ভবঘুরেকথা
দশ অবতার শ্রীরাম অবতারের কাহিনী

-অগ্নিপুরাণ (পৃথ্বীরাজ সেন)

সূর্য বংশজাত রাজা দশরথ। অযোধ্যার প্রতাপশালী রাজা মৃগয়ায় বেরিয়ে শব্দভেদী বাণের দ্বারা এক ঋষিবালক, বধ করেন। তার অন্ধ পিতা-মাতা পুত্রের শোকে পাগল হয়ে রাজাকে অভিশাপ দিলেন যে, তিনিও পুত্র শোকে মারা যাবেন।

দশরথ বললেন-আমি অপুত্রক, পুত্রশোক পাব কী করে?

অন্ধমুনি বললেন- পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করো, পুত্রলাভ হবে।

পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আয়োজন করলেন রাজা দশরথ। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির পৌরহিত্যে যজ্ঞ সুসম্পন্ন হল। যজ্ঞে উত্থিত চরু, রাজা তার তিন রানিকে খেতে বললেন।

ভগবান শ্রীহরি এবার চার ভাগ হয়ে তিন রানির গর্ভে প্রবেশ করলেন। যথাসময়ে বড়রানি কৌশল্যা, জন্ম দিলেন রামের। কৈকেয়ীর গর্ভজাত সন্তান হল ভরত। আর ছোটো রানি সুমিত্রা দুই পুত্রের জননী হলেন- লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন।

এদিকে রাজা জনক যজ্ঞভূমি কর্ষণের সময়ে অজোনিসম্ভবা এক কন্যাকে লাভ করলেন। নাম দিলেন সীতা। তিনি আসলে স্বয়ং দেবী লক্ষ্মী।

গুরুদেব বশিষ্ঠের অধীনে চারভাই বিদ্যার্জন করলেন। তারা অস্ত্রবিদ্যাতেও পারদর্শী হয়ে উঠলেন। সেই সময় এক বিশদ দেখা দিল। তপোবনে মুনি- ঋষিরা হোম- যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারতেন না। লঙ্কেশ্বর রাবণের অনুচরেরা যত রাক্ষস-রাক্ষসী এসে তা পণ্ড করে দিত।

মহামুনি বিশ্বামিত্র রাক্ষসের উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য রাজা দশরথের শরণাপন্ন হলেন। এবং তার কাছে রাম ও লক্ষণকে প্রার্থনা করলেন।

রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে বিশ্বামিত্র পথে চলেছেন। এমন সময় ভীষণ আকৃতির এক রাক্ষসী তাদের পথ আগলে দাঁড়াল। নাম তাড়কা। বিশ্বামিত্র তাকে দেখে কাঁপতে থাকলেন। শ্রীরাম এক বাণে সেই রাক্ষসীকে ধরাশায়ী করে দিলেন।

এবার তারা এলেন সেই স্থানে, যেখানে ঋষি গৌতমের অভিশাপে অহল্যা পাষাণ হয়ে পড়ে আছে। মুনি বিশ্বামিত্র রামকে তাঁর চরণ স্পর্শ দিতে বললেন। রামের পায়ের ছোঁয়া মাথায় পেয়ে অহল্যা সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণ করলেন। তিনি করজোড়ে শ্রীরামের প্রশস্তি গাইলেন।

এবার তারা চললেন তপোবনের দিকে। মাঝে আছে গঙ্গা নদী। নদী পার হয়ে যেতে হবে। কিন্তু নৌকার মাঝি রাজি নয়। যাঁর পায়ের স্পর্শে পাষাণী মানবী হয়ে যায়, তাহলে হয়তো তার নৌকো মানব-মানবী হয়ে যাবে। মাঝি রামচন্দ্রের চরণ যুগল ধুয়ে দিলেন।

তাকে সাদরে নৌকায় বসালেন। তারপর তাদের গঙ্গা নদী পার করে দিলেন। রামচন্দ্র ওই মাঝির প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তার নৌকাটি সোনায় পরিণত করলেন।

অবশেষে তিনজনে তপোবনে এসে উপস্থিত হলেন। রামচন্দ্র জানতে পারলেন, রাক্ষসদের উপদ্রবে ঋষিরা নির্বিঘ্নে হোম -যজ্ঞ করতে পারে না। রামচন্দ্র তাদের আশ্বস্ত করলেন। যজ্ঞ শুরু হতেই দলে দলে রাক্ষস-রাক্ষসী ধেয়ে এল। শ্রীরাম তার বাণের সাহায্যে প্রত্যেকের বিনাশ ঘটালেন। এইভাবে তপোবন হল রাক্ষস মুক্ত।

মুনি-ঋষিদের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে রাম-লক্ষ্মণ বিশ্বামিত্রের সঙ্গে এলেন মিথিলাতে, রাজর্ষি জনকের গৃহে অতিথি হলেন।

রাজা জনক অতি সমাদরে অতিথি সৎকার করলেন। বিশ্বামিত্র রাম ও লক্ষ্মণের পরিচয় দিয়ে বললেন, শ্রীরামের সঙ্গে আপনার কন্যা সীতার বিবাহের ব্যবস্থা করুন।

রাজা জনক শ্রীরামের রূপ দেখে অত্যন্ত পুলকিত হলেন। তবুও তিনি সংশয়াপূর্ণ মনে বললেন-মুনিবর আমার একটি ধনুক আছে, স্বয়ং শিব সেটি আমায় দান করেছিলেন। আমি পণ করেছি, যে ব্যক্তি ধনুকে গুণ দিয়ে সেটি ভাঙতে পারবে, তার হাতেই আমি কন্যা সম্প্রদান করব।

ইতিমধ্যেই রাম লক্ষ্মণের আগমনবার্তা পৌঁছে গেছে অন্তঃপুরে, সীতার সখীরা জানাল, রামের রূপের কথা। সীতা মনে মনে উৎফুল্ল হলেন। পরক্ষণেই মুষড়ে পড়লেন- ওই পুরুষ কি হরধনু ভঙ্গ করে তার বাবার পণ রক্ষা করতে পারবেন? ইতিপূর্বে অনেক বড়ো বড়ো বীর এসেও সেই ধনুক ভাঙতে পারেননি। তুলতে পর্যন্ত পারেননি।

খবর পেয়ে মামাবাড়ি নন্দীগ্রাম থেকে ফিরে এলেন ভরত। মাকে অত্যন্ত তিরস্কার করলেন। পিতার শ্রাদ্ধশান্তি শেষ করে তপস্বীর বেশে বনে এলেন। চিত্রকূট পর্বতে দেখা হল রামের সঙ্গে। পিতার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে ভরত দাদা রামকে অযোধ্যায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলেন।

শ্রী রামচন্দ্র কিন্তু অনায়াসে হরধনু ঊর্ধদিকে তুলে ধরলেন। গুণ দিতে গিয়ে তা ইক্ষু দণ্ডের মতো ভেঙে গেল।

জনক রাজা অত্যন্ত খুশি হলেন। অযোধ্যায় দূত পাঠিয়ে দিলেন, রাজা দশরথকে বিয়ের সংবাদ জানিয়ে।

দশরথ মহা আনন্দে চতুরঙ্গ দলের সঙ্গে ভরত ও শত্রুঘ্নকে নিয়ে মিথিলায় এসে উপস্থিত হলেন।

শুভলগ্নে রাম ও সীতার বিয়ে হল। ওই একই সঙ্গে বিয়ে হল জনকের অপর কন্যা ঊর্মিলার সঙ্গে লক্ষ্মণের। জনক রাজার ভাই কুশধ্বজের দুই কন্যা মাণ্ডবী আর শ্রুতকীর্তি। তারা ভরত ও শত্রুঘ্নকে স্বামীত্বে বরণ করলেন।

পরের দিন দশরথ চার পুত্র ও চার পুত্রবধূকে নিয়ে অযোধ্যার পথে এগোলেন। পথে দেখা হল পরশুরামের সঙ্গে।

তিনি বললেন- জগতে একজনই রাম থাকবে। পুরাতন হরধনু ভঙ্গকারীকে আমি বধ করব।

শ্রীরাম এগিয়ে এসে বললেন-আমিই সেই রাম। হরধনু যদি পুরোনো ছিল, তাহলে আপনারটা আমায় দেখান দেখি।

পরশুরাম ক্রোধ ভরে নিজের ধনুঃশরটি শ্রীরামচন্দ্রের হাতে তুলে দিলেন। এ সময় রাম পরশুরামের তেজ হরণ করে নিলেন। সকলে খুশি মনে অযোধ্যায় ফিরে এলেন।

মহারাজ দশরথ বৃদ্ধ হয়েছেন। তিনি রামকে রাজা করার জন্য মনস্থ করলেন। এ সংবাদ দাসী কুঁজী মন্থরার কাছে থেকে জানতে পারলেন মেজোরানি কৈকেয়ী। মন্থরার কুমন্ত্রণায় রানী দশরথের কাছে পূর্ব প্রতিশ্রুত দুটি বর চেয়ে নিলেন। একবরে রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনে পাঠাতে হবে এবং দ্বিতীয় বরে ভরতকে সিংহাসনে বসাতে হবে।

কৈকেয়ীর মুখে এমন নির্মম পরিহাস শুনে রাজা কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। রাম পিতৃসত্য পালনের জন্য বনে গেলেন, সঙ্গে গেলেন পত্নী সীতা এবং অনুজ লক্ষ্মণ। পুত্রের শোকে রাজা দশরথ- হা রাম, হা রাম, করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

খবর পেয়ে মামাবাড়ি নন্দীগ্রাম থেকে ফিরে এলেন ভরত। মাকে অত্যন্ত তিরস্কার করলেন। পিতার শ্রাদ্ধশান্তি শেষ করে তপস্বীর বেশে বনে এলেন। চিত্রকূট পর্বতে দেখা হল রামের সঙ্গে। পিতার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে ভরত দাদা রামকে অযোধ্যায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলেন।

পিতার শোকে শ্রীরাম শোকাহত হলেন। তিনি বললেন- ভাই ভরত, তুমি অযোধ্যায় ফিরে যাও। চোদ্দ বছর পূর্ণ হলেই আমি আবার রাজকার্য হাতে তুলে নেব। ততদিন তুমিই হলে অযোধ্যার রাজা।

সীতা ভিক্ষা দিতে এগিয়ে এলে তাকে পুষ্পক রথে তুলে লঙ্কার দিকে যাত্রা করলেন। হা রাম, হা রাম” করে সীতাদেবী কাঁদতে কাঁদতে গায়ের আভরণ ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন। রাজা দশরথের বন্ধু জটায়ু পাখির কানে সীতার এই হৃদয় বিদারক ক্রন্দন ধ্বনি পৌঁছোল।

ভরতের মন চাইছিল না। তবু ভ্রাতৃআজ্ঞা পালন করতেই হবে। অবশেষে শ্রীরামের পাদুকাযুগল মাথায় করে ফিরে এলেন রাজ্যে। সিংহাসনে সে দুটি স্থাপন করে রাজকার্য পরিচালনা করতে লাগলেন।

চিত্রকুট পর্বতে পিতার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে অগস্তের তপোবন ঘুরে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ এলেন পঞ্চবটী বনে। সেখানে কুটির নির্মাণ করা হল। অনুজ লক্ষ্মণ, রাম ও সীতার সেবায় নিয়োজিত সর্বক্ষণ।

লঙ্কার রাজা রাবণের বোন শূর্পনখা একদিন ওই বনে এসে ঢুকল। রাম -লক্ষ্মণের দিব্য মূর্তি দেখে সে কামে জর্জরিত হল। সুন্দরী নারীর রূপ ধরে তাকে বিয়ে করার জন্য প্রার্থনা করল। কিন্তু রাম লক্ষ্মণ আপত্তি করলেন। সুর্পনখা রেগে গিয়ে সীতাকে গিলে খাওয়ার জন্য উদ্যত হল।

রেগে গিয়ে লক্ষ্মণ সেই রাক্ষসীর নাক, কান কেটে দিলেন। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বোন গিয়ে দাঁড়াল দাদা রাবণের কাছে। রাবণ সমস্ত কথা অবগত হয়ে ঠিক করলেন সীতা দেবীকে চুরি করে নিয়ে আসবেন। এজন্য তার প্রয়োজন হল মামা মারীচকে। মারীচ মায়াবলে বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারত।

সে সোনার হরিণের রূপ ধরে কুটিরের আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সেই সময় সীতা সেই সুন্দর হরিণ ধরে এনে দেওয়ার জন্য রামকে অনুরোধ করলেন। রাম ছুটলেন হরিণ ধরতে। অনেক দূর যাওয়ার পর রাম একটি বাণ নিক্ষেপ করলেন। মারীচ আহত হল। আর রামের কণ্ঠস্বরে চেঁচিয়ে উঠল- ভাই লক্ষ্মণ! আমায় রক্ষা করো। তারপর মারীচ মারা গেল।

শ্রীরামের আকুল আর্তনাদ শুনে সীতা চঞ্চলা হলেন। দেবর লক্ষ্মণকে তিনি জোর করে পাঠিয়ে দিলেন স্বামীর উদ্দেশ্যে। কুটিরে তখন একাকিনী সীতাদেবী। এই সুযোগে তপস্বীর ছদ্মবেশে রাবণ ভিক্ষার ঝুলি হাতে দাঁড়ালেন কুটিরে সামনে।

সীতা ভিক্ষা দিতে এগিয়ে এলে তাকে পুষ্পক রথে তুলে লঙ্কার দিকে যাত্রা করলেন। হা রাম, হা রাম” করে সীতাদেবী কাঁদতে কাঁদতে গায়ের আভরণ ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন। রাজা দশরথের বন্ধু জটায়ু পাখির কানে সীতার এই হৃদয় বিদারক ক্রন্দন ধ্বনি পৌঁছোল।

তিনি রাবণের পথ আগলে দাঁড়ালেন। রাবণ খঙ্গর আঘাতে জটায়ুর পাখা ছেদন করলে মৃতপ্রায় পাখিটি মাটিতে পড়ে গেল।

রাবণ সীতাকে লঙ্কায় নিয়ে এসে রামকে ভুলে গিয়ে তাকে বিয়ে করতে বললেন। সীতা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন- শ্রীরাম বিনা আমি কাউকে পুজো করি না। আমায় হরণ করার ফলে তুই নির্বংশ হবি।

রাগে দুঃখে অপমানে রাবণ সীতাকে অশোকবনে বন্দি করে রেখে দিলেন। সীতাকে পাহারা দেওয়ার জন্য শত শত ভয়ংকর দর্শন চেড়ী নিয়োগ করা হল।

এদিকে মায়াবী রাক্ষসকে মেরে রাম কুটিরের অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথে লক্ষ্মণের সঙ্গে দেখা হল। তিনি ভাইকে বকুনি দিয়ে বললেন- সীতাকে একা কুটিরে রেখে তোমার বেরিয়ে আসা উচিত হয়নি। না জানি কপালে কী আছে!

সুগ্রীবের আহ্বানে বহু বানর সেনা এসে জড়ো হল। শ্রীরাম তাকে উদ্ধার করতে আসবেন- সীতাকে এই কথা বলে আশ্বস্ত করার অভিপ্রায়ে হনুমান গেল লঙ্কায়। সেখানে গিয়ে আগুনে সব ছারখার করে দিল। তারপর সীতার সঙ্গে দেখা করে তার কুশল সংবাদ নিয়ে ফিরে এল রামের কাছে।

কুটিরে ফিরে এসে দুই ভাই হতবাক। সীতা নেই, তাকে চারদিকে খোঁজা হল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না।

খুঁজতে খুঁজতে অরণ্য মধ্যে এক জায়গা থেকে একটি কঙ্কণ কুড়িয়ে পেয়ে রামচন্দ্র চিনতে পারলেন, এ সীতারই অলংকার, বুঝলেন, সীতাকে কেউ চুরি করেছে।

পথে আহত ও মৃতপ্রায় জটায়ুর সঙ্গে তার দেখা হল। জানতে পারলেন, লঙ্কার রাজা রাবণ সীতাকে হরণ করেছে। তাকে বাধা দিতে গিয়ে পক্ষীটির মরণাপন্ন অবস্থা।

খানিকবাদে জটায়ুর মৃত্যু হল। সরযূ নদীর তীরে জটায়ুর অগ্নি-সকার করে রাম-লক্ষ্মণ ঋষ্যমূক পর্বতে এলেন। সেখানে বাস করতেন সুগ্রীব, হনুমান, সুষেণ, নল ও নীল নামে পাঁচ বানর। তারা রাম ও লক্ষ্মণকে প্রণাম করলেন।

শ্রীরাম সীতাহরণের কথা জানিয়ে বানরদের সাহায্য প্রার্থনা করলেন।

সুগ্রীব বলল- আমি আমার ভাই বালির দ্বারা নিজ রাজ্য থেকে বিতাড়িত। যদি রাজ্য ফিরে পাই, তাহলে কথা দিচ্ছি সীতা উদ্ধারে সাহায্য করব।

রাম সুগ্রীবের সাথে মিতালি পাতালেন। তারপর ছলে বলে কৌশলে বালিকে হত্যা করে সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা করে দিলেন।

সুগ্রীবের আহ্বানে বহু বানর সেনা এসে জড়ো হল। শ্রীরাম তাকে উদ্ধার করতে আসবেন- সীতাকে এই কথা বলে আশ্বস্ত করার অভিপ্রায়ে হনুমান গেল লঙ্কায়। সেখানে গিয়ে আগুনে সব ছারখার করে দিল। তারপর সীতার সঙ্গে দেখা করে তার কুশল সংবাদ নিয়ে ফিরে এল রামের কাছে।

তারপর নল এবং অন্যান্য বীরসেনারা শিলার ওপর রামনাম লিখে সাগরে ভাসিয়ে দিল। তৈরি হল সেতু। সেই সেতু ধরে সকল বানর সেনা এসে হাজির হল লঙ্কায়।

রাবণের ভাই বিভীষণ ছিলেন সৎ। তিনি দাদা রাবণকে বললেন-যে, সীতাদেবীকে ফিরিয়ে দিয়ে শ্রীরামচন্দ্রের চরণে ঠাঁই নাও। রাবণ ভাইয়ের তোষামোদ বাক্য শুনে অত্যন্ত কুপিত হলেন। তিনি বিভীষণকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন।

পুত্রশোকে অধীর হয়ে রাবণ যুদ্ধক্ষেত্রে এলেন। রাবণের শক্তিশেল বাণের আঘাতে লক্ষ্মণ মারা গেলেন। সুষেণ বৈদ্যের পরামর্শে হনুমান গন্ধমাদন পাহাড়কে তুলে নিয়ে এল। সেখান থেকে আহরণ করা হল বিশল্যকরণীর গাছ। সেই ঘ্রাণে লক্ষ্মণ প্রাণ ফিরে পেলেন।

অপমানিত বিভীষণ এলেন রামের কাছে। তার চরণে আশ্রয় নিলেন। রামচন্দ্র তাকে বন্ধু বলে স্বীকার করলেন।

রণক্ষেত্রে স্বয়ং রাবণ এসে দাঁড়ালেন। রাম অনায়াসে বাণের আঘাতে তার মাথার দশটি মুকুট মাটিতে ফেলে দিলেন। অপমানিত হয়ে রাবণ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিদায় নিলেন। তারপর কিছুদিন কেটে গেল নীরবতার মধ্যে, ইতিমধ্যে বালির পুত্র অঙ্গদ রাবণের সভায় হাজির হয়ে একথা সেকথা বলে তাকে তাতিয়ে দিয়ে এল।

এবার রামের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য বেছে বেছে বীরদের পাঠাতে থাকলেন লঙ্কেশ্বর রাবণ। রাবণের পুত্র মেঘনাদ। মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করতে লাগল। সে নাগপাশে রাম-লক্ষ্মণকে বন্দি করল। পবনদেব গরুড়ের সাহায্য নিয়ে রাম-লক্ষ্মণকে নাগপাশ মুক্ত করলেন।

রাবণের আর এক ভাই কুম্ভকর্ণ। সে ছমাস জাগে। অসময়ে জাগালে তাঁর মৃত্যু হবে। এমন বর ছিল তার। কিন্তু লঙ্কার এই দুরাবস্থার দিনে চুপ করে কি বসে থাকা যায়। রাবণ তাঁকে ঘুম থেকে তুলে দিলেন। এবং পাঠিয়ে দিলেন রণাঙ্গনে। রামের বাণে তাঁর মৃত্যু হল।

এরপর বীরবাহু, মকরা প্রভৃতি রণদক্ষ বীররা এল। কিন্তু কেউই প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারল না। এবার যুদ্ধক্ষেত্রে এসে দাঁড়াল বিভীষণের বালক পুত্র তরণী সেন। সে ছিল শ্রীরামচন্দ্রের পরম উপাসক। তার উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত প্রতিটি বাণ ব্যর্থ হল রামচন্দ্রের।

তিনি তখন ওই বালককে বধ করার জন্য বিভীষণের সঙ্গে পরামর্শ করতে শুরু করলেন। বিভীষণ বললেন- ব্রহ্মবাণই ওর মৃত্যুবান।

রাম ব্রহ্মবাণ নিক্ষেপ করবেন। তরণীর মুণ্ড কেটে পড়ে গেল মাটিতে। সেই কাটা মুণ্ড রামনাম জপ করতে লাগল।

ইন্দ্রজিৎ বহু যুদ্ধ জয়ী বীর। যুদ্ধে অপরাজিত থাকার প্রার্থনায় শিবের পুজো করার জন্য যজ্ঞাগারে প্রবেশ করল। তার পুজো শেষ হলে কেউ তাকে পরাজিত করতে পারবে না। তাই বিভীষণের যুক্তিতে লক্ষ্মণ ও হনুমান যজ্ঞগৃহে প্রবশে করলেন। হনুমান যজ্ঞ পণ্ড করে দিল। আর লক্ষ্মণ ব্রহ্মাস্ত্র মেরে ইন্দ্রজিতের সংহার করলেন।

পুত্রশোকে অধীর হয়ে রাবণ যুদ্ধক্ষেত্রে এলেন। রাবণের শক্তিশেল বাণের আঘাতে লক্ষ্মণ মারা গেলেন। সুষেণ বৈদ্যের পরামর্শে হনুমান গন্ধমাদন পাহাড়কে তুলে নিয়ে এল। সেখান থেকে আহরণ করা হল বিশল্যকরণীর গাছ। সেই ঘ্রাণে লক্ষ্মণ প্রাণ ফিরে পেলেন।

এ খবর শুনে শত্রুঘ্ন ছুটে এল। বালকদের সাথে যুদ্ধ হল। এবং অবশেষে শত্রুঘ্ন পরাজিত হয়ে বন্দি হলেন। ভরত ও লক্ষ্মণও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দিত্ব গ্রহণ করলেন। শেষে অশ্বমেধ ঘোড়া উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং রামচন্দ্র।

রাম-রাবণের যুদ্ধ শুরু হল। যতবার রামের বাণ রাবণের মুণ্ডু কেটে দিল, ততবার সেগুলো অদ্ভুত ভাবে জোড়া লেগে যেতে লাগল।

বিভীষণের পরামর্শে রামের আজ্ঞায় হনুমান এল রাবণের পত্নী মন্দোদরীর কাছে। মিথ্যে আছিলায় নিয়ে এল রাবণের মৃত্যুবাণ। সেই বাণ নিক্ষেপ করে শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কেশ্বর রাবণকে নিধন করলেন।

সীতাকে অশোক কানন থেকে উদ্ধার করা হল। ইতিমধ্যে বনবাসের চৌদ্দ বছর পার হয়েছে। পুষ্পকরথে চড়ে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা ফিরে এলেন অযোধ্যায়। অযোধ্যাবাসী আনন্দে নাচতে লাগল। শ্রীরাম সিংহাসনে বসলেন, পাশে বসালেন পত্নী সীতাকে।

দেবতারা স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করলেন। সীতা বহুদিন রাক্ষসের ঘরে ছিল। তাঁর চরিত্র কলঙ্কিত হয়েছে এই অপবাদ শুনে রামচন্দ্র সীতাকে বনবাসে পাঠালেন। তখন সীতাদেবী ছিলেন গর্ভবতী, বাল্মীকি মুনির আশ্রমে তিনি ঠাঁই পেলেন।

সেখানেই দুই যমজ পুত্র লব ও কুশের জন্ম হল। মুনি দুই শিশুকে নানাবিধ শস্ত্র ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী করে তুললেন।

এদিকে রামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞের উদ্যোগ করছেন। যজ্ঞের ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘোড়া এসে দাঁড়াল পঞ্চবটী বনে। তার কপালে জয়পত্র লেখা দেখে লব ও কুশ। তাকে বন্দি করল।

এ খবর শুনে শত্রুঘ্ন ছুটে এল। বালকদের সাথে যুদ্ধ হল। এবং অবশেষে শত্রুঘ্ন পরাজিত হয়ে বন্দি হলেন। ভরত ও লক্ষ্মণও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দিত্ব গ্রহণ করলেন। শেষে অশ্বমেধ ঘোড়া উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং রামচন্দ্র।

শ্রীরাম তাঁর রাজ্যপাট ভাইদের এবং ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। পূর্ব প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য রাম একদিন দুঃখিত হয়ে লক্ষ্মণকে পরিত্যাগ করলেন। তারপর ভরত ও শত্রুঘ্নকে নিয়ে সরযূ নদীর জলে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। বৈকুণ্ঠ লোকে গিয়ে চার ভাইয়ের মিলন হল এবং সৃষ্টি হল এক অদ্বিতীয় নারায়ণ।

তিনি জানতেন না যে এই দুই শিশু যোদ্ধা তাঁরই আত্মজ। তিনিও তাদের সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠলেন না। অবশেষে মূচ্ছা গেলেন।

যুদ্ধে জয় লাভ করে নাচতে নাচতে লব-কুশ মা সীতাদেবীর কাছে ফিরে এল। যুদ্ধের বৃত্তান্ত শুনে মা কেঁদে আকুল হলেন। ঠিক করলেন আর বেঁচে থেকে কী লাভ। বিধবার মৃত্যু হওয়াই শ্রেয়। আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য তৈরি হলেন।

এ সময় বাল্মীকি মুনি এগিয়ে এসে তাকে একাজ থেকে নিবৃত্ত করলেন। তারপর মন্ত্রপুত জল ছিটিয়ে দিলেন শ্রীরাম ও অন্যান্যদের ওপর। রাম যজ্ঞশ্ব, ভ্রাতা ও অনুচরবর্গকে নিয়ে ফিরে গেলেন অযোধ্যায়।

বাল্মীকি লব ও কুশকে সঙ্গে নিয়ে রামের সভায় এসে হাজির হলেন। দুই পুত্র বীণা বাজিয়ে সুমধুর কণ্ঠস্বরে রামায়ণ কীর্তন করলেন। শ্রীরাম জানতে পারলেন, এই দুই শিশু তাঁরই সন্তান।

মুনির পরামর্শে রামচন্দ্র সীতাদেবীকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। কিন্তু প্রজারা জানালেন, সীতা দেবীকে আবার অগ্নি পরীক্ষা দিতে হবে। কারণ আগেরবার তিনি যখন এই পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তখন তারা কেউ সামনে ছিল না।

এ কথা শুনে সীতাদেবী অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন। তিনি ক্ষোভে দুঃখে ধরিত্রীমার নাম স্মরণ করলেন। পৃথিবী দুভাগ হল। সীতা ধরিত্রী গর্ভে প্রবেশ করলেন।

মাকে হারিয়ে লব-কুশ কাঁদতে শুরু করল। রামচন্দ্র ধনুকে বাণ সংযোজন করলেন ধরিত্রীর উদ্দেশ্যে। ব্রহ্মা তাকে একাজ থেকে বিরত করলেন।

শ্রীরাম তাঁর রাজ্যপাট ভাইদের এবং ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। পূর্ব প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য রাম একদিন দুঃখিত হয়ে লক্ষ্মণকে পরিত্যাগ করলেন। তারপর ভরত ও শত্রুঘ্নকে নিয়ে সরযূ নদীর জলে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। বৈকুণ্ঠ লোকে গিয়ে চার ভাইয়ের মিলন হল এবং সৃষ্টি হল এক অদ্বিতীয় নারায়ণ।

…………………….
অগ্নিপুরাণ
সম্পাদনা – পরিমার্জনা – গ্রন্থনা: পৃথ্বীরাজ সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………
আরো পড়ুন:
গ্রীক পৌরাণিকে সৃষ্টিতত্ত্ব
বাইবেলে সৃষ্টিতত্ত্ব
সৃষ্টিতত্ত্ব : জালালী মত
মৎস্য অবতারের কাহিনী
কূর্ম অবতারের কাহিনী
বরাহ অবতারের কাহিনী
নৃসিংহ অবতারের কাহিনী
বামন অবতারের কাহিনী
পরশুরাম অবতারের কাহিনী
শ্রীরাম অবতারের কাহিনী

বলরাম অবতারের কাহিনী

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!