-গৌতম মিত্র
১০. শ্রী হরি পাল
বাংলাদেশের যশোহর জেলার কেশবপুর গ্রামে গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম সাধক গোলক পাগলের পুত্র শ্রী হরিপাল। তিনি খুলনা জেলার ডুমুরিয়া গ্রামে সূর্যনারায়ণ পালের কাছে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া মতাদর্শ সম্পর্কে জানতে পারেন। সূর্য নারায়ণের সাথে ওড়াকান্দিতে গেলে সেখানে তার গুরুচাঁদ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ হয়।
সেসময় থেকেই তিনি গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতাদর্শ দেশে দেশে প্রচার করতে শুরু করেন। শ্রী হরি পাল শ্রীশ্রী হরিচাঁদের প্রেমে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদের ভাবেতে মাতাইল পাল বংশ সহ অনেক গ্রাম মতুয়া মতবাদ প্রচার করেন। তারমধ্যে পালপাড়া, শুক্তাগ্রাম, কালুখালী, ঘসিবেড়ে, দিঘলীয়া গ্রাম উল্লেখযোগ্য।
শ্রী হরিপাল বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে বাঁদায় গিয়েছিল চকে কাঠ কাটতে। সেখানে বসে তিনি শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের দর্শন পান। সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে এসে মূর্তি স্থাপন করেন। সেই বিগ্রহ এখনও সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশের নড়াইলের দেবদানু শ্রী হরিপাল মন্দিরে।
১১. শ্রী রাধাক্ষেপা
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমকালে মতুয়া মত প্রচারকদের মধ্যে বরিশালের লেবুবেড়ের অন্যতম সাধক ছিল রাধাক্ষেপা। তিনি গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম সাধক। তাঁর পিতার নাম শ্রী নন্দকুমার চক্রবর্তী। রাধানাথ চক্রবর্তী ওড়াকান্দি গিয়ে ঠাকুরকে যখন প্রথম দেখেন তখন ব্রহ্ম পরাৎপর ভেবে বিস্ময় হন।
রাধানাথ প্রথমে যখন ঠাকুরকে দর্শন করে তখন গুরুচাঁদ ঠাকুর বলে, তোমার পরিচয় কি বল? রাধানাথ বলেন, ব্রাহ্মণ কুলেতে জন্ম আমার। শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেন, বেদগুরু ব্রাহ্মণ তোমরা কেন আমার কাছে এসে সবিনয় কর? তখন রাধানাথ চক্রবর্তী বলেন-
রাধানাথ বলে পিতা কি বলিব আর।
আপনি যে এই ভবে ব্রহ্ম পরাৎপর।।
ব্রহ্মার ব্রাহ্মণ্য দেব আপনি ধরায়।
দাঁড়াও না ওহে প্রভু হেরে দুরাশয়।।
জাতিকুল আভিজাত্য যা ছিল আমার।
সপিনু জন্মের মত পদে আপনার।।
রাধানাথ গুরুচাঁদ ঠাকুরকে বলেন, কিভাবে আমি হইব মানুষ, কার সঙ্গ লাভে আমি চিনিব মানুষ? একথা শুনে গুরুচাঁদ ঠাকুর রাধানাথকে কবি রসরাজ শ্রী তারক সরকারের কাছে পাঠান। তাকে গুরু রূপে বরণ করে, তারক সরকারের ছবি হৃদয়ে এঁকে হরিগুরু চাঁদের নাম প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে প্রচার শুরু করেন।
আসাম প্রদেশ, ত্রিপুরা, ময়মনসিংহের মহিনন্দ গ্রামে, কেশবগঞ্জের রামদিয়া, সাহেবের হাট, জন্না গ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ মন্দির স্থাপন করে হরিচাঁদের নামে প্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে তুলেন তিনি।
বরিশাল বিভাগের বাকেরগঞ্জ থানার কৃষ্ণকাঠী (শ্রী অনন্ত গোঁসাইর বাড়ি), শিয়ালঘুনী, কালেরকাঠী সহ অনেক গ্রামে এই রাধাক্ষেপার বিচরণ ঘটে।
রাধানাথ চক্রবর্তী পরর্বতীতে শ্রী রাধাক্ষেপা নামে পরিচিত হয়ে উঠেন। ১৩৫০ সালে শ্রী রাধাচরণ ক্ষ্যাপা কর্তৃক হৃদয়গঞ্জ, চর ভৈরবী, নোয়াখালী থেকে মতুয়াদের আদি দলিল ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’-এর ৩য় সংস্করণ বের করেন।
১২. শ্রী বিচরণ পাগল
বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কাশিয়ানী থানার তালতলা গ্রামে ১২৮৬ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীনাথ বিশ্বাসের পুত্র বিচরণ বিশ্বাস। তিনিও গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম সাধক। তিনি ছিলেন শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমসাময়িক কালের অন্যতম সাধু ভক্ত মতুয়ামত প্রচারকের এক জন।
বারুনীর সময় শ্রীধাম ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়িতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হত। সপ্তাহব্যাপী মেলার লোকের সমাগম থাকত। ভক্তদের থাকা খাওয়া ও মল-মূত্র ত্যাগে যে আবর্জনা হত। লজ্জা ঘৃণা বিসর্জন দিয়ে বিচরণ পাগল নিজ হাতে ঝুড়ি ও কোদাল তা পরিষ্কার করতেন।
হরিনামের পাগল বিচরণ পাগল মনে করত হরিচাঁদের ভক্তদের সেবা করলেই শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের সেবা করা হয়। তাই সে কর্মই ছিল বিচরণ পাগলের কাছে সাধন স্বরূপ। একদিন ঠাকুর গুরুচাঁদ খুঁশি হয়ে বিচরণকে পাঁচ সিকা (১ টাকা ২৫ পয়সা) দান করে বলেন, তুমি বাড়িতে গিয়ে লবণের ব্যবসা করো।
ব্যবসার নীতি বুঝিয়ে দিয়ে বলেন- ক্রেতাকে ওজনে ফাঁকি দিবে না, নিজ মূলধন শূন্য করবে না, হরিভক্ত বলে বাণিজ্য করবে। এই তিনটা উপদেশই ছিল বিচরণের ধর্ম ও কর্ম। তাঁর কর্ম সম্পর্কে বলা হয়-
এই আজ্ঞা পেয়ে বিচু গেল নিজালয়।
গুরু কৃপা ধন লয়ে বাণিজ্যে যায়।।
বিকি কিনি করে সাধু মুখে হরিনাম।
তাঁহারে করেছে কৃপা গুরু গুনধাম।।
বিচারণ পাগল ওড়াকান্দি থেকে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের কৃপা, আর্শিবাদ ও পাঁচ সিকা পয়সা মূলধন নিয়ে মহাজনের কাছ থেকে লবণ কিনে গ্রামে গ্রামে লবণ বিক্রি করতেন। সেই সাথে হরিনাম, হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের ধর্ম ও কর্ম এবং মানব সেবার কথা প্রচার করতেন।
ধর্ম প্রচারকদের মধ্য বিচরণ পাগল ছিলেন স্বতন্ত্র প্রচারক। কারণ তিনি কর্মের সাথে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ প্রচার করতেন। তিনি রবিবার ২রা চৈত্র ১৩৮১ বঙ্গাব্দে তিনি দেহ রাখেন।
(সমাপ্ত)
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন
তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর
……………………………
আরো পড়ুন:
মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া
বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বর্ণবাদীদের গাত্রদাহ
ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
বিধবাবিবাহের প্রচলন ও গুরুচাঁদ ঠাকুর