-জগদীশচন্দ্র রায়
এই বিষয়ে বিশ্লেষণের পূর্বেই জানিয়ে দিই যে, এই দেহতত্ত্ব কিন্তু বৈদিক ভাবনার নয়। এটা মতুয়া দর্শনের হলেও এটা বৈজ্ঞানিক ও সার্বজনীন ব্যাখ্যা। এখানে বৈদিকতার কোনো স্থান নেই।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজসংস্কার ও মুক্তির দিশা-
মাটি দিয়ে গড়া দেহ মাটিতেই লয়।
দেহ হেত দেহ তাই প্রকৃতি গড়ায়।।
এবে শুন কেবা কান্দে কিসের মায়ায়।
ব্রহ্মের বিকারে সৃষ্ট ব্রহ্মাণ্ড যে হয়।।
ব্রহ্মের বিকার ভাগ হল পঞ্চ ক্রমে।
ক্ষিতি অপ: তেজ: মরুদ্বোম্ পঞ্চ নামে।।
ব্রহ্ম ধরে ‘আত্মা’ নাম তত্ত্বে দেহ কয়।
উভয়ে মিলন হ’লে জীব সৃষ্টি হয়।।
ভূত ত আধঅর মাত্র দেহ নাম ধরে।
চিৎ শক্তি আত্মা আছে তাই চলে ফিরে।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৩৫৪/৩৫৫)
মতুয়া ধর্ম দর্শনের আকর গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ ও ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’-এ এমন ভাবে কিছু মণিমুক্ত সাজানো আছে, যেটাকে খুঁজতে হলে এর গহ্বরে প্রবেশ করতে হবে দক্ষ ডুবুরির মতো। যে কথা লীলামৃতে কবি তারক সরকার বলেছেন-
শ্রোতাগণ হংসবৎ দোষ ছাড়ি গুণ যত
দুগ্ধবৎ করুণ গ্রহণ।
(শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত, পৃ-৩৯)
এবার আমরা উপরের কথাগুলির ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।
প্রকৃতি পাঁচটি উপাদানে গঠিত। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। প্রকৃতির এই পাঁচটি উপাদানের চারটি উপাদানে গঠিত হয় জীব। ব্যোম বা মহাশূন্য জীব সৃষ্টির জন্য সরাসরি প্রয়োজন হয় না। প্রকৃতির এই চারটি উপাদানের আনুপাতিক মিশ্রণে প্রথমে জীবের উদ্ভব হয়।
বিবর্তনের মাধ্যমে কোটি কোটি বছর পরে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে। এই প্রাণীর মধ্যে সব থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে মানব। এই মানব বা যে কোনো প্রাণী, পুরুষ ও নারীর শুক্রাণেু ও ডিম্বাণুর উপযুক্ত ‘উভয়ে মিলন হলে জীব সৃষ্টি হয়।’
জীবের মধ্যে চেতনার সঞ্চার হয়। সেই চেতনাকে কেউ ব্রহ্ম বলেন। আবার কেউ আত্মাও বলেন। প্রশ্ন হচ্ছে- কবি এখানে বলেছেন- ‘মাটি দিয়ে গড়া দেহ মাটিতেই লয়। দেহ হতে দেহ তাই প্রকৃতি গড়ায়।’
সেটা কীভাবে ঘটছে? তাহলে আসুন সেই ব্যাখ্যার অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাক। আমি প্রথমেই জানিয়েছি প্রকৃতির পাঁচটি উপাদান বা পঞ্চভূতের চার ভূত লাগে জীব সৃষ্টির জন্য। যার মধ্যে ক্ষিতি বা মাটিও আছে। একটু গভীরভাবে ভাবলে আমরা দেখতে পাই- শক্তির উৎস হচ্ছে ‘তেজ’ বা সূর্য।
সেই জল শরীর দাহ করা বা কবর দেওয়ার ফলে ধীরে ধীরে চলে যায়। আর পড়ে থাকে শুধু মাংস বা হাড়। সেই মাংস বা হাড় এক সময়ে মাটিতে মিশে যায়। অর্থাৎ প্রাণীর শরীরে যে মাংস ও হাড় সেসব বাস্তবে মাটিরই অংশ। তাই কবি এখানে গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভাবনা ও বিচার বুদ্ধির সমন্বয় রেখে প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক নিয়মকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
এই সূর্য থেকেই প্রতিটি প্রাণী বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে। প্রশ্ন আসে কীভাবে? পাঠকগণ আপনারা মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান বইতে জেনে থাকবেন উদ্ভিদ তার খাদ্য উৎপন্ন করে সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) প্রক্রিয়ায় পাতার মাধ্যমে। তার থেকেই সূর্যের শক্তি সঞ্চারিত হয় উদ্ভিদের মধ্যে।
পশু বা প্রাণীরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সেই উদ্ভিজ্জ গ্রহণ করে। তখন শক্তিটা উদ্ভিজ্জ থেকে পশু বা প্রাণীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এই হচ্ছে শক্তি সঞ্চারণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পশু বা প্রাণীরা বেঁচে থাকে। তারপর প্রকৃতির নিয়মেই আবার এক সময় মারা যায় বা চেতনা বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য প্রথম উপাদান দেখলাম ‘তেজ’ বা শক্তি। দ্বিতীয় উপাদান হচ্ছে- ‘মরুৎ’ বা বায়ু। প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য বায়ু একান্ত আবশ্যক। তৃতীয় উপাদান হচ্ছে- ‘অপ্’ বা জল। প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য জলও আবশ্যক।
এবার প্রশ্ন আসতে পারে তিনটি উপাদান সম্পর্কে তো জানলাম কিন্তু চতুর্থ উপাদান ‘ক্ষিতি’ বা মাটি আমাদের সঙ্গে কীভাবে জীড়য়ে আছে?
কোনো প্রাণীর মৃত্যু হলে আমরা দেখতে পাই বা বুঝতে পারি, যেসব উপাদানের সমন্বয়ে প্রাণীর উদ্ভব হয়েছিল, মৃত্যুর পরে আবার সেগুলি স্ব স্ব উপাদানে মিলিত হয়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বায়ু বন্ধ হয়ে যায়। শরীরে প্রকৃতির মতোই চার ভাগের তিন ভাগ জল আছে।
সেই জল শরীর দাহ করা বা কবর দেওয়ার ফলে ধীরে ধীরে চলে যায়। আর পড়ে থাকে শুধু মাংস বা হাড়। সেই মাংস বা হাড় এক সময়ে মাটিতে মিশে যায়। অর্থাৎ প্রাণীর শরীরে যে মাংস ও হাড় সেসব বাস্তবে মাটিরই অংশ। তাই কবি এখানে গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভাবনা ও বিচার বুদ্ধির সমন্বয় রেখে প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক নিয়মকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
যার জন্য বলেছেন- ‘মাটি দিয়ে গড়া দেহ মাটিতেই লয়। দেহ হতে দেহ তাই প্রকৃতি গড়ায়।’
পরে আমরা দেখতে পাই- আমরা যে মায়ার জালে জড়িয়ে আছি, সেই মায়ার জালটা হচ্ছে- পিতামাতার থেকে সন্তানের জন্ম হয়। পরবর্তীতে এই একই সূত্র চলতে থাকে। যে সূত্রের সঙ্গে এই মায়ার জালও নিবিড় ভাবে যুক্ত আছে।
ব্রহ্ম ধরে ‘আত্মা’ নাম তত্ত্বে দেহ কয়।
উভয়ে মিলন হ’লে জীবন সৃষ্টি হয়।।
অর্থাৎ পিতামাতার চেতনার মিলনের ফলে জীবের সৃষ্টি হয়। সেই চেতনাকে ব্রহ্ম বা আত্মা বলা হয়। যে চেতনা দেহের মধ্যে সদা অনুভূত হয়। আবার বলা হয়েছে যে, ‘ভূত’ত আধার মাত্র দেহ নাম ধরে। চিৎ শক্তি আত্মা আছে তাই চলে ফিরে।।’
পূর্বেই বলেছি, চার ভূতের যে আনুপাতিক মিলনের ফলে প্রাণীর জন্ম হয়। সেই প্রাণী আকার বা দেহ নাম ধারণ করে। আর এই দেহের মধ্যে যে চিৎ শক্তি বা চেতনা শক্তি আছে, তাকেই আত্মা বলা হয়েছে। যে চিৎশক্তি বা চেতনা শক্তি আমৃত্যু নিরন্তর চেতনা প্রবাহকে জারি রাখে।
এ বিষয়ে আমরা শ্রীশ্রীহরিলীলামৃতে দেখতে পাই-
তুমি-স্থূল আমি সূক্ষ্ম উভয়ে অভিন্ন।
দেহ আত্মা মোরা দেঁহে মূলে নহি ভিন্ন।।
(শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত, পৃ-৭৩; প্রকাশ; ২০০৯, ঠাকুরনগর)
এখানেও আমরা দেখতে পাই ‘তুমি স্থূল’ অর্থাৎ শরীর বা দেহ হচ্ছে স্থূল। ‘আমি সূক্ষ্ম’ আমি এখানে চেতনা। এই শরীর ও চেতনা উভয়ে একত্রে অবস্থান করে। একের অবসানে অন্যের ও অবসান বা মৃত্যু।
অর্থাৎ শরীরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দেহের মধ্যে অবস্থিত চেতনা বা আত্মারও মৃত্যু ঘটে। আর এই অবসানের পর আবার উপাদানগুলি স্ব স্ব বিলীন হয়ে যায়।
তবে ভাবুক মানুষের মনের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা জাগৃত না হলে এই সহজ তত্ত্ব তাঁরা বুঝতে চাইবেন না। তাঁরা বৈদিকতার চিন্তা ধারার ভাইরাসকেই সব সময় কার্যকরী করার চেষ্টা করবেন। যদিও সামান্য একটু বিচার করলেই এই চরম সত্যকে বোঝা যায়।
কারণ জীবের সৃষ্টির জন্য যেমন প্রকৃতি নির্ভর। তেমনি বেঁচে থাকার জন্য ও সর্বক্ষণ প্রকৃতি নির্ভর। সেটা হচ্ছে- খাদ্য, পানীয়, বায়ু ও খনিজ পদার্থ বা মৃত্তিকা।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র উপেন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যুতে পুত্র শোকে মুহ্যমান সত্যভামা যখন মৃত পুত্রকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছে বিলাপ করছিলেন, তখন ঠাকুর বলেন-
মরা শব লাগি কান্দ’ ওরে জ্ঞানহীনা।
দেহ ছেড়ে গেলে প্রাণ কখনো ফিরে না।।
মরণ জানিবে ধ্রুব দেহধারী পক্ষে।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৩৪৬)
বৈদিক গ্রন্থানুসারে মৃত্যু, শুধু শরীরের। জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করার মতো। কর্ম অনুযায়ী স্বর্গ বা নরকে স্থান হয়। আত্মার কোনো বিনাশ হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, তাই যদি হয় তবে কেন মৃতের উদ্দেশ্যে ঘটা করে জিনিসপত্র দান, মন্ত্রপাঠ?
আসলে এসবই বৈদিকবাদীদের ধর্মীয় ব্যবসা। গুরুচাঁদ ঠাকুর এই বৈদিক ধর্মীয় ব্যবসাকে বলেছেন- ‘কোথায় ব্রাহ্মণ দেখ, কোথায় বৈষ্ণব। স্বার্থ বসে অর্থ লোভী যত ভণ্ড সব।’
পরিবারের যে কেউ মারা গেলে সেটা বড় একটা শোকের ছায়া নিয়ে আসে। কিন্তু যদি কেউ একবার মারা যায়, সে আর ফিরে আসে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তাই তিনি স্বীয় পুত্রের অকাল মৃত্যুতে জীবনসাথীকে সান্তনা দিয়ে জানিয়েছেন, জীবন-মৃত্যু, এটা ধ্রুব সত্য। জন্মিলে তো একদিন তাকে মৃত্যুকে বরণ করতেই হবে।
ধরিয়া মানব দেহ বাঁচিয়া রহে না কেহ,
বিধাতার এই নীতি না হবে লঙ্ঘন।।
অসম্ভব কথা এই দেহ ধরে মৃত্যু নেই
মৃত্যুর অধীনে মাত্র জীব দেহ ধরে।
মরণ পরম সত্য মৃত্যু বুকে এই তত্ত্ব
অনিত্য সংসারে সব সৃষ্টির বিকারে।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৬৮)
জন্ম মৃত্যু প্রকৃতির নিয়ম। কেউ জন্মগ্রহণ করলে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। প্রকৃতির এই নিয়ম কেউ কোনো প্রকারেই লঙ্ঘন করতে পারে না।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই কথা বলার উদ্দেশ্য শুধু মাত্র জীবনসঙ্গীনির জন্যই নয়, সমস্ত মানবজাতিকে জন্মমৃত্যুর এই প্রাকৃতিক নিয়মকে বোঝানোর জন্য। আর এই নিয়মের বাইরে যারা কথা বলে অর্থ উপার্জন করে তাদের ভণ্ডামিকে বোঝানোর জন্য।
যদিও গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই চিরন্তন ও বৈজ্ঞানিক ভাবনাকে এখনো মানুষেরা বুঝলো না। কারণ তারা পুঁথিগত শিক্ষা পেলেও চেতান জাগরণের শিক্ষা থেকে অনেক দূরে। এখনো তারা বৈদিকতার জালে ফেঁসে আছে।
……………………………
গুরুচাদ ঠাকুরের সমাজসংস্কার ও মুক্তির দিশা
……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন
তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর
……………………………
আরো পড়ুন:
মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া