ভবঘুরেকথা
সাধু গুরু পাগল বৈষ্ণব গোঁসাই

-দ্বীনো দাস

আমি একটা প্রশ্ন সাধুগুরুদের কাছে রেখেছিলাম, নিচে সেটা তুলে ধরলাম। অনেকেই অনেক সুন্দর মন্তব্য করেছেন, আমি কৃতজ্ঞ সকলের কাছে। এবার আমার নিজের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা তুলে ধরবো, ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

প্রশ্ন:
সাধু (বাস্তব বস্তুবাদী) – সরে যা, দূর হয়ে যা চোখের সমনে হতে, বদমাইস, লম্পট, কর্মচোর, ধর্মচোর, নাফারমান, ব্যভিচারী, অবৈধ, গুরু মারা মোনাফেক, লোভী, চতুর, শিরককারী, দূরূহ – ফাকে থাক, ধর্ম মারাতে আইছে।।

সাধু (ভাববাদী) – আহ বেটা আইছো কতো কষ্ট করে আইছো, বসো বসো একটু জিরিয়ে নাও। একটু চাল জল করে নাও, তারপর বাছা এবার একটু ভাল করে তামুক সাজোতো দিকি, টানি।

কে উত্তম?

আমার অভিজ্ঞতা-

বেশকিছু দিন আগের কথা আমি এক বাস্তব বস্তুবাদী সাধুর সাথে প্রায় মাঝে মাঝে সঙ্গ করতাম, আমি তাকে গভীরভাবে চেনার চেষ্টা করতা। তার ভাবটা ছিল রাগী, তার সামনে তার ভক্তরা সহজে আসতো না। কারণ তার মুখের ভাষা ছিল ভীষণ কটু।

কিন্তু লক্ষ করে দেখলাম প্রতিটা কথা বা তার আচরণ বাস্তবমুখি এবং কল্যাণ নিহত। একদা আমি বসে আছি তার সঙ্গে। গুটি কয়েক ভক্তরা একটু দূরে বসে আছে। আমাদের আলোচনা চলছে আকার আর নিরাকার নিয়ে। বস্তু আর ভাব নিয়ে। উনি সাঁইজির একটা পদ বললেন তার কিছু তুলে ধরলাম-

সেই প্রমাণ এখানে মানি
অদেখারে দেখে কেমনে চিনি,
যদি চিনা যায়, তার বিধি হয়
আরেক জনকে সত্য বিশ্বাস করে।

নবুয়ত বিলায়েত কারে বলা যায়
যে ভজে মুর্শিদ সেই জানতে পায়,
লালন ফকির কয়, আরেক ধাঁধা হয়
বস্তু বিনে নামে পেট কৈ ভরে।।

তখন আমি কিছু যুক্তি দিলাম নিরাকারের, সাথে সাথে তিনি বললেন-

বস্তু না হলে পরিচয়
চিনি বওয়া বলদের ন্যায়,
বয় ভাড়া লজ্জত না পায়
দুষ্টু তেমনি প্রায়।

বস্তু হাসেল হলে পরে
আকবারি হজ্ব হয় তাহারে,
লালন বলে সাক্ষাতে সেজদা
করে বন্দেগী আদায়।।

সাধুগুরু বললেন এইখানেই দাঁড়াতে হবে সাক্ষাতে সেজদা। পরে বুঝলাম কি সেই সাক্ষাত সেজদা আর বস্তু। তিনি বললেন, আচ্ছা নুর কি নিরাকার? না সেও বস্তু আকার, বস্তু বিনে নুরের কি প্রমাণ আছে?

ঠিক এই কথা চলছে এমন সময় তার দুইজন ভক্ত আসলো, সঙ্গে কিছু ফল জাতিয় খাবার নিয়ে। যথারীতি তারা ‘জয়গুরু সাঁইজি’ দিয়ে ভক্তি করতে গেলো তক্ষুণি তিনি অগ্নিশর্মা। সে এক বিরাট ভয়ংকর রূপ ধরলেন।

উপরে যে ভাষাগুলো লিখেছি বস্তুবাদী সাধুর হবহু এই ভাষাগুলো ঐ ভক্ত দুজনকে বললেন। আমিতো থ হয়ে বসে আছি। তিনি এও বললেন, চলে যা নইলে কাসার এই বদনা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিবো। আসরে বসা ভক্তরা তাড়াতাড়ি উঠে ঐ দুইজনকে সরিয়ে নিয়ে বিদায় করে দিলো।

সবাই আমরা নিশ্চুপ। সাধু রেগে লাল হয়ে আছে, কোন কথা নাই। ভাল করে লক্ষ্য করলাম সাধু প্রায় ৩০ মিনিট খুব গোপনে দমের কাজ করলেন এবং ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেলেন। এবার উনি চা করতে বললেন, চা আসলো। সবাই চা খাচ্ছি শান্ত ফুরফুরে মেজাজে।

এবার চললাম ভাববাদী সাধুগুরুর নিকটে। বসে আছি সাধুগুরুর নিকটে। অনেকে আসছে, যাচ্ছে বসছে, ভক্তি দিচ্ছে, তামাক সাজা হচ্ছে। ভক্তিমূলক ভাবগান হচ্ছে। সাধুগুরু অবিচল বসে আছেন মাঝে মাঝে ভাবের দেশের কথা হচ্ছে।

আমি বললাম একটা কথা জানতে চাই তারপর আমি উঠবো। উনি বললেন, বলো কি জানতে চাও?

আমি বললাম, ওদেরকে এভাবে না বকে তাড়িয়ে না দিলে কি পারতেন না বুঝিয়ে বলতে?

তিনি হাসলেন, কিছুই বলছেন না। অনেকক্ষণ পর বললেন, তোমার মা বাবা কি চায় তুমি লেখাপড়ায় ফেল করো?

আমি বললাম, নাহ্।

ঠিক তেমনিই আমার শূন্য গোয়াল ভাল। কিন্তু দুষ্ট এঁড়ের দরকার নাই। উনি বললেন, শোন আমার শেষ কথা, নকল করে পাশ করা সার্টিফিকেট ধারী ছাত্র বা সন্তান আমার দরকার নাই।

আমি বললাম, বাহ্ সাধুগুরু জয়হোক জয়হোক আপনার চরণে, জয়হোক বাস্তব বস্তুবাদী সাধুগুরুর।

এবার চললাম ভাববাদী সাধুগুরুর নিকটে। বসে আছি সাধুগুরুর নিকটে। অনেকে আসছে, যাচ্ছে বসছে, ভক্তি দিচ্ছে, তামাক সাজা হচ্ছে। ভক্তিমূলক ভাবগান হচ্ছে। সাধুগুরু অবিচল বসে আছেন মাঝে মাঝে ভাবের দেশের কথা হচ্ছে।

জানি ওদের সাধন ভোজন কর্ম কিছুই নাই। সাধুসঙ্গ করতে করতে যদি কারো কোনদিন চৈতন্য জ্ঞান উদয় হয় ঐদিন সে নিজেই টের পাবে তার কি করা উচিত। সাধুর তামাক আমরা অসাধুরা খাচ্ছি। সে তখন তামুক ছেড়ে দেবে আর আত্মা অনুসন্ধানে রত হবে।

হঠাৎ অনেক দূর হতে কজন লোক আসলো, সাধুগুরু তাদেরকে খুবই যত্ন করে বসতে দিলেন। ঠিক উপরে ভাববাদী সাধু যে ভাবে বললেন ওভাবেই।

উনারা বসলো, চালপানি সেবা করলো তারপর তামাক সাঝলো, তামাক নিলো, এবার বসে আলাপ শুরু হলো। আলাপ চলছে আমি শুনছি। শেষে যা বুঝলাম ওরা সবাই গৃহবাসী সংসারে ব্যস্ত মানুষ। জীব জগৎ নিয়ে আছে। বস্তু জগতের কোনকিছুই সারা হয়নি। তারা এসেছে ভাববাদীর কাছে ভাব শিখতে। যাহোক একবেলা পর ওরা চলে গেলো।

আর লক্ষ-কোটিতে দুই একটা ভক্ত মেলে বাবা। দুই একজনই প্রকৃত সাধু হয়। তিনি বললেন, ‘কাটার মুখ কেউ চুকা করে দেই না, কাটা নিজেই জন্ম থেকে চুকা হয়েই আসে।’

রাতে যখন আমরা নিরিবিলি হয়েছি তখন সাধুগুরুকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা এই যে মানুষ আপনার কাছে আসছে যাচ্ছে তারাতো ভাবজগতের কোনই কাজ করছে না। সবাই দেখছি বাহ্য আলাপে ব্যস্ত আর তামুক খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত।

আপনি ওদের নিষেধ করেন না কেনো এখানে আসতে? আপনারতো ওদের না হলেও চলে? বরং আপনার সাধনার সময় নষ্ট হয়।

তিনি বললেন, আহা বাবা ওদেরকে তাড়িয়ে দিলে ওরা আরো বিপথে চলে যাবে। তামুক খাচ্ছে নিষেধ করি না কারণ তামুকে সাময়িক কিছু সময়ের জন্য ওরা দুনিয়াদারীর মোহ টান হতে দূরে থাকে। আর সমাজে গর্হিত অন্যায় কাজ হতে দূরে থাকে।

জানি ওদের সাধন ভোজন কর্ম কিছুই নাই। সাধুসঙ্গ করতে করতে যদি কারো কোনদিন চৈতন্য জ্ঞান উদয় হয় ঐদিন সে নিজেই টের পাবে তার কি করা উচিত। সাধুর তামাক আমরা অসাধুরা খাচ্ছি। সে তখন তামুক ছেড়ে দেবে আর আত্মা অনুসন্ধানে রত হবে।

আর লক্ষ-কোটিতে দুই একটা ভক্ত মেলে বাবা। দুই একজনই প্রকৃত সাধু হয়। তিনি বললেন, ‘কাটার মুখ কেউ চুকা করে দেই না, কাটা নিজেই জন্ম থেকে চুকা হয়েই আসে।’

কোটিতে গুটি হয় বাবা। তাই প্রেম দিয়েই অভক্তকে মানুষে রূপান্তর করে তারপর তাকে বাস্তবদী বস্তুর সন্ধানে সেই স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া, এটাইতো আমার কাজ।

বেশ আমার উত্তর আমি পেয়ে গেলাম, এবার আমি উঠবো, তাকে ভক্তি দিলাম। জয়হোক আপনার চরণে, জয়হোক ভাববাদী সাধুগুরুর।

এই হলো আমার বাস্তব জীবনের দুটি ঘটনার রূপ বললাম আমার অনুভূতিগুলো আপনাদের করে নিবেন এই আশা করি। ভুল হলে ক্ষমা করবেন।

………..
বি.দ্র.
আমার এই লেখা কিছু ইতিহাস থেকে নেওয়া কিছু সংগৃহীত, কিছু সৎসঙ্গ করে সাধুগুরুদের কাছ থেকে নেওয়া ও আমার মুর্শিদ কেবলা ফকির দুর্লভ সাঁইজি হতে জ্ঞান প্রাপ্ত। কিছু নিজের ছোট ছোট ভাব থেকে লেখা। লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।। আলেক সাঁই। জয়গুরু।।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………….
আরো পড়ুন:
অবশ জ্ঞান চৈতন্য বা লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া
ঈশ্বর প্রেমিক ও ধৈর্যশীল ভিখারী
সুখ দুঃখের ভব সংসার
কর্ম, কর্মফল তার ভোগ ও মায়া
প্রলয়-পূনঃউত্থান-দ্বীনের বিচার

ভক্তি-সংসার-কর্ম

………………………..
আরো পড়ুন:
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: এক
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: দুই
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: তিন


লালন ফকিরের নববিধান: এক
লালন ফকিরের নববিধান: দুই

লালন ফকিরের নববিধান: তিন

লালন সাঁইজির খোঁজে: এক
লালন সাঁইজির খোঁজে: দুই


মহাত্মা লালন সাঁইজির দোলপূর্ণিমা
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির স্মরণে বিশ্ব লালন দিবস
লালন গানের বাজার বেড়েছে গুরুবাদ গুরুত্ব পায়নি
লালন আখড়ায় মেলা নয় হোক সাধুসঙ্গ
কে বলে রে আমি আমি
ফকির লালন সাঁই
ফকির লালনের ফকিরি
ফকির লালন সাঁই


বিশ্ববাঙালি লালন শাহ্
ফকির লালন সাঁইজির শ্রীরূপ
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
বিকৃত হচ্ছে লালনের বাণী?

লালন অক্ষ কিংবা দ্রাঘিমা বিচ্ছিন্ন এক নক্ষত্র

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!