ভবঘুরেকথা
ফকির লালন বাউল সাধুসঙ্গ

লালন ফকিরের নববিধান: তিন

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

ফকির লালন সাঁইজি সকলের জন্যই বিধান দিয়ে গেছেন। যেমন যার জ্ঞান, তার তেমন প্রাপ্তি। তবে এর গুপ্তভেদ জানতে গেলে অর্থাৎ অন্তর্নিহিত অর্থ জানতে গেলে একজন উপযুক্ত পথপ্রদর্শক প্রয়োজন। সাধনপথে এই পথপ্রদর্শক ‘গুরু’ নামে পরিচিত।

সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থী যে মেধারই হোক না কেনো, অর্থ-বৃত্ত থাকলে তারজন্য একজন না একজন শিক্ষক ঠিকই জোগার করে ফেলা যায়। আবার একজন শিক্ষককে পছন্দ না হলে আরেকজন শিক্ষক বদলেও নেয়া যায়। বা একসাথে বহু শিক্ষকও রাখা যায়। কিন্তু সাধনপথ এ নিয়মে চলে না। এখানে একজন উপযুক্ত গুরুর সন্ধান পেতে কারো কারো কয়েক জনমও লেগে যায়।

আর গুরু পেলেই তিনি যে শিষ্য করে নেবেনই তাও জোর দিয়ে বলা যায় না। আবার গুরুকে রাজি করে দীক্ষা নিলেও যদি গুরুভক্তি না থাকে-পূর্ণ সমর্পণভাব না জাগে ; তাহলে গুরুর কাছ থেকেও অজান খবর জানার পথের হদিস পাওয়া যায় না।

সাধারণ পড়াশোনায় যেমন বই-খাতা-কাগজ-কলম ইত্যাদিসহ নামী-দামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের প্রয়োজন হয়। সাধনপথে এ সবের পরিবর্তে লাগে ভক্তি-শ্রদ্ধা-বিনয়-আদব-সমপর্ণভাব অর্থাৎ প্রেম। সাধারণ পাঠে যেমন পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে হয় পরীক্ষা পাসের আশায়। অন্যদিকে প্রেম-ভক্তিভাব না থাকলে অর্থাৎ অপরের কল্যাণের কথা বা অপরের জন্য বাঁচতে না শিখতে পারলে সাধনপথে প্রাপ্তি কম।

সাধনপথের পরীক্ষা বড়ই কঠিন। গুরু বিরূপ হলে সর্বনাশ। কথায় বলে, ‘দেবতা বিরূপ হলে মাপ পাওয়া যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। কিন্তু গুরু বিরূপ হলে ক্ষমা নাই।’ তাই সাধককে সর্বক্ষণ স্মরণে ও স্বপনে গুরুবাক্যের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হয়। কোনো সাধক গুরুবাক্য লঙ্ঘন করলে ; গুরু যা সিদ্ধান্ত নিবেন সাধককে তাই মেনে নিতে হয়।

সাধনপথে গুরুভক্তি ও গুরুসেবা অত্যাবশ্যক। তবে যারা আমার মতো এখনো গুরুর সন্ধান পাননি। বা গুরুর সন্ধানে নামেনই নি। বা গুরুর কথা চিন্তাতেও আনেন নি তাদেরকেও নিরাশ করেন নি ফকির লালন। কেবল দীক্ষাধারীরাদের জন্যই তিনি তাঁর বিধান দিয়ে গেছেন বিষয়টা তেমন নয়। কি অগতির গতি-কৃপাসিন্ধু।

তবে দীক্ষাধারী ব্যতিরেকে বাকিদের জন্য যে জ্ঞান ব্যাক্ত আছে, তা সুন্দর জীবনের জন্য-সুন্দর সমাজের জন্য-সুন্দর মানুষের জন্য। আর দীক্ষাধারী বা যারা এই জ্ঞানের গভীর তত্ত্ব বোঝবার ক্ষমতা অর্জন করে তাদের জন্য আছে সীমাহীন প্রেমের বারতা। সে যাক। সাধারণ জ্ঞানে অর্থাৎ ফকির লালনের পদের শাব্দিক ব্যাখ্যা যা সাধারণের জন্য নির্হিত এ ধারাবাহিক লেখা কেবল তাকে নির্ভর করে।

পদের অন্তর্নিহিত অর্থের ভেদ অনুসন্ধান এই লেখার কর্ম্ম নয়। এ লেখা কেবলই শাব্দিক অর্থের ব্যাখ্যা করার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। যদি নবীন অনুসন্ধানী চিত্তের কিছুটা তৃষ্ণা মেটে তবে এই লেখার সার্থকতা পাবে। ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন-

সে রূপ দেখবি যদি নিরবধি
সরল হয়ে থাক,
আয় না চলে ঘোমটা ফেলে
নয়ন ভরে দেখ।।

সরলভাবে যে তাকাবে
অমনি সে রূপ দেখতে পাবে,
রূপেতে রূপ মিশে যাবে
ঢাকনি দিয়ে ঢাক।।

চাতক পাখির এমনি ধারা
অন্য বারি খায় না তারা,
প্রাণ থাকিতে জ্যান্তে মরা
ঐরূপ ডালে বসে ডাক।।

ডাকতে ডাকতে রাগ ধরিবে
হৃদ কমল বিকশিত হবে,
লালন বলে সেই কমলে
হবে মধুর চাক।।

ফকির লালনের নববিধান সাধারণের জন্য-

  • অনন্ত সময় ধরে পরমের দরশন করতে গেলে, গুরুর সান্নিধ্য পেতে গেলে, মনের মানুষ-অচিন মানুষ-অধর মানুষ-সহজ মানুষের রূপ দরশন করতে গেলে স্বভাবে আনতে হবে ‘সরলতা’।
  • নাচতে গেলে যেমন ঘোমটা দিলে চলে না। তেমনি সাধনায় লীন হতে গেলে স্বভাবে ‘ইতস্তত’ ভাব থাকলেও কাজ হবে না।
  • যা করতে হবে তা পূর্ণ বিশ্বাস-ভক্তি-প্রেম নিয়ে করতে হবে।
  • পরমের বা নিজের দরশন করতে গেলে অর্থাৎ আত্মজ্ঞান বা স্বরূপের দরশন পেতে গেলে জীবন যাপন হতে হবে সরল-সহজ।
  • মনের সর্ববাঁধা-প্রতিবন্ধকতা-কুপ্রবৃত্তি ত্যাগ করে; বাঁধাহীন চিত্তে দেখবার আকাঙ্খা জাগ্রত করতে হবে।
  • দেখবার দৃষ্টি হতে হবে প্রেমময়।
  • নয়নে থাকতে হবে সরলতা।

………………..

  • সাধকের স্বভাবে যখন বিনয়-নমনীয়তা-ভক্তি-শ্রদ্ধা সর্বোপরি প্রেমভাব জাগবে। নয়নে যখন সেই প্রেম সেই সরলতা দৃষ্ট হবে। তখন সেই রূপ আপনিই দৃশ্যমান হবে।
  • সহজ হলেই সহজ মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে।
  • সহজ মানুষের দরশন পেতে গেলে নিজেই সহজ মানুষ হতে হবে; এর বিকল্প নেই।
  • সেই রূপ যখন দৃশ্যমান হবে অর্থাৎ নিজেকে নিজে সাধক চিনতে পারবে। তখন তা দিয়ে যাতে অহং তৈরি না হয়। সেদিকে সজাগ থাকতে হবে।
  • আত্মজ্ঞান প্রাপ্তিতে যদি করো মনে অহং তৈরি হয় তাহলে তার সাধনা সেখানেই সমাপ্তি।
  • তাই স্বরূপের দরশন হলে তা নিজের মধ্যেই রাখতে হবে।
  • অজান খবর সাধককে অজানই রাখতে হয়।
  • অজান খবর যথাতথা বলার বিধান নাই। প্রত্যেককেই তার নিজে প্রাপ্য হয়ে, তা জেনে নিতে হয়।

………………..

  • সাধনায় সাধককে চাতক পাখির মতো হতে হয়।
  • চাতক যেমন বৃষ্টির পানি ভিন্ন অন্যকিছু পান করে না। তেমনি সাধককেও কেবল পরমপ্রাপ্তির দিকেই দৃষ্টি রাখতে হয়।
  • বেঁচে থেকেও জ্যান্ত মরা অর্থাৎ জিন্দামরা বেশ নিতে হয়।
  • বেঁচে থেকে যে মৃত্যুকাল ভোগ করে যায়; তাকে আর মৃত্যুর পরবর্তী চিন্তা করতে হয় না।
  • মুক্তি বা নির্বাণ পেতে চাইলে। চাতক যেমন আকাশের পানে বৃষ্টির অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে। তেমনি সাধককে একমুখি হতে হয়।
  • দুই নৌকায় পা দিলেই বিপদ। এক ধ্যান-এক জ্ঞান হলেই তাকে মিলবে। আর তার জন্য চাই বেঁচে থেকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণের সাহস।

………………..

  • ধ্যানে-জ্ঞানে তাকে স্মরণ করতে থাকলেই কেবল সে হৃদয়ে উদয় হবে।
  • পরমকে বা নিজেকে স্মরণ করে যেতে হবে অবিরত।
  • প্রকট না হওয়া পর্যন্ত ডেকেই যেতে হবে। অর্থাৎ তাঁর স্মরণেই থাকতে হবে প্রতি দমে।
  • দম সাধনায় অর্থাৎ প্রতি নি:শ্বাসেই স্মরণে রাখতে হবে। সহজ মানুষ পেতে গেলে সহজ মানুষ হতে হবে। আর এই সহজ মানুষ হওয়ার চর্চা যেন এক নি:শ্বাসের জন্যও নড়চড় না হয়।
  • চাতকের মতো সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হবে। আর এই সিদ্ধান্তে অটল-অবিচল থাকতে পারলেই সহজ মানুষ দরশনের পথ উন্মুক্ত হবে।
  • শুদ্ধতার চর্চা না হলে কিছুই হবে না। সেই রূপ দেখতে গেলে শুদ্ধতার চর্চাই একমাত্র পথ।
  • যে কাজে মনের পবিত্রতা নষ্ট হয়-মনে পাপের জন্ম দেয়-চিত্তে অশান্তি আসে-অপরে কষ্ট পায় সেই সকল প্রকার কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে সরল স্বভাব ধারণ করতে হবে। নয়নে প্রেমভাব নিয়ে তার সন্ধান করতে হবে তবেই সেই অধরা ধরা দেবে।

সর্বপোরি বলা যায়, সহজ মানুষ হয়ে সহজের সাধনা করলেই সহজ মানুষের দরশন পাওয়া যাবে। আর যদি সেই রূপ দরশন হয় তাহলেও অহমিকায় পরলে তা বিফলে যাবে। তাই প্রতি দমেই তাঁর স্মরণ করে যাওয়াই সাধকের কর্ম। প্রাপ্তির জন্য সাধন নয়। সাধন হলো ভক্তি-প্রেমভাব উদয় করা। পূর্ণ সমর্পণভাব জাগ্রত করা। আর এরূপে এগিয়ে যেতে পারলেই তবে হবে তার দরশন। অনন্ত দরশন।

জয়গুরু

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই “সাধু পঞ্জিকা” দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………..
আরো পড়ুন:
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: এক
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: দুই
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: তিন


লালন ফকিরের নববিধান: এক
লালন ফকিরের নববিধান: দুই

লালন ফকিরের নববিধান: তিন

লালন সাঁইজির খোঁজে: এক
লালন সাঁইজির খোঁজে: দুই


মহাত্মা লালন সাঁইজির দোলপূর্ণিমা
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির স্মরণে বিশ্ব লালন দিবস
লালন গানের বাজার বেড়েছে গুরুবাদ গুরুত্ব পায়নি
লালন আখড়ায় মেলা নয় হোক সাধুসঙ্গ
কে বলে রে আমি আমি
ফকির লালন সাঁই
ফকির লালনের ফকিরি
ফকির লালন সাঁই


বিশ্ববাঙালি লালন শাহ্
ফকির লালন সাঁইজির শ্রীরূপ
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
বিকৃত হচ্ছে লালনের বাণী?

লালন অক্ষ কিংবা দ্রাঘিমা বিচ্ছিন্ন এক নক্ষত্র

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!