-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
গুরুত্বপূর্ণ ক্লাইন্ট মিটিং, কিন্তু ঢাকা শহরের জ্যাম তো তা বোঝে না। কি আর করা, মার্কেটিং চিফ অগ্নি গাড়িতে বসেই পাঠাও মটরসাইকেল কল করে নিলো; যে জ্যাম তাতে গাড়ি আর এগুবে বলে মনে হয় না। শাহবাগে সম্ভবত রাস্তা বন্ধ করে কোনো আন্দোলন চলছে। এমনিতেই মিটিং এর টাইম অলরেডি হয়ে গেছে।
গাড়িতে বসে থাকলে সব পরিশ্রম শেষ। তবে মটরসাইকেলে উঠেও কোনো লাভ হলো না। মতিঝিল যাওয়া দরকার, কিন্তু শেরাটনের রাস্তা ধরে ঘুরে গিয়েও শেষ রক্ষা হলো না; সে রাস্তাতেও ভয়াবহ জ্যাম।
ক্লাইন্ট যখন ফোনে জানিয়ে দিলো দেরি করে ফেলায় মিটিং ক্যানসেল হয়ে গেছে তখন এই দেশে কেনো জন্মেছে এই ভাবতে ভাবতে চরম মেজাজ খারাপ নিয়ে কিছু চিন্তা না করেই নেমে পড়লো বেইলী রোডের মুখটায়। পাঠাও ছেড়ে দেয়ার পর মনে পরলো কেনো নামলো? এখন কি করবে সে?
তিনমাস ঘুরে এই ক্লাইন্টের সাথে মিটিং সেট হয়েছিল। এটা মিস হয়ে যাওয়ায় অফিস থেকে কি পরিমাণ ঝামেলায় পরতে হবে ভেবেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। যদি চাকরি চলে যায় তাহলে সদ্য কেনা গাড়ির-ফ্ল্যাটের ইনস্টলোমেন্ট!! নাহ্! আর ভাবতে পারছে না অগ্নি।
তবে বেশিভাগ মানুষের কোনো হেলদোল নেই, তারা জ্যামের মধ্যে বাসে বা গাড়িতে বসে থেকে থেকে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। শিকড় গজিয়ে যাওয়ার পরও তারা নামবে বলে মনে হয় না। কিন্তু সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না এখন কি করা উচিত। গুলশান বা ধানমন্ডির দিকে হলে অফিসের কোনো কাজ সেরে নেয়া যেত।
সন্ধ্যার দিকে হলেও না হয় কোনো সুরিখানায় বসে সময় কাটানো যেতে কিন্তু ঘড়িতে মাত্র বারোটা, আর জীবনেরও বারোটা। তিনমাস ঘুরে এই ক্লাইন্টের সাথে মিটিং সেট হয়েছিল। এটা মিস হয়ে যাওয়ায় অফিস থেকে কি পরিমাণ ঝামেলায় পরতে হবে ভেবেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
যদি চাকরি চলে যায় তাহলে সদ্য কেনা গাড়ির-ফ্ল্যাটের ইনস্টলোমেন্ট!! নাহ্! আর ভাবতে পারছে না অগ্নি। দামী লাইটার দিয়ে ফটাস করে সিগারেটখানা ধরিয়ে তীব্র গরমে ঘামতে ঘামতে গাছের ছায়ায় দাঁড়াতেই খেয়াল হলো রমনায় ঢুকে পড়লে কেমন হয়? সেই কবে শেষ এসেছিল রমনায়?
বটতলার গান শুনতে নাকি অন্য কোনো সময়, ঠিক মনে করতে পারলো না। কর্পোরেট হতে হতে কখন যে জীবনের নির্মলতাগুলো হারিয়ে গেছে কে জানে। দামী দামী হোটেল-রিসোর্ট ছাড়া অন্য কোথাও আজকাল আর যাওয়াই হয় না।
যাক সে কথা, গাছতলায় কোনো বেঞ্চিতে বসে একটু ঠান্ডা হওয়া যাক; এরমধ্যে জ্যাম কিছুটা কমলে ভালো। তখন কোনদিকে যাওয়া যায় ভেবে দেখা যাবে। সিগারেটখানা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে পার্কের গেট দিয়ে ঢুকে পড়লো। কিন্তু হায়! কোথায় বসবে! প্রায় সকল বেঞ্চিতেই খুব কাছাকাছি বসে জোড়ায় জোড়ায় প্রেম করছে যুগলরা।
তাদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে নিরিবিলি জায়গা খুঁজতে এগিয়ে চললো পার্কের ইটবিছানো পথ ধরে। যেখানে গেলে মনটাকে একটু শান্ত করা যায় এমন একটা জায়গা দরকার বসবার জন্য। কি হবে জীবনের ভাবতে ভাবতে পার্কের সবুজে এগিয়ে চললো অগ্নি।
হালকাপাতলা গড়নের মাঝারি উচ্চতার ভদ্রলোক অনেকটা লোকনাথ ব্রহ্মচারী স্টাইলে বেঞ্চির উপর পা তুলে আয়েস করে বসে আছে; তার সামনে বেশ কয়েকটা টোকাই ছেলেমেয়ে দুইটা কুকুর। ভদ্রলোক তাদের সাথে বেশ রসিয়ে রসিয়ে কথা বলছে আর চুক চুক করে চা খাচ্ছে। এই ধরনের লোক দেখলে অগ্নির মাথায় রক্ত উঠে যায়। যতসব ভন্ডের দল;
হাঁটতে হাঁটতে পার্কের নিরিবিলি অংশে চলে এলো সিনিয়ার মার্কেটিং ম্যানেজার অগ্নি; ফোনটা ততক্ষণে বন্ধ করে দিয়েছে নইলে অফিস থেকে ফোন করে পাগল করে দেবে। এখন আর কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না অফিসের কারো সাথে। বেশকিছুটা সময় একা কাটাতে মন চাইছে। বহুদিন এমন ঘটনা ঘটেনি এই ইঁদুর দৌঁড়ের জীবনে।
পার্কের এই অংশটা বেশ শীতল, বড় বড় গাছের ছায়ায় হাঁটতে বেশ লাগছে। দুই একটা অপরিচিত পাখির ডাক আরও মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। এইদিকে মানুষজনও কম, বসার জন্য একটা বেঞ্চি খুঁজতে গিয়ে তা আর চোখে পড়লো না। যাও আছে তা এতোটাই ভাঙ্গা যে তাতে আর বসা সম্ভব না।
কিছু দূরে আলখেল্লা টাইপের সাদা ধবধবে পোষাক পরে একমাত্র টিকে যাওয়া বেঞ্চিটাতে এক মাঝবয়সি লোক বসে আছে; বেশ সাধু সাধু ভাব যদিও বিশাল দাঁড়িমোচ নেই; হালকাপাতলা গড়নের মাঝারি উচ্চতার ভদ্রলোক অনেকটা লোকনাথ ব্রহ্মচারী স্টাইলে বেঞ্চির উপর পা তুলে আয়েস করে বসে আছে; তার সামনে বেশ কয়েকটা টোকাই ছেলেমেয়ে দুইটা কুকুর।
ভদ্রলোক তাদের সাথে বেশ রসিয়ে রসিয়ে কথা বলছে আর চুক চুক করে চা খাচ্ছে। এই ধরনের লোক দেখলে অগ্নির মাথায় রক্ত উঠে যায়। যতসব ভন্ডের দল; কোনো কাজ কাম নাই, শুয়েবসে জীবন কাটিয়ে দেয় আরামসে। এদের জন্যই দেশটার কিছু হলো না। বদের হাড্ডি একেকটা।
আউল-বাউল সেজে ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়; জ্ঞান দিয়ে বেড়ায়। ভাবখানা এমন যেন সবজান্তা। রাজশাহী যাওয়ার ট্রেনে একবার এমন একজনের সাথে মুখোমুখি হয়েছিল সেদিন মাথায় অনেক কাজের বোঝা থাকায় তার সাথে কথায় পেরে উঠেনি অগ্নি। আজ মনে মনে একটা পণ করে নিলো এই হারামজাদার উপরেই আজকের সমস্ত রাগ উগরে দিয়ে শান্ত করতে হবে মনকে।
তবে সে এটা কাউকে টের পেতে দেয় না, আশপাশের কাউকে না, এমনকি নিজেকেও না। মার্কেটিং-এ জব করতে করতে মানুষকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হয় কিভাবে কথার মারপ্যাচে ফেলে কার্য হাসিল করতে হয় সেই বিদ্যা তার ভালোই জানা।
বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে শিখেছিল মন উত্তেজিত হলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বা দৃশ্যমান কোনো বস্তুর উপর রাগ উগড়ে দিয়ে মন হালকা করে নিতে হয়। মন চঞ্চল থাকলে কাজের ক্ষতি হয়। অগ্নির শুধু চোখের কোণে নয় ঠোঁটের কোনেও একটা হাসির রেশ খেলে গেলো।
সকালের সকল ব্যর্থতা, ঢাকা শহরের জ্যাম, অফিসের কাজ, ফ্ল্যাট-গাড়ির ইনস্টলমেন্ট, বউয়ের ফর্দের লিস্টি, একমাত্র কন্যার বায়না সব দূরে সরিয়ে অগ্নি এগিয়ে গেলো সেই লোকের কাছে; মনে মনে এঁটে নিলো সকল প্যাঁচ; আজ বেটার খবর আছে।
প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার জিম করা সুদর্শন তীক্ষ্ম বুদ্ধির তরতাজা যুবক অগ্নি। চারপাশে প্রচুর কম্পিটিশন থাকলেও সে তার কাজটা ভালোই চালিয়ে যাচ্ছে।
বন্ধু-পরিবার-পরিজন-প্রতিবেশিরা তার সাফল্যে ইর্ষা করে। সেটাকে সে খুব উপভোগ করলেও মনে মনে জানে দিন দিন যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছে আর চারপাশে যে হারে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; যে হারে প্রতিষ্ঠানগুলো ভাঙছে তাতে একটা শঙ্কার শীতল জল নেমে যায় গভীর থেকে গভীরে।
তবে সে এটা কাউকে টের পেতে দেয় না, আশপাশের কাউকে না, এমনকি নিজেকেও না। মার্কেটিং-এ জব করতে করতে মানুষকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হয় কিভাবে কথার মারপ্যাচে ফেলে কার্য হাসিল করতে হয় সেই বিদ্যা তার ভালোই জানা।
ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ হয়নি এখনো তবে বেশ একটা মুরুব্বিয়ানা ভাব আছে। অগ্নি তার কাছাকাছি গিয়ে বললো, বসতে পারি? ভদ্রলোক মাথা তুলে গভীরভাবে অগ্নিকে দেখলো; তারপর চায়ের কাপখানা বেঞ্চিতে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে দুইহাত জড়ো করে ভক্তি দিয়ে কোমল গলায় বললো, জয় গুরু! বসেন বাপ।
এই ভঙ্গিতে স্বাগত জানানোতে অগ্নি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। এমন একটা অভ্যর্থনা হতে পারে ভাবতে পরেনি। ভেতরের আগুনের তেজটা যেন কিছুটা কমে এলো। তারপরও নিজেকে সামলে নিতে নিতে থতমত করে বলে উঠলো ‘জয় গুরু’। এই শব্দটা সে কেনো বললো তা সে নিজেই জানে না। ভেতরে ভেতরে ভাবতে লাগলো, হারামজাদা মস্ত টাউট। কেমন একটা মুরব্বী মুরব্বী ভাব নিচ্ছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে বেঞ্চির ফাঁকা অংশটায় বসে পরলো। ভদ্রলোক তার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে টোকাইদের সাথে গল্পে ডুবে গেলো। সবই উচ্চমার্গের দার্শনিক কথাবার্তা হচ্ছে; আশ্চর্যের বিষয় হলো শিশুগুলো মুগ্ধতা নিয়ে হা হয়ে শুনছে এমনকি কুকুর দুটিও। যেন তারা সবই বুঝছে এমন একটা ভাব। অগ্নি মনে মনে হিসেব করতে লাগলো কি করে আলাপ শুরু করা যায়।
মার্কেটিং সুলোভ ভঙ্গিতে অগ্নি বললো, কিছু মনে করবেন না চারপাশে সবাই তো ভন্ড তাই বলে ফেলেছিলাম; আর নিজেও খুব ঝামেলার মধ্যে আছি। বাদ দেন। তাহলে আপনি এখন কি নামে পরিচিত? বাউল? সাধু? নাকি সন্ন্যাসী?
তারপরও প্রায় মিনিট দশেক তাদের কথা চললো তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলো না অগ্নি। একসময় আলোচনা শেষ করে ভদ্রলোক সবাইকে বিদায় দিলো। তাদের সাথে কুকুর দুটিও লেজ নাড়াতে নাড়াতে চলে গেল। এবার অগ্নির দিকে তাকিয়ে বললো, বাপ চা খাবেন? অগ্নি বললো চা কোথায় পাবেন?
আমি আর পাবো কোথায় বাপ পার্কের ঐ গ্রিলটায় সামনে যেয়ে চা বলে ডাকলে চা দিয়া যাবে। অগ্নি বললো, না থাক চা খাব না। যদিও অগ্নির চা খাওয়ার তীব্র তেষ্টা পেয়েছে কিন্তু এইসব লোককে বিশ্বাস নাই চায়ের সাথে কি না কি মিশিয়ে দেবে, শেষে সব শেষ হবে। অগ্নি বললো আপনার নাম কি?
ভদ্রলোক আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস ভাবে বললো, নাম একটা ছিল তবে এখন আর নাই।
-নাম নাই মানে? ভন্ডামী করছেন?
ভদ্রলোক আরো শান্ত ভঙ্গিতে একটু হাসি হাসি মুখে বললো, বাপ! ভন্ডামী করতে অনেক গুণ লাগে এতো গুণ আমার নাই। যা যা গুণ ছিল তাও ছেড়ে দিচ্ছি। নাম ছাড়ছি… পোষাক ছাড়ছি… বলতে বলতে থেমে গেলো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। অগ্নি এইবার ভদ্রলোকের প্রতি একটু ইন্টারেস্ট ফিল করতে শুরু করলো।
বিষয়টা ইন্টরেস্টেং এর সাথে খেলা যাক; নিজেকে সামলে নিলো, খারাপ ব্যবহার করলে আলোচনা আগাবে না। মার্কেটিং সুলোভ ভঙ্গিতে অগ্নি বললো, কিছু মনে করবেন না চারপাশে সবাই তো ভন্ড তাই বলে ফেলেছিলাম; আর নিজেও খুব ঝামেলার মধ্যে আছি। বাদ দেন। তাহলে আপনি এখন কি নামে পরিচিত? বাউল? সাধু? নাকি সন্ন্যাসী?
-যে যা ডাকে বাপ। আমার নিজের একটা নাম পছন্দ ছিল কিন্তু গুরু বলছে কোনো পছন্দ রাখা যাবে না তাই সেটাও বাদ দিয়েছি। আপনার যা খুশি ডাকতে পারেন।
-লোকে আপনাকে তাহলে কি নামে ডাকে এখন?
-যে যেমন বুঝে সে তেমন ডাকে- ভান্ডারি, সাধু, বাউল, ফকির, শাহ্, সাঁইজি, বাপ, বাপজি, কাকা, মামা, ভাই, দাদা আরো কত কি?
-আমি কোন নামে ডাকবো?
-এর মধ্যে আপনার কোনটা পছন্দ? নাকি নতুন কোন নাম দিবেন?
অগ্নি এক মুর্হুত ভাবলো। সাধু নামটা পছন্দ হয়েছে কিন্তু এই লোক মস্ত টাউট একে তো সাধু নাম দেয়া যায় না। তাহলে কি হতে পারে? ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হলের সেই উদাস রুমমেটের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ করেই।
সিগারেট ধরিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতো সারাদিন, মাঝেমধ্যে কবিতা-টবিতা লিখতো; কোথায় কোথায় হারিয়ে যেত আবার ফিরে আসতো, সেই বড় ভাইয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিল।
এই ভদ্রলোকের সাথে চেহারার কোনো মিল না থাকলেও ভাবে কিছুটা মিল আছে, একে জীবন নামে ডাকলে কেমন হয়? কথা বলার জন্য একটা নামতো দরকার তাই না? অগ্নি বলে ফেললো, আমি আপনাকে জীবন, মানে জীবন ভাই ডাকতে পারি?
-বাপ! আপনি যা খুশি ডাকতে পারেন সমস্যা নাই।
-ঠিক আছে তাহলে সে কথাই থাকলো জীবন ভাই। নাহ্ জীবন ভাই ঠিক যাচ্ছে না তারচেয়ে জীবন দা’ কেমন হয়?
-আপনার যেমন খুশি বাপ।
-কথায় কথায় এতো বাপ বাপ বলেন কেনো? এতে আপনার উদ্দেশ্য কি? বাপ ডাকলে মানুষের মন গলে যাবে, মানুষজন আপনারে টাকাপয়সা দিবে? আমাকে এতোই বোকা মনে হয় আপনার?
জীবন দা’ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বললো, দুনিয়ায় জাতি দুইটাই; একটা পুরুষ জাতি আরেকটা নারী জাতি। পুরুষরে বাপ ডাকি আর নারীরে জননী বা মা। তাদের প্রতিক্ষণে স্মরণ করায়া দেই এইখানে তার ছেইল্ল্যে বইসা আছে; জন্মদিলে তো হইবো না তারে তো মানুষও করন লাগবো তাই না বাপ?
-মানে?
-সংসারে পুরুষ হইলো ব্রহ্মরূপ অর্থাৎ যিনি জন্ম দেন; নারী হইলো বিষ্ণুরূপ যিনি পালন করেন আর গুরু হইলো শিবরূপ যে সংহার করে; গুরু আগের জীবন সংহার কইরে নতুন জীবন দান করে। তাই ব্রহ্ম-বিষ্ণু-শিব বা মহেশ সকলেই তো গুরু; সকলরেই ভক্তি দিতে হয় বাপ।
এই কথার উত্তরে কি বলা যায় ভাবছে অগ্নি। ভদ্রলোকের সাথে তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না সাবলীল ভঙ্গিতেও বেশ আকর্ষণ করছে। কিন্তু তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, আমার নাম অগ্নি, আমাকে এই নামে ডাকলেই আমি খুশি হবো।
-বাপ! আপনেরে খুশি করার সাধ্য কি আর আমার আছে। আমি নাম মনে রাখি না। আমার কথায় মনে কষ্ট নিয়েন না বাপ। আপনি একা এইখানে বসতে চাইলে আমি চইল্ল্যা যাই। এই বলে জীবন দা’ উঠে দাঁড়াতে গেলেই অগ্নি বলে উঠলো, না না বসেন আপনার সাথে কথা বলি। আপনার কোনা কাজ নেই তো!
-না বাপ! আমার কোনো কাজকর্ম নাই।
বলেন কি? আপনি কোনো কাজ করেন না?
-না বাপ!
-মানে কি? কোনো কাজ নাই ফাও ফাও ঘুরে বেড়ান? আপনার মতো মানুষজনদের জন্যই এই দেশের কিচ্ছু হচ্ছে না। দেশ-জাতি-সমাজ নিয়ে আপনাদের কোনো দায়িত্ব কর্তব্য নাই? শুধু নিজের জন্য বাচঁবেন অথচ এই দেশে থাকবেন, খাবেন, এটা কোনো কথা হতে পারে, আপনিই বলেন?
-বাপ! দেশ-জাতি-সমাজ নিয়া ভাববার আগে নিজেরে চেনা জরুরী; নইলে সব নির্ণয়ই ভুল হইয়া যায়। কোন চিন্তা-কাজ-পরিকল্পনা কিছুই স্থায়ী হয়না। তাতে না হয় নিজের উপকার, না হয় দেশ-জাতি-সমাজের উপকার। সময় নষ্ট আর প্রাপ্তি কেবল দু:খ-কষ্ট। আর কিছু না বাপ।
-এই যে এতো বড় বড় কথা বলছেন, এসব আপনি শিখলেন কোথা থেকে?
-এসব তো বড় বড় কথা না বাপ। এসব তো সহজ কথা। সহজ মানুষের কথা। এর মধ্যে গভীর তত্ত্ব আছে ঠিকই কিন্তু জটিলতা নাই।
-আপনি কি সোজাসুজি কোনো কথার উত্তর দিতে পারেন না?
-রবী ঠাকুর নিজেই বলছেন বাপ ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’।
-বাহ্! রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়ছেন না, তাকেও কোড করছেন? বাহ্! বেশ তো। তা কতদূর পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন জানতে পারি কি?
-পড়াশোনা করি নাই বাপ। তবে পড়তে পারি বাংলা এতটুকুই।
-হুমম আমারো তাই ধারণা। কম জানা লোক জ্ঞান দেয় বেশি। আপনি সেই দলেরই লোক। আমি ঠিক বলছি না জীবন দা’? আমি বড় বড় ঘাগু পাবলিকরে দেখেই তার মনের কথা বলে দিতে পারি। আপনি আমার সাথে চালাকি করে পার পাবেন না। হা হা হা।
-হা হা হা। বাপ! ঠিকই বলছো আমি কিছুই জানি না। তয় অনুমতি দিলে আপনারে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
-কি প্রশ্ন? আমি কি করি? কত টাকা মাসে কামাই? গ্রামের বাড়ি কই? বিয়ে করেছি কিনা? হাসি হাসি মুখে ব্যাঙ্গের সুরে বললো অগ্নি।
-না বাপ! সেসব জেনে আমি কি করবো। আমার প্রশ্নটা হইলো, আপনি কে?
-আমি কে মানে? আমি অগ্নি।
-অগ্নি তো আপনার নাম, কিন্তু আপনি কে?
-আমি কে মানে? আমি এই শহরের বড় একটা কোম্পানির মার্কেটিং চিফ।
-সে তো আপনার কর্ম, কিন্তু বাপ আপনি কে?
-এই যে আমাকে দেখছেন এই তো আমি।
-বাপ এটাতো আপনার শরীর, কিন্তু আপনি কে?
-মানে কি, আপনি আমাকে সম্মোহন করতে চাইছেন? আমি এই প্যাঁচে পরবো না আমি; শরীর মন নাম কর্ম সব মিলেই আমি।
-বাপ! তারমানে আপনি বলতে চান যার শরীর আছে, আপনার মতো মন আছে, আপনার মতো নাম আছে, আপনার মতো কর্ম আছে হেরা সবাই আপনি? নাকি আপনার মধ্যে আলাদা কিছু আছে যা আপনাকে সবার থেকে আলাদা করেছে? সেই আপনাকে কি আপনি চিনেন বাপ?
বাপ! আমার মনে হয় আপনের মন ভালো নাই। আপনি কিছু সময় একা থাকেন। নিজের সাথে কথা বলেন মন ভালো হবে। মনে ময়লা থাকলে নিজেের চেনা যায় না; জগতরেও চেনা যায় না। যে নিজেরেই চিনে না। সে আর মানুষরে দিবে কি? জীবন দা’ অগ্নিকে হাত জোর করে ভক্তি দিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো।
-আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করছেন জীবন দা’। আপনি কি চান বলেন। মিথ্যা বলবো না বহুদিন পর কারো সাথে কথা বলে ভালোই লাগছে। প্রথমে আপনার সম্পর্কে যে ধারণা ছিল তার থেকে এখন কিছুটা উন্নত হয়েছে। আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করে যদি কিছু আদায় করতে চান।
সেটা না করে আমাকে সরাসরি বলেন। কিছু টাকা-পায়সা চাইলে আমি দিতে পারি; কিন্তু আমার সাথে তার জন্য চালাকি করবার চেষ্টা করবেন না। আপনার বিপদ হয়ে যাবে। আমি অনেক ক্ষমতাশালী না হলেও আমার সাথে প্রচুর এমন মানুষের পরিচয় আছে যারা অনেক ক্ষমতা রাখে।
জীবন দা’ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো- বাপ! আমার মনে হয় আপনের মন ভালো নাই। আপনি কিছু সময় একা থাকেন। নিজের সাথে কথা বলেন মন ভালো হবে। মনে ময়লা থাকলে নিজেের চেনা যায় না; জগতরেও চেনা যায় না। যে নিজেরেই চিনে না। সে আর মানুষরে দিবে কি? জীবন দা’ অগ্নিকে হাত জোর করে ভক্তি দিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো।
অগ্নি কিছুটা আদেশের সুরেই বললো- জীবন দা’ দাঁড়ান। কথা শেষ করে যান।
-কি কথা বাপ?
-বলে যান আমি কে?
জীবন দা’ এতো সহজে কি তারে চেনা যায় পাগল, তারজন্য পারি দিতে হয় দীর্ঘ যাত্রা। তার জন্য লাগে শ্রদ্ধাভাব। মনে ময়লা থাকলে তা হয় না বাপ। নিজেকে ধীরে ধীরে তৈরি করতে হয়। সেই সময় কি আর আপনার হাতে আছে? তারপর হাসতে হাসতে বেসুরে গলায় গেয়ে উঠলেন-
ভজরে আনন্দের গৌরাঙ্গ।
যদি ত্বরিতে বাসনা থাকে
ধর রে মন সাধুর সঙ্গ।।
সাধুর গুণ যায় না বলা
শুদ্ধ চিত্ত অন্তর খোলা।
সাধুর দরশনে যায় মনের ময়লা
পরশে প্রেমতরঙ্গ।।
সাধুজনার প্রেম হিল্লোলে
কত মানিক মুক্তা ফলে
সাধু যারে কৃপা করে
প্রেমময় দেয় প্রেমঅঙ্গ।।
এক রসে হয় প্রতিবাদী
এক রসে ঘুরছে নদী।
এক রসে নৃত্য করে
নিত্যরসের গৌরাঙ্গ।।
সাধুর সঙ্গগুণে রং ধরিবে
পূর্ব স্বভাব দূরে যাবে।
লালন বলে পাবে প্রাণের গোবিন্দ
কররে সৎসঙ্গ।
(চলবে)
.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট
সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট
4 Comments