ভবঘুরেকথা
ফকির লালন সাঁইজি

লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব সাত

-মূর্শেদূল মেরাজ

আর যারা সাহায্য-সহযোগিতা পায় তাদের গবেষণা অনেকটাই চেয়ার টেবিল নয়তো বই-পত্র-পত্রিকা নির্ভর। তাই সেসব থেকে চিন্তার নতুন কোনো খোরাক পাওয়া যায় না। কিছু সাহিত্য পাওয়া যায়। আর কিছু সংকলন। তারা মূলত একত্রিত করণের কার্যটি করে থাকেন।

এই বিষয়ে একটা গল্প বলি, প্রায় এক দশক আগে পরিচিত এক ভদ্রলোক বললেন। ভাই আপনি তো কুষ্টিয়া যাতায়াত করেন। কয়েকজন গুরুর সন্ধান দিতে পারেন?

আমি অবাক হয়ে বললাম, ভাই একজন গুরুই খুঁজে পাই না। কয়েকজন গুরুর সন্ধান দিব কি করে?

উনি বললেন, আহ্ হা হা। তা বলছি না। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক লালন ফকিরের উপর গবেষণা করবেন। তাই কয়েকজন লালন মতের লোক লাগবে। যারা তার সম্পর্কে বলতে পারবেন।

আমি বললাম, ও তাই বলেন। লালন মতে খেলাফতধারী কয়েকজনের সন্ধান দিতে পারি। যারা প্রবীণ ও বিচ্ছক্ষণ বলে মনে হয়। আমি খোঁজ খবর নিয়ে আপনাকে জানাতে পারবো। সাঁইজিকে নিয়ে কাজ হলে তো সেটা ভালো কথা। অবশ্যই পাশে থাকবো।

ভদ্রলোক বলেলন, ভাই! হাতে সময় নেই। উনি নভেম্বর ডিসেম্বরের দিকে দেশে আসবেন। মাস তিন-চার থাকবেন। প্রয়োজন হলে আরো বেশি থাকবেন। আপনাকে কিন্তু সাহায্য করতে হবে। প্রয়োজনে উনার সাথে যাবেন। উনি অনেক বছর পর দেশে আসবেন। বুঝেনই তো।

আমি আশ্বাস দিলাম। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব করবো। চিন্তা করবেন না।

একদিন সেই ভদ্রলোক বাসার টেলিফোনে লন্ডন থেকে ফোন করলেন। তিনি কি কি করবেন বিশাল বিশাল সব পরিকল্পনার কথা বলতে লাগলেন। মানুষের পরিকল্পনা শুনতে আমার কোনো কালেই বিশেষ ভালো লাগে না।

আমার ধারণা, যারা বেশি বেশি পরিকল্পনার আলাপ দেয়। সেটা বেশিভাগ ক্ষেত্রে আলাপেই থেকে যায়। যারা করে তারা এতো আলাপ দেয় না। বিশেষ করে বাইরের মানুষের সাথে আলাপ দেয় না। যদিও এর ব্যতিক্রম থাকতেই পারে।

রেকর্ড করার জন্য কি কি যন্ত্রপাতি আনবেন সাথে। সেগুলোর কত কত দাম। কোথা থেকে কিনছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি আমার জন্য কি কি করবেন। তার লম্বা ফিরিস্তি দিতে লাগলেন। তেল দেওয়াটা আমার বিরক্ত লাগে। কেউ আমাকে দিলে তাকে লাগে অসহ্য।

তবে আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। আমি বললাম, আপনি আগে দেশে আসেন। দেখেন। শুনেন। বুঝেন। তারপর না হয় ভাববেন কি কি করা যায়।

উনি আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আরে ভাই দেইখেন আমি কি কি করি। লালন ফকিরের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করেছি। আমি… আমি… আমি…

অর্থাৎ তিনি কি কি করেছেন আর কি কি করবেন ফিরিস্তি দিয়েই চললেন। যাক সে সব কথা। আমি যা কথা দিয়েছিলাম সেই মতে আমার পক্ষ থেকে যতটুকু করা তা করার চেষ্টা করলাম। সাঁইজির তিরোধানে কুষ্টিয়া গিয়ে সাধুগুরুদের সাথে কথা বললাম।

তাদের ঠিকানা, কিভাবে যেতে হবে, প্রয়োজনে খোঁজখবর পাওয়া যাবে এমন ফোন নাম্বার ইত্যাদি ইত্যাদি জোগার করলাম। সাধুগুরুদের সাথে কথা বলে রাখলাম, কয়েকজন মানুষ কিছুদিন তাদের আখড়ায় থাকবে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

আসার পর সেই পরিচিত ভদ্রলোককে জানালাম। ভদ্রলোক সম্ভবত সেই লন্ডনের গবেষকের সাথে কথা বললেন। তিনি আমাকে একদিন ফোন দিলেন। তাকে সব জানালাম। তিনি শুনে খুবই আনন্দিত। কোথায় কতদিন থাকবেন।

রেকর্ড করার জন্য কি কি যন্ত্রপাতি আনবেন সাথে। সেগুলোর কত কত দাম। কোথা থেকে কিনছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি আমার জন্য কি কি করবেন। তার লম্বা ফিরিস্তি দিতে লাগলেন। তেল দেওয়াটা আমার বিরক্ত লাগে। কেউ আমাকে দিলে তাকে লাগে অসহ্য।

ভদ্রলোককে বললাম, ভাই সাঁইজিকে নিয়ে কাজ করবেন সেটাই বড় কথা। কাজটা আগে হোক তারপর দেখা যাবে। উনি আমার কথা শোনেন না বলেই যান।

যাক তারপর একদিন ফোন করে বললেন, ভাই আপনি কি আমার হয়ে ইন্টারভিউগুলো নিয়ে দিতে পারবেন? আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনার গবেষণা আপনি করবেন না? আপনি আসবেন না?

উনি বললেন, আমি কাজ অনেকটাই করে ফেলেছি, এখন কয়েকটা ইন্টারভিউ হলেই হয়। আপনি একটু সংগ্রহ করে দেন।

আমি বললাম, কি কি প্রশ্ন আপনি করতে চান তাদের কাছে। মানে কি কি জানতে চান?

কয়েকদিন পর ফোন করে বললেন, আপনি পারবেন। আপনি আপনার মতো করে ইন্টারভিউ নিবেন। সেগুলো আমাকে পাঠাবেন। আমি ঠিকঠাক করে নেবো।

আস্তে আস্তে আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম ভদ্রলোকের প্রতি। আমি বললাম, আপনার কাজ আপনারই করা উচিৎ। একবার দেশে আসেন। সামনাসামনি কথা বলি। আপনিও সাধুগুরুদের সাথে কথা বলেন। যাকে নিয়ে গবেষণা করবেন তার ভূমিতে যান। নইলে কেমনে হবে।

যে সকল প্রতিষ্ঠান গবেষণার কাজে সহায়তা করেন তারা সঠিক-শুদ্ধ মানুষকে সেই সহযোগিতা করবেন যাতে এই দুরহ কাজটা করা কিছুটা সহজ হয়। আর যারা সত্যি সত্যি গবেষণা করে যাচ্ছেন। তাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভক্তি। জয়গুরু।।

উনি বললেন, ভাই আজকাল ওসব কিছু লাগে না। আমি কিছু বইপত্র দেশ থেকে আনিয়েছিলাম। সেখান থেকেই সব তথ্য পেয়ে গেছি। আপনি একটা রেকর্ডার কিনে কয়েকটা ইন্টারভিউ সংগ্রহ করে দেন। আমি সেই টাকা আপনাকে দিয়ে দিবো।

আমি হেসে বললাম, দু:খিত ভাই। এইকাজ আমাকে দিয়ে হবে না। এই রকম গবেষণার সাথে যুক্ত থাকবার ইচ্ছে আমার নেই। আমাকে ক্ষমা করবেন।

এইরকম আরো বেশ কয়েকজন লালন গবেষক ও পিএইচডি থিসিস লেখকের সাথে পরিচয় হওয়ার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। তারপর তাদের সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। একজন গবেষক তো দাবি করেই বসলেন তিনি সাঁইজির পদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা কোনো সাধুগুরুর সাধ্য নাই করার।

একজন বললেন, তারচেয়ে বেশি সাঁইজিকে বোঝেই নাই কেউ। একজন তো নিজেকে মহামানব দাবী করে বসলেন। যাক সবার চরণে ভক্তি রেখে আসায় আছি একদিন অহং ছেড়ে শুদ্ধ মানুষেরা বিষয়ভিত্তিক গবেষণায় নামবে।

যে সকল প্রতিষ্ঠান গবেষণার কাজে সহায়তা করেন তারা সঠিক-শুদ্ধ মানুষকে সেই সহযোগিতা করবেন যাতে এই দুরহ কাজটা করা কিছুটা সহজ হয়। আর যারা সত্যি সত্যি গবেষণা করে যাচ্ছেন। তাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভক্তি। জয়গুরু।।

লালন চর্চায় শিল্পীসমাজ-

বর্তমানে লালন গানের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভালো লাগুক না লাগুক প্রায় সকল শিল্পীকেই কয়েকখানা লালন গান জানতেই হয়। শিখে নিতেই হয়। তাই এখন সকল শিল্পীই লালন গান করেন। কিন্তু তাদের বড় একটা অংশ লালনকে ভালোবেসে লালন গান করেন কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

আসলে ভাব গান ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে প্রেমময় না হয়ে গাইলে তার মাঝে প্রাণ আসে না। অনেকটা ডেকোরেশন টাইপ হয়ে যায়। আরোপিত মনে হয়। আবার উদ্ভট ভাবে সাজসজ্জা করে লালন গান উপস্থাপনও অনেক সময়ই দৃষ্টিকটু মনে হয়।

বাউল-বৈষ্ণব-বোষ্টমীর সাথে লালন বা ফকিরি ধারাকে অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। আর এই গুলিয়ে ফেলে লালনের পদকে উপস্থাপন করেন রং ঢং মেখে। বিষয়টা কোনো কোনো শিল্পী মাননসই করে উপস্থাপন করতে পারলেও। নবাগত অনেকেই ঠিকঠাক মতো উৎরে উঠতে পারেন না।

এই কথার প্রেক্ষিতে অনেকেই বলতে পারেন। কেনো বাপু! রবীন্দ্রনাথের গান গাইলে কি পাঞ্জাবী-পায়জামা শাল পরেই গাইতে হবে? জিন্স-টিশার্ট পরে গিটার নিয়াও তো দিব্যি গাইছে মশাই। সেটা যদি হয়। তাহলে লালনে দোষ কোথায়?

শিল্পীদের দায়িত্ব সাঁইজির বাণী বহন করে নিয়ে যাওয়া। অনেকটা মুখস্থ করে বয়ে চলার মতো। তাদের দায়িত্ব গান বহন করা। আর এই বহন করার জন্য শুদ্ধ শব্দ-শুদ্ধ উচ্চারণ, শুদ্ধ বাণী জানা জরুরী। তার অন্তর্নিহিত ভাব না বুঝলেও তেমন আপত্তি নেই।

এই কথার তর্কে যাব না। তবে লালন যে মতাদর্শ দিয়েছেন। যে জীবনধারা দিয়ে গেছেন। তাঁকে যথার্থভাবে কণ্ঠে ধারণ করতে গেলে তাঁর ভাব বোঝা জরুরী। ভাবগানের ধারাই এমন। এর ব্যতিক্রম হতেই পারে। তবে ব্যতিক্রম আর বিকৃতি এক কি?

যেখানে লালনকে আমরা চিনতেই পাররাম না। সেখানে তাকে নিয়ে এক্সপ্রিমেন্ট করতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা থেকেই যায়। প্রচার-প্রসারের জন্য তাকে নিয়ে নানা আয়োজন হয়েছে। কিন্তু শেষে অনেকেই স্বীকার করেছেন। লালন গাইতে গেলে তার ভাবধারায় গাওয়াই উত্তম।

শহুরে আধুনিক যুব সমাজের কাছে লালনকে পৌঁছে দিতে অনেক রক-পপ শিল্পী বিশাল ভূমিকা রাখলেও। পরবর্তীতে সেই সকল শিল্পীরাই লালনের মূলভাবে গান গাওয়ার চেষ্টা নিয়েছেন। বা লালন গান গাওয়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন।

শিল্পীদের দায়িত্ব সাঁইজির বাণী বহন করে নিয়ে যাওয়া। অনেকটা মুখস্থ করে বয়ে চলার মতো। তাদের দায়িত্ব গান বহন করা। আর এই বহন করার জন্য শুদ্ধ শব্দ-শুদ্ধ উচ্চারণ, শুদ্ধ বাণী জানা জরুরী। তার অন্তর্নিহিত ভাব না বুঝলেও তেমন আপত্তি নেই।

কিন্তু ভাব বোঝা জরুরী। ভাব না বুঝলে অনেক সময়ই সঠিক শব্দ হারিয়ে যায় ভাব গান থেকে। যেমন অনেকেই সাঁইজির পদকে গাইতে গিয়ে শহুরে শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা নিয়েছেন। অনেকে আবার সুরে-তালে ফেলবার জন্য করেছেন শব্দের পরিবর্তন।

(চলবে…)

<<লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয় ।। লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব আট>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………………
আরো পড়ুন-
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এক
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দুই
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তিন
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব চার
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব সাত
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব আট
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব নয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দশ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এগারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব বারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তেরো

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!