ভবঘুরেকথা
বলরাম অবতার

-অগ্নিপুরাণ (পৃথ্বীরাজ সেন)

চিরকাল সুখ কোথাও বিরাজ করে না। রামচন্দ্রের অবর্তমানে অযোধ্যায় বেড়ে গেল স্বেচ্ছাচারিতা। প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার অন্ত রইল না। অনাচার, পাপাচারে দেশ ভরে গেল। পণ্ডিত ও ধার্মিকেরাও সেই পাপাচার থেকে রেহাই পেলেন না।

এসময় পাপের বিনাশ ঘটাতে স্বয়ং শ্রীহরি বলরামকে সঙ্গে নিয়ে ব্রজধামে এসে উপনীত হলেন।

ভোজবংশে শক্তিশালী রাজা আহুকের দুই পুত্র উগ্রসেন ও দেবক। উগ্রসেনের পুত্র কংস, অত্যন্ত দুরাচারী। দেবকের কন্যা দেবকী, তার স্বামীর নাম বসুদেব। তিনি শূরসেনের পুত্র। কংস বর কনের রথের সারথি হলেন। এসময় আকাশ বাণী শোনা গেল। দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কংসের প্রাণহন্তারক হবে।

সেই দৈববাণী শুনে কংস ক্ষেপে গেলেন। তিনি দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। বসুদেব বহু চেষ্টা করে স্ত্রীকে কংসের হাত থেকে রক্ষা করলেন। কংস তাদের বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন।

কৃষ্ণ-বলরামকে হত্যা করতে এ পর্যন্ত কংস অনেক রাক্ষস-অসুরদের পাঠিয়েছেন। কিন্তু কেউই কাজ শেষ করে ফিরে আসতে পারেননি। বরং প্রাণ দিয়েছে। তাই কংস ঠিক করলেন তিনি দেবকীকে আর বাঁচিয়ে রাখবেন না। খঙ্গ উঁচিয়ে ধরে ছুটে এলেন কারাগারে।

বসুদেব তাঁর প্রতিশ্রুতি মতো দেবকীর গর্ভের প্রতিটি সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দিলেন। এইভাবে দেবকীর ছয়টি সন্তানের বিনাশ ঘটল।

দেবকী সপ্তমবারের জন্য গর্ভবতী হল। ভগবানের ইচ্ছায় দেবী যোগমায়া দেবকীর সেই গর্ভ আকর্ষণ করে বসুদেবের অন্য পত্নী রোহিণীর গর্ভে প্রবিষ্ট করালেন। রোহিণী সেই পুত্রের জন্ম দিলেন। গর্গাচার্য তার নাম রাখলেন, বলরাম। রোহিণী তখন কংসের ভয়ে গোপরাজ নন্দের ঘরে বসবাস করছিলেন।

দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত সন্তান শ্রীকৃষ্ণ গোকুলে নন্দ ও যশোদার পুত্র রূপে বড়ো হতে লাগলেন। বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ দুটি ভাই নানা লীলাখেলার মাধ্যমে ব্রজবাসীদের মুগ্ধ করে রাখতেন। বড়ো হয়ে তাঁরা গেলেন গোচারণে। অনেক গোপবালক তাদের সখা হল।

কৃষ্ণ ও বলরামকে হত্যা করার জন্য কংস প্রলম্ব নামে এক দানোকে পাঠাল। সখা রূপে সে ঢুকে পড়ল গোপবালকদের সঙ্গে। দুপক্ষে খেলা শুরু হল। এক পক্ষে বলরাম ও তার সাথীরা। অন্য পক্ষে কৃষ্ণ ও তার সখীরা। দানো প্রলম্ব ছিল কৃষ্ণের পক্ষে। কৃষ্ণের দল হেরে গেল।

এখন বিজিত দলকে মাথায় নিয়ে নাচতে হবে। প্রলম্ব এগিয়ে এসে বলরামকে মাথায় নিয়ে মথুরার দিকে পা বাড়াল। বলরাম বুঝতে পারলেন, এ নির্ঘাত কোনো অসুর। পা দিয়ে সজোরে মারলেন এক লাথি। প্রলম্বাসুর সেখানেই অক্কা পেল।

কৃষ্ণ-বলরামকে হত্যা করতে এ পর্যন্ত কংস অনেক রাক্ষস-অসুরদের পাঠিয়েছেন। কিন্তু কেউই কাজ শেষ করে ফিরে আসতে পারেননি। বরং প্রাণ দিয়েছে। তাই কংস ঠিক করলেন তিনি দেবকীকে আর বাঁচিয়ে রাখবেন না। খঙ্গ উঁচিয়ে ধরে ছুটে এলেন কারাগারে।

ত্রেতাযুগে রাজ্যের রাজা রৈবতকের কন্যা রেবতী উপযুক্ত পাত্রের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হয়ে তপস্যা করেছিলেন। ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিয়েছিলেন। দ্বাপর যুগে দ্বারকার বলরাম হবে তার উপযুক্ত স্বামী। রাজা রৈবর্ত কন্যা রেবতাঁকে নিয়ে দ্বারকায় এলেন।

দেবকীকে লক্ষ্য করে খঙ্গ তুলতেই বলরাম অনন্ত রূপে হাজার ফণা বিস্তার করে ভীষণ শব্দে গর্জন করতে লাগলেন। তার চোখ দুটি দিয়ে আগুনের গোলা বেরিয়ে এল। কংস ভয়ে কারাগার থেকে ছুটে পালিয়ে গেলেন।

বলরাম আসলে অনন্তদেব। তিনি সর্বদা শ্রীহরির পাশে থেকেছেন। ত্রেতাযুগে রামের পাশে ছিলেন লক্ষ্মণ হয়ে, দ্বাপরে কৃষ্ণের দাদা বলরাম আর কলিতে হাড়াই পন্ডিতের পুত্ররূপে নিত্যানন্দ হয়ে নিমাইয়ের পাশে থেকেছেন।

কৃষ্ণ বলরামের উপস্থিতিতে বৃন্দাবনে সর্বদা আনন্দের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে।

এদিকে কংস কৃষ্ণ নিধনের জন্য চিন্তা করছেন। অবশেষে নারদের পরামর্শে তিনি কৃষ্ণ ও বলরামকে মথুরায় ডেকে পাঠালেন।

কৃষ্ণ কংসের সেই আয়োগব নামে ধনুকটিকে অনায়াসে ভেঙে ফেললেন। কুবলয়বীড় নামে এক মত্ত হাতিকে পাঠানো হল দুই ভাইকে নিধন করতে। দুই ভাই হাতিকে মেরে তার দাঁত দুটো উপড়ে নিল।

এবার চানুকের সঙ্গে কৃষ্ণ আর মুষ্টিকের সঙ্গে বলরামের মল্ল যুদ্ধ শুরু হল। দুই মল্লবীর দুই ভাইয়ের হাতে প্রাণ দিল। এবার কংসকে বিনাশ করা হল। বসুদেব ও দেবকীকে কারামুক্ত করা হল। মথুরার রাজা হলেন উগ্রসেন। দুই ভাই তাকে রাজকাজে সাহায্যে করলেন।

তারা গেলেন অবন্তী নগরে। সান্দীপানি মুনির কাছে বিদ্যাশিক্ষা লাভ করে ফিরে এলেন। জরাসন্ধকে পরাজিত করে এলেন দ্বারকায়।

ত্রেতাযুগে রাজ্যের রাজা রৈবতকের কন্যা রেবতী উপযুক্ত পাত্রের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হয়ে তপস্যা করেছিলেন। ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিয়েছিলেন। দ্বাপর যুগে দ্বারকার বলরাম হবে তার উপযুক্ত স্বামী। রাজা রৈবর্ত কন্যা রেবতাঁকে নিয়ে দ্বারকায় এলেন।

কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ রোধ করার জন্য কৃষ্ণ অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু বিফল হলেন। মনের দুঃখে বলরাম তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি এলেন নৈমিষারণ্যে, সেখানে লোমহর্ষণ মুনি শৌনকাদি ষাট হাজার ঋষিদের সামনে বসে পুরাণকাহিনি ব্যক্ত করছিলেন।

ত্রেতাযুগের মানুষরা ছিল চৌদ্দ হাত লম্বা। বিশাল আকারের লোক দেখে দ্বারকাবাসীরা ভীত হল। তারা কৃষ্ণ বলরামের কাছে ছুটে এল।

রাজা তাদের কাছে সব কথা খুলে বললেন-এবং ব্রহ্মার বরানুসারে রৈবতীর সাথে বলরামের বিয়ে হল। যেহেতু রেবতী উচ্চতায় অনেক লম্বা ছিলেন, তাই লাঙলের দ্বারা তার নিজের উচ্চতার সমান করে নিলেন। দ্বাপর যুগে মানুষরা ছিল সাত হাত লম্বা আর সত্যযুগে তাদের উচ্চতা ছিল একুশ হাত।

অনেকদিন পর বলরাম বৃন্দাবনে এলেন। নন্দ ও যশোদাকে প্রণাম করলেন। শ্রীকৃষ্ণের খবর জানালেন, গোপীদের সাথে তিনি রাসলীলায় মেতে উঠলেন। জলকেলি করার জন্য যমুনার ডাক পড়ল। বলরাম অন্য খেলায় মত্ত থাকাতে যমুনা ফিরে যেতে উদ্যত হল।

তখন বলরাম লাঙলের সাহায্যে তাকে আকর্ষণ করল। তারপর তারা জলকেলি করলেন। কিছুদিন বৃন্দাবনে কাটিয়ে বলরাম ফিরে এলেন দ্বারকায়।

কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব দুর্যোধনের কন্যা লক্ষ্মণাকে হরণ করা কালে বন্দি হলেন। বলরাম এই খবর পেয়ে গদা নিয়ে ছুটে গেলেন। বলরামের শক্তির কাছে হার স্বীকার করে দুর্যোধন নিজের কন্যা ও শাম্বকে তার হাতে তুলে দিলেন।

কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ রোধ করার জন্য কৃষ্ণ অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু বিফল হলেন। মনের দুঃখে বলরাম তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি এলেন নৈমিষারণ্যে, সেখানে লোমহর্ষণ মুনি শৌনকাদি ষাট হাজার ঋষিদের সামনে বসে পুরাণকাহিনি ব্যক্ত করছিলেন।

বলরামকে দেখে সকলে উঠে দাঁড়াল, প্রণাম করল। কেবল লোমহর্ষণ মুনি বাদে, অপমানে বলরাম একটি কুশের অগ্রের দ্বারা মুনির মাথাটি কেটে ফেললেন।

নৈমিষারাণ্যে এক অসুরের উপদ্রব চলছিল। বল্লাসুরকে বিনাশ করে বলরাম সেখানে শান্তির বাতাবরণ ফিরিয়ে আনলেন।

কৌশিক, প্রয়াগ ইত্যাদি তীর্থস্থান ঘুরে প্রভাসে এসে তিনি শুনলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রচণ্ডভাবে শুরু হয়ে গেছে।

<<সৃষ্টিতত্ত্ব : জালালী মত ।। কূর্ম অবতারের কাহিনী>>

…………………….
অগ্নিপুরাণ
সম্পাদনা – পরিমার্জনা – গ্রন্থনা: পৃথ্বীরাজ সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………
আরো পড়ুন:
গ্রীক পৌরাণিকে সৃষ্টিতত্ত্ব
বাইবেলে সৃষ্টিতত্ত্ব
সৃষ্টিতত্ত্ব : জালালী মত
মৎস্য অবতারের কাহিনী
কূর্ম অবতারের কাহিনী
বরাহ অবতারের কাহিনী
নৃসিংহ অবতারের কাহিনী
বামন অবতারের কাহিনী
পরশুরাম অবতারের কাহিনী
শ্রীরাম অবতারের কাহিনী

বলরাম অবতারের কাহিনী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!