-প্রফেসর জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া
বহুকাল থেকে এ উপমহাদেশে ধর্মীয় সাধকদের মধ্যে ধ্যান সাধনার চর্চা ছিল। তবে এসব ধ্যানবিধি শুধু গুরু-শিষ্য পরম্পরা সীমিত ছিল। সাধারণ মানুষেরা এসব পদ্ধতির সাথে বিশেষ একটা সম্পৃক্ত ছিল না। এ সব ধ্যান সাধনার উদ্দেশ্য এক এক সাধকের নিকট এক এক রকম হলেও এতে সাধকের মন বা চিত্তের একাগ্রতা সাধন তরান্বিত হতো।
ফলে সাধক কিছু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে মানুষকে বিস্মিত করতে পারতেন। প্রচলিত এসব ধ্যান পদ্ধতিতে মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা যায় যথা- শমথ ও বিপশ্যনা।
যে ধ্যান চিত্ত বা মনের ক্লেশ বা লোভ-দ্বেষ-মোহ ইত্যাদি শান্ত করে একে শমথ ধ্যান বলে। শমথ ধ্যানের মাধ্যমে চিত্তের একাগ্রতা সাধন সম্ভব হয়। একাগ্রতা সাধনের জন্য কোন একটি বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে এর স্মৃতি অনুধাবনে চিত্ত বা মনকে কেন্দ্রস্থ করা হয়।
ধ্যানের বিষয় বস্তুর সাথে চিত্তের তদগতভাবে লীন হওয়ার নাম একাগ্রতা। এতে অবলম্বনকৃত লক্ষ্যবস্তুর প্রতি ক্রমাগত মনসংযোগ করা হয়। কোন বিষয়ে বারবার জপ বা স্মরণ করা অথবা লক্ষ্যস্থানে চিত্তকে স্থিরভাবে নিবন্ধ করার প্রচেষ্টার নাম শমথ ভাবনা।
চিত্ত বা মনের অবস্থা সর্বদা চঞ্চল, ইতস্তত, ধাবমান ও গতিপ্রিয়। চঞ্চল গোবাছুরকে খুঁটিতে রশি দিয়ে আবদ্ধ করে চরতে দিলে সে খুটির চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে খুটিতে রশি পেচিয়ে রশির দূরত্ব ক্ষীণতর হয় এবং অবশেষে বাছুরটি এদিক সেদিক আর ঘুরাফিরা করতে পারে না।
তদ্রূপ চঞ্চল চিত্ত বা মন লক্ষ্য বস্তুকে আশ্রয় কর বিক্ষিপ্তভাবে ইতস্তত ছুটাছুটি করার পর ক্রমশ নমিত, দমিত, কেন্দ্রীভূত ও একাগ্র হয়। এরূপ একাগ্রতা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে চিত্ত বর্হির্জগতের সবকিছু ভুলে অন্তর্জগতের অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা সাধনীয় লক্ষ্য বস্তুর মধ্যে অভিরমিত ও কেন্দ্রীভূত হয়ে স্থিত হয়।
শমথ ভাবনার ফলে শারীরিক ও মানসিক অশান্তি দূর করে অনুপম শান্তি লাভ করা যায় এবং জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। এ পর্যন্ত চল্লিশ প্রকার শমথ ধ্যানের পরিচয় পাওয়া যায়। এদেরকে আবার সাতভাগে বিভক্ত করা হয়েছে; যেমন-
১. দশ কসিন।
২. দশ অশুভ জিনিস।
৩. এক খাদ্যবস্তুর দোষ।
৪. এক ভূত বিশ্লেষণ।
৫. দশ অণুস্মৃতি।
৬. চার বহ্মবিহার।
৭. চার অরূপ ধ্যান।
ধ্যানের জন্য মনের প্রাথমিক একাগ্রতার জন্য যে বস্তুগুলোর নির্দেশ আছে তাদের কসিন (সমগ্র) বলা হয়। এই কসিন দশ প্রকার। যথা-
১. মাটি।
২. জল।
৩. অগ্নি।
৪. বায়ু।
৫. লাল।
৬. নীল।
৭. হলদে।
৮. সাদা।
৯. আলো।
১০. সীমিত স্থান।
অস্থির মনকে সব কিছুর থেকে গুটিয়ে এনে একটি বিশেষ কিছুর মধ্যে সমাহিত করার জন্য এই কসিনগুলোর নির্বাচন। এই কসিনগুলোর একটিও কিন্তু মানুষের তৈরি কোনো বস্তু নয়। বিশাল বিশ্বপ্রকৃতি থেকে তাদের বাছাই করে নেয়া হয়েছে।
কসিনগুলোর যে কোন একটিকে নিয়ে মন যদি কাউকে স্থিরতা বা একাগ্রতা শিক্ষা দেয় তাই যথেষ্ট। এই কসিনগুলো কিন্তু নিছক প্রাথমিক একাগ্রতার জন্য প্রয়োজন। তারপর কসিনগুলোর আর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
দশটি অশুভ জিনিসের যে কোনো একটিকে নিয়েও মনকে সমাহিত করার চেষ্টা করা যায়। এই দশটি অশুভ জিনিস হলো-
১. ফুলে ওঠা শবদেহ।
২. নীলাভ শবদেহ।
৩. পচে ওঠা শবদেহ।
৪. খণ্ডিত শবদেহ।
৫. নখরের দ্বারা আঁচড়ানো শবদেহ।
৬. চারদিকে ছড়ানো শবের টুকরো।
৭. কুপিয়ে কাটা শবদেহ।
৮. রক্ত মাখা শবদেহ।
৯. পোকাভর্তি শবদেহ।
১০. কংকাল।
এর ফলে মন দেহ সম্বন্ধে মোহমুক্ত হবে। খাদ্যবস্তুর ঘৃণাকর অবস্থা হচ্ছে ধ্যানের আরেকটি বিষয়। এর ফলে খাদ্যবস্তু সম্বন্ধে লোভ মন থেকে একেবারে সরে যাবে। ভূত বিশ্লেষণ অর্থাৎ প্রতিটি দ্রব্যের ধাতুগত বিশ্লেষণ ধ্যানের একটি বিষয়। এই ধ্যানের দ্বারা প্রতিটি বস্তুর অনিত্যতা সম্বন্ধে নি:সংশয় হওয়া যায়।
দশটি অণুস্মৃতি বা স্মরণ ধ্যানের বিষয়গুলো হচ্ছে-
১. বুদ্ধের স্মরণ।
২. ধর্মের স্মরণ।
৩. সংঘের স্মরণ।
৪. শীল বা সদাচারের স্মরণ।
৫. উদারতার স্মরণ।
৬. দেবতাদের স্মরণ।
৭. মৃত্যুর স্মরণ।
৮. দেহ সম্বন্ধে সজাগতা।
৯. নিশ্বাস-প্রশ্বাস সম্বন্ধে সজাগতা।
১০. শান্তির স্মরণ।
চারটি অপ্রমেয় বা ব্রহ্মবিহার ও ধ্যানের বিষয় হলো-
১. মৈত্রী।
২. করুণা।
৩. মুদিতা।
৪. উপেক্ষা।
মৈত্রী হচ্ছে নিষ্কাম নিরাসক্ত প্রেম, করুণা জীব জগতের প্রতি একাগ্রতাজাত অনুভূতি, মুদিতা হচ্ছে অচঞ্চল স্থির আনন্দ এবং উপেক্ষা মনের সেই প্রশান্ত সাম্য অবস্থা যখন সুখ দু:খ সব সমান বলে মনে হয়। ধ্যানের অরূপ বিষয় হচ্ছে-
১. অসীম বিস্তার ক্ষেত্র (আকাশনন্তায়ন)।
২. চেতনার অনন্তবোধ ক্ষেত্র (বিজ্ঞানানন্তায়তন)।
৩. নির্বস্তুতার ক্ষেত্র (আকিঞ্চনায়তন)।
৪. অনুভূতি নয় অনানুভূতিও নয় সেইরূপ ক্ষেত্র (নৈবসংজ্হানাসংঙ্গায়তন)।
চল্লিশ প্রকার শমথ ধ্যানের বিষয় থাকলেও সবগুলো বিষয়ের উপর ধ্যান করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। উপরোক্ত বিষয়গুলোর মধ্য থেকে ধ্যানী নিজের উপযোগী একটি বিষয় ধ্যানের জন্য নির্বাচন করে থাকেন। সাধারণত ধ্যানী আচার্য বা শিক্ষকের নিকট ধ্যানের বিষয়বস্তু বা কর্মস্থান প্রার্থনা করে থাকেন।
শমথ মানুষের চেতন মনের বিকারসমূহ দূর করে একে শান্ত করে, কিন্তু অচেতন বা অর্ধচেতন মনে সঞ্চিত বিকারসমূহ উৎপাটন করতে পারে না। অপরদিকে বিপশ্যনা চেতন অচেতন উভয় মনের বিকারসমূহের মূল উৎপাটন করে ভবিষ্যতে তা সৃষ্টির পথ রুদ্ধ করতে পারে।
তখন আচার্য সংশ্লিষ্ট ধ্যানীর চরিত্র অনুযায়ী ধ্যানের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দিয়ে থাকেন। আচার্যের অভাবে যদি কেউ বইপুস্তক হতে নিয়ম কানুন দেখে নিজে নিজে ধ্যান করতে চায়, তাহলে স্বীয় চরিত্রানুযায়ী কোন একটি অথবা সকল চরিত্রের জন্য নির্দিষ্ট কোন একট ধ্যেয় বিষয়বস্তু গ্রহণ করে শুদ্ধও পবিত্র মনে ধ্যান আরম্ভ করতে পারে।
এই বিষয়ে আরো বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে শমথ ধ্যানের বিষয়গুলোর মধ্যে থেকে সকল চরিত্রের মানুষের উপযোগী বা কার্যকর ধ্যান পদ্ধতি-আনাপান স্মৃতি সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হবে।
অন্য দিকে বিপশ্যনা বা বিদর্শন ধ্যান হলো ধারণার বশবর্তী না হয়ে বস্তুর যথার্থভাবে অণুদর্শন। বিশেষভাবে দর্শনই বিদর্শন বা বিপশ্যনা। এই বিশেষভাবে দর্শন হচ্ছে পঞ্চস্কন্ধ বা উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত জীবনকে জানা। যে ধ্যান চিত্তের ক্লেশসমূহকে সমূলে বিনাশ করে প্রজ্ঞা উৎপাদন করে তাই বিপশ্যনা।
সংক্ষেপে বিপশ্যনা হচ্ছে জীবনদর্শন, জীবন গবেষণা ও সমালোচনা করে জীবনের প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কার করা। নিজের সাড়ে তিনহাত দেহমনে অতীত ভবিষ্যত ব্যতিরেকে শুধু বর্তমানের প্রতিমুহূর্তে যে যে সংবেদনা ও অনুভূতি দেখা দিচ্ছে সমতায় অবস্থান করে এদেরকে সঠিকভাবে জানার কাজ হচ্ছে বিপশ্যনা।
শমথ ও বিপশ্যনার মূল পার্থক্য হলো, শমথ ধ্যানের বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট থাকে, অন্যদিকে বিপশ্যনার কোন নির্দিষ্ট বিষয় থাকে না এবং ধ্যানীকে উপস্থিত সকল বিষয়ের প্রতি সদা জাগ্রত থাকতে হয়। কারণ তার সমস্ত ইন্দ্রিয় যেমন চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক ও মন প্রত্যেকটি যে কোন সময় সক্রিয় হতে পারে।
শমথ মানুষের চেতন মনের বিকারসমূহ দূর করে একে শান্ত করে, কিন্তু অচেতন বা অর্ধচেতন মনে সঞ্চিত বিকারসমূহ উৎপাটন করতে পারে না। অপরদিকে বিপশ্যনা চেতন অচেতন উভয় মনের বিকারসমূহের মূল উৎপাটন করে ভবিষ্যতে তা সৃষ্টির পথ রুদ্ধ করতে পারে।
এর অনুশীলনের জন্য কোন ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক আচার অনুষ্ঠান পালনেও প্রয়োজন হয় না। তবে কেউ যে কয়দিন বিপশ্যনা শিবিরে ধ্যান চর্চায় রত থাকবে-সে কয়দিন প্রাণী হত্যা, চুরি, মিথ্যা ভাষণ, ব্যাভিচার ও মাদক সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।
শমথ হলো লৌকিক আর বিপশ্যনা হলো লোকোত্তর ধ্যান। শমথ ধ্যান দ্বারা বিমুক্তি লাভ হয় না, তবে বিমুক্তি লাভ হয় না, তবে বিমুক্তি সাধনার ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। এ কারণে বিপশ্যনার প্রস্তুতিমূলক বা প্রাথমিক স্তর বা ধাপ হিসেবে শমথ ধ্যানকে গ্রহণ করা হয়।
কারণ শমথ ধ্যানের মাধ্যমে অস্থির চিত্তকে প্রথমত শান্ত করা হয়, তারপর বিপশ্যনার মাধ্যমে আত্মবিশ্লেষণ বা নিরীক্ষণ করাজ শুরু করা হয়। বিপশ্যনার অপর নাম প্রজ্ঞা ভাবনা। কারণ বিপশ্যনার মাধ্যমে প্রজ্ঞার উৎপত্তি হয় এবং প্রজ্ঞার উৎপত্তি হলে ক্লেশসমূহ উৎপাটিত হয়ে মানুষ নির্মল সুখ অনুভব করে। তাই বলা হয় ধ্যান ছাড়া জ্ঞান হয় না; আর জ্ঞান ছাড়া মুক্তি নেই।
শমথ ধ্যান এ উপমহাদেশে দীর্ঘদিন থেকে প্রচলিত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় গুরু বা আচার্যদের মধ্যে এসবের কোন না কোন পদ্ধতির চর্চা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বিপশ্যনা ধ্যানের আবিস্কারক গৌতম বুদ্ধ।
তিনি নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও গবেষণার দ্বারা এটি উদ্ভাবন করেন এবং জনকল্যাণে তা প্রচার করেন। বিপশ্যনা কোন বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়।
এর অনুশীলনের জন্য কোন ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক আচার অনুষ্ঠান পালনেও প্রয়োজন হয় না। তবে কেউ যে কয়দিন বিপশ্যনা শিবিরে ধ্যান চর্চায় রত থাকবে-সে কয়দিন প্রাণী হত্যা, চুরি, মিথ্যা ভাষণ, ব্যাভিচার ও মাদক সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।
জাগতিক ও অন্যান্য যাবতীয় কাজকর্ম সে কয়দিন স্থগিত রাখতে হয়। মৌনতা অবলম্বন করে আচার্য বা শিক্ষকের নির্দেনাসুযায়ী দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বিপশ্যনা অনুশীলন করতে হয়।
………………………….
মনুষ্যত্ব বিকাশে ধ্যান: প্রফেসর জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া