ভবঘুরেকথা
পরকাল চুরাশির ফেরে জন্মান্তর প্রলয়

-দ্বীনো দাস

মৃত্যুর সময় প্রত্যেক ব্যক্তিই তাহার সকল শক্তিকে একটি কেন্দ্রে একত্রিত করিয়া প্রাণবীজে বা সূক্ষ্ম শরীরে মহা এক অপ্রাকৃত ভূমি বা ভাব লোকে অবস্থান করে।

‘আকৃতি তখন প্রকৃতির রূপ ধারণ করে।’

সূক্ষ্ম দেহের অবচেতন স্তরে জন্ম-জন্ম সঞ্চিত অসংখ্য সংস্কার বা কর্মের রূপ বীজাকারে সুপ্ত থাকে। মানুষের চরিত্রে যাহা বাস্তব বা নগদ আকারে প্রকাশিত হয় তা ঐ সুপ্ত সংস্কাররূপ বীজ।

Re-surrection/Re-rise

অনন্তকালব্যাপী জন্ম-মৃত্যুর চক্রের পরিক্রমার ভেতর দিয়ে সকল আত্মাকে উন্নততর স্তর অতিক্রম করতে হবে- ‘ইন্নানিল্লাহে ওয়া ইন্নানিল্লাহের রাজেউন।’

সাধারণ মানুষের সূক্ষ্মদেহ স্ব-লোক পর্যন্ত থাকে। মহলোকে এসে সকলেরই দেহ নষ্ট হয়ে যায়। ধুম মাত্র থাকে। ঐ বায়ুময় দেহ অবলম্বন করে উর্দ্ধদিকে যাওয়া যায়। এই মহালোকে দেহ পতনের সময়ও যাদের ভোগের কিঞ্চিৎ মাত্র ইচ্ছা থাকে, তাদের সেখান হতে ভোগের পতন হয়।

কিন্তু ভোগায়ত্ম দেহ স্থূল দেহ পায় না বলে একেবারে ভুলোকে এসে দেহ ধারণ করতে হয়। যাদের মহলোকেও ভোগের কোন কারণ থাকে না। তারা ক্রমমুক্তির দিকে এগিয়ে যায় ও তাদের সূক্ষ্মদৃষ্টি ক্রমশ বর্ধিত হয়।

ব্রক্ষ জীব হলে তারও ভুল হয়ে যায়। কারণ অনেক বার আবর্তনের ঘূর্ণিপাকে বা চক্রে এসে স্বরূপ চাপা বা ঢাকা পড়ে যায়। তাই তখন নিজেকে ভুলে যায়। সে ভুলে যায় তার নিজ স্বত্ব কারণ সৃষ্টি স্রষ্টার সত্তে সত্তশালী, সৃষ্টি ভুলে যায় সত্ত। ভোক্তা দেহানুগত হয়ে যায়।

মূল জায়গায় ফিরে যায়- প্রলয়, রায়, পুনঃউণ্থান। খুব স্থির ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় জগতের ও জীবনের প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষয় হতে থাকে। প্রতিনিয়ত দুনিয়ায় জীবের বিনাশ বা ক্ষয় হচ্ছে; উদ্ভিদ জ্বালানি হচ্ছে এভাবে জলজ, খেচর, উভচর, স্থল সব জীবের ক্ষয় হচ্ছে।

উন্নততর জীব মানুষ যার কিনা হুস নাই। তার (বেভুল) স্বত্ব, সেতো স্বত্বশালী তার ও ক্ষয়-নিঃশ্বাস আসা যাওয়ার ভেতর দিয়ে তার পরমায়ু ক্রমেই কমে আসছে, এভাবে নানা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষয় হচ্ছে।

হচ্ছেটা কেন? কারণ জীবন চলার পথে চলন্ত অনিত্য যা কিনা অনৈতিকতার আসক্তি। যা অনিত্য বাসনা তাকে আকড়ে ধরার কারণে, ওটাকে মূখ্য মনে করার কারণে, জীবনের এই গোলক চক্রের পথ পাড়ি দিয়ে এসে আজ জীবের অনেক কিছুই মনে নেই।

‘এখানেই সেই মহা সূত্র -দেখা বস্তু অদৃশ্য হয়েছে।’

ফেলে আসা কর্মের রূপ যা একদিন সামনে ছিল সেই সব স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে সব ঢেকে গেছে। তাও ঐ অনিত্য বাসনার কারণে মন বা স্মৃতির খাতায় (কর্মফল) ময়লার আবরন বা মায়া জালের আবরনে ঢাকা পড়ে আছে। তাইতো স্মৃতির পথে অনেক ঘটনায় মনে পড়েনা। আসলে ব্যাপারটা এরকম অনিত্য যা কিনা নিত্য নয়। এটা আমার ওটা আমার আসলে কোনটাই আমার না। এটাইতো জীব বোঝেনা এটাকেই অনিত্য বলে।

এই অনিত্য সম্পূর্ন ভুল এবং মিথ্যা। যাকে আকড়ে ধরলে শুধু অধগতিই হয়, নরকে পতিতো হতে হয়।ঠিক সেই কারণে জীব আজ বিস্মৃতির অতল গহিনে ডুবে সব কিছুই ভুলে বসে আছে। এখানে বলা যায় ব্রক্ষ আবরিত অবর্তা হতে হতেই জীবে সাকারে রূপ নিয়েছেন আর আবারন নাশ হলেই জীব ব্রক্ষত্ব লাভ করতে পারে।

ব্রক্ষ জীব হলে তারও ভুল হয়ে যায়। কারণ অনেক বার আবর্তনের ঘূর্ণিপাকে বা চক্রে এসে স্বরূপ চাপা বা ঢাকা পড়ে যায়। তাই তখন নিজেকে ভুলে যায়। সে ভুলে যায় তার নিজ স্বত্ব কারণ সৃষ্টি স্রষ্টার সত্তে সত্তশালী, সৃষ্টি ভুলে যায় সত্ত। ভোক্তা দেহানুগত হয়ে যায়।

আর নিত্য বাসনা-“জাত থেকে সিফাত সৃষ্টি (রুহ) যখন হয় তখন তারই লজ্জার রূপ অপলকে চেয়েছিল এক মহা আনন্দ তৃপ্তি সহকারে এবং অনেক কিছু বলা কওয়া হয়েছিল-ঐ রূপ নকসা, নিশানা নিয়ে সেই বলা কওয়া মাফিক কর্ম করাকেই নিত্য বলে। সাঁইজি লালন ফকির বললেন অনিত্য বাসনা ছাড়-

নিত্য ভেবে নিত্য থাক লীলা
বসে যেও নাকো।।
সাঁইজি লালন ফকির

লিলা অনিত্য, এই নিত্য অনিত্যের খেলায়-অনিত্যকে যে আশ্রয় করবে তার হবে ঐ দশা, সব ভুলে বসে থাকবে। আর নিত্য- সদাআন্দময়, সেতো তার ঐ রূপ নকসা নিশানা নিয়ে মহা আনন্দে নৃত্য করবে। মহা সত্য নিত্য আর মিথ্যা অনিত্য।

আবার ঐ নিত্য জীবের সর্ব তেতনা থাকা সত্বেও শারিরিক বা স্থূল দেহের কিছু ক্ষয় হবেই। তা না হলে মরণশীল বা মৃত্যুর আওতাভুক্ত হতনা কোন জীবন।
জীবের চেতন অচেতন যাই বলা হোক না কেন – তার জীবন্ত দুনিয়াটার শুদ্ধ মহাপ্রলয়টা হয় সেদিন। এখানে সুদ্ধ ও অসুদ্ধ এর ভেতর ফারাক আছে।

‘ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাহে রজেউন’

-নিশ্চয় শুদ্ধ ও পবিত্র সত্তা হতে এসেছি নিশ্চয় পবিত্র সত্তার সাথে মিলিত হব।

জীব যখন তার কোন (আসক্তির) দুর্নিবার টান, যে টানে সে হারিয়ে যায়। তখন ভাবময়ী কারাগারে বন্দি হয়ে ঐ চেতন সৃষ্টির বা সজাগ জীবন্ত দুনিয়াটার সব টান হতে বিচ্ছিন্ন হয়। -আর ঠিক তখনই তার ঘটে মৃত্যু।

মানুষ বা জীব যখন ঐ দুনিয়ার ভাবময়ী স্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। তার জীবন্ত সজাগ স্মৃতির চেতনা থেকে বিছিন্ন হতে থাকে। বা সম্পর্কচুত্য হতে থাকে। ধীরে ধীরে সে তখন এক বিরাট শব্দ বা বিকট আওয়াজের ধ্বনি শুনতে পায়।

যা কিনা তার সজাগ বা পার্থিব জগতের সমস্ত খেয়ালকে ঝলসিয়ে, ধাঁধিয়ে মুছে দেয়। পরক্ষণেঁ তার চেতন চক্ষুর সামনে এক মহা আলোর প্রাণ ঝলসানো আলোর রাজ্য উপস্থিত হয়।

মনোমোহিনী রূপ দেখে যখন কোন পুরুষের নারীর প্রতি এক মহা আর্কষণে দেহের প্রতিটা কোষ জেগে উঠলো- (বিচার কার্য্য ঘটানোর লক্ষ্যে) ছিটকানোর জন্য এক সম্মোহিত টানে রত হল, তখনই সংযোগ সৃষ্টি হল সেই ভাবময়ী সত্তার সাথে এবং তক্ষণে আকর্ষণরত পুরুষ দেহে বা তার কামময় সত্তায় এক ঘনীভূত স্বচ্ছ বীজদানা অবস্থার ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকলো।

মোট কথা ঐ শব্দ ও আলো মিলে (জীবের) বহু সাধের কামনা বাসনা ভরা আসক্তি জগতের মোহটান এমনকি তার নিজের অস্তিত্ব বিলিন হয়ে চেতনহারা হয়ে যায়। তখন সে বুঝতে পারে হৃদয় বিদারণ, দুঃখ, ক্লেশ, যন্ত্রণায় তাকে বন্দি ও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এই মায়ার পৃথিবী।

এই এতেই তার সমগ্র অস্তিত্ব লয় হয়ে অতঃপর সূক্ষ্ম শরীরী বা ভাবদেহ হয়ে সে তখন মহা ভাবভূমিতে অবস্থান করতে থাকে। পরক্ষণে প্রক্ষেপ বা (ছুড়ে) দেওয়া সমভাব কর্তৃক নারী ও পুরুষের মিলনের মধ্যপথ দিয়ে ঐ ভাবভূমিতে অবস্থানরত সূক্ষ্ম শরীর অঙ্কুরিত ভ্রূণে বিকশিত হয়ে কায়া বা স্থূল দেহে রূপান্তরিত হত লাগলো।

তখন কাম উন্মত্ততায় বিভোর নারী পুরুষের দুয়ের এক মিলনের উত্তাল সেই প্রক্ষেপ ছুড়ে দেওয়া অভিকর্ষ (ম্যাগেটিক) টানের প্রভাবে দেহের ভেতর মহা এক লাভা বা তাপের সৃষ্টি হয়। পরক্ষণে বিধিবদ্ধ ধারার নিয়মে এক বিরাট গুমগুমানি শব্দের মধ্য দিয়ে ঐ সূক্ষ্ম ভাবভূমিতে অবস্থানরত ভাবাবিষ্টে বন্দি হয়ে স্মৃতিহারা ‘কার’ পাড়ি দিয়ে অন্ধকার কারাগারের মধ্যে।

তার পূর্ব (কর্মফল) বা সংস্কার নিয়ে বিধি বিধান অনুযায়ী সন্মোহিত (হ) হয়ে বীজ বা ভ্রূণ ‘হ’ কুন -তারপর মাতৃজঠরে পতিত হয়। তারপর স্রষ্টার হুকুমে বিবর্তন, পরির্বদ্ধন, পরির্বত্তনের ধারা মাফিক প্রাপ্য পাওনা যুক্ত শরীর ধারন বা গ্রহণ করে স্রষ্টার আজ্ঞা বহন করতে লাগলো বা কায়েমী হতে থাকলো। এটাকেই বলা হয় পুন:উত্থান হওয়া বা শরীরী জন্ম নেওয়া।

‘কেয়ামতের কার্য্য চক্ষুর নিমেষ বৈ নহে- অথবা তাহা আরও নিকটতম।’-সুরা নহল-৭৭-র-১১

মনোমোহিনী রূপ দেখে যখন কোন পুরুষের নারীর প্রতি এক মহা আর্কষণে দেহের প্রতিটা কোষ জেগে উঠলো- (বিচার কার্য্য ঘটানোর লক্ষ্যে) ছিটকানোর জন্য এক সম্মোহিত টানে রত হল, তখনই সংযোগ সৃষ্টি হল সেই ভাবময়ী সত্তার সাথে এবং তক্ষণে আকর্ষণরত পুরুষ দেহে বা তার কামময় সত্তায় এক ঘনীভূত স্বচ্ছ বীজদানা অবস্থার ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকলো।

আর ঠিক তখনই ঐ যে সত্তা বা আত্মা, জীব- মহা ভাবভূমিতে অবস্থান করিতেছিল সম্মোহিত অজ্ঞান অবস্থায়, তাকে আবার আকারে সৃজন করার লক্ষে ঐ আর্কষনরত ঘনিভুত ভাব ধারায় হল তার পুনঃউত্থান বা সৃষ্টি হওয়ার বিকাশময় মধ্যপথ। সৃষ্টি হওয়ার রায়।

নিরাকারে তুমি নুরী ছিলে ডিম্ব অবতারি,
সাকারে সৃজন গঠলেন ত্রিভুবন
আকারে চমৎকার ভাব দেখালে।
-সাঁইজি লালন ফকির

এই যে সৃষ্টির সৃজন প্রক্রিয়ার কি চমৎকার ভাব- মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আদমের ভেদ, আদম আমার ভেদ বা রহস্য।’ মানুষই হচ্ছে আল্লাহর দলিল। আদম তনের ভেতর দিয়ে জন্ম মৃত্যু ও তার বিচারকার্য সব কিছুর নিগূঢ় হিসাব কিতাব করা হচ্ছে তা এত সূক্ষ্ম যে এই হিসাব জীব বা জীব মানুষের বুঝার সাধ্য নাই।

‘জীবে কি তার মর্ম জানে।’

ঐ মধ্যপথ অবলম্বন করার সাথে সাথেই যার যার কর্মফল মাফিক সে যে সংস্কার বা কর্মফল নিয়া সুকর্ম ভাব ভূমিতে আবিষ্ট হয়েছিল। তখন তার কর্মফলের রায় স্রষ্টার নির্দেশে প্রদান করা হবে এবং ঐ পূর্ব সংস্কার ভাব সম্মোহিত অঙ্কুরে তাকে পুনরায় কায়েম বা সৃষ্টি হতে হুকুম করা হবে।

…………….
আরো পড়ুন:
অবশ জ্ঞান চৈতন্য বা লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া
ঈশ্বর প্রেমিক ও ধৈর্যশীল ভিখারী
সুখ দুঃখের ভব সংসার
কর্ম, কর্মফল তার ভোগ ও মায়া
প্রলয়-পূনঃউত্থান-দ্বীনের বিচার

ভক্তি-সংসার-কর্ম
সাধনকর্ম

………..
বি.দ্র.
আমার এই লেখা কিছু ইতিহাস থেকে নেওয়া কিছু সংগৃহীত, কিছু সৎসঙ্গ করে সাধুগুরুদের কাছ থেকে নেওয়া ও আমার মুর্শিদ কেবলা ফকির দুর্লভ সাঁইজি হতে জ্ঞান প্রাপ্ত। কিছু নিজের ছোট ছোট ভাব থেকে লেখা। লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।। আলেক সাঁই। জয়গুরু।।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!