-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: গন্ধ: গন্ধের রাজ্যে : নবম পর্ব
আলোচনা করছিলাম গন্ধের রাজ্যে নিয়ে। তো যুগে যুগে মানবকুল প্রকৃতির নানাবিধ সর্বনাশ করলেও প্রকৃতি জীবের প্রতি সবসময়ই সেবা ভাবেই থাকে। মানব সৃষ্ট নানাবিধ দুর্ষনের পরও প্রকৃতি প্রতিনিয়ত সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যায় জীবকে পরিশুদ্ধ অক্সিজেন পৌঁছে দিতে।
এটা প্রকৃতির একটা অন্যতম দান জীবের জন্য। তাই তার কাছ থেকে প্রতিমুর্হূতে তুমি শ্বাসের মাধ্যমে যে বায়ু গ্রহণ করছো। তার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। তাই প্রতিনিয়ত প্রকৃতির কাছে তার জন্য ঋণ স্বীকার করো। অর্থাৎ দমে দমে তাকে স্মরণ করো।
আর এই দমে দমে স্মরণ করা বা দমকে প্রতিনিয়ত স্মরণে রাখাকে সহজ ভাষায় বলে ‘দম সাধনা’।
এই দম সাধনাকে অনেকে প্রাচীন ভারতের যোগের প্রাণায়ামের সাথে তুলনা করেন। কি করে শ্বাসকে ব্যবহার যায়। অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসে যে তিনটা ক্রিয়া হয়- পূরক, কুম্ভক ও রেচক। তার মাত্রা ও সময়জ্ঞানকে মাথায় রেখে পাশাপাশি কোন নাসিকা ছিদ্র দিয়ে তা নেয়া হবে ইত্যাদির বিস্তারিত যোগ শাস্ত্রে পাওয়া যায়।
শ্বাস ভেতরে নেয়াকে বলা হয় পূরক; শ্বাস বাইরে ছাড়াকে বলা হয় রেচক। শ্বাসকে থামিয়ে দেয়াকে বলা হয় কুম্ভক। একে ব্যবহার করে কি করে নিজেরে ভেতরের যে প্রাণশক্তি তাকে কি করে জাগ্রত করতে হয়। কি করে সুস্থ থাকতে হয়। কি করে এই প্রাণশক্তিকে কাজে লাগানো যায় এর বিস্তারিত রয়েছে ‘পাতঞ্জল শাস্ত্রে’।
অবশ্য বাউল-ফকির ও সুফি সাধকরা দম সাধনাকে যোগ সাধনার সাথে তুলনা করতে চান না বেশিভাগ ক্ষেত্রে। তাদের মতে দম সাধনা সামান্য ব্যাপার নয়। এই দম সাধনায় সাধক তার নিজের, গুরুর, ব্রহ্মাণ্ডের বা স্রষ্টার সাথে যে সম্পর্ক স্থাপন করে তার কাঠামো যোগ থেকে ভিন্ন।
তবে শ্বাস-প্রশ্বাসের এই ক্রিয়ায় কোন সাধনার সাথে কোনো সাধনায় মিল-অমিল আছে তা নিয়ে এই আলোচনা নয়। বা দম সাধনার বিস্তারিত বিবরণও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এ লেখার উদ্দেশ্য আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোকে একটু সহজে বুঝবার চেষ্টা মাত্র।
তেমনি ঘ্রাণের অনুভূতিকে কেন্দ্রীভূত করে কেবল নি:শ্বাস-প্রশ্বাসের আসা-যাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হয়। আর এই মনোনিবেশ করতে পারলেই সাধক ধীরে ধীরে তার নিজের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
আর সেই যাত্রায় পথে যারা যারা চলে আসছে তা সম্পর্কে সবচেয়ে সংক্ষেপে একটু বলে যাওয়া। আর সেই সূত্রেই ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে যে আমরা বিশাল একটি কাজ করে চলেছি প্রতিনিয়ত সেটা মনে করিয়ে দেয়া। যদিও তা আমরা প্রতিনিয়তই করে চলেছি কিন্তু বিষয়টা স্মরণে রাখতে পারি না।
সাধককুল বলেন, সর্বসময় শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল রাখো, পাশাপাশি তার স্রষ্টাকে স্মরণ করো। এই খেয়াল বা স্মরণে রাখলে চিন্তা ছড়িয়ে পরে না। বিক্ষুব্ধ চিন্তা মনের মাঝে ঢুকে পরতে পারে না। মনের স্থিতি বজায় থাকে। মানুষ কেন্দ্রীভূত হতে পারে।
আর এই ধারাবাহিক আলোচনায় এক এক করে ইন্দ্রিয়ের আলোচনায় আপনাদের কাছে এতোক্ষণে নিশ্চয় বিষয়টা পরিষ্কার। মন নামের বিষয়টা যত স্থির হবে, যত কেন্দ্রীভূত হবে, ইন্দ্রিয় ততটা সময় পাবে কোনো কিছু সম্পর্কে অনুভূতি গ্রহণ করতে।
আর স্থির মন ততটা সত্যের কাছাকাছি প্রতিকৃয়া দিতে পারবে যতটা সে স্থির। কারণ স্থিরতা মানেই সঞ্চিত সংস্কারের উপর তার কর্তৃত্ব। সঞ্চিত সংস্কারকে হয়তো মানুষ সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারে না। কিন্তু তার ব্যবহার সে জানতে শুরু করে সাধন পথে।
কতটা সে তার উপর নির্ভর করবে, কতটা অবজ্ঞা করবে তা স্থির মনই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তার জন্য ইন্দ্রিয় চোখ যেমন বন্ধ রাখতে হয়, শব্দ থেকে যেমন বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে হয় অর্থাৎ নিরব হতে হয়, স্বাদ নেওয়া থেকে জিহ্বাকে নিবৃত করতে হয় বা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, বর্হি জগতের শব্দ শোনা থেকে কানকে বিচ্ছিন্ন করতে হয়।
তেমনি ঘ্রাণের অনুভূতিকে কেন্দ্রীভূত করে কেবল নি:শ্বাস-প্রশ্বাসের আসা-যাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হয়। আর এই মনোনিবেশ করতে পারলেই সাধক ধীরে ধীরে তার নিজের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
সহজভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, মানুষ তার জ্ঞানেন্দ্রিয়ে প্রত্যক্ষ ব্যবহার বন্ধ করে পরোক্ষ বা অজানা এক ব্যবহারের দিকে এগিয়ে যায়। যাতে সে নিজের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখতে শুরু করে।
আর উঁকি দিয়ে দেখার সহজ অর্থ অনেকটা এমন যে, অনুমতি নেই তাও দেখবার আকাঙ্খা।
কারণ সাধক তখনো নিজেকে জানে না চিনে না, বোঝে না। ধীরে ধীরে সে নিজেকে জানতে-চিনতে-বুঝতে শুরু করে। আর নিজেকে চিনতে চিনতে বেড়িয়ে পরে নিজের ভেতর দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডকে জানার পথে।
কিন্তু এ পথ সহজ পথ হলেও বিষয়টা মোটেও এমন সহজ নয় যে, বসে পরলাম আর দেখে নিলাম। বিষয়টার জন্য চাই দীর্ঘ সাধনা, তপস্যা। ইন্দ্রিয়কে ধীরে ধীরে চিনে মন-বুদ্ধি সংস্কারকে পরিশুদ্ধ করা।
কি কি করলে আরো ভালোভাবে সকলকে নিয়ে বাঁচা যায় ভাবনাটা এই পর্যায়ে রাখতে পারবে। নিজে যে ব্রহ্মাণ্ডের একটা অংশ কেবল তাই নয়। সকল জীবই ব্রহ্মাণ্ডের অংশ এবং সকলেই গুরুত্ববহ ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবে ভাবতে পারবে।
সাধককুল বলেন, আর এ কাজটি করা বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। তার জন্য চাই প্রেমময় মন। ভক্তিপূর্ণ হৃদয়। শুদ্ধ বিচার।
তবে একজন প্রজ্ঞাবান পথপ্রদর্শক যদি সামনে থাকে। যার কাছ নিজেকে সমর্পণ করা যায় পূর্ণ আস্থায়। তবে পথটা হয় সহজ। সে তোমাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না কথা সত্য। তবে সে তোমাকে পথ দেখাতে পারবে। ভরসা দিতে পারবে। আর প্রকৃত সাধকের জন্য এটুকুই প্রয়োজন।
বাকিটা সে নিজেই হাঁটতে পারে। তবে এই পথপ্রদর্শক ‘কে’ হবে তা নিয়ে আছে নানান মত। প্রথাগত ধর্ম বিশ্বাসীরা বলেন, স্রষ্টাই একমাত্র পথপ্রদর্শক। আবার তাদের একদল বলেন, স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত পয়গম্বর-অবতার-দেবদেবতাই একমাত্র সেই পথ দেখাতে পারে।
অনেকে বলেন, শাস্ত্র মানলেই সেই পথ পাওয়া যায়। অনেকে বলেন, পাহাড়-জঙ্গল-সাগর প্রকৃতির কাছে শিখে নাও সেই পথ। অনেকে বলেন, এর জন্য চাই তীর্থ যাত্রা।
আবার গুরুবাদীরা বলেন, উপরের সকলকিছুই করতে হবে তবে তা একজন মানুষগুরুর অধীনে করলে সবচেয়ে সুবিধে হয়।
যাক সে সব কথা। মতের ভিন্নতা থাকবেই। বিশ্বাসের পাশে অবিশ্বাসও থাকবে। সেটা মেনে নিয়ে ভিন্নভিন্ন চিন্তা-চেতনার মানুষ পাশাপাশি বসবাস করবে। একে অন্যের প্রতি কোনোরূপ বিদ্বেষ পোষণ করতে না। হিংস্র আচরণ করবে না।
শুধু নিজের পরিবার-পরিজনকে নিয়েই ভাবতে ভাবতে জীবন শেষ করে দিবে তা নয়। তার চারপাশে যারাই আছে তা সে ক্ষুদ্র চড়াই থেকে বিশাল সমুদ্র সকলকেই ভালোবাসবে। নিজের পক্ষ থেকে তাদের কোনোরূপ ক্ষতি যাতে না হয় সে দিকে স্বজাগ থাকবে।
কি কি করলে আরো ভালোভাবে সকলকে নিয়ে বাঁচা যায় ভাবনাটা এই পর্যায়ে রাখতে পারবে। নিজে যে ব্রহ্মাণ্ডের একটা অংশ কেবল তাই নয়। সকল জীবই ব্রহ্মাণ্ডের অংশ এবং সকলেই গুরুত্ববহ ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবে ভাবতে পারবে।
তখনই আসলে মানুষ আসলে বুঝতে পারবে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রকৃত কাজ কি।
নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেয়াই নাকের বা ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের একমাত্র কাজ নয়। যা খাটে অন্য সকল ইন্দ্রেয়ের ক্ষেত্রেও। তার কাজ আর অনেক গভীর। যা সাধারণ জ্ঞানে ধরা পরে না। আর সেই বিষয়গুলো একটু ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করার জন্যই এই দীর্ঘ ধারাবাহিক লেখা।
‘আমি সামান্য কবি-একদা পূর্ববঙ্গবাসী, অধুনা ভ্রাম্যমাণ-গঙ্গোপাধ্যায় বংশীয় সুনীল আমার নাম। যদিও ব্রাহ্মণকুলে জন্ম, কিন্তু জ্ঞানের অভিমানের বদলে ভালোবাসার শক্তিতেই আমার বেশি বিশ্বাস। তাই ভালোবাসার এই অমরগাথা শোনাতে চেয়েছি।
এর কতটা বোঝাতে পারলাম আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে, তা আমি জানি না। আমি যা বুঝবার চেষ্টা করছি তা সকলের সাথে একটু শেয়ার করাই হয়তো এই লেখা। বা এই লেখার আরেকটা মানে হতে পারে এর থেকে প্রত্যেকের কিছু কিছু ভাবনার খোরাক পাক।
যাতে সে এর যে কোনো শব্দ থেকে নতুন করে ভাবতে শুরু করতে পারে। আর যারা এ সম্পর্কে অনেক অনেক বেশি জানেন তাদের কাছে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এই বিশাল বিষয়কে নিয়ে লিখবার ধৃষ্টতা করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আমি নিজেই খুব ভালো ভাবে জানি, এই লেখা কখনো শেষ হবার হয়। তারপরও সাধুগুরুপাগল সর্বচরণে ভক্তি রেখে ভুল-ত্রুটিগুলো নিজ গুণে ক্ষমা করে দিবেন এই প্রত্যাশা রেখে ইতি টানতে চাইছি।
আমার এই ধৃষ্টতার জন্য সকলের কাছে ক্ষমা চাইবার জন্য অনেক কিছুই, অনেক ভাবেই বলা যেতো বা যায়। কিন্তু এই মুর্হূতে আমার কাছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার একটা অংশই বারবার ভেসে উঠছে। যদিও আমি কবি-সাহিত্য-শিল্পী-লেখক-গবেষক কিছুই নই। ব্রাহ্মাণকুল বা কুলীন কোনো বংশেও আমার জন্ম নয়।
তারপরও সুনীলের কথাগুলোকে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। তাই তা তুলে দিয়ে এই যাত্রায় সকলের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। জয়গুরু।।
সুনীল তার প্রথম জীবনের লেখা ‘সোনালি দুঃখ’-এ লিখছেন-
‘আমি সামান্য কবি-একদা পূর্ববঙ্গবাসী, অধুনা ভ্রাম্যমাণ-গঙ্গোপাধ্যায় বংশীয় সুনীল আমার নাম। যদিও ব্রাহ্মণকুলে জন্ম, কিন্তু জ্ঞানের অভিমানের বদলে ভালোবাসার শক্তিতেই আমার বেশি বিশ্বাস। তাই ভালোবাসার এই অমরগাথা শোনাতে চেয়েছি।
আমার বাকশক্তি সীমিত, আমার ভাষাজ্ঞান সীমিত, আমি জানি না শব্দের ঝংকার, জানি না বর্ণনার ছটা! আপনারা গুণীজন, আপনারা বহুদর্শী, রসজ্ঞ সহৃদয়- আপনাদের সভায় ভরসা করে এ গান শোনালাম। এ গান শুনলে, যে দুর্বল সে আবার শক্তি ফিরে পায়।
ভালোবাসায় যার অবিশ্বাস এসেছে, সে আবার ভালোবাসায় বেঁচে ওঠে। যার জীবনে কখনো ভালোবাসা জাগেনি, এ গান শুনলে সেই পাথরের বুক ভেদ করে বেরিয়ে আসে ঝরনা। এই ভালোবাসার গান শুনলে মানুষ মরতে ভয় পায় না।
ভালোবাসা ছাড়া জীবন হয় না, যেমন দুঃখ ছাড়া ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসার জাত নেই, গোত্র নেই, ধর্ম নেই।’
(সমাপ্ত)
……………………
আরো পড়ুন:
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-১
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-২
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৩
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৪
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৫
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৬
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৭
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৮
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৯