আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
মাই ডিভাইন জার্নি : আট
বৈশাখ মাস, শহরে পিচগলা গরম। তার উপর কোথায় যেন কি একটা ঝামেলা হয়েছে; তাই বিনা নোটিশেই শহরের সকল লোকাল বাস বন্ধ হয়ে গেছে। আর এই শহরের চিরায়ত নিয়মানুযায়ী রাস্তায় বাস না থাকলে রিকশাচালকেরা নিজেরাই নিজ উদ্যোগে অঘোষিত ঈদ শুরু করে দেয়।
আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি ঢাকার রাস্তায়। ঘটনাচক্রে এই মুর্হূতে রিকশা চালকরাই নিয়ন্ত্রণকর্তা আর যারা রিকশা পেয়েছে তারা সফল নায়ক।
অন্যদিকে সফল হওয়ার অভিলাষে প্রায় প্রত্যেক পথিকই কোনো ফাঁকা রিকশা পেলে তার পেছনে দৌঁড় লাগাচ্ছে। যেন যে আগে যেতে পারবে রিকশা তার। সেদিন মধ্যদুপুরেও এমনি অবস্থা। শাহবাগ যাব, বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষ। আমার নানী রাস্তায় কয়েকটা মানুষের জটলা দেখলেই বাড়ি ফিরে বলতো রাস্তায় মানুষের মাথা মানুষে খায়।
আজ সেই অবস্থা। গণপরিবহন নেই বললেই চলে, যে কয়টা টিকেট কাউন্টারের বাস চলছে তারাও এতো যাত্রী দেখে দরজা বন্ধ করে সাঁই সাঁই করে টানছে। মানুষজন প্রায় রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে; যে গাড়ি আসবে তাতেই উঠবে। আর সে কারণে কোনো গাড়িই থামছে না কোথাও। রাস্তার প্রায় ডান পাশ ঘেঁষে ফাঁক গলে দ্রুত বেড়িয়ে যাচ্ছে।
মনকে শান্তনা দিলাম একটু সামনে যাই, কিছু একটা নিশ্চয়ই পেয়ে যাবো। এভাবে এক’পা দু’পা এগুতে এগুতে পল্টন পর্যন্ত গেলাম। দুই পাশেই এতো মানুষ যে ভালোভাবে হাঁটা পর্যন্ত যাচ্ছে না।
তার উপর রোদের তেজ এতোটাই যে শরীরের সমস্ত পানি ঘাম হয়ে জলাঞ্জলি দেয়ার পর আমার মতো সকলেই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। আমিও পল্টন পর্যন্ত যেয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার অবস্থায়।
বুঝতে পারছি না বাকিটা হেঁটে শাহবাগ যেত পারবো কিনা। ফেরারও উপায় নাই। তাহলেও প্রায় ততটাই হাঁটতে হবে। পল্টন মোড়ে বহু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে।
দরদর করে কপাল বেয়ে ঘাম যখন স্রোতের মতো বইছে সেসময় প্রায় গোবেচারা টাইপের মাঝবয়সী একজন সাধারণ মানুষ একটা ফাইল হাতে আমার কাছে এসে বললো, ভাই কয়টা বাজে? হাতে ঘড়ি পরিনা বহুদিন। তবে পকেটে মোবাইল ছিল, চাইলেই সময়টা বলে দিতে পারি।
আমি একটু এগিয়ে পুলিশ বক্সের সামনের রাস্তায় দাঁড়ালাম। রোদের তীব্রতার জন্য এই পাশটায় লোকজন কিছুটা কম। ফাঁকা অংশে দাঁড়িয়ে দম নেয়ার চেষ্টা করছি।
রাস্তার বিপরীত দিকে অর্থাৎ শাহবাগ রোড ধরে যে বাসগুলো পল্টন মোড়ে এসেছে কিন্তু গেট বন্ধ করে আছে যাত্রী তুলছে না। সেগুলোকে ঐপাড়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন পথ আটকে উঠার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।
বাস যাত্রী হওয়ার ইচ্ছুক লোকজন নিজেদের মাঝেই ধাক্কাধাক্কি করছে সেকারণে ঐ রাস্তাটায় ছোটখাট একটা জ্যাম লেগে আছে। আর আমাদের দিকের রাস্তা ধরে দরজা বন্ধ করা টিকিট সার্ভিসের বাসগুলো সাঁই সাঁই করে ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছে।
দরদর করে কপাল বেয়ে ঘাম যখন স্রোতের মতো বইছে সেসময় প্রায় গোবেচারা টাইপের মাঝবয়সী একজন সাধারণ মানুষ একটা ফাইল হাতে আমার কাছে এসে বললো, ভাই কয়টা বাজে? হাতে ঘড়ি পরিনা বহুদিন। তবে পকেটে মোবাইল ছিল, চাইলেই সময়টা বলে দিতে পারি।
কিন্তু রাস্তার এই যাতনায় মেজাজটা বিগড়ে আছে সেকারণেই হয়তো কিছুটা রূঢ় ভঙ্গিতেই বললাম, ঘড়ি নাই।
লোকটা একটু আহত হয়ে আমার কাছ থেকে কয়েকগজ সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রাস্তার প্রায় মাঝ বরাবার। লোকটার দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, কেনো এমনটা করলাম?
সময়টা তো বলেই দেয়া যেত। এই সব ভাবছি এমনসময় একটা গেটবন্ধ বাস প্রায় পুলিশবক্স পার হতে হতে হেলপার গেট খুলে মোহম্মদপুর মোহম্মদপুর ডাকতে শুরু করলো নিচু গলায়।
তার মুখ থেকে ডাক বের হওয়ার আগেই আমার দুই পাশ দিয়ে মানুষজন আমাকে প্রায় ফেলে দিয়ে বাসের অর্ধেক খোলা গেট লক্ষ করে ছুঁটতে শুরু করে দিলো। হয়তো ড্রাইভার ভাবতে পারেনি এই জায়গায় থামালেও এত্ত মানুষ উঠার চেষ্টা করতে পারে তাই থামাতে থামাতেও না থামিয়ে হঠাৎই গতি বাড়িয়ে দিলো। ততক্ষণে অবশ্য দেরি হয়ে গেছে।
দুইজন অলরেডি বাসের সিঁড়িতে পা দিয়ে প্রায় উঠে গেছে তাদের ধরে আরো অনেক অনেক মানুষ। চোখে পরলো যে ব্যক্তিটি আমার কাছে সময় জানাতে চেয়েছিল তিনি হেন্ডেল ধরে ঝুলে থাকা দুইজনের মাঝে পরে উঠতে গিয়েও কোনো কিছু না ধরতে পেরে রাস্তার উপর ধপাস করে পরে গেল।
দেখতে দেখতে লোকটি বাসের তলায় চলে গেল মুর্হূতে। আমি মানুষের ধাক্কা সামলে মাত্র দাঁড়াতে শুরু করেছি তখন।
মানুষজনের চিৎকারে বাস থামার আগেই ভদ্রলোকের উপর বাসের পেছনের চাকা প্রায় অর্ধেকটা উঠে গেছে। লোকজন ভদ্রলোকের পা ধরে টানতে শুরু করছে; কিছু যাত্রী বাসকে পেছনে টানার চেষ্টা করছে।
কয়েক সেকেন্ডে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাকে সামলে নিয়ে আমি কি করবো সেটা ভাববার আগেই হঠাৎ বাসের জানালায় চোখ পড়তেই দেখি ড্রাইভার জানালা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছে।
আমার ঠিক কি হলো জানি না। আমার মনে হলো ড্রাইভারকে ধরা দরকার। আমি আমার স্বভাবের বিরপীতে গিয়ে প্রাণপণ দৌড় লাগালাম। সবাইকে পাশ কাটিয়ে বাসের ঐ পাশে যাওয়ার আগেই দেখি ড্রাইভার রোড ডিভাইডারে লাগানো কাঁটাতার পার হয়ে দৌড়াতে শুরু করেছে।
সেইক্ষণে কি ঐশ্বরিক শক্তি বলে জানি না, যে আমি টুল থেকে পরে অজ্ঞান হয়ে যাই; সেই আমি এক লাফে কাঁটাতার টপকে ড্রাইভার বেটার কলার চেপে ধরলাম। আমার চেয়ে তিন গুণ ওজনের একটা মানুষকে আমি কি করে টানতে টানতে পুলিশবক্স পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলাম সেই হিসাব আমি এখনো মিলাতে পরি না।
ততক্ষণে জনতা আমাকে হিরো বানিয়ে ফেলেছে। উল্লাসে কেউ কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরছে। সবাই সাব্বাসি দিচ্ছে। এরই মাঝে আমার পায়ে শেষ খঁড়খুটোর মতো জড়িয়ে থাকা ড্রাইভারকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো। ঠিক তক্ষুণি আমার পৃথিবীর সমস্ত আলো নিভে গেলো।
ড্রাইভার বেটা আমার পা জড়িয়ে ধরে মাপ চাইছে আর বলে চলছে, স্যার ছাইড়া দেন… স্যার ছাইড়া দেন… তখনো লোকজন আহত লোকটাকে বাসের চাকার তল থেকে বরে করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ঠিক পুলিশবক্সের সামনে আসার পর আমার সম্বৎ ফিরে এলো।
যখন হুশ এলো তখন আমার হাতে ড্রাইভারের কলার। আর ড্রাইভার আমারে পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর বলছে, স্যার ছাইড়া দেন আমারে মাইরা ফেলবো।
এইবার আমি হতবিহম্বল হয়ে গেলাম। আমি এখন কি করবো? ড্রাইভারকে জনতার হাতে তুলে দেব? নিজে পিটাবো? নাকি পুলিশে দেব? নিজে পেটাতে পাবরো না সেটা আমি জানি। তাই শুরুতেই তা বাদ।
ততক্ষণে উত্তেজিত জনতা আমার দিকে আসতে শুরু করেছে। আর ঐপাশ থেকে যারা দেখেছে আমি ড্রাইভারকে ধরেছি তারা আমার পেছন পেছনে রাষ্ট্র করতে করতে আসছে, ভাই ড্রাইভাররে ধরছে। ভাই ড্রাইভাররে ধরছে।
সামনের লোকজন পেছনের লোকজন আমাকে ঘিরে ধরতে শুরু করেছে। সবার চোখে রক্তের ছোপ। রাক্ষসের উল্লাস। ড্রাইভার আরো শক্ত করে আমার পা চেপে ধরছে। আমি তখন ভাবতে শুরু করেছি জনতাকে ঠেলে ড্রাইভার বেটাকে পুলিশবক্সে ঢুকিয়ে দেই। কিন্তু তা একটু দেরি হয়ে গেছে।
ততক্ষণে জনতা আমাকে হিরো বানিয়ে ফেলেছে। উল্লাসে কেউ কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরছে। সবাই সাব্বাসি দিচ্ছে। এরই মাঝে আমার পায়ে শেষ খঁড়খুটোর মতো জড়িয়ে থাকা ড্রাইভারকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো। ঠিক তক্ষুণি আমার পৃথিবীর সমস্ত আলো নিভে গেলো।
চারপাশের সমস্ত সোরগোল থেমে গিয়ে আমি নিজেকে আবিস্কার করলাম রক্ত মাখা হাতে। কেউ যেন ভেতর থেকে বলে উঠলো, প্রথম ভুলটি যদি ড্রাইভারটি করে থাকে দ্বিতীয় ভুলটি তুমি করলে জনতার হাতে তাকে তুলে দিয়ে।
আবরো সম্বিৎ ফিরে পেতেই শুনতে লাগলাম ড্রাইভারের দম ফাটানো চিৎকার আর জনতার উল্লাস। তাকে ঘিরে সকলে পেটাচ্ছে। আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা।
ড্রাইভারের মাগো বাবাগো বলে সেই চিৎকার আমি আজো শুনতে পাই। লোকজন আহত লোকটাকে চাকার তলা থেকে বের করার বদলে ড্রাইভারকে পিটানোতে মনোযোগ দিয়েছে।
আমি মাতালের মতো টলতে টলতে শাহবাগের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলাম। রাস্তা বন্ধ করে জনতা গাড়ি ভাঙছে। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ আহত লোকটাকে বের করার চেষ্টা করছে অবশ্য। তবে বেশিভাগ মানুষ দাঁত বের করে মজা দেখছে।
আমি যখন টলতে টলতে এগুচ্ছি। তখন মজা দেখা শেষ করে যারা ফিরতে শুরু করছে তারা বলছে, এই ভাই না ড্রাইভাররে ধরছে। এই ভাই না ড্রাইভাররে ধরছে। কেউ কেউ আমাকে এসে দেখে যাচ্ছে।
এভাবেই কখন প্রেসক্লাবের সামনে যেন চলে এসেছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম একটা রিকশা প্রায় আমার শরীরের কাছাকাছি এনে দাঁড় করিয়েছে। তাতে বসে থাকা মাঝ বয়সী যাত্রীটি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রায় টেনে রিকশায় তুলে নিলো। একটা পানির বোতল আমাকে দিয়ে বললো ভাই চোখে মুখে পানি দেন।
ভদ্রলোক আমাকে কোথা থেকে ফলো করেছেন জানি না। তিনি পুরো ঘটনা বুঝতে পেরেছেন কিনা তাও জানি না। তারসাথে আমার কথা হয়নি একটাও তার দিকে ভালো করে তাকাইওনি। পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে কিছুটা গলায় ঢাকার পর মনে হলো শরীরটা ছেড়ে দিলো। ততক্ষণে রিকশা বাংলা একাডেমীর সামনে।
ভদ্রলোক বললো, আসেন এখানে একটু বসে যান ভালো লাগবে। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, ভাই আপনার রিকশাটা আমি নিয়ে যাচ্ছি; আমি ছবির হাঁটের দিকে যাই। সেখানে বসবো। ধন্যবাদ দিয়ে আমি এগিয়ে যেতে যেতে ভাবছিলাম, আমার দ্বারা এ কি হয়ে গেলো? কেনো হলো? আমি কেনো ড্রাইভারকে ধরতে গেলাম?
জীবনে যে কয়টা পাপ করেছি তার মধ্যে এই ঘটনাটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি তাড়িয়ে বেড়ায়। যখনই ঘটনাটা মনে পরে তখনই নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হয়। বেশি সময় ভাবতে পারি না। মনে হয় ড্রাইভার এখনো আমার চা চেপে ধরে চিৎকার করে চলছে, স্যার ছাইড়া দেন আমারে মাইরা ফেলবো।
সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। আর অন্ধকার হলেই নিজের ভেতরের আমি’টা নড়েচড়ে বসে। প্রশ্ন করে। নানান প্রশ্ন। যে উত্তরগুলো হয়তো জানা আছে কিন্তু স্বীকার করে নেয়া কষ্টকর। গলায় সুর থাকলে ঠিকই গেয়ে উঠতাম-
আমার দিন কি যাবে এই হালে।
আমি পড়ে আছি অকুলে
কত অধম পাপী তাপী অবহেলে তরালে।।
জগাই মাধাই দুটি ভাই
কাঁধা ফেলে মারিল গায়
তারে ও তো নিলে;
আমি তোমার কেউ নই দয়াল
তাই কি মনে ভাবিলে।।
অহল্যা পাষাণী ছিল
সেও তো মানব হলো
প্রভুর চরণ ধূলে;
আমি পাপী ডাকছি সদাই
দয়া হবে কোন কালে।।
তোমার নাম লয়ে যদি মরি
দোহাই দেই তবু তোমারই
আর আমি যাবো কোন কুলে;
তোমা বৈ আর কেউ নাই দয়াল
মুঢ় লালন কেঁদে বলে।।
এই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন পত্রিকার পাতায়-টিভি পর্দায় চোখ রাখার সাহস করি নি। পাছে চোখে পরে যায় এমন কোনো সংবাদ যাতে গণধোলাইতে ড্রাইভারটির মৃত্যু সংবাদ শুনতে হয়। মৃত্যু!
কি ভয়ঙ্কর শব্দ তাই না!! অথচ জগতের অন্যতম সত্য ঘটনা হলো মৃত্যু। সকলেই জানি জন্মের স্বাদ গ্রহণ করলে মৃত্যুর স্বাদও গ্রহণ করতে হবে; এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
মৃত্যু সুনিশ্চিত তারপরও আমরা মৃত্যুকে কতই না ভয় পাই। শুধু নিজের না অন্যের মৃত্যুর সংবাদেও ভয় পাই। এই মৃত্যু নিয়ে সাধুগুরুরা কি ভাবেন? এই ভাবনার পেছনে তাড়া করতে যেয়ে জেনেছি, জন্মান্তরে বিশ্বাসী সাধুগুরুরা মনে করেন মৃত্যু মানে কেবলই দেহের পরিবর্তন মাত্র। যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মা নির্বাণ পাবে।
তাই তারা একে বলেন দেহত্যাগ। মৃত্যু শব্দটা ব্যবহার করেন না। শব্দটার আরো গভীরে গিয়ে অনেকে বলেন তিরোধান। সকলের তিরোধান হয় না। মৃত্যু হয় সাধারণ মানুষের। সাধকদের হয় দেহত্যাগ। মহাসাধকদের হয় তিরোধান। যাকে আর ফিরতে হবে না মানব দেহ নিয়ে তিনিই তিরোধান লাভ করেন।
মৃত্যু ভয় জীবনের অন্যতম ভয়। আর এই ভয়কে সাথে নিয়ে আমরা সাধারণেরা নিত্য জীবনকে যাপন করি। অন্যদিকে সাধুরা এই ভয়কে জয় করে স্থির হয়ে একজায়গায় অবিচল থাকে। মৃত্যু তাদের কাছে দেহ পরিবর্তন ভিন্ন অন্যকিছুই নয়।
জ্ঞান পরীক্ষার এটাই সবচেয়ে সহজতর ও সর্বাপেক্ষা উত্তম পন্থা। অহঙ্কার আর জ্ঞান একসাথে বসত করে না। একজন অন্যজনকে সমীহ করে চলে। জ্ঞানের আলো প্রকাশ পেলে অহঙ্কার তলানীতে চলে যায়। আর অহঙ্কার থাকলে জ্ঞানের আলো জ্বলতে পারে না।
এক দেহ থেকে অন্য দেহে যাত্রা। এই নতুন যাত্রায় যৎকিঞ্চিৎ উত্তেজনা থাকতে পারে কিন্তু ভয় কখনোই নয়।
আর ভয় নেই বলেই যাপিত জীবন তাদের পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে না। অন্যদিকে আমরা সদাই মৃত্যু ভয় নিয়ে অস্থির থাকি। মতি স্থির হয় না। ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্র বলে, যা সম্পর্কে মানুষের ধারণা নেই তার প্রতিই মানুষের আগ্রহ ও ভয় প্রবল থাকে।
পরিপূর্ণরূপে তত্ত্বের মাধ্যমে কোনো কিছু জানতে পারলে এবং জেনে তা অনুভব দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলেই তাকে আসক্তির পাশাপাশি ভয় চলে যায়।
আমাদের যেমন কোনোকিছু কিনবার আশা জাগলে মন তীব্রবেগে সেই দিকে চলতে শুরু করে কিন্তু কিনে নিজের করে পাবার পর হয়তো তা খুলেও দেখা হয় না। তেমনি জ্ঞান এই আশ্চর্য প্রদ্বীপের মতো যতক্ষণ তাতে ঘঁষা দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে ততক্ষণ আকাঙ্খা থেকেই যায় জ্বীন বের হবে কি হবে না।
ঘঁষা দিয়ে নিশ্চিত হলেই জ্ঞান পোক্ত হয়। তাই জ্ঞানকে কেবল জানলে হয় না তা অনুভবের ভেতর দিয়ে উপলব্ধিতে পৌঁছাতে হয়। তবেই না তার সন্ধান পাওয়া যায়। নইলে তা কেবলই তর্কের বস্তু হয়ে থাকে মাত্রে। তাকে জ্ঞান বলা যায় না। জ্ঞান হলো আলো। যা জাগলে মানুষ আপনাতেই টের পাবে।
তারজন্য বিশেষ ভঙ্গিমায় কথাবলা বা চলাচল বা পোশাকের প্রয়োজন পরে না। তবে এটাও সত্য জ্ঞানের আলো জ্বলতে শুরু করলে সে তার নিজস্ব একটা ভঙ্গিমা নিজেই তৈরি করে নেয় আর সেটা হয় বিনয়ের।
কখনোই অহঙ্কারের নয়। তার মধ্যে জ্ঞানের জন্য বিন্দুমাত্র অহঙ্কার রয়ে যায় তার মধ্যে জ্ঞান প্রকৃত অর্থে বিকাশ লাভ করে নাই।
জ্ঞান পরীক্ষার এটাই সবচেয়ে সহজতর ও সর্বাপেক্ষা উত্তম পন্থা। অহঙ্কার আর জ্ঞান একসাথে বসত করে না। একজন অন্যজনকে সমীহ করে চলে। জ্ঞানের আলো প্রকাশ পেলে অহঙ্কার তলানীতে চলে যায়। আর অহঙ্কার থাকলে জ্ঞানের আলো জ্বলতে পারে না।
সাধক পাগলদের মাঝে এক ধরনের তেজ লক্ষ্য করা যায় কিন্তু তা কখনোই অহঙ্কার নয়। তাদের মধ্যে সাধারণের জন্য বিনয়ভাব কম মনে হলেও একটু কাছে যেয়ে মিশলে সেই বিনয়টা টের পাওয়া যায়। তেমনি হঠাৎ করেই চন্দন পাগলার সাথে পরিচয় হয়ে গেল মাধবদীর বাবুরহাঁটে ভাবনগরের দুইতলার উপরের হুমায়ুন সাধুর ভক্তের আখড়ায়।
লাল মলিন টিশার্ট পরা চন্দন পাগলা আখড়ায় ঢুকেই বললো, ‘যদি করো চালাকি, তাইলে বুঝবা চন্দন পাগলার জ্বালা কি।’ তারপর মিলিয়ে না যাওয়া একটা হাসি। সেই হাসিতে শব্দ হবে না। তাতেই মাত। উনি ঘরে প্রবেশের আগে এতো কথা শুনছিলাম ভেবেছিলাম উম্মাদ কেউ চলে আসবে এসেই সকলকে মাইর লাগাবে।
আদৌতে এমন কিছুই নয়। ছোটখাট পিটানো শরীরের চন্দন পাগলা মুখ বন্ধ রাখতে পারেন না একটানা বলেই যান। কিন্তু ঐ যে বলেছে আগেই চালাকি করলে তখন বোঝা যায় চন্দন পাগলার জ্বালা। কিন্তু চালাকি না করলে তিনি তার জন্য জান-পরান দিয়ে দিতে পারেন। অল্পতেই ভাব জমে গেলো।
পরদিন আমি আর সুধাম সাধু ফিরবো ঢাকায় ব্যাগ গুছিয়ে প্রস্তুত; এমন সময় চন্দন পাগলা চূড়ান্ত বেঁকে বসলো। সে কিছুতেই আমাদের আসতে দিবে না। সে আবু সাধুর বাড়িতে আমাদের দুইজনকে নিয়ে যাবে। এটাই তার আর্জি।
সেখানে আবু সাধুর কন্যা আছেন। সেই নব্বই বছর বয়সী কন্যা কি করে একদিন পরই আমার মা হয়ে গেলো সে ঘটনা সময় করে অন্য সময় হয়তো বলবো। আজ বলি চন্দন পাগলার কথা।
চন্দন পাগলা কান্নাকাটি বারাবারি অভিনয় করে নেচে গেয়ে আমাদের ঠিকই রাজি করিয়ে ফেললো। আসলে পাগলের কথা ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য কি আর আমাদের আছে। নাকি করা উচিৎ? আমরা দুই-তিনটি অটো-সিএনজি পাল্টে যাচ্ছি আবু সাধুর বাড়িতে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সিএনজি ছুটে চলেছে।
পেছনে আমি চন্দন পাগলা আর সুধাম সাধু। সামনে বুক ছাড়িয়ে যাওয়া দাঁড়িওয়ালা সবুজ রঙের পাঞ্জাবী পরা একজন হুজুর হুজুর টাইপের মানুষ। বাচ্চা ড্রাইভারের অপরপাশে মনে না রাখার মতো একজন বসেছেন। চন্দন পাগলা তার স্বভাব অনুযায়ী একটানা কথা বলেই যাচ্ছে।
এক কথা থেকে আরেক কথায় যাচ্ছে। স্বভাবমতো কখনো কোমল আবার কখনো উত্তেজিত হয়ে উঠছেন কথা বলতে বলতে। আমি চারপাশের গ্রামের অপরূপ রূপ দেখছি শেষ বিকেলের মিলিয়ে যাওয়া সূর্যের টিকে যাওয়া আলোর আভাসে।
বেশকিছুটা চলার পর অল্পবয়সী সিএনজিচালক চন্দন পাগলার কথায় ফোড়ন কাটতে শুরু করলো। শরিয়তি ব্যাখ্যা দিয়ে চললো আবার মাঝে মধ্যে উত্তেজিতও হয়ে উঠছিল চালক। সব কিছুর সে সাক্ষী মানছে তার বামপাশে বসা হুজুরকে। বারবার বলছে, ‘হুজুর দেখছেন এরা কি বলে এসব? এসব বললে জাত ধর্ম থাকবো?’
হুজুর কোনো কথা বলছেন না। তিনি বেশ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তবে পাগলা নিজের মতো করে উত্তর দিয়েই চলছে।
আমি ভাবছিলাম ঘটনাটা অনাকাঙ্খিত কোনো দিকে মোড় না নেয়। যদি হুজুর চালকের সাথে যোগ দেয় তাহলে বিপদ। আর চন্দন পাগলাকে বলে কিছু হবে না; সে যা বলার তা বলবেই। সুধাম সাধু অবশ্য মাঝে মধ্যে চালক ছোরাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
একসময় ঘটনা যখন অগ্নিতে রূপ নিচ্ছে তখন হুজুরের নামার সময় হয়ে এসেছে। নির্দিষ্ট বাজারের সামনে হুজুর নেমে পরলেন।
মাদ্রাসার পোলাপানরেও শিখানোর চেষ্টা করি আগে মানুষ হইতে। কিন্তু সেটা জটিল; কারণ সব শিক্ষকরা তো এক না। তোমার মতো লোকও আছে। তাও সকলরে বলি মানুষ হইলে তবেই ইবাদত শুরু। মানুষই হইতে পারলানা ইবাদত লইয়া নাচানাচি করলে কিছুই হবো না বাপ।’
তিনি চালককে বললেন, বাপ গাড়ির স্টার্টটা একটু বন্ধ করো দুইটা কথা বলি। আমি সোজা হয়ে বসলাম। শরীরের আড়মোড়া ভাঙতে সুধাম সাধু নেমে দাঁড়িয়েছেন। হুজুর বলতে শুরু করলেন, আমি ভারতের দেওঘর মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছি। তারপর দেশে ফিরে বহু মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছি।
এখন একটা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। তোমার মতো বয়সে শুধু না আরো বড় হইয়াও বহু তর্ক করছি মানুষের সাথে ধর্ম নিয়া। চন্দন পাগলাকে দেখিয়ে বললো, কিন্তু উনার মতো এক লোকের মুখে লালন ফকিরের একটা গান শুইনা সব উল্টাপাল্টা হইয়া গেলো।
নতুন কইরা জানতে শুরু করলাম। তখন বুঝতে শিখলাম, না জানলেই মানুষ তর্ক করে। তুমি যেমন করতাছো। আমি একজনের হাতে বায়াত হইছি। এখন মানুষরে সম্মান দিতে শিখছি। নিজে জানি এটা জাহির করা বিদ্যা না বাপ। তুমি যা জানো তারচেয়ে হিসাব করলে যদি সার্টিফিকেটও দেখো তাও আমি বেশি জানি।
একটা মাদ্রাসা চালাই তাই ধর্ম তোমার চেয়ে আমি কম জানি, তা তো তুমি বলতে পারবা না, তাই না? মানুষ হইয়া মানুষরে সম্মান দেওয়াই বড় ঘটনা। তোমার সিএনজিতে আজ যারা বসছে তাদের তুমি চিনলানা। তাদের সাথে তর্ক করলা। তারা ভদ্রলোক তাই তোমার সাথে তর্কে যায় নাই।
কারণ তুমি অবুঝ না তুমি বেশি বুঝো। অ-বুঝরে বোঝানো যায় বেশি-বুঝরে বোঝানো যায় না বাপ। আমি বহু পাশ দিছি বহু বহু ওয়াজ করছি এসব কিছুর বিরোধিতা কইরা; কিন্তু এখন কপাল থাপড়ানি ছাড়া আর কিছুই করার নাই। ওয়াক্তে ওয়াক্তে মাপ চাই, ক্ষমা চাই।
এই অপরাধ যাতে আমার দ্বারা আর না হয়। এই অপরাধ কারো দ্বারাই যাতে না হয়।
মাদ্রাসার পোলাপানরেও শিখানোর চেষ্টা করি আগে মানুষ হইতে। কিন্তু সেটা জটিল; কারণ সব শিক্ষকরা তো এক না। তোমার মতো লোকও আছে। তাও সকলরে বলি মানুষ হইলে তবেই ইবাদত শুরু। মানুষই হইতে পারলানা ইবাদত লইয়া নাচানাচি করলে কিছুই হবো না বাপ।’
সিএনজি অন্ধকারে এগিয়ে চলছে। অসম্ভবকে সম্ভব করে চন্দন পাগলা চুপ। সুধাম সাধু আর আমার মুখেও কথা নেই। অন্য যাত্রীটি কোথাও নেমে গেছে। সিএনজি চালক মনে মনে কি ভাবছিল জানি না।
তবে আমি নিজেকে শুধরে নিচ্ছিলাম হুজুর হুজুর টাইপের মানুষ দেখলেই যে বুকের ভেতরটা আৎকে উঠে এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পরবে। সেই সংস্কার থেকেও বের হতে হবে। সাঁইজি–
ক্ষম অপরাধ ওহে দীননাথ
কেশে ধরে আমায় লাগাও কিনারে,
তুমি হেলায় যা কর তাই করতে পার
তোমা বিনে পাপীর তারন কে করে।।
না বুঝে পাপ সাগরে ডুবে খাবি খাই
শেষ কালে তোর দিলাম গো দোহাই,
এবার আমায় যদি না তরাও গো সাঁই
তোমায় দয়াল নামের দোষ রবে সংসারে।।
শুনতে পাই পরম পিতা গো তূমি
অতি অবোধ বালক আমি,
যদি ভজন ভুলে কুপথে ভ্রমি
তবে দাও না কেন সুপথ স্মরণ করে।।
পতিতকে তারিতে পতিত পাবন নাম
তাইতো তোমায় ডাকি গুনধাম,
তুমি আমার বেলায় কেন হইলে বাম
আমি আর কতকাল ভাসব দুংখের পাথরে।।
অথই তরঙ্গে আতঙ্কে মরি
কোথায় হে অপারের কাণ্ডারী,
অধীন লালন বলে তরাও হে তরি
নামের মহিমা জানুক ভবসংসারে।।
যেখানেই যাই না কেনো ঘুরে ফিরে এই শহরেই ফিরতে হয়। তেমনি একদিন রাস্তাপারের এক দোকানে বসে সন্ধ্যার নাস্তা করছি আনমনে। হঠাৎ খেয়াল করলাম সমানের ভদ্রলোক এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
একসময় অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শেষে না পেরে বলেই ফেললেন, ভাই চা’য়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে পুরি খাচ্ছেন কেনো? পুরি কি এভাবে খাওয়ার জিনিস?
প্রথমে ভাবলাম অনধিকার চর্চার জন্য একটা ঝাঁড়ি দেই। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম আপনিও একটু সাহস করে ডুবায়া খেয়ে দেখেন কেমন লাগে। ভদ্রলোক কিছুটা সময় এটা সেটা ভেবে। অর্ডার দিলেন। তারপর একে একে ৮খানা পুরি আর দুই কাপ চা খেয়ে বললেন। ভাই জটিল জিনিস খাইলাম।
সেটাই প্রথম পরিচয় শাহ আলম ভাইয়ের সাথে। এরপর থেকে শাহ্ আলম ভাই পুরান ঢাকায় আসলেই। ফোন করে বলেন, আসেন ভাই ডুবায়া খাই। গরম চা’য়ে পুরি ডুবিয়ে খেতে খেতে উদাস হয়ে শাহ্ আলম ভাই হঠাৎই বলে উঠলেন, ভাই পুরান ঢাকার খাবার খাওয়ার জন্য হলেও আরেকবার আমি এই দেশেই জন্মাতে চাই।
এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বা ঘটনা না। এরকম ঘটনা আমরা প্রতিবেলাতেই হয়তো বলি; কিন্তু আমার সেমুর্হুতে মনে হয়েছিল ভিন্ন একটা কথা। এই যে জন্মান্তর।
এই যে বার বার জন্ম নেয়া; এই যে গমনাগমন, তা জেনে বুঝে মেনে বা না মেনে আমরা কিন্তু বলেই চলি জন্মন্তরের কথা। জন্মন্তরের এই লীলার কথা অনেক সাধকই বলেছেন।
নামের আগে বা পরে ফকির লাগালেই ফকির হওয়া যায় না। জীবনের বৈতরণী শুদ্ধরূপ পার হতে পারলেই ফকিরি। তবেই না সাধক। তবেই ধরা দেয় জ্ঞান। বেড়িয়ে আসা যায় জন্মজন্মন্তরের গমণাগমণ থেকে।
অনেক মত-পথ এমনকি শাস্ত্রও সমর্থন করে জন্মান্তর। তবে বিষয়টা বলা যতটা সহজ বোঝা ততটাই জটিল ও কঠিন। কারণ মানুষ হিসেবে সহজ হতে না পারলে ব্রহ্মাণ্ডের হিসেব বোঝা সহজ হয় না। জন্মজন্মান্তরের এই লীলায় কে কোন্ হিসেবে কার সাথে কোন অংক কষায় মগ্ন; কয় জন তা বুঝতে পারে।
হয়তো শাহ্ আলম ভাই গত জন্মেও চা’য়ে ডুবিয়ে পুরি খাওয়ার জন্যই আরেকটা জীবন চেয়েছিলেন। এই জনমে চা’য়ে পুরি ডুবাতে ডুবাতে সে একই বাসনা করে জন্মন্তরের চক্রেই হয়তো পরে গেলেন। হয়তো এটাও লুপ। এই লুপ থেকে বের হওয়ার জন্যই সাধকরা সাধনা করে; চায় নির্বাণ। চায় লীন হতে পরমে।
কিন্তু মায়া-মোহ-লোভ-কামনা-বাসনার জ্বাল ছিন্ন করে আমরা পারি না নির্বাণের সাধনায় যেতে। ভিখিরি হওয়া সহজ। হাত পাতলেই হওয়া যায়। তাই আমরা সকলেই ভিখিরি সাজি। প্রত্যেক ব্যক্তি-বস্তু-পরিস্থিতির কাছেই চাই। সুযোগ পাইলে সৃষ্টিকর্তার কাছেও চাইতে ছাড়ি না।
আর বেশিভাগ সম্পর্কও গড়ে উঠে এই চাওয়া পাওয়া নিয়েই। এই স্বভাব হলো ভিখিড়ির স্বভাব। কিন্তু ফকির! ফকির হওয়া কি চাট্টিখানি কথা। নিজের সকল সম্পদ-সম্পত্তি-সম্পর্ক-আমিত্ব-আত্মিকত্বা-নাম-পরিচয়-মর্যাদা সকলকিছু ছেড়ে দিয়ে – দান করে দিয়ে ফকির হতে হয়।
নামের আগে বা পরে ফকির লাগালেই ফকির হওয়া যায় না। জীবনের বৈতরণী শুদ্ধরূপ পার হতে পারলেই ফকিরি। তবেই না সাধক। তবেই ধরা দেয় জ্ঞান। বেড়িয়ে আসা যায় জন্মজন্মন্তরের গমণাগমণ থেকে। সাঁইজি বলেছেন–
আজব রং ফকিরি সাধা সোহাগিনী সাঁই।
ও তার চুপিসারি ফকিরি ভেক কে বুঝিবে রাই।।
সর্বকেশী মুখে দাড়ি
চরণে তার চুড়ি শাড়ি,
কোথা হতে এল সিড়ি
জানতে উচিত চাই।।
ফকিরি গোরের মাঝার
দেখ হে করিয়া বিচার,
ও সে সাধা সোহাগী সবার
আধ ঘর শুনতে পাই।।
সাধা সোহাগিনীর ভাবে
প্রকৃতি হইতে হবে,
সাঁই লালন কয়, মন পাবি তবে
ভাব সমুদ্রে থাই।।
কত জায়গায় ঘুরি; কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়। আলাপচারিতা হয়। সকলকে মনে থাকে না। সকলের নামধামও মনে থাকে না। কার সাথে কোন জনমে কি হিসাব ছিল কে জানে।
কেনো মানুষের সাথে আন্তরিকতা হয় কেনো বিরোধ লাগে এসব হিসেব আমি ঠিক বুঝতে পারি না। এমনি নাম ভুলে যাওয়া এক ভদ্রলোকের সাথে আমার মাঝেমধ্যেই দেখা হয়।
ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলেই একটা বিষয় নিয়েই কথা বলেন। তার বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের সাথে লালনের কোনো দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। বিষয়টা যে শুধু তিনিই বলেন তাতো নয়। বহু জায়গায় বহু মানুষের মুখেই শুনেছি। কেউ কেউ আবার তর্ক জুড়ে দেন, লালনের গানের খাতা কার কাছে গেলো এই নিয়ে।
নানাবিধ কুটিলতর্ককে বুদ্ধিজীবী মহল বেশ রসিয়ে রসিয়ে বিশ্লেষণ করে আরো উস্কে দেয়। নদীয়া না কুষ্টিয়া। বাংলাদেশ না ভারত। জাত না অজাত তাই নিয়েই আসলে তাদের মাতামাতি। সত্যের প্রতি তাদের কোনো যাত্রাও নেই; ইচ্ছেও নেই এমনকি আগ্রহও নেই। তারা কেবল তর্কে জয়ী হতে চায়।
এসব নিয়ে আমার অবশ্য কোনো মাথাব্যাথা নেই। যার যার কাজ সে সে করবে। কিন্তু হঠাৎই মনে হলো আমার ধারণাটাও এই যাত্রায় পরিষ্কার করে নেয়াই ভালো।
যৌবনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর যাতে শুধু প্রতিবাদ করতে হবে বলেই নয় বরঞ্চ বুঝে-শুনে-দেখে বিচার-বিবেচনা করে এগুতে পারে। নবীন সাধকরাও যেন তর্কে সময় না নষ্ট করে প্রকৃতভাবে সত্যের অনুধাবন করে।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন সাঁইজির দ্বারা এতোটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, উনার ইচ্ছাকে পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করেই তিনি লালন সাঁইজির সাথে বা লালন সাঁইজির কোনো ছবি তোলেন নি বা প্রকাশ করেন নি। অন্যদিকে পিতৃদেবের ব্রাহ্মধর্মের হাল ধরার জন্য লালন মতকে চাইলেও গ্রহণ করতে পারেন নি।
তবে তিনি লালনের সাথে পরিচয়ের পরে বাউলের বাইরে আর কিছুই হননি। আমি রবীন্দ্র গবেষক নই তবে হলফ করে বলতে পারি। শিলাইদহ এসে সাঁইজির সাথে বা সাঁইজির মতাদর্শের সাথে সাক্ষাতের পর তাঁর ভেতরে যে পরিবর্তন এসেছে তা তার আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, দর্শনদারী এমনকি সাহিত্য-শিল্পকলা সহ সকল কিছুতেই তার ছাপ রয়েছে।
তিনি লালন সাঁইজিকে সেই রূপেই সম্মান দিয়েছে বলে আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি। অনেকেই হয়তো আমার সাথে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষন করবেন। তবে এখানে প্রসঙ্গক্রমে আরো একটা কথা স্পষ্ট করেই বলতে চাই। যেহেতু এখন পর্যন্ত আমি কোনো সাধুগুরুর কাছে সরাসরি দীক্ষা গ্রহণ করি নাই।
তাই আমি আমার গুরু হিসেবে ফকির লালনকেই মানি। আর আমি যাকে গুরু মানি, তিনি যাঁকে গুরুর আসনে বসিয়েছেন অর্থাৎ সিরাজ সাঁইজি। সেই সিরাজ সাঁইজি আমার গুরু লালন সাঁইজিকে বলছেন, “সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে, কুতর্কের দোকান সে করে না আর”।
তাই আমার পক্ষে কুতর্ক তো দূরের কথা কোনো তর্কে জড়ানোর মানে হয় না। আমি কেবল আমার ভাবনার কথা, অনুভুতির কথা, উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করতে পারি মাত্র। বাকিটা পাঠকের উপর। আর যারা এই নিয়ে সন্ধিহান কবি গুরু ফকির লালনের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন কি করেন নি।
তাদের উদ্দেশ্যে শুধু এটুকুই বলা, আপনি নিজে কি বিশ্বাস করেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ লালন সাঁইজির নাম শুনেছেন।
তার পরিবারের মানুষ তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এমনকি তাদের জমিদারিতে থাকেন এমন একজন মানুষের কথা শোনার পর তিনি তার সাক্ষাৎ করেন নি? মশাই অন্য কেউ হলে মেনে নিতাম রবীন্দ্রনাথের মতো পর্যটক কবি যিনি বহু জায়গায় লালনের গানের উদ্বৃতি দিয়েছেন।
লালনের গানের জবাবী গান লিখেছেন। লালনের গানের ভাবগ্রহণ করে নিজে রচনা করেছেন তিনি তাঁর সাক্ষাৎ করবেন না এটা কি আপনি নিজেই মানতে পারেন? মশাই আপনি নিজে মানতে পারলেও আমি পারি না। ক্ষমা করবেন অধমকে।
আর যারা যাত্রাপালার কাহিনীর সূত্র ধরে ফকির লালনের জাত খুঁজতে চান তাদের উদ্দেশ্যে এটুকুই বলতেই হয়, ‘এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা করো।’
সাঁইজির জাত যদি খুঁজে বের করা সহজ হতো তাহলে তিনি তা প্রকাশ করেই যেতেন। নয়তো তার শিষ্যরা প্রকাশ করে দিতেন। তিনি যা প্রকাশ করেন নি তার সে ভেদ খোঁজা বোকামি ভিন্ন আর কিছুই নয়।
যা প্রকাশ করে গেছেন পারলে সেই ভেদ পরিস্কার করা উচিৎ। তবেই মনের ঘোর কেটে যাবে। সাঁইজিকে বোঝা সহজ হবে। সাঁইজিকে বুঝতে হলে তিনি কার ঔরসে জন্মেছেন, কার গর্ভে জন্মেছেন এ দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।
এদিয়ে কিছু প্রমাণও করা যাবে বলে মনে হয় না। সাঁইজিকে আমাদের বা ওদের এভাবে ভাগ করাও যাবে না। তিনি সে পথ রেখে যান নি। তাই সে পরিশ্রমও বৃথা।
যদি যথাযথই সাঁইজিকে বুঝতে হয়। তবে তার পদে ডুব দিতে হবে; ডুবতে ডুবতে বোঝা যাবে তিনি কে ছিলেন-কি ছিলেন। মনের ঘোর কেঁটে যাবে। নইলে কেবলই হাপুড়হুপুড় ডুব পারাই সার। হাপুড়হুপুড় ডুব পারতে পারতে কোথাও পৌঁছানো যাবে কিনা জানি না।
তবে সেই বিষয়গুলোই বারবার ঘুরে ফিরে আসে মৃত্যুই শেষ নাকি জন্মান্তরের গমণাগমের আসাযাওয়া? এমন মানব জনম কি আর হবে? সাধুগুরুদের মাঝে বসতে পারবো? খুব ভাবায়। খুব ডোবায়। ভাবতে ভাবতে সাইজির বাণীতে ঢুকে যাই-
আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে।
হেলায় হেলায় দীন বয়ে যায় ঘিরে নিল কালে।।
কত কত লক্ষ্য যোনি
ভ্রমন করে জানি,
মানব কূলে মন রে তুমি
এসে কি করিলে।।
মানব কুলেতে আসায়
কত দেব দেবতা বাঞ্চিত হয়,
হেন জনম দীন দয়াময়
দিয়েছে কোন ফলে।।
ভুলনারে মনরসনা
সমঝে কর বেচাকেনা,
লালন বলে কুল পাবা না
এবার ঠকে গেলে।।
(চলবে…)
…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই
মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে