ভবঘুরেকথা
বিশ্বাসীদের দেখা শুনা - লালন সাঁইজি

লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব নয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

লালন চর্চায় সঙ্গীতানুষ্ঠান

দেশ বিদেশে ফকির লালন সাঁইজিকে কেন্দ্র করে এখন প্রচুর সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। একক লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান যেমন হয়। তেমনি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাঝেও হয় লালন গানের বিশেষ পর্ব। এর বেশিভাগ অনুষ্ঠানই হয় দর্শক-স্রোতার মন ভোলাতে।

একটা সময় যেমন নিদেনপক্ষে দুই-একটা রবীন্দ্রসংগীত না জানলে কাউকে শিল্পী হিসেবে ধরাই হতো না। তেমন এখন জোয়ার চলছে ফকির লালন সাঁইজির। লালনের গোটা কয়েক গান না জানলে এখন বাংলাভাষাভাষি শিল্পীদের শিল্পত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠে।

মঞ্চ মাতাতে অন্ত্যত একটা-দুইটা চটকদার সুরের লালনগীতি এখন লাগে, এমনটাই বলেছিলেন এক হার্ড রক শিল্পী বন্ধু। তিনি আনন্দ নিয়ে বলেছিলেন না আক্ষেপ নিয়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারি নাই। তবে এ কথা ঠিক যে, বর্তমানে মঞ্চে-অনুষ্ঠানে লালনগীতি একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।

যেখানে লালন স্রেফ একজন বাউল। যিনি গান লিখেছেন আনন্দ-উল্লাসের জন্য। অথচ একজন ফকিরের কাছে। ফকিরি পথের পথিকের কাছে গান হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞান হচ্ছে আরাধনা। তারা ভক্তিতে-বিনয়ে-প্রেমে গান করেন। জ্ঞান চর্চা করেন।

সেই অনুষ্ঠান এলাকার মোড়ে, অজ পাড়াগায়ে হোক কিংবা রাষ্ট্রিয়। সকল জায়গাতেই লালনের পদ আসন করে নিয়েছে। যদিও লালনকে মেনে নেয়নি কেহই। এমনকি ওয়াজেও এখন লালন প্রাসঙ্গিক। কুটক্তি করতে গিয়ে লালনকেই বারবার টেনে আনা হয়।

কারণ লালনই এখন কট্টাবাদীদের বিরোধের অন্যতম হাতিয়ার। মুক্ত বিশ্বাসের জায়গাগুলো যখন ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে। তখন ফকির লালন তার অবারিত দ্বার খুলে বসে আছেন। এখানে ভক্ত-অনুরাগী-অনুসারীরা সেই পথে প্রবেশের চেষ্টায় রত।

কিন্তু সেই পথে সাগত জানাতে উপযুক্ত মানুষ না পাওয়ায় বেশিভাগ মানুষ সেই দ্বারের আশপাশে ঘুরঘুর করেই দিনাতিপাত করছে। এতে দ্বারের সম্মুখে কেবল ভিড়ই বাড়ছে। আর এই অহেতুক ভিড়ের কারণে যারা প্রবেশের সুযোগ পেতে পারে তারাও হচ্ছে বিভ্রান্ত।

আর এই বিভ্রান্তির মায়াজালে বন্দি হয়ে অনেক নবীন সাধকই শুদ্ধতা হারিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে অতলে। গহীনে। অন্ধকারে। যেখান থেকে ফিরে এসে সাঁইজির সেই অবারিত দ্বারে প্রবেশের পথ খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন হয়ে পরছে।

লালনকে যৎকিঞ্চিৎ জ্ঞান না করে কেবল লালনকে ঘিড়ে আয়োজিত সঙ্গীতানুষ্ঠানগুলো লালনকে গীতিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। লালন হয়ে উঠছে বিনোদনের পণ্য। চটকদার গান, সাথে উত্তাল বা খেমটা নৃত্য, অযাচিত তত্ত্ব কথা দিয়ে সাজানো হচ্ছে অনুষ্ঠান।

যেখানে লালন স্রেফ একজন বাউল। যিনি গান লিখেছেন আনন্দ-উল্লাসের জন্য। অথচ একজন ফকিরের কাছে। ফকিরি পথের পথিকের কাছে গান হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞান হচ্ছে আরাধনা। তারা ভক্তিতে-বিনয়ে-প্রেমে গান করেন। জ্ঞান চর্চা করেন।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো সাধুগুরুদের অনেক সঙ্গেও বিকৃত উপস্থাপন লক্ষ করা যায়। সেখানে সাধুগুরুদের অনেক সময়ই অসহায় মনে হয়। আসলে ধীরে ধীরে সাধুগুরুদের হাত থেকেও সাধুসঙ্গের মঞ্চ চলে যাচ্ছে সেই সব ভক্তদের মাঝে। যারা চটক পছন্দ করে।

বোষ্টুমী ঢঙ্গে নৃত্যকেই অনেকে ভেবে নিয়েছেন লালন গানের উপস্থাপন। আধুনিক অনেক বাদ্যযন্ত্রের সাথে মিলিয়ে গান গাওয়াকে ভাবা হচ্ছে জাতে উঠা। মঞ্চে উঠবার আগে শ্বেত বস্ত্র পরিধানকে ভেবে নেয়া হচ্ছে আভিজাত্যতা।

অনেক সময় বাইজি নাচের মতো করে হচ্ছে অনুষ্ঠানগুলো। যেখানে মানুষ টাকা দিয়ে বা না দিয়ে এসে বাইজি নাচ দেখে যাচ্ছে। শুনতে খারাপ লাগলেও বিষয়টা সত্য মনে হয় কোনো কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে। আয়োজকদের একেবার দোষও দেয়া যায় না।

কারণ লালন ধারাকে যারা বহন করে চলেছেন জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে। তারা কোনো নীতি নির্ধারণ করতে পারেন নি। যার ভিত্তিতে লালনকে উপস্থাপন করা যেতে পারে। তবে এতে আবার একটা সেন্সরশীপের বিষয় চলে আসতে পারে। এটিও ভালো কোনো কথা নয়।

অন্ত্যত লালনের মতো মুক্ত মানুষের মতাদর্শের ক্ষেত্রে তো নয়ই। কিন্তু সাধুগুরুরা যদি আপন আপন ভক্তদের মাঝেও লালনকে কি করে মঞ্চে উপস্থাপন করতে হবে। সেই শিক্ষার বুনিয়াদ রোপন করে দিত তাহলে হয়তো তাদের দেখা দেখি অন্যান্য শিল্পীরা তা শিখে নিতে পারতো। কিছু না হলেও একটা আদর্শিক মান দৃশ্যমান থাকতো।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো সাধুগুরুদের অনেক সঙ্গেও বিকৃত উপস্থাপন লক্ষ করা যায়। সেখানে সাধুগুরুদের অনেক সময়ই অসহায় মনে হয়। আসলে ধীরে ধীরে সাধুগুরুদের হাত থেকেও সাধুসঙ্গের মঞ্চ চলে যাচ্ছে সেই সব ভক্তদের মাঝে। যারা চটক পছন্দ করে।

চটকে চলছে জগৎ। তাই সকলে সেই স্রোতে গা ভাসাচ্ছে। কিন্তু যারা ডুব সাঁতার জানে। তারা কেনো সেই স্রোতে গা ভাসাচ্ছে সেটাই ভাবায়।

তবে এতো প্রতিকুলতার মাঝেও গুটি গুটি পায়ে অল্প পরিসরে হলেও অনেকে চেষ্টা চালাচ্ছে। সাঁইজির মূল ভাব ধরে রেখে সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজন করার। তারা সফল হোক এটাই প্রত্যাশা। জয়গুরু।।

লালন চর্চায় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান-

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে লালনকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। গভীর প্রেম ও প্রণয় থেকে এই ভাবনার জন্ম তা সকল ক্ষেত্রে বলা যায় না। আসলে চাহিদার প্রেক্ষিতে জোগান দেয়ার একটা রেওয়াজ প্রচলিত আছে। তাই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান লালনকে নিয়ে নতুন করে ভাবছেন।

বিষয়টি মন্দের ভালো বলা যায়। কথায় বলে, ‘কিছুই না হওয়ার চেয়ে কিছু একটা হওয়া ভালো’। আবার এ কথাও প্রচলিত আছে যে, ‘মন্দ কাজ হওয়ার চেয়ে, কাজ না হওয়াও ভালো’। তাই আসলে বিষয়টা ভালোর দিকে যাচ্ছে না মন্দের দিকে যাচ্ছে তা হুট করে বলা ঠিক হবে না।

তবে সাধারণ দৃষ্টিতে বলা যায়, কাজ হতে থাক। যোগ্য মানুষ এর মাঝ থেকে ঠিকই মণি-মুক্তা খুঁজে বের করবেন। যদি প্রচারণায় না থাকে তাহলে মানুষের কাছে পৌঁছাবে কি করে? আবার অধিক মানুষের কাছে পৌঁছালেই যে, লালন যে মানব সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন তা বাস্তবায়ন হবে তারও কোনো মানে নেই।

আসলে ভাববাদে সকল বিষয়ই আপেক্ষিক। এখানে কোনো একটা মতে টিকে থাকা মানে নিজের সাথে নিজের প্রতারণা করা। এই পথ হচ্ছে উত্তোরণের পথ। এখানে প্রতি মুর্হূতে সাধক নিজেকে আবিষ্কার করে নতুন করে। নতুন রূপে।

আর নিজেকে চেনার তো কোনো শেষ নেই। যতই চেনা যায় ততই বোঝা যায় সবটা চেনা অসম্ভব। তাই একসময় নিজের মাঝে লীন হতে চায় সাধক। যাকে চিনে উঠা সম্ভব নয়। তাতে মিশে যেতে পারলে তাকে মেনে নিতে সহজ হয়।

সেই সকল স্থানেও বর্তমানে এক রাত হলেও লালনগীতির আয়োজন থাকে। এই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়াও কম বিষয় নয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যদি গবেষণায় এগিয়ে আসে। লালনকে জানার চেষ্টা করে। সেই মোতাবেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

এই সহজ সত্যটি কিতাবী মানুষের পক্ষে মেনে নেয়া অধিকতর কষ্টের। আর মনে নেয়া প্রায় অসম্ভব। তাই লালনকে নিয়ে বিনোদন অনুষ্ঠান আয়োজন করা সহজ। তাকে ধারণ করা সহজ নয়। এটি দোষেরও নয়। সকলে সকল কাজ করবে না। এটাই সমাজের বিধি।

সকলে যদি একই কাজে মনোনিবেশ করে তাহলে আধুনিক রাষ্ট্র স্থবির হয়ে উঠতে পারে। যদি না তা সাত্বিক কর্ম হয়। সাত্বিক কর্ম হয় অন্যের ক্ষতি সাধন না করে। অন্যের উপকার হয়-মঙ্গল হয় এমন ব্রতের কর্ম। সাত্বিক মানুষ সকলের কথা স্মরণে রেখে জীবন পরিচালনা করেন।

অন্যদিকে তমসিক ও রাজসিক চরিত্রের মানুষ হয় অলসতা করে; নয়তো অধিক কর্ম করে। তারা হয় কুঁড়ে নয় আগ্রাসি। তাই স্বভাব-চরিত্র সাত্বিক না হলে সকলে যদি একই কর্মে অভ্যস্ত হয়ে যায় তাহলে সমাজে গতি হারানোর ভয় থেকেই যায়।

সে কারণে সাঁইজির বাণী কেউ জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে যেমন বয়ে নিয়ে যাবে। কেউ নিয়ে যাবে সুরে। কেউ ছন্দে। কেউ তালে। কেউ মনন। কেউ প্রচারণায়। কেউ প্রসারে। কেউ বা গবেষণায়। কেউ বা গদ্যে। কেউ অভিনয়ে। কেউ নৃত্যে। কেউ না চিত্রকলা।

কেউ তাকে তুলে ধরবে চলচ্চিত্রে। কেউ নাটকে। কেউ ভিন্ন কোনো মাধ্যমে। এই সূত্রে সকলেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। সাঁইজি যে ধীরে ধীরে সকল পর্যায়ে প্রাসঙ্গিক হয় উঠছেন। সেটাই আশার কথা। একসময় যেখানে কেবল কবিগান, বাউলগান, জারি, সারি হতো।

সেই সকল স্থানেও বর্তমানে এক রাত হলেও লালনগীতির আয়োজন থাকে। এই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়াও কম বিষয় নয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যদি গবেষণায় এগিয়ে আসে। লালনকে জানার চেষ্টা করে। সেই মোতাবেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

নিজেদের শিল্পীদের যদি সেই মনে প্রস্তুত করে। তাহলে আরো সুন্দর ও শুদ্ধ রুপে লালনকে উপস্থাপন করতে পারবো। সে বিষয়ে আশাবাদি হওয়াই যায়। জয়গুরু।।

লালন চর্চায় আয়োজকবৃন্দ-

ফকির লালন সাঁইজির পদের প্রচার-প্রসারে অনুষ্ঠান আয়োজকদেরও আছে বিশাল ভূমিকা। পাশাপাশি আছে দায়িত্ব-কর্তব্য। অনুষ্ঠানে কেবল লালন গানের আইটেম রাখলেই হয়ে গেলো না। তাকে যথাযথ ভাবে ভক্তি-মর্যদা দিয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে কিনা সেদিকেও নজর দেয়া জরুরী।

বর্তমানে রাষ্ট্রিয় হোক বা গ্রামের ছোট্ট অনুষ্ঠান সময়ের প্রেক্ষিতে লালন ফকির তার নিজের আসন সব জায়গাতেই ঠিকঠাক করেই নেন। তাই আয়োজকরাও তা আর অস্বীকার করতে পারেন না। তারাও লালন গানকে একটা জায়গা দিয়েই থাকেন।

(চলবে…)

<<লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব আট ।। লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দশ>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………………
আরো পড়ুন-
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এক
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দুই
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তিন
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব চার
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব সাত
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব আট
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব নয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দশ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এগারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব বারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তেরো

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!