-মূর্শেদূল মেরাজ
তারা যেহেতু কর্মের স্বীকৃতি চায় না। তাই তারা তা প্রকাশও করে না। এই শ্রেণীর ভক্তের সংখ্যা কম হলেও তারা আছেন যুগে যুগে, শতাব্দী-সহস্রাব্দী ধরেই। তবে তারা নিরবে নিভৃতিতেই থাকেন। তাদেরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেও করেন। না বুঝিয়ে দিলেও করেন। কর্ম করে যাওয়াতেই তাদের সুখ।
এই ভাগের আরেক শ্রেণী হলো যারা নিজ উদ্যোগেই কর্ম করে যান। তারা কর্ম করে যান সত্য, কিন্তু চান গুরু তা দেখুক-জানুক। আর কেউ মূল্যায়ন না করলেও গুরু কর্তৃক একটা সূক্ষ্ম মূল্যায়ন তারা প্রত্যাশা করেন। একে মূল্যায়ন না বলে গুরুর আর্শিবাদের কাতরও বলা যায়।
তারা গুরুকে খুশি করতেই কর্ম করেন। তারা গুরুর মনোযোগ আশা করে। তা না পেলে ব্যথিত হয়। তবে তা জনে জনে বলে বেড়ান না। কিন্তু তাদের মনোবেদনা তাদের আচরণে প্রকাশ পায়।
এই ভাগের আরেক শ্রেণী হলো যারা নিজ উদ্যোগে কর্ম করে গেলেও তার যে প্রতিদান তারা পাচ্ছেন না তা তারা ব্যক্ত করেন। অনেকটা সংসারের অবহেলিত মায়ের মতো আচরণ তাদের। যারা সারাক্ষণ কাজ করেই যান, পাশাপাশি তাদের যে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না তাও বলেই চলেন, বলেই চলেন।
এদের মধ্যে কাজচোরা একটা শ্রেণী আছে। তারা কাজ দেখলেই নানান বাহানা শুরু করে দেয়। তারা যদিও জানে শেষ বিচারে তাদের কাজটা করতেই হবে। তারপরও তাদের বাহানা দেখানোতে কমতি থাকে না। শেষ পর্যন্ত তারা পিছলে বেড়িয়ে যেতে চায়।
তারা যে অনেক সম্পদ-সম্পত্তি অর্থ-বিত্ত প্রত্যাশা করেন এমন নয়। কিন্তু তারা যে কর্ম করে যাচ্ছেন সেটা সকলে অনুভব করুক। তাদের কর্মের স্বীকৃতি তারা আশা করে। এর বিনিময়ে তাদের আগ্রহ নেই। কিন্তু কাজ করেই যাচ্ছে কারো নজরে পরছে না সেটা তারা মানতে পারেন না।
তাদের নানা অভিযোগ-অভিমান থাকে। সেসব কথা তারা সামনে যাকে পায় তাকেই বলতে থাকে। তবে কথা বললে আপনার কখনোই মনে হবে না তারা কাজ করতে অপছন্দ করেন। তারা বলবে অনেক কথা, কিন্তু কাজ করা থামাবে না। কর্মই তাদের ধর্ম।
কিন্তু কোথায় জানি একটা স্বীকৃতির আক্ষেপ-প্রত্যাশা তাদের কর্মকে পূর্ণতা দেয় না।
অন্যদিকে চাপিয়ে দেয়া কর্মবাদী ভক্তরা সাধারণত কর্মবাদী হলেও তাদের বলে বলে কাজ করাতে হয়। নিজে থেকে নিয়ে তারা কাজ করে না। বললে অবশ্য করে। তাদের মাঝেও আছে নানান ভাগ-বিভক্তি।
এদের মধ্যে কাজচোরা একটা শ্রেণী আছে। তারা কাজ দেখলেই নানান বাহানা শুরু করে দেয়। তারা যদিও জানে শেষ বিচারে তাদের কাজটা করতেই হবে। তারপরও তাদের বাহানা দেখানোতে কমতি থাকে না। শেষ পর্যন্ত তারা পিছলে বেড়িয়ে যেতে চায়।
এই দুই শ্রেণীকে কর্মবাদী ভক্ত বলা যায় কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আমি তাদের কর্মবাদী প্রকারেই ফেলতে চাই। কারণ কর্ম নিয়েই তাদের ভাবনা। তারা উদাসীন নয়। তারা নিজেরা কর্ম না করলেও কর্মকে ঘিড়েই তাদের যত কর্মকাণ্ড।
আরেক শ্রেণীর চাপিয়ে দেয়া কর্মবাদী ভক্ত আছে যারা আগে থেকেই কাজ আসছে বুঝতে পারলেই কেটে পরে। এদের ফাঁকিবাজ কর্মবাদীও বলা যায়। কারণ এরা জানে সামনে থাকলে কাজ তাদের করতেই হবে। তা থেকে মুক্তি পাবে না।
চাপিয়ে দেয়া ভক্তের মধ্যে আরেক শ্রেণী আছে। যাদের বেকুব কর্মবাদী ভক্ত বলা যেতে পারে। যারা কাজ করতে চায় না। কিন্তু কাজের জায়গাতেই ঘোরাফেরা করে। বা বলা যায় কাজ তাদের পিছু পিছু হাঁটে। তারা বিরক্তি নিয়ে কাজ করে যায়। কাজ করার সময় গজগজ করতেই থাকে।
চাপিয়ে দেয়া কর্মবাদী ভক্তদের মধ্যে আরেক শ্রেণীকে দেখা যায়। যাদের ফপর দালাল বলা চলে। এরা নিজেরা কাজ করে না। কিন্তু কাজ করিয়ে নিতে ওস্তাদ। তাদের মধ্যে দুই দল। একদল খুবই পিঠ হাতিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। আরেকদল আছে যারা আদেশের সুরে কাজ করিয়ে নিতে ওস্তাদ।
নতুন, বয়সে ছোট, অভাবী-দুস্থ ভক্ত দেখা মাত্র তাদের কাজে লাগিয়ে দেয়। তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়।
এই দুই শ্রেণীকে কর্মবাদী ভক্ত বলা যায় কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আমি তাদের কর্মবাদী প্রকারেই ফেলতে চাই। কারণ কর্ম নিয়েই তাদের ভাবনা। তারা উদাসীন নয়। তারা নিজেরা কর্ম না করলেও কর্মকে ঘিড়েই তাদের যত কর্মকাণ্ড।
কর্মবাদী ভক্তদের গুরুরা বিশেষ পছন্দ করেন। তাদের তেমন কিছু দেন বা না দেন। তাদের উপস্থিতি তাকে ভরসা জোগায়। কারণ তারা না থাকলে প্রতিষ্ঠান চলমান থাকে না।
ভক্তিবাদী ভক্তের প্রকার
সাধনপথে ভক্তিবাদী ভক্তদের চিহ্নিত করা সবচেয়ে জটিল প্রকৃয়া। কারণ ভক্তি বিষয়টা কি সেটাই আমাদের কাছে সাধারণ ধারণায় ঠিক পরিষ্কার নয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন কারো কথা মতো কাজ করে যাওয়াই ভক্তির প্রকাশ। কেউ মনে করেন, প্রতিবাদ না করাই ভক্তি।
কেউ কেউ মনে করেন, কারো কথায় সায় দিয়ে চলাই ভক্তি। কেউ আবার ভাবেন, দুই হাত কচলে তোষামদি করাই ভক্তির প্রকাশ। অনেকে মনে করেন, মনে প্রশ্ন জাগলেও তা হজম করে যাওয়াই ভক্তি। আবার এমনটাও ভাবা হয়, খুব আদব-কায়দার পোশাক করে মাথা নিচু করে বসে থাকলেই ভক্তির প্রকাশ ঘটে।
ভক্তি বিষয়টা আসলে এরকম কিছুই নয়। ভক্তি বিষয়টা হয় স্বভাবে থাকতে হয়। না হয় নিজ সাধন বলে উদয় করতে হয়। ভেতর থেকে জাগ্রত করতে হয়। জাগ্রত করতে হয় কথাটাও সঠিক নয়। আসলে বলা উচিত প্রেমের পথে হাঁটলে ‘ভক্তি আপনাআপনি জাগ্রত হয়’।
যার স্বভাবে ভক্তিবাদ আছে বা জাগ্রত সে নিয়ে আর কিছু বললাম না। কিন্তু যিনি জাগাতে চান তার ক্ষেত্রে প্রথম যা তাকে রপ্ত করতে হয়। তা হলো আদব। আদব যদি কারো মাঝে পূর্ণরূপে প্রকাশ পায় তখন তার মাঝে বিনয় বাসা বাঁধতে শুরু করে।
আর আদব-বিনয় মিলেমিশে মনের মাঝে শ্রদ্ধা-ভক্তির জন্ম দেয়। আদব-বিনয়-শ্রদ্ধা-ভক্তি মিলেমিশে তৈরি হয় প্রেমভাব। আর এই প্রেমভাব উদয় হলেই ভক্তি স্থির হয়। এর আগে যেটা থাকে সেটা খানিকটা অভিনয়, খানিকটা ভনিতা, খানিকটা মোহ, খানিকটা অভ্যাস, খানিকটা গুরুর ভাব প্রকাশ ইত্যাদি।
এই খানিকটা খানিকটা করে ভক্তি হয় না। এটা অল্পদিনেই বা অল্পসময়েই কেটে যায়। যেমন একটা সিনেমা দেখলে বা একটা ভালো গান শুনলে অল্প সময়ের জন্য আমরা তার মাঝে হারিয়ে যাই। কিন্তু সেই আবেশ কেটে গেলে আবার বাস্তবতায় ফিরে আসি। তখন আর তা মাথায় বা মননে থাকে না।
আরেক শ্রেণীর ভক্তিবাদী আছেন। যারা গুরু সেবাকেই জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান মনে করেন। তারা সর্বক্ষণ গুরুর আজ্ঞার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। তারা তাদের ভক্তির চরমে পৌঁছালে গুরুর সাথে এমন এক সম্পর্ক তৈরি হয় যে, গুরু আদেশ দেয়ার আগেই তারা বুঝতে পারে গুরু কি চাইছে।
তাই ভক্তির অভিনয় বেশিদূর টেনে নেয়া যায় না। যদিনা ভক্তিভাব মনে উদয় হয়। ভক্তিভাব ধরণ করে ঘুরে ফিরলে তা এক সময় না এক সময় প্রকাশ পাবেই। কারণ ভক্তির অভিনয় করা সহজ নয় যদি না স্বভাবে থাকে। বা বড় ধরণের প্রতারক না হলে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “স্বামীজী- গুরুভক্তি থাকলে সব সিদ্ধান্ত প্রত্যক্ষ হয়-পড়বার শুনবার দরকার হয় না। তবে এরূপ ভক্তি ও বিশ্বাস জগতে দুর্লভ। ওর (গিরিশবাবু) মত যাঁদের ভক্তি বিশ্বাস, তাঁদের শাস্ত্র পড়বার দরকার নেই। কিন্তু ওকে (গিরিশবাবুকে) imitate (অনুকরণ) করতে গেলে অন্যের সর্বনাশ উপস্থিত হবে। ওর কথা শুনে যাবি, কিন্তু কখনও ওর দেখাদেখি কাজ করতে যাবি না।”
ভক্তিবাদীদের মাঝে অন্ধ ভক্তিবাদী একটা বড় শ্রেণী আছে। যারা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই ভক্তি প্রদর্শন করে যায়। কোনো কিছু পুরোটা শুনবার আগেই হা হা করতে থাকে। মাথা ঝাঁকাতে থাকে। ভক্তিতে নুয়ে পরে। এই চরিত্রের ভক্তরা সকলের কাছেই বিরক্তির কারণ। তারা নিজেরা তা বোঝা না বা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে।
আরেক শ্রেণীর ভক্তিবাদী আছেন। যারা গুরু সেবাকেই জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান মনে করেন। তারা সর্বক্ষণ গুরুর আজ্ঞার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। তারা তাদের ভক্তির চরমে পৌঁছালে গুরুর সাথে এমন এক সম্পর্ক তৈরি হয় যে, গুরু আদেশ দেয়ার আগেই তারা বুঝতে পারে গুরু কি চাইছে।
আরেক শ্রেণীর ভক্তিবাদী ভক্ত আছে যারা মূলত পাগল ভক্ত। তাদের মধ্যে আবার প্রধান তিন শ্রেণী জালালী পাগল, মজ্জব পাগল আর উদাসী পাগল। এই তিন শ্রেণীর পাগল ভক্তের প্রকৃতি পৃথক হলেও প্রেমে কেউ কারো থেকে কম যায় না।
আরেক শ্রেণীর ভক্তিবাদী আছেন, যারা জীব সেবাকে জীবনের ধ্যানজ্ঞান মানেন। তারা সকলকে সেবা দেয়াকেই পরম ধর্ম মনে করেন। দেশ-কাল-পাত্র তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। তারা সকল স্থানেই জীব সেবায় মন দেন। জীবন সেবার নূন্যতম সুযোগ তারা হাতছাড়া করেন না।
এরাই ভাববাদ বা গুরুবাদের সবচেয়ে আলোকিত দিকটা বহন করে। এদের আলোতেই আলোকিত হয় ভাববাদ। সাধক-অনুসারী-অনুরাগীরা মূলত এই শ্রেণীর ভক্ত হয়ে যায়।
আরেক শ্রেণীর ভক্তিবাদী ভক্ত আছেন, যাদের দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। তাদের সর্বদেহে-সর্বমনে-সর্বক্ষণে ভক্তির ভাব প্রকাশিত হয়। লক্ষ লোকের মাঝে প্রচারিত না হলেও যারা তাদের চেনেন তারা তাদের মনের মানুষ হয়ে যান।
তারা সাধারণত নরম প্রকৃতির, স্বল্প ও মৃদু ভাষী। এক কথায় তারা প্রেমিক শ্রেণী। প্রেমই তাদের হাতিয়ার। এমন প্রেম ডোরে মানুষকে তারা বেঁধে ফেলে যে তা থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব।
আরেক শ্রেণীর ভক্তিবাদী ভক্ত আছে যারা মূলত পাগল ভক্ত। তাদের মধ্যে আবার প্রধান তিন শ্রেণী জালালী পাগল, মজ্জব পাগল আর উদাসী পাগল। এই তিন শ্রেণীর পাগল ভক্তের প্রকৃতি পৃথক হলেও প্রেমে কেউ কারো থেকে কম যায় না।
(চলবে…)
ভক্তের প্রকার: চতুর্থ কিস্তি>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………….
আরো পড়ুন:
ভক্তের প্রকার: প্রথম কিস্তি
ভক্তের প্রকার: দ্বিতীয় কিস্তি
ভক্তের প্রকার: তৃতীয় কিস্তি
ভক্তের প্রকার: চতুর্থ কিস্তি
ভক্তের প্রকার: পঞ্চম কিস্তি