি করেন, যেন তিনি ছিলেন দীর্ঘ এক খেজুর গাছ। তারপর যখন তিনি বৃক্ষ-ফল আস্বাদন করেন, তখন দেহ থেকে তার পোশাক খসে পড়ে।
এ হলো অপরাধের স্বীকারোক্তি, তাওবার শরণাপন্ন হওয়া এবং উপস্থিত মুহুর্তে আল্লাহর নিকট নিজের হীনতা, বিনয় ও অসহায়ত্বের অভিব্যক্তি। বলা বাহুল্য যে, আদমের সন্তানদের যে-ই অপরাধ স্বীকার করে এরূপ তাওবা করবে। ইহকাল ও পরকালে তার পরিণাম মঙ্গলজনকই হবে।
তখন সর্বপ্রথম তার যে অঙ্গটি প্রকাশ পেয়েছিল তাহলো তার লজ্জাস্থান। নিজের লজ্জাস্থান দেখে তিনি জান্নাতের মধ্যে দৌড়াতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তার চুল একটি বৃক্ষে আঁটকে যায়। ফলে তিনি তা টেনে নেন। তখন আল্লাহ তা’আলা তাকে লক্ষ্য করে বললেন,
আদম! তুমি কি আমার থেকে পালিয়ে যােচ্ছ? আল্লাহর কথা শুনে আদম (আ) বললেন, পালাচ্ছি না হে আমার রব! লজ্জায় এমনটি করছি।
ছাওরী (র) বুর্গ এর ব্যাখ্যায় ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন- এখানে জান্নাতের যে বৃক্ষ-পত্রের কথা বলা হয়েছে তা ছিল ডুমুর বৃক্ষের পাতা। এটাই সহীহ সনদ। সম্ভবত তা আহলি কিতাবদের বর্ণনা থেকে নেওয়া হয়েছে। আয়াতে সুস্পষ্টভাবে কোন নির্দিষ্ট পাতার কথা বলা হয়নি। আর এটা মেনে নিলেও কোন ক্ষতি নেই। আল্লাহই সর্বজ্ঞ |
হাফিজ ইব্ন আসাকির (র) উবাই ইব্ন কা’ব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ‘তোমাদের পিতা আদম (আ) লম্বা খেজুর গাছের ন্যায় ষাট হাত দীর্ঘ ঘন। কেশবিশিষ্ট ছিলেন এবং গোপনাঙ্গ আবৃত ছিল। তারপর জান্নাতে অপরাধ করে বসলে তাঁর গোপনাঙ্গ প্রকাশ হয়ে পড়ে।
ফলে তাঁকে জান্নাত থেকে বের হতে হয়। তখন একটি বৃক্ষের মুখোমুখি হলে বৃক্ষটি তাঁর মাথার সম্মুখ ভাগের কেশগুচ্ছ ধরে ফেলে। এদিকে আল্লাহ তা’আলা। তাকে ডেকে বললেন, আমার নিকট থেকে পালাতে চাও হে আদম? আদম (আ) বললেন, আল্লাহর শপথ! আপনার লজ্জায় নিজ কৃতকর্মের জন্যে এমনটি করছি, হে আমার রব!
অন্যান্য সূত্রে বিশুদ্ধতর সনদে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে অনুরূপ একটি রিওয়ায়ত রয়েছে- তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষের নিকটবতী হতে বারণ করিনি? এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শক্র?
তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং দয়া না কর তবে অবশ্য আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।
এ হলো অপরাধের স্বীকারোক্তি, তাওবার শরণাপন্ন হওয়া এবং উপস্থিত মুহুর্তে আল্লাহর নিকট নিজের হীনতা, বিনয় ও অসহায়ত্বের অভিব্যক্তি। বলা বাহুল্য যে, আদমের সন্তানদের যে-ই অপরাধ স্বীকার করে এরূপ তাওবা করবে। ইহকাল ও পরকালে তার পরিণাম মঙ্গলজনকই হবে।
অর্থাৎ- আল্লাহ বললেন, তোমরা নেমে যাও, তোমরা একে অপরের শত্রু এবং পৃথিবীতে তোমাদের কিছুকাল বসবাস ও জীবিকা রয়েছে। (৭ : ২৪)
আদম (আ), হাওয়া (আ) ও ইবলীসকে সম্বোধন করে এ আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কারো কারো মতে, তাদের সঙ্গে সাপটিও এ আদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সীমালংঘন করার অপরাধে তাদেরকে জান্নাত থেকে নেমে যাওয়ার এ আদেশ দেওয়া হয়।
সঠিক কথা হলো- বিষয়বস্তু এক হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা’আলা শব্দগতভাবে কথাটি দু’বার উল্লেখ করেছেন এবং প্রতিবারের সাথে একটি করে অবশ্যম্ভাবী বিধান জুড়ে দিয়েছেন। প্রথমটির সাথে জুড়ে দিয়েছেন তাদের পারস্পরিক শক্রিতা এবং দ্বিতীয়টির সাথে জুড়ে দিয়েছেন যে, পরবর্তীতে তাদের উপর যে হিদােয়ত নাযিল করা হবে, যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে। সে হবে ভাগ্যবান, আর যে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে হবে ভাগ্যাহত। বলা বাহুল্য যে, কুরআনে করীমে এ ধরনের ভাবভঙ্গির বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আদম ও হাওয়া (আ)-এর সাথে সাপের উল্লেখের সপক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একটি হাদীস পেশ করা হয়ে থাকে। তাহলো- রাসূলুল্লাহ (সা) সাপ হত্যার আদেশ দিয়ে বলেন, ‘যেদিন- ওগুলোর সাথে আমরা লড়াই করেছি, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ওগুলোর সাথে আর আমরা সন্ধি করিনি।’ সূরা তা-হায় আল্লাহ তা’আলা বলেন :
– তােমরা দু’জনে একই সঙ্গে জান্নাত থেকে নেমে যাও। তােমরা পরস্পর পরস্পরের ‘…’।
এই আদেশ হলো আদম (আ) ও ইবলীসের প্রতি। আর হাওয়া আদমের এবং সাপ ইবলীসের অনুগামী হিসাবে এ আদেশের আওতাভুক্ত। কেউ কেউ বলেন, এখানে দ্বিবচন শব্দ দ্বারা একত্রে সকলকেই আদেশ করা হয়েছে। যেমন একস্থানে আল্লাহ তা’আলা বলেন-
অর্থাৎ-এবং স্মরণ কর দাউদ ও সুলায়মানের কথা, যখন তারা বিচার করছিল শস্য ক্ষেত্র সম্পর্কে তাতে রাত্রিকালে প্রবেশ করেছিল কোন সম্প্রদায়ের মেষ; আমি প্রত্যক্ষ করছিলাম তাদের বিচার। (২১ : ৭৮)।
সঠিক কথা হলো-এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বহুবচন শব্দ দ্বারা দু’ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন। কেননা, বিচারক দু’ব্যক্তির মাঝে বিচার করে থাকেন। একজন বাদী অপরজন বিবাদী। অথচ ‘পূর্ব, ‘আমি তাদের বিচার প্রত্যক্ষ করছিলাম।
সূরা বাকারায় (৩৬-৩৯) আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-
আয়াতে আল্লাহ তা’আলা দু’বার ‘…’ বলে অবতরণের আদেশ করেছেন। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কোন কোন মুফাসসির বলেন, প্রথম অবতরণ দ্বারা জান্নাত থেকে পৃথিবীর নিকটবতী আসমানে নেমে আসা আর দ্বিতীয়টি দ্বারা নিকটবতী আসমান থেকে দুনিয়াতে, নেমে আসা বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাখ্যাটি দুর্বল। কারণ আল্লাহ তা’আলা প্রথম আদেশে বলেছেন :
অর্থাৎ ‘আমি বললাম, তােমরা একে অন্যের শত্রুরূপে নেমে যাও। পৃথিবীতে কিছু কালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।’ এ আয়াত প্রমাণ করে যে, প্রথমবারেই তাদেরকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
সঠিক কথা হলো- বিষয়বস্তু এক হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা’আলা শব্দগতভাবে কথাটি দু’বার উল্লেখ করেছেন এবং প্রতিবারের সাথে একটি করে অবশ্যম্ভাবী বিধান জুড়ে দিয়েছেন। প্রথমটির সাথে জুড়ে দিয়েছেন তাদের পারস্পরিক শক্রিতা এবং দ্বিতীয়টির সাথে জুড়ে দিয়েছেন যে, পরবর্তীতে তাদের উপর যে হিদােয়ত নাযিল করা হবে, যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে। সে হবে ভাগ্যবান, আর যে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে হবে ভাগ্যাহত। বলা বাহুল্য যে, কুরআনে করীমে এ ধরনের ভাবভঙ্গির বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে।
হাফিজ ইব্ন আসাকির (র) মুজাহিদ (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-কে তাঁর নৈকট্য থেকে বের করে দেয়ার জন্য দু’জন ফেরেশতাকে আদেশ দেন। ফলে জিবরাঈল (আ) তাঁর মাথা থেকে মুকুট উঠিয়ে নেন এবং মীকাঈল (আ) তাঁর কপাল থেকে মুকুট খুলে ফেলেন এবং একটি বৃক্ষশাখা, তাকে জড়িয়ে ধরে। তখন আদম (আ) ধারণা করলেন যে, এটা তার তাৎক্ষণিক শাস্তি।
তাই তিনি মাথা নিচু করে বলতে লাগলেন-ক্ষমা চাই, ক্ষমা চাই। তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন, তুমি কি আমার নিকট থেকে পালাচ্ছে? আদম (আ) বললেন, বরং আপনার লজ্জায় এমনটি করছি, হে আমার মনিবা!
ইমাম আহমদ (র) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : দিবসসমূহের মধ্যে জুমুআর দিন হলো সর্বোত্তম। এদিনে আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হয়, এদিনে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়, এ দিনে তাকে জান্নাত থেকে বের করা হয় এবং এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। বর্ণনাটি মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ।
আওযায়ী (র) হাসসান ইব্ন আতিয়্যা (র) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আদম (আ) জান্নাতে একশ’ বছরকাল অবস্থান করেন। অন্য এক বর্ণনায় ষাট বছরের উল্লেখ রয়েছে। তিনি জান্নাত হারানোর দুঃখে সত্তর বছর, অন্যায়ের অনুতাপে সত্তর বছর এবং নিহত পুত্রের শোকে চল্লিশ বছর ক্ৰন্দন করেন। ইব্ন আসাকির (র) এটি বর্ণনা করেন।
ইব্ন আবু হাতিম (র) বর্ণনা করেন যে, ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, আদম (আ)-কে মক্কা ও তায়িফের মধ্যবতীর্ণ দাহনা নামক স্থানে নামিয়ে দেয়া হয়। হাসান (র) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আদম (আ)-কে ভারতে, হাওয়া (আ)-কে জিদায় এবং ইবলীসকে বসরা থেকে মাইল কয়েক দূরে দস্তমীসান নামক স্থানে নামিয়ে দেয়া হয়। আর সর্পটিকে নামানো হয় ইস্পাহানে।
সুদী (র) বলেন, আদম (আ) ভারতে অবতরণ করেন। আসার সময় তিনি হাজরে আসওয়াদ ও জান্নাতের এক মুঠো পাতা নিয়ে আসেন এবং এ পাতাগুলো ভারতের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে দেন। ফলে সে দেশে সুগন্ধির গাছ উৎপন্ন হয়। ইব্ন উমর (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আদম (আ)-কে সাফায় এবং হাওয়া (আ)-কে মারওয়ায় নামিয়ে দেওয়া হয়। ইব্ন আবু হাতিম এ তথ্যটিও বর্ণনা করেছেন।
আব্দুর রাযযাক (র) আবু মূসা আশআরী (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা আদম (আ)-কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়ার সময় যাবতীয় বস্তুর প্রস্তুত প্রণালী শিখিয়ে দেন এবং জান্নাতের ফল-ফলাদি থেকে তার আহার্যের ব্যবস্থা করে দেন। সুতরাং তোমাদের এ ফল-মূল জান্নাতের ফল-মূল থেকেই এসেছে। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, এগুলোতে বিকৃতি আসে আর ওগুলোর কোন বিকৃতি নেই।
হাকিম (র) তার মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেন যে, ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন- আদম (আ)-কে জান্নাতে শুধুমাত্র আসর থেকে সূর্যস্ত পর্যন্ত সময়টুকু থাকতে দেয়া হয়েছিল। হাকিম (র) বলেন, হাদীসটি বুখারী, মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ, তবে তারা হাদীসটি বর্ণনা করেন নি।
সহীহ মুসলিমে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ‘দিনসমূহের মধ্যে জুমুআর দিন হলো সর্বোত্তম। এ দিনে আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হয়, এদিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়, এ দিন তাকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করা হয়।’ সহীহ বুখারীতে অন্য এক সূত্রে আছে যে, ‘এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।’
ইমাম আহমদ (র) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : দিবসসমূহের মধ্যে জুমুআর দিন হলো সর্বোত্তম। এদিনে আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হয়, এদিনে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়, এ দিনে তাকে জান্নাত থেকে বের করা হয় এবং এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। বর্ণনাটি মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ।
কেউ কেউ বলেন, আদম (আ) আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বাণী প্রাপ্ত হয়েছিলেন তাহলো- হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন তাহলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তাদের অন্তর্ভুক্ত হবো।
ইব্ন আসাকির (র) বর্ণনা করেন যে, আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : আদম (আ) ও হাওয়া (আ)-কে বিবস্ত্র অবস্থায় একত্রে নামিয়ে দেওয়া হয়। তখন তাদের দেহে জান্নাতের পাতা জড়ানো ছিল। তখন আদম (আ) অসহ্য গরম অনুভব করেন।
এমনকি তিনি বসে কান্নাকাটি করতে শুরু করেন এবং হাওয়াকে লক্ষ্য করে বলেন যে, হাওয়া! গরমে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, তারপর জিবরাঈল (আ) তাঁর কাছে কিছু তুলো নিয়ে আসেন এবং হাওয়াকে সুতা কাটার আদেশ দিয়ে তাকে তা শিখিয়ে দেন।
আর আদম (আ)-কে কাপড় বুননের আদেশ দেন এবং তাকে বুনন কার্য শিক্ষা দেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন, আদম (আ) জান্নাতে তাঁর স্ত্রীর সংগে সহবাস করেননি; ইতিমধ্যেই বৃক্ষ-ফল খাওয়ার অপরাধে তাদেরকে জান্নাত থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, তারা উভয়ে আলাদা শয়ন করতেন।
একজন বাতহায় এবং অপরজন অন্য প্রান্তে শয়ন করতেন। একদিন জিবরাঈল (আ) এসে তাকে সহবাসের আদেশ দেন এবং তার পদ্ধতিও শিখিয়ে দেন। তারপর যখন আদিম (আ) স্ত্রী সঙ্গম করলেন, তখন জিবরাঈল (আ) এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, আপনি আপনার স্ত্রীকে কেমন পেয়েছেন?
আদম (আ) বললেন, সতী-সাধবী পেয়েছি। ইব্ন আসাকির (র) বর্ণিত এ হাদীসটি গরীব’ পৰ্যায়ভুক্ত এবং এটি মারফু হওয়া অত্যন্ত মুনকার’। কোন কোন
ইমাম বুখারী (র) এ লোকটিকে মুনকারুল হাদীস বলে অভিহিত করেছেন। ইব্ন হিব্বান বলেন, এ লোকটি যতসব জাল হাদীস বর্ণনা করে। ইব্ন আদী (র) বলেন, লোকটি একান্তই অজ্ঞাত পর্যায়ের। –
অর্থাৎ- তারপর আদম তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে কিছু বাণী প্রাপ্ত হলো। ফলে আল্লাহ তার প্রতি ক্ষমা পরবশ হলেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (২ : ৩৭)
কেউ কেউ বলেন, আদম (আ) আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বাণী প্রাপ্ত হয়েছিলেন তাহলো- হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন তাহলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তাদের অন্তর্ভুক্ত হবো।
মুজাহিদ, সাঈদ ইব্ন জুবায়র, আবুল আলিয়া, রবী ইব্ন আনাস, হাসান, কাতাদা, মুহাম্মদ ইব্ন কা’ব, খালিদ ইব্ন মাদান, আতা আল-খুরাসানী (র) ও আবদুর রহমান ইব্ন যায়ীদ (র) থেকে এ অভিমত বর্ণিত আছে।
ইব্ন আবু হাতিম (র) বর্ণনা করেন যে, উবাই ইব্ন কা’ব (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : আদম (আ) বললেন, হে আমার রব! আমি যদি তাওবা করি ও ফিরে আসি; তাহলে আমি কি আবার জান্নাতে যেতে পারব? আল্লাহ বললেন, হ্যা।
এটাই সে বাণী যার কথা-এ আয়াতে বলা হয়েছে। এ সূত্রে হাদীসটি গরীব এবং এতে ইনকিতা তথা বিচ্ছিন্নতা রয়েছে।
ইব্ন আবু নাজীহ (র) মুজাহিদ (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন- ঐ বাণীগুলো হলো-
অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আমি তোমার পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করি। হে আমার রব! নিশ্চয় আমি আমার নিজের প্রতি অত্যাচার করেছি। অতএব, তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও। নিশ্চয় তুমি ক্ষমাকারীদের সর্বোত্তম।
তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন, তুমি মুহাম্মদকে চিনলে কি করে অথচ এখনও তাঁকে আমি সৃষ্টি-ই করিনি? আদম (আ) বললেন, হে আমার রব! যখন আপনি আমাকে আপনার নিজ হাতে সৃষ্টি করলেন এবং আমার মধ্যে আপনার রূহ সঞ্চার করলেন তখন আমি মাথা তুলে আরশের স্তম্ভসমূহে।
হে আল্লাহ! তুমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। আমি তোমার পবিত্ৰতা বর্ণনা করি ও প্রশংসা করি। হে আমার রব! নিশ্চয় আমি নিজের প্রতি আবিচার করেছি। আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও।
হে আল্লাহ! তুমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। আমি তোমার পবিত্ৰতা বর্ণনা করি ও প্রশংসা করি। হে আমার রব! আমি নিজের প্রতি অন্যায় করেছি। আমার প্রতি তুমি ক্ষমা পরবশ হও। নিশ্চয় তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ আদম (আ) বললেন, হে আমার রব! আপনি কি আমাকে আপনার নিজ কুদরতী হাতে সৃষ্টি করেননি? বলা হলো, হ্যা। তখন তিনি বললেন, আপনি কি আমার দেহে আপনার রূহ সঞ্চার করেননি? বলা হলো, হ্যা।
তখন তিনি পুনরায় বললেন, আমি হাঁচি দিলে আপনি কি বা ‘…’ (আল্লাহ্ তোমাকে রহম করুন) বলেননি? এবং আপনার রহমত কি আপনার গযবের উপর প্রবল নয়? বলা হলো, হ্যা। পুনরায় তিনি বললেন- আপনি কি একথা নির্ধারণ করে রাখেননি যে, আমি এ কাজ করব?
বলা হলো, হ্যা। এবার আদম (আ) বললেন, আচ্ছা, আমি যদি তাওবা করি; তাহলে আপনি পুনরায় আমাকে জান্নাতে ফিরিয়ে নেবেন কি? আল্লাহ বললেন, হ্যা। হাকিম বলেন, এর সনদ সহীহ কিন্তু ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) হাদীসটি বর্ণনা করেননি।
হাকিম, বায়হাকী ও ইব্ন আসাকির (র) উমর ইব্ন খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : ‘আদম (আ) যখন ভুল করে বসলেন তখন বললেন, হে আমার রব! মুহাম্মদের উসিলা দিয়ে আমি আপনার দরবারে প্রার্থনা করছি যে, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন!
তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন, তুমি মুহাম্মদকে চিনলে কি করে অথচ এখনও তাঁকে আমি সৃষ্টি-ই করিনি? আদম (আ) বললেন, হে আমার রব! যখন আপনি আমাকে আপনার নিজ হাতে সৃষ্টি করলেন এবং আমার মধ্যে আপনার রূহ সঞ্চার করলেন তখন আমি মাথা তুলে আরশের স্তম্ভসমূহে।
…লিখিত দেখতে পাই। তাতে আমি বুঝতে পারলাম যে, আপনার পবিত্র নামের সাথে আপনি সৃষ্টির মধ্যে আপনার সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো নাম যোগ করেননি। তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন, তুমি যথার্থই বলেছ, হে আদম! নিশ্চয় তিনি সৃষ্টির মধ্যে আমার প্রিয়তম।
তাঁর উসিলায় যখন তুমি আমার কাছে প্রার্থনা করেই ফেলেছি, তখন আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। আর মুহাম্মদ (সা)-কে সৃষ্টি না করলে তােমাকে আমি সৃষ্টিই করতাম না।
বায়হাকী বলেন, এ সূত্রে আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ ইব্ন আসলাম-ই হাদীসটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন। আর তিনি হলেন দুর্বল রাবী। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। উল্লেখ্য যে, এ আয়াতটি নিম্নের আয়াতটির অনুরূপ :
অর্থাৎ- আদম তার প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করল, ফলে সে ভ্ৰমে পতিত হলো। এরপর তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হলেন ও তাকে পথ-নির্দেশ করলেন। (২০ : ১২১-১২২)
………………………
বি.দ্র: লেখার আরবী অংশগুলো ভুলত্রুটি হতে পারে এই বিবেচনায় এই পর্যায়ে উল্লেখ করা হয়নি। ভবিষ্যতে বিষয়টি উল্লেখ করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এই জন্য সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………..
আরও পড়ুন-
মহাবিশ্বের উৎপত্তি : প্রথম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি : দ্বিতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : প্রথম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : দ্বিতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : তৃতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : চতুর্থ কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : পঞ্চম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : ষষ্ঠ কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : সপ্তম কিস্তি
সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে প্লাতনের মতবাদ
মহাবিশ্বের সৃষ্টি কাহিনী
পবিত্র কোরানে সৃষ্টিতত্ত্ব
আরশ ও কুরসী সৃষ্টির বিবরণ
সাত যমীন প্রসঙ্গ
সাগর ও নদ-নদী
পরিচ্ছেদ : আকাশমণ্ডলী
ফেরেশতা সৃষ্টি ও তাঁদের গুণাবলীর আলোচনা
পরিচ্ছেদ : ফেরেশতাগণ
জিন সৃষ্টি ও শয়তানের কাহিনী
সীরাত বিশ্বকোষে বিশ্ব সৃষ্টির বিবরণ
আদম (আ) পৃথিবীর আদি মানব
আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য
আদম (আ)-এর সালাম
আদম (আ)-এর অধস্তন বংশধরগণ
হাদীসে আদম (আ)-এর সৃষ্টি প্রসঙ্গ
আদম (আ)-এর সৃষ্টি