ভবঘুরেকথা
ফকির লালন সাঁইজি

লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দশ

-মূর্শেদূল মেরাজ

অনেক জায়গায় আবার শুধু লালন সাঁইজিকে কেন্দ্র করেই সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের ডিজাইন করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এখনো অনুষ্ঠান ডিজাইন করার সময় কেবল খেয়াল রাখা হয়; কতজন শিল্পী গান পরিবেশন করবেন। কোন কোন শিল্পী থাকবেন।

কতজন পুরুষ শিল্পী আর কতজন নারী শিল্পী থাকবেন। যন্ত্রী কারা হবে। কার পর কাকে গাইতে দেয়া হবে। কার আগে কাকে পরিবেশন করতে বললে কে মন খারাপ করবে; সেটাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। লালন ঘরে যাদের একটু যাতায়াত আছে; তারা প্রথমে দৈন্য পদ দিয়ে শুরু করতে হবে বলে নির্ধারণ করে থাকে।

তারপর যা যেমন খুশি। যে যেই গান পারে সে তার বেলায় সেটি পরিবেশন করে মঞ্চ ত্যাগ করে। এতে গানের কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না। ভাবেরও কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না। লালন পদের যে ধারা স্থূলপ্রবর্তসাধকসিদ্ধি সেই ক্রম মানা হয় না।

এতে দর্শক-শ্রোতা ঠিক গানের ভাবে প্রবেশ করতে পারে না। আবার কোন পদের পর কোন পদ ধরতে হবে সেটারও কোনো তালমিল থাকে না। বেশিভাগ ক্ষেত্রে মঞ্চ মাতাতে যে শিল্পী যেই গানটা ভালো গায় তার সময়ে সেটিই পরিবেশন করেন।

খেয়ালে রাখেন না, তার পূর্বের শিল্পী কোন পদটা করে গেলেন। কোন ভাব দিয়ে গেলেন। কোন প্রশ্নটা রেখে গেলেন। কোন দেশের পদ গেয়ে গেলেন। পাশাপাশি লক্ষ রাখেন না সেই সময় কোন প্রহর চলছে। সেই হিসেবে কোন রাগে কোন পদ ধরতে হবে সেদিকেও সকল শিল্পী বিশেষ লক্ষ্য রাখেন না।

যারা কেবলই শখের বশে লালন ফকিরের গান করেন। তাদের কথা ভিন্ন। তারা মঞ্চ মাতানোর জন্য চকটদার অল্প কয়েকটা গান তুলে নেন কণ্ঠে। যা দিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করতে চান। কিন্তু যারা লালন ঘরে যাতায়াত করেন। তারা যখন এমন আচরণ করেন তখন বিষয়টা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়।

শহুরে পরিবেশের অনুষ্ঠান ডিজাইনেই কেবল এই সমস্যা দেখা যায় তা কিন্তু নয়। অনেক সময় সাধুগুরুদের সাধুসঙ্গেও এইরূপ দশা দেখতে হয়। কোনো কোনো সাধুসঙ্গে সাধুগুরুরা দৈন্য-প্রবর্ত নিজেরা করে বাকিটা শিল্পীদের হাতে ছেড়ে দেন।

আবার কোনো কোন সঙ্গে পুরো অনুষ্ঠানই পরিচালিত হয় শিল্পীদের খেয়াল খুশি মতো। অন্তত সাধুগুরুরা যদি তাদের সাধুসঙ্গের গানের পর্বটা দায়িত্ব নিয়ে ধারা অনুযায়ী পরিচালিত করতেন। তাহলে হয়তো আমরা তাদের কাছে থেকে সুন্দর-শুদ্ধ-সুষ্ঠ বিষয়টা শিখতে ও জানতে পারতাম।

এ বিষয়ে তাদের সাথে আলাপচারিতায় গেলে। বেশিভাগ সাধুগুরুই আক্ষেপ করে বলেন, “আগে হইতো বাপ। এখন আর হয় না। আমরা একসময় পাইছি। সেই সময় পুরো সাধুসঙ্গ অনুষ্ঠিত হইতো জবাবি গান দিয়া। একজন এক গানে প্রশ্ন করতো অন্য জন তার উত্তর দিতো।

খুবই সাম্প্রতিক কালে আরেকটা বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। শিল্পীরা মঞ্চে উঠে কথা বলতে শুরু করে দেয়। আয়োজকরা সেই সুযোগটাও করে দেয়। এতেও ভাবের নষ্ট হয়। কে কোথা থেকে এসেছে, উপস্থিত অতিথিদের কতটা পা চাটতে পারে।

বা একজন যে গান গাইতো সেই গানের ধারায় অপর জন তার পরের গানটা ধরতেন। এখন সেসব হয় না। আগে হইতো।”

কিন্তু আজ তাদের হাতে সেই ক্ষমতা আছে। বিষয়গুলো মেনে নিজের সাধুসঙ্গে চাইলে করতে পারেন। কিন্তু কেনো করেন না, এই বিষয়ে জানতে চাইলে বেশিভাগ সাধুগুরুই উত্তর দেন না। তাদের অসহায়ত্ব দেখা যায় চোখে মুখে।

আসলে গানের অনুষ্ঠানের পর্বটা পরিচালনা চলে গেছে উঠতি ভক্তদের হাতে। তারা নিজেদের মতো শিল্পী এনে গান পরিবেশন করায়। আর শিল্পী বড় হয়ে গেলে তাদের বলে কয়ে কিছু করার সাধ্য কার আছে। সকলকেই বিশাল মাপের শিল্পী এনে কেনো প্রমাণ করতে হবে, সাধুসঙ্গ মানেই বাহারি গায়ক-গাইকার উপস্থিতি, তা কে জানে?

আবার অনেক অনুষ্ঠানেই দেখা যায় প্রভাবশালী ভক্ত। সংগঠনের লোক। ভক্তদের আত্মীয়স্বজন, ছেলেপিলে, ভক্তের ভক্তদের গান গাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়।

একটা ভাবে পদ পরিবেশন চলছিল। সকলে ভাব থেকে মহাভাবে পৌঁছাতে চলেছে। এমন সময় দেখা গেলো অনুরোধের ঢেকি গিলে এমন কাউকে মঞ্চে জায়গা করে দেয়া হলো। যে পুরো ভাবটাই নষ্ট করে দিলো।

খুবই সাম্প্রতিক কালে আরেকটা বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। শিল্পীরা মঞ্চে উঠে কথা বলতে শুরু করে দেয়। আয়োজকরা সেই সুযোগটাও করে দেয়। এতেও ভাবের নষ্ট হয়। কে কোথা থেকে এসেছে, উপস্থিত অতিথিদের কতটা পা চাটতে পারে।

বর্তমানে অন্য অনেক তরিকার দর্শনেও লালন গান প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। চাহিদা বেড়েছে। আবার এসকল অনুষ্ঠানের আয়োজকরা লালন গানকে অনুষ্ঠানের তালিকায় ঢুকাতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের ডিজাইন সুন্দর করে করতে না পারায় এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাচ্ছে না।

কার কার পা চেটে এ পর্যন্ত এসেছে এসব ফিরিস্তি দেয়া শুরু করে। উপস্থাপকরাও এমন কাণ্ড প্রায়শই করে থাকে। আবার গান শেষে কে কত অর্থ উপহার দিল। তার পরিমাণ কত। যিনি দিয়েছেন তার চোদ্দগুষ্টির পারিবারিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয় পর্ব চালাতে গিয়ে গানের ভাব আর অবশিষ্ট থাকে না।

তবে শিল্পীরা যখন মঞ্চে উঠে গানের উল্টা-পাল্টা ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করে তখন সবচেয়ে কষ্ট লাগে। ভাবগানের অর্থ স্থির থাকে না। তাই তার শাব্দিক অর্থ ধরে কিছু বলা বেশ শক্ত। অতি পণ্ডিত ব্যক্তি তা বলে পার পেয়ে গেলেও।

সাধারণ মেধার মানুষ তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করলে বিপদের উপরে বিপদ। তার উপর অপরে কি করলো। অন্য মানুষ কি করছে। অপরের কুৎসা করা তো তাদের কর্ম না।

তাও আজকাল অনেক শিল্পীই এই কাজটি করে চলেছে। আয়োজকরাও এ বিষয়টি নিয়ে আগে থেকে শিল্পীদের সর্তক করে দেয় না। এতে পরিবেশ নষ্ট হয়। মানুষ ভাব পায় না। দর্শক অনুষ্ঠান শেষের আগেই স্থান ত্যাগ করে।

বর্তমানে অন্য অনেক তরিকার দর্শনেও লালন গান প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। চাহিদা বেড়েছে। আবার এসকল অনুষ্ঠানের আয়োজকরা লালন গানকে অনুষ্ঠানের তালিকায় ঢুকাতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের ডিজাইন সুন্দর করে করতে না পারায় এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাচ্ছে না।

এতে এই বছর জোর করে লালন গান তালিকায় রাখলেও। পরের বছর তা রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পরতেই হয়।

আর যারা সারারাত জুড়ে গান শুনতে অভ্যস্থ তাদের কাছে তৃতীয় প্রহর অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এই সময় সকল মানুষই স্থির হয়ে যায়। আবেগী হয়ে উঠে। এই সময় চাহিদা তৈরি হয় বিচ্ছেদ ধারার গানের। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় এইসময়ও শিল্পীরা চটক গান গাইতে শুরু করে।

তবে লালন গানের যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রত্যাশা রাখি আয়োজকরা বিষয়টিকে আরো গুরুত্ব দিয়ে আয়োজন করবেন। পালাগান-জারিগান-কবিগান দীর্ঘ সময় ধরে এই অঞ্চলে মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে। তার পরিবেশন কি হবে তা এখন অলিখিত দলিল হয়ে গেছে।

আবার আয়োজকরা অনেক সময় দেশীয় যন্ত্রের বদলে মঞ্চে বিদেশী যন্ত্র নিয়ে আসে। তাতে লালন গানের আদি ভাব ধরে রাখাও মুশকিল হয়ে যায়। লালন সাঁইজির পদের সাথে দেশীয় যন্ত্র যে অনুসঙ্গ তৈরি করে। বিদেশী যন্ত্রে সেই ভাব আনা আনাড়ি যন্ত্রীর কর্ম নয়।

আবার আয়োজকরা যন্ত্রীদের সাথে আগে থেকে আলোচনা করে নেন না যে, শিল্পী যেভাবেই গান পরিবেশন করুক না কেনো সেই গানটা তুলে দিতে হবে। তাকে ডুবিয়ে দেয়া যাবে না। এরজন্য অনেক সময়ই দেখা যায় নবীন শিল্পী হলে বা প্রবীণ বাউল হলে যন্ত্রীরা তাকে সহযোগীতা করে না।

গানের সময় এমন বাদ্য বাজায় যে গান আর দর্শক-শ্রোতার মনে দাগ কাটতে পারে না। আবার অনেক সময় যন্ত্রীরা এমন ভাবে বাদ্য বাজায় যে শিল্পীর গলা খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বিষয়গুলো আয়োজকদের অধিক মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।

নইলে দেখা যায়, প্রথম প্রহরে শিল্পীরা মঞ্চে গোষ্ঠের গান গাইতে শুরু করে দেয়। তাই সাধু সাবধান।

তবে লালন গানের যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রত্যাশা রাখি আয়োজকরা বিষয়টিকে আরো গুরুত্ব দিয়ে আয়োজন করবেন। পালাগান-জারিগান-কবিগান দীর্ঘ সময় ধরে এই অঞ্চলে মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে। তার পরিবেশন কি হবে তা এখন অলিখিত দলিল হয়ে গেছে।

অনেক সময় আয়োজকরা অপটু হলেও জাত শিল্পীরাই অনুষ্ঠান সফল করে তোলে। কিন্তু লালন গান অনেক অনুষ্ঠানেই নতুন সংযোজন। তারও স্থায়ী হতে সময় লাগবে সন্দেহ নেই। এরজন্য শিল্পীদের যেমন দায়িত্ব নিয়ে পরিবেশন করতে হবে। তেমনি আয়োজকদেরও সেই মতে পরিকল্পনা করতে হবে। জয়গুরু।।

লালন চর্চায় আলোচনা/সেমিনার-

শহুরে নাক উঁচু লোকের কাছে ফকির লালন সাঁইজি অজো পাড়াগায়ের ব্রাত্য একজন সাধক মাত্র। তাকে মহান প্রমাণ করবার জন্য বারবার বলা হয়- একজন আপত নিরক্ষর মানুষ কি করে এতো গভীর কথা বললেন। এই বিষয়টাতেই আপত্তির শুরু।

জ্ঞান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়। জ্ঞান প্রথাগত-নির্দিষ্ট পথেই অর্জন করতে হবে। এটাই একমাত্র পথ। এমনটা ভাববারও কারণ নেই। এইভাবে কাউকে বড় বা ছোট করা প্রকৃত মূল্যায়ণের পথে প্রথম অন্তরায়। লালন কারো করুণার পাত্র নয়।

তিনি আপন মহিমায় বিকশিত। গ্রামের একজন মানুষ এইরূপ ভাবতে পেরেছেন বলে তিনি মহান। বিষয়টা মোটেও তেমন নয়। তিনি মহান তাই তিনি ভাবতে পেরেছেন। ভাবাতে পেরেছেন। ভাবিয়ে চলেছেন। ভাবিয়ে চলবেন। এটাই লালন।

ফকির লালন সাঁইজি ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী। এই নিয়ে আছে নানান মুনির নানান মত। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাবনায় পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি প্রদান করে থাকেন। সে বিষয়ের গভীর প্রবেশ করছি না। তবে এইখানে শুধু এইটুকুই বলতে চাই, লালন বস্তুবাদী হলেও তাকে ভাববাদ দিয়ে বুঝতে হয়।

জ্ঞানে তাকে ধরা কঠিন। তাকে ধরতে হবে প্রেমে-বিনয়ে-ভক্তিতে। নইলে তাকে ধরা বেশ শক্ত। তবে আমাদের জ্ঞানের যে ধারা সমাজে প্রচলিত ও স্বীকৃত। তাতে এই প্রকারে জ্ঞান নেয়াকে মূর্খামির নামাস্তর বলেই ধরে নেয়া হয়। তাই শিক্ষিত সমাজ লালনকে দেখতে চায় ভিন্ন দৃষ্টিতে।

যুক্তির প্রমাণে লালনকে ধরতে গিয়ে, তাদের বড় অংশ লালন গানের অর্থ করায় মনোযোগী হয়ে উঠেন। যা সাধারণত শব্দের অর্থের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে। এটিও লালনকে বোঝার একটি পর্যায়। সেটি অস্বীকার করবার উপায় নেই।

(চলবে…)

<<লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব নয় ।। লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এগারো>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………………
আরো পড়ুন-
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এক
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দুই
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তিন
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব চার
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব সাত
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব আট
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব নয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দশ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এগারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব বারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তেরো

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!