ভবঘুরেকথা
ফকির লালন সাঁইজি

লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

যদিও ফকির লালন সাঁইজির এই অনুরাগীকুলকে লালন ধারার খেলাফতধারী গুরু ও দীক্ষাধারী শিষ্যরা লালন অনুসারী বলে স্বীকার করে না। তাদের সাফ কথা- দীক্ষা না নিলে, গুরুর হাতে হাত না দিলে; ঘোরা ফেরা কেবল পানি সেচা। অথচ সাঁইজি বলেছেন-

অনুরাগ নইলে কি সাধন হয়।
সে তো শুধু মুখের কথা নয়।।

বনের পশু হনুমান
রাম বিনে তার নাই রে ধিয়ান,
কইট্ মনে মুদে নয়ন
অন্যরূপ না ফিরে চায়।।

তার প্রমাণ দেখ চাতকেরে
তৃষ্ণায় জীবন যায় মরে,
তবু অন্য বারি খায় না সে রে
থাকে মেঘের জলের আশায়।।

রামদাস মুচির ভক্তিতে
গঙ্গা মেলে চাম-কেঠোতে,
ঐ-রূপ সাধল কত মহতে
লালন কূলে কূলে বায়।।

তবে তাৎপূর্যপূর্ণ কথা হলো একই সাথে গুরুত্বহীন ও সমান গুরুত্বপূর্ণ এই অনুরাগী শ্রেণী থাকে সকল প্রকার সকল বাঁধা-নিষেধের ঊর্ধে। তাদের ঘাড়ে থাকে না কোনো চাপিয়ে দেয়া বিধি-নিষেধ, রীতি-নীতি। তাই তারাই উন্মুক্ত ভাবে ভাবতে পারে। চাইলে অনেক কাজ করতেও পারে।

সেই হিসেবে তারাই করে চলেছে অনেক কাজ। যদিও যারা কেবল চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করে চলেছেন। সাধু-গুরু-ফকিরদের সাথে না মিশে। না জেনে। তারা বিষয়টাকে সাহিত্যের বা সাংবাদিকার ভাষায় নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে শব্দের অর্থে নিয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু লালন ফকির আরো অনেক বিশাল বিষয়। যার তল খুঁজে পাওয়া সাধারণের কর্ম নয়। তবে সম্ভাবনার কথা হলো, যিনি এই পথে পা রাখতেন তিনিই এগিয়ে যেতে পারবেন। সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। ক্ষুদ্র হোক। শুদ্ধ জ্ঞানে কাজ করলে তার পরিণাম ভালো হবেই। জয়গুরু।।

লালন চর্চায় লেখককূল-

ফকির লালনকে বুঝতে গিয়ে সবচেয়ে সহজ যে পথ তা হলো বাজারে গিয়ে গোটা কয়েক বই কিনে ফেলা। যদিও এখন আধুনিক সময়ে বিনামূল্যেও নেট থেকে প্রচুর বই সংগ্রহ করা যায়। পাঠাগারের বিষয়টা আমাদের দেশে দিন দিন বিলুপ্তি ঘটার পথে থাকায় সে বিষয়ে না হয় নাই বা বললাম।

পকেটে পয়সা না থাকলেও বই সংগ্রহ করা যায় এখনো। পরিচিত লোকজনের কাছ থেকে চেয়েও নেয়া যায় পড়বার জন্য। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো ফকির লালনকে বুঝবার জন্য বই খুঁজতে গেলে শূন্য হাতেই ফিরে আসতে হয়।

বড়জোড় সাঁইজির গানের বই পাওয়া যায়। এ কথাও সত্য যে সাঁইজি তাঁর যা কিছু প্রকাশ করতে চেয়েছেন তার সবই তাঁর পদে বলে গেছেন। জ্ঞানী মাত্রই তার জ্ঞান-মেধা-বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী তা অনুধাবন করতে পারে।

কিন্তু মুশকিল হলো সাঁইজির ভাব না বুঝতে পারলে। মনে শুদ্ধতা-সহজতা-প্রেম-ভক্তি না থাকলে কেবল জ্ঞানে তাঁকে ধরা যায় না। এই গানের বা জ্ঞানের অর্থ নিজেকেই আবিষ্কার করে নিতে হয়। বা আবিষ্কারের পদ্ধতি নিজেকেই জেনে নিতে হয়।

তাই সাধুগুরুরা বলেন, আদতে বই পড়ে প্রকৃত জ্ঞান আহরণ করা যায় না। বই থেকে কিছু নতুন পথের দিশা পাওয়া যায়। সেই হিসেবে একমুখী ভাবনা থেকে সড়ে আরো নানাভাবে ভাবতে শিখতে পারে মানুষ। সেই বই পড়ার সঠিক মূল্যায়ণ করতে পারে। সেই জ্ঞানের পথে হাঁটতে পারে।

তবে এ কথাও ঠিক। প্রথম প্রথম বুঝতে গেলে মূল অর্থ বুঝবার জন্য সাধক অস্থির হয়ে উঠে। সেই অস্থিরতাকে স্থিরতায় আনা সহজ কাজ নয়। একথা বুঝে নিতে অনেক সময় লাগে জ্ঞান অনুয়ায়ীই আসলে ভাব গানের অর্থ ধরা দেয়।

আগে থেকে জানার বাইরের জ্ঞান শুনলেই, কোনো কিছু বোঝা হয় না। আসলে ভাবের অর্থ জানতে হয় লেহাজ করে। অন্যের কাছ থেকে শুনে বিশেষ কোনো উপকারে আসে না। বা অভিধান দেখে অর্থ বুঝে নিলেই বোঝা হয়ে গেছে ভাবটাও যথার্থ হয় না সকল ক্ষেত্রে।

তাই ভাব নিয়ে লিখতে গেলে লেখককে যেমন অনেক দায়িত্ব নিয়ে লিখতে হয়। তেমনি পাঠকে পড়তেও হয় সমান কর্তব্যজ্ঞান নিয়ে। পড়লে অনেক দিগন্ত যেমন উন্মুক্ত হয়। তেমনি আবার ভাবনার অনেক পথ বন্ধও হয়ে যায়।

যখন বইতে কোনো ভাবের অর্থ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। তখন সকল পাঠক আর সেই গণ্ডি পেড়িয়ে নতুন কোনো তত্ত্ব ভাবতে পারে না। তার মাথায় সেই সংজ্ঞা নির্দিষ্ট হয়ে যায়। আর একবার কোনো কিছু না বুঝে সংজ্ঞা মুখস্ত করে ফেললে ভাবনা আর এগুতে চায় না। সেখানে স্থির হয়ে যায়।

তাই সাধুগুরুরা বলেন, আদতে বই পড়ে প্রকৃত জ্ঞান আহরণ করা যায় না। বই থেকে কিছু নতুন পথের দিশা পাওয়া যায়। সেই হিসেবে একমুখী ভাবনা থেকে সড়ে আরো নানাভাবে ভাবতে শিখতে পারে মানুষ। সেই বই পড়ার সঠিক মূল্যায়ণ করতে পারে। সেই জ্ঞানের পথে হাঁটতে পারে।

আর যারা বই পড়ে তা ধ্রুব সত্য মেনে নিয়ে ভেবে বসে থাকে সব বুঝে ফেলেছে। ভাব জগতে তাকে জ্ঞান বা জ্ঞানী কিছুই বলা যায় না। ভাব জগৎ হলো উপলব্ধির জগৎ। এখানে বলা হয় শিক্ষা দুই প্রকার। যথা- সফিনা ও সিনার শিক্ষা।

বা বিভিন্ন তরিকায়। তাদের জানা শোনা ভালো। বিস্তর। কিন্তু রচনাতে রসকষ পাওয়া যায় না। গবেষণাপত্রের মতো করে রচিত। তাই সেগুলো পরে কোনো কিছু বুঝবার চেষ্টা করাও দুরহ। আবার কলকাতা কেন্দ্রীক যারা লালন সাঁইজিকে নিয়ে লিখেছেন।

সফিনা হলো- পুস্তকলব্ধ জ্ঞান। আর সিনা হলো- অন্তরের শিক্ষা যা উপলব্ধির ভেতর দিয়ে জেনে নিতে হয়ে; নিজেকে নিজে। এখানে সাধককে নিজে উপলব্ধি করে জেনে নিতে হয়। অন্যের জানা নিয়ে জ্ঞান জাহির করা যায় না। সেই পথও নেই।

প্রকৃত লেখক নিজেও এই বিষয়টা বেশ ভালোভাবেই জানেন। তাই তারা এমন ভাবেই লিখবার চেষ্টা করেন যাতে পাঠক বিভ্রান্ত হলেও নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে না যায়। আর যে লেখনিতে এমন উন্মুক্ত পথ থাকে সেই লেখকের বই পড়ে ভাববাদ-বস্তুবাদ বুঝতে চাওয়া কিছুটা কার্যকর হলেও হতে পারে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ফকির লালন সাঁইজিকে নিয়ে যা কিছু রচনা। তার বড় অংশই কল্পনাপ্রসুত রচনা। লালনের পথে না হেঁটে কেবল লোক মুখে শুনে বা বইপত্র ঘাঁটাঘাটি করে রচিত রচনা। অবশ্য কিছু রচয়িতা আছেন যারা দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করছেন লালন ঘরে।

বা বিভিন্ন তরিকায়। তাদের জানা শোনা ভালো। বিস্তর। কিন্তু রচনাতে রসকষ পাওয়া যায় না। গবেষণাপত্রের মতো করে রচিত। তাই সেগুলো পরে কোনো কিছু বুঝবার চেষ্টা করাও দুরহ। আবার কলকাতা কেন্দ্রীক যারা লালন সাঁইজিকে নিয়ে লিখেছেন।

তাদের অনেকে বিস্তর পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু তাদের কেউ কেউ বাউল আর ফকিরকে অনেকক্ষেত্রেই গুলিয়ে ফেলেছেন। বৈষ্ণবীয় ধারাকেই ফকিরি ধারা মেনে নিয়েছেন। বাকুড়া, বীরভূমের বাউল সাধকদের বিবেচনায় ফকির লালনকে দেখবার চেষ্টা করেছেন।

গুটি কয়েক লেখনিতে সাঁইজিকে বুঝবার চেষ্টা হয়েছে তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তার পরিমাণ ও সংখ্যা এতোই কম যে তা দিয়ে মহত্মা লালন সাঁইজিকে বোঝা সহজ নয় না। বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখবার পরিসর উন্মুক্ত হয় না। আদতে শেষে লালন সাঁইজিকে নিয়ে লেখনি এখনো শুরুই হয়নি।

অন্যদিকে লালনকে নিয়ে রচনার সবচেয়ে বেশি সময় নষ্ট করা হয়েছে তিনি কোনো জাতের। হিন্দুর ঘরে জন্ম। নাকি মুসলমানের ঘরে জন্ম। এই নেয় বিস্তর কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি হয়েছে। যে মানুষটা জাত-পাতের ঊর্দ্ধে তাকে ঘিরেই সবচেয়ে বেশি সময় নষ্ট করা হয়েছে তাঁর জাত অনুসন্ধানে।

বিষয়টা আক্ষেপের হলেও সত্য। অন্যদিকে আরেক শ্রেণীর সাধক জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন, ফকির লালন সাঁইজির সাথে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছে কি হয় নাই। আরেকদল সময় ক্ষেপণ করেছেন, লালনের কোন গানের কোন কথা, কোন সুর রবীন্দ্রনাথ তার রচনায় ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে।

আরেক দল লড়ে গেছেন, লালন সাঁইজির গানের খাতা যা ঠাকুর বাড়িতে রয়ে গেছে তার ব্যবচ্ছেদ করতে। আর সবচেয়ে বেশি যে কাজটি হয়েছে তা হলো লালন সাঁইজির গানের সংকোলন। গানের সংকোলন প্রকাশের পাল্লা দিতে গিয়ে সেই গানের তালিকায় ঢুকে পরেছে অন্যান্য অনেক মহতের পদ।

গুটি কয়েক লেখনিতে সাঁইজিকে বুঝবার চেষ্টা হয়েছে তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তার পরিমাণ ও সংখ্যা এতোই কম যে তা দিয়ে মহত্মা লালন সাঁইজিকে বোঝা সহজ নয় না। বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখবার পরিসর উন্মুক্ত হয় না। আদতে শেষে লালন সাঁইজিকে নিয়ে লেখনি এখনো শুরুই হয়নি।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, যারা এই বিষয়ে সবচেয়ে ভালো লিখতে পারতেন। তারা লিখতে আগ্রহী নন। তারা যদি লিখতেন তাহলে সাঁইজি সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ আরো বাড়তো বলেই মনে হয়। আমার মতো নগন্য মানুষরা ভাবনার নতুন দিশা প্রাপ্ত হতো। যদিও সাঁইজি বলেছেন- “পড়ে ভূত আর হোসনে মনোরায়।”

অন্যদিকে বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী বলেছেন, “যদি কেউ সহস্র কিতাবও পাঠ করে থাকে, তবুও তাকে আলেম বলা যাবে না। যদি তার ইলমে মারেফত জানা না থাকে।”

তবে যে গুটি কয়েক লেখনিতে লালন ফকিরকে নিয়ে ভাবনার দিগন্ত খুলে দেয়ার কাজ করেছে। তাদের সাধুবাদ জানাতেই হয়। শুধু দুই বাঙলারই নয় পৃথিবী জুড়েই ফকির লালন এক বিস্ময়। আর এই বিস্ময়কে বুঝবার জন্য অনেকেই অনেক ভাবে চেষ্টা করেছেন। করছেন এবং করবেন।

সেই সকল লেখককে ভক্তি। তাদের কাছ থেকে আরো এমনসব লেখা প্রত্যাশা করি যে লেখা পড়ে। লালন ফকিরকে জানবার জন্য আরো উৎসাহিত হবে মানুষ। বই পড়ে নিজেরাও শুরু করবে অনুসন্ধান। আমরাও পাবো আরো অনেক রসদ। যা দিয়ে আমরা নতুন করে লালনকে চিনতে পারবো। জয়গুরু।।

লালন চর্চায় গবেষককূল-

ফকির লালন সাঁইজিকে কেন্দ্র করে যত সৃজনশীল, জ্ঞান-গুণী মানুষ একত্রিত হন। সেই অনুযায়ী সাঁইজিকে নিয়ে তেমন কোনো কর্ম চোখে পরে না। লালন ফকিরের মতো মানুষকে নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা। তার প্রতিটি পদ নিয়ে, পদক্ষেপ নিয়ে যে অন্তনির্হিত গবেষণা হবার কথা ছিল তার কিছুই হয়নি।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যা কিছু করবার চেষ্টা করা হয়েছে তাও যে খুব বেশি গবেষণাপ্রসুত কিছু হয়েছে। যারা গবেষণা করেছেন তারাও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না। অল্প-বিস্তর কাজ হয়েছে বটে। তাও সবই প্রায় ব্যক্তি পর্যায়ে।

স্বল্প পরিসরের এই সকল গবেষণায় আরো সময় ও শ্রম দিতে পারলে হয়তো ভালো কিছু হতো। কিন্তু এর জন্য যে পরিমাণ সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন তা পাওয়া যায় না বলে। সেসব কেবল বই আকারে প্রকাশ পেয়েই কার্য সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।

আর বই আকারে প্রকাশের তাড়া থাকলে গবেষণা তার পূর্ণতা থেকে দূরে সরে যায়। অন্যদিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে সকল মানুষ নিরলশ পরিশ্রম করে কোনো কিছু দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন, মূল্যায়নের অভাবে সেসবও হারিয়ে যায়।

(চলবে…)

<<লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ ।। লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব সাত>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………………
আরো পড়ুন-
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এক
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দুই
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তিন
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব চার
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব সাত
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব আট
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব নয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দশ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এগারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব বারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তেরো

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!