সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি দ্বিতীয়
-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
এ-ধারণাও সাধারণত স্বীকৃত হয়েছে যে, মুক্তি বা ত্রিতাপনাশের পদ্ধতি হিসেবে সাংখ্য ওই ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতি থেকে পুরুষ বা আত্মার স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি করবার উপদেশ দিয়েছে। আমরা একটু পরে দেখবো, এ-জাতীয় তত্ত্ব সাংখ্য-দর্শনের উপর বেদান্তর প্রভাবেরই পরিণাম।
আপাতত কথা হলো, সাংখ্য-দর্শনের আদি-রূপ অনুসারে পুরুষ বলতে আত্মা বা soul বোঝায়নি। কালক্রমে অবশ্যই সাংখ্যের পুরুষ আত্মাবাচক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো; কিন্তু এখানে আমাদের আলোচনাটা সাংখ্যের আদি-রূপ নিয়ে, এবং আদি-পর্বে সাংখ্যের ওই পুরুষ বলতে আত্মা বোঝাতো না- তার বদলে পুরুষমানুষই বোঝাতো।
এ-বিষয়ে অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডে[৭০৯] ইতিপূর্বেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ব্রাহ্মণগ্রন্থের ক্রিয়াকাণ্ড প্রসঙ্গে পুরুষ শব্দটির প্রয়োগ বিশ্লেষণ করে তাঁরা সিদ্ধান্ত করছেন-
This clearly shows that Purusa originally denoted the human being with its peculiar bodily structure and not any inner or spiritual entity in dwelling therein. (In the first and second group of our Upanisadic texts, this is almost the exclusive sense in which the term is used.)
অর্থাৎ, এ-থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, আদিতে পুরুষ বলতে দেহবিশিষ্ট মানবই বুঝিয়েছে- এই দেহাভ্যন্তরের কোনো আধ্যাত্মিক সত্তা নয়। (আমাদের পর্যায়বিভাগ অনুসারে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের উপনিষদগুলিতে পুরুষ শব্দ প্রায় সর্বত্রই একমাত্র এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।)
এই প্রকৃতি এবং পুরুষের মধ্যে প্রাধান্য কিন্তু প্রকৃতিরই এবং এইদিক থেকেই আমরা দেখাবার চেষ্টা করছি যে, সাংখ্য-দর্শনে মাতৃপ্রাধান্যমূলক চেতনার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। অতএব এইখানে একটি মৌলিক সমস্যা ওঠে- সাংখ্য যদি সত্যিই মাতৃপ্রাধান্যমূলক ধ্যানধারণার পরিচায়ক হয়, তাহলে তার মধ্যে পুরুষের তত্ত্ব একান্তই কী ভাবে স্থান পেতে পারে?
অবশ্যই, ব্রাহ্মণ-উপনিষদাদির মতো বৈদিক সাহিত্যের মধ্যেই সাংখ্যের আদিরূপটির সন্ধান পাওয়া যায় কিনা- এ-প্রশ্ন স্বতন্ত্র। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, আদিতে সাংখ্য বৈদিক আর্যদের মতো ছিলো না এবং আমরা পরে দেখবো, এ-বিষয়ে অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে এবং হেনরিখ জিমার প্রমুখ পাশ্চাত্যের বিদ্বানেরাও মহামহোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত হবেন।
এবং, আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে যারা বৈদিক সাহিত্যের উপরই নির্ভর করে সাংখ্যের উৎস ও বিকাশ সংক্রান্ত ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছেন তাদের সিদ্ধান্ত অনিবার্যভাবেই অসম্পূর্ণ হয়েছে।
কিন্তু তা-সত্ত্বেও, আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো যে, সাংখ্যের আদিরূপটিকে পুনর্গঠন করবার উদ্দেশ্যে ওই বৈদিক সাহিত্যের ইংগিতগুলি- এবং বিশেষত বেদান্তসূত্রের উক্তিগুলিই- আমাদের কাছে অমূল্য; তার কারণ, বৈদিক চিন্তাধারার সামনে প্রধানতম প্রতিপক্ষ বলতে ছিলো সাংখ্য ধ্যানধারণা।
সাংখ্য-প্রবচন-সূত্রে, এমন কি সাংখ্য-কারিকায়, সাংখ্যের যে পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে বৈদান্তিক চিন্তার সঙ্গে সাংখ্যের আপোষের চেষ্টাটাই প্রধান; অপরপক্ষে, উপনিষদাদি গ্রন্থের যেখানে সাংখ্যের উল্লেখ পাওয়া যায় সেখানে প্রধানতম চেষ্টা হলো, সাংখ্যের মূল তত্ত্বকে খণ্ডন করবার বা বৈদান্তিক তত্ত্বের চেয়ে ছোটো করে দেখাবার।
তাই আদিতে সাংখ্য ভারতীয় চিন্তাধারায় অবৈদিক ঐতিহ্যের পরিচায়ক হলেও ওই উপনিষদাদি গ্রন্থের মধ্যেই পূর্বপক্ষবর্ণন হিসেবে সাংখ্যের যে-পরিচয় পাওয়া যায় তা থেকে সাংখ্যের আদিরূপটিকে অনুমান করবার অবকাশ আছে।
এ-প্রশ্নের আলোচনায় আমরা পরে প্রত্যাবর্তন করবো। আপাতত আমাদের যুক্তি শুধু এইটুকুই যে, আদিতে সাংখ্যে পুরুষ অর্থে যে আত্মা বা soul বোঝায়নি- তার বদলে রক্তমাংসের পুরুষমানুষই বুঝিয়েছে,- অধ্যাপক বেলভেলকার ও রানাডের এই সিদ্ধান্ত ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ সাহিত্যের স্বাক্ষরের উপর নির্ভরশীল হলেও স্বীকারযোগ্য।
অতএব, সংক্ষেপে- প্রকৃতি আর পুরুষ নিয়েই সাংখ্যের মূল তত্ত্ব। কিন্তু প্রকৃতি বলতে শুধুমাত্র primordial matter-ই নয়, female principle-ও। অপরদিকে, পুরুষ বলতে আদিতে soul বা আত্মা নয়; তার বদলে পুরুয়মানুষই।
এই প্রকৃতি এবং পুরুষের মধ্যে প্রাধান্য কিন্তু প্রকৃতিরই এবং এইদিক থেকেই আমরা দেখাবার চেষ্টা করছি যে, সাংখ্য-দর্শনে মাতৃপ্রাধান্যমূলক চেতনার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। অতএব এইখানে একটি মৌলিক সমস্যা ওঠে- সাংখ্য যদি সত্যিই মাতৃপ্রাধান্যমূলক ধ্যানধারণার পরিচায়ক হয়, তাহলে তার মধ্যে পুরুষের তত্ত্ব একান্তই কী ভাবে স্থান পেতে পারে?
শঙ্করাচার্যের এই যুক্তি সাংখ্যমতকে ধুলিসাৎ করে কিনা, সে-আলোচনা স্বতন্ত্র। কিন্তু, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এখানে তিনি সাংখ্য-মতের মূল অন্তঃবিরোধটির প্রতিই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন- “কথঞ্চোদাসীনঃ পুরুষঃ প্রধানং প্রবর্ত্তয়েং”- উদাসীন পুরুষ কীভাবে প্রধানকে প্রবর্তন করতে পারে?
কিংবা, পুরুষ যদি একান্তভাবেই অপ্রধান এবং উদাসীন হয় এবং প্রকৃতির তত্ত্বই যদি সাংখ্যের প্রধান তত্ত্ব হয়, তাহলে এই সাংখ্যের মধ্যে পুরুষের কথা ওঠেই বা কেন?
প্রাচীন আচার্যরাও সাংখ্যের বিরুদ্ধে যে-আপত্তি তুলেছেন তার মধ্যেও এই সমস্যাটিরই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। উদাহরণ-স্বরূপ বলা যায়, শঙ্করাচার্য[৭১০] সাংখ্য-মত খণ্ডনের যুক্তি হিসেবে বলছেন, যদিও সাংখ্যকারের অন্ধ ও পঙ্গুর বা লৌহ ও অয়স্কান্তের দৃষ্টান্ত দিয়ে পুরুষ আর প্রকৃতির সম্বন্ধটা ব্যাখ্যা করতে চান তবুও সে-ব্যাখ্যা স্বীকারযোগ্য হতে পারে না।
শঙ্কর বলছেন, সাংখ্যবাদীরা দু’রকম দৃষ্টান্তের সাহায্যে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন। এক অন্ধ ও পঙ্গুর দৃষ্টান্ত- পঙ্গু প্রবৃত্তিশক্তিবিহীন হলেও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন এবং অন্ধ দৃষ্টিশক্তিবিহীন হলেও প্রবৃত্তিশক্তিসম্পন্ন- অতএব পঙ্গু অন্ধের উপর অধিষ্ঠিত হয়ে তাকে প্রবর্তিত করতে পারে। কিংবা, দুই? অয়স্কান্ত যেমন ‘স্বয়ং অপ্রবর্তমান থাকিয়াও লোহকে প্রবর্তিত করে, সেইরূপ পুরুষও প্রধানকে প্রবর্তিত করে।’ কিন্তু, উভয় দৃষ্টান্তই বিফল-
সে পক্ষে দোষ এই যে, প্রধানের স্বতন্ত্রতা বা স্বাধীন প্রবৃত্তি অঙ্গীকার করিতে হয়, অথচ পুরুষের প্রবর্তকত্ব স্বীকার করা যায় না। অবশ্যই তাহা সাংখ্যের পক্ষে দোষ- স্বীকৃতহানি দোষ। বিবেচনা কর, উদাসীন পুরুষ কিরূপে প্রধানকে প্রেরণ করিবে?
পঙ্গুর বাকশক্তি প্রভৃতি আছে, তদ্বারা সে অন্ধকে প্রেরণ করিতে পারে; কিন্তু পুরুষের এমন কোন প্রবর্তক ব্যাপার নাই, যদ্বারা পুরুষ প্রধানকে কার্ঘ্যে প্রবর্তিত (কার্যোন্মুখ) করিতে পারেন। পুরুষ নিগুণ ও নিক্রিয়। তিনি চুম্বকের ন্যায় কেবলমাত্র সন্নিধানবলে প্রধানকে প্রবর্তিত করেন, এরূপ বলাও সঙ্গত নহে।
তাহার সন্নিধান নিত্য- চিরকালই সমান- তদনুসারে প্রধানের প্রবৃত্তিও নিত্য ও সদা কাল সমান থাকা উচিত। দেখা যায়, চুম্বকের সন্নিধান অনিত্য। অর্থাৎ, কদাচিৎ (কখনো)। বিশেষতঃ তাহা পরিমার্জন ও ঋজুভাবে স্থাপনাদি অপেক্ষা করে।
এই সকল কারণে পুরুষ ও চুম্বক উভয়ই অনুপন্যসনীয়, অর্থাৎ অযোগ্য দৃষ্টান্ত। আরও দেখো, প্রধান অচেতন ও পুরুষ উদাসীন। সে কারণে উক্ত উভয়ের সম্বন্ধ হওয়া অসম্ভব। সম্বন্ধ ঘটনা করায়- এমন তৃতীয় পদার্থ সাংখ্যমতে নাই।
শঙ্করাচার্যের এই যুক্তি সাংখ্যমতকে ধুলিসাৎ করে কিনা, সে-আলোচনা স্বতন্ত্র। কিন্তু, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এখানে তিনি সাংখ্য-মতের মূল অন্তঃবিরোধটির প্রতিই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন- “কথঞ্চোদাসীনঃ পুরুষঃ প্রধানং প্রবর্ত্তয়েং”- উদাসীন পুরুষ কীভাবে প্রধানকে প্রবর্তন করতে পারে?
এই অন্তঃবিরোধের কথা শুধুই যে প্রাচীন আচার্যদের চোখে পড়েছে, তাই নয়। আধুনিক বিদ্বানেরাও এ-বিষয়ে সচেতন হয়েছেন যে, সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের স্থান রয়েছে অথচ তা থাকবার যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে[৭১১] লিখছেন,- যদিও, দুঃখের বিষয়, এখানে তিনি সাংখ্যর পুরুষ শব্দ ব্যবহার না করে তারই প্রতিশব্দ হিসেবে soul কথাটি ব্যবহার করে বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে বোঝবার ব্যাপারে কিছুটা অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন,-
What place, however, in a system which holds such views is to be found for the soul (অর্থাৎ, পুরুষ)? Strangely enough, former scholars who made exhaustive investigations into the Samkhya system did not succeed in answering this question. They regard the soul (অর্থাৎ, পুরুষ) in this system as entirely superfluous, and hold that its founder would have shown himself much more logical if he had altogether eliminated it.
শুধুই যে পারিবারিক ক্ষেত্রে মাতাই প্রধান ও একমাত্র বন্ধন তাই নয়, সিণ্টেঙ প্রদেশের মতো সবচেয়ে আদিম পার্বত্য অঞ্চলে সম্পত্তিতে প্রকৃত অধিকার শুধু মায়েরই এবং এই মাতৃত্বসূত্রেই উত্তরাধিকার প্রবর্তিত হয়। পিতার সঙ্গে সন্তানদের জ্ঞাতিসম্বন্ধ নেই; সন্তানেরা মাতৃগোত্রান্তর্গত।
যে-দর্শনের এই জাতীয় মতবাদ, সে-দর্শনে পুরুষের স্থান কী হতে পারে? বিস্ময়ের কথা হলো, ইতিপূর্বে যে বিদানেরা সাংখ্য-দর্শন নিয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা করেছেন তারা এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাননি। তাদের মতে, এ-দর্শনে পুরুষের তত্ত্ব বাহুল্য মাত্র এবং তারা বলেন এ-দর্শনের প্রবর্তক যদি ওই পুরুষের কথা একেবারেই বাদ দিতেন তাহলে তিনি অনেক সুসঙ্গত কাজ করতেন।
অধ্যাপক গার্বে নিজে কীভাবে সাংখ্য-দর্শনে ওই পুরুষের স্থানকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন, সে-প্রশ্ন অবশ্যই স্বতন্ত্র। কিন্তু তাঁর উক্তি থেকে এটুকু নিশ্চয়ই স্বীকার্য যে, আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে অনেকেই হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে, ওই সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের কোনো স্থান থাকা যুক্তিযুক্ত নয়, অথচ তা রয়েছে। আমরা দেখাতে চাইছি যে, এইটিই হলো সাংখ্যের সবচেয়ে মূল আত্মবিরোধ।
এই জাতীয় আত্মবিরোধের ব্যাখ্যা কী? আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, মাতৃপ্রধান সমাজ-বাস্তবের মধ্যেই এমন এক স্ববিরোধ লুকিয়ে রয়েছে যা ওই মাতৃপ্রধান সমাজের প্রতিবিম্ব নারীপ্রধান দর্শনের মধ্যে এইভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অতএব আমরা, আমাদের পদ্ধতি অনুসারে, সাংখ্য-দর্শনের এই বৈশিষ্ট্যটিকে বোঝবার আশায় মাতৃপ্রধান সমাজ-বাস্তবের আলোচনায় ফিরে যাবো।
আসাম-অঞ্চলে খাসিদের মধ্যে আজো মাতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থা অনেকাংশেই অক্ষুন্ন রয়েছে।
Their social organization presents one of the most perfect examples still surviving of matriarchal institutions, carried out with a logic and thoroughness which, to those accustomed to regard the status and authority of the father as the foundation of society, are exceedingly remarkable.
Not only is the mother the head and source and only bond of union of the family; in the most primitive parts of the hills, the Synteng country, she is the only owner of real property, and through her alone is inheritance transmitted. The father has no kinship with his children, who belong to their mother’s clan.(৭১২) এবং, অতএব-
The Khasis have a saying, ‘From the Woman sprang the clan.’ This does not leave much scope for the man. As a husband he is a stranger to his wife’s people, who refer to him curtly as a ‘begetter.’[৭১৩]
অর্থাৎ, খাসিদের সমাজসংগঠন হলো, আজো মাতৃপ্রধান ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ থাকবার একটি প্রায় নিখুঁত দৃষ্টান্ত; এ-ব্যবস্থা এতো যুক্তিযুক্তভাবে ও ভালো করে পালন করা হয় যে, যারা পিতার প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তিকেই সমাজের ভিত্তি বলে চিন্তা করতে অভ্যস্ত তাদের কাছে বিস্ময়কর বোধ হবে।
শুধুই যে পারিবারিক ক্ষেত্রে মাতাই প্রধান ও একমাত্র বন্ধন তাই নয়, সিণ্টেঙ প্রদেশের মতো সবচেয়ে আদিম পার্বত্য অঞ্চলে সম্পত্তিতে প্রকৃত অধিকার শুধু মায়েরই এবং এই মাতৃত্বসূত্রেই উত্তরাধিকার প্রবর্তিত হয়। পিতার সঙ্গে সন্তানদের জ্ঞাতিসম্বন্ধ নেই; সন্তানেরা মাতৃগোত্রান্তর্গত।
আমাদের যুক্তি হলো, সাংখ্য-ধ্যানধারণার মধ্যে মাতৃপ্রধান সমাজের প্রতিবিম্ব খুঁজে পাওয়া যায় বলেই সে-সমাজে পুরুষের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে যে-অস্তদ্বন্দ্ব তাই সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের তত্ত্বকে কেন্দ্র করে ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ, মাতৃপ্রধান সমাজের মনোভাবটির দিক থেকে সাংখ্য-দর্শনের এই উভয় তত্ত্বেরই একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।
এবং অতএব, খাসিদের মধ্যে প্রবাদ আছে, ‘নারী থেকেই ক্লানের (গোত্রান্তর্গত সকলের) উদ্ভব’। ফলে, এ-ব্যবস্থায় পুরুষদের ভূমিকা বলতে খুব বেশি কিছু থাকবার কথা নয়। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর আত্মীয়দের কাছে সে আগন্তুক অনাত্মীয় মাত্র। স্ত্রীর আত্মীয়রা তাকে তাচ্ছিল্যভরে ‘জন্মদাতা’ বলে উল্লেখ করে।
অতএব, মাতৃপ্রধান সমাজে পুরুষের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে একটা অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। এই সমাজে একদিকে পুরুষ জন্মদাতা বলে স্বীকৃত। এটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা- নারীর সঙ্গে পুরুষের মিলন ঘটলে পরই সন্তানজন্ম সম্ভব হয়।
আবার অপরদিকে কিন্তু এই পুরুষের সঙ্গে সন্তানদের কোনো আত্মীয়তা নেই; কেননা, সন্তানেরা মাতৃবংশের অন্তর্গত- তাদের জন্মদাতা পিতা তাদের কাছে স্বতন্ত্র গোত্রান্তর্গত আগন্তুক ব্যক্তিমাত্র। মাতৃপ্রধান সমাজে এটাও সমান প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই।
আমাদের যুক্তি হলো, সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের ভূমিকাটিকে কেন্দ্র করে যে-অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে মাতৃপ্রধান সমাজের পুরুষের ভূমিকাসংক্রান্ত ওই অস্তদ্বন্দ্বের প্রতিবিম্ব অনুমান করা যায়।
সাংখ্য একদিকে বলছে, প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের মিলনের দরুনই সৃষ্টি- “যথা স্ত্রী ও পুরুষের সংযোগে সন্তান-উৎপত্তি হয় সেইরূপ প্রধান-পুরুষের সংযোগে সৃষ্টির উৎপত্তি হয়।” আবার অপরদিকে সাংখ্য বলছে, প্রকৃতিই প্রধান- পুরুষ নেহাতই অপ্রধান এবং উদাসীন।
এই দ্বিবিধ মনোভাব কী করে একইসঙ্গে থাকতে পারে তা বুঝতে আমাদের পক্ষে অসুবিধে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনেই যদি সৃষ্টি সম্ভব হয় তাহলে তা সত্বেও পুরুষ কেন এতোখানি গৌণ হয়ে যাবে? কিংবা, পুরুষ যদি সত্যিই অমন একান্তভাবে অপ্রধান ও উদাসীন হয় তাহলে সৃষ্টিব্যাপারে তার একান্তই কোনো ভূমিকা কী করে থাকতে পারে?
প্রাচীন আচার্যরা তাদের নিজেদের পরিভাষায় সাংখ্যের বিরুদ্ধে এই আপত্তিই তুলেছেন। তারা দেখাচ্ছেন অন্ধ-পঙ্গু বা অয়স্কান্ত-লৌহের দৃষ্টান্ত দিয়েও সাংখ্য এই মূল অস্তদ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পেতে পারে না। এবং আধুনিক গবেষকদের মধ্যেও অনেকেই বলছেন যে, সাংখ্যদর্শন প্রবর্তক ওই পুরুষের কথাটুকু বাদ দিলেই অনেক সুসঙ্গত মনোভাবের পরিচয় দিতেন।
আমাদের যুক্তি হলো, সাংখ্য-ধ্যানধারণার মধ্যে মাতৃপ্রধান সমাজের প্রতিবিম্ব খুঁজে পাওয়া যায় বলেই সে-সমাজে পুরুষের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে যে-অস্তদ্বন্দ্ব তাই সাংখ্য-দর্শনে পুরুষের তত্ত্বকে কেন্দ্র করে ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ, মাতৃপ্রধান সমাজের মনোভাবটির দিক থেকে সাংখ্য-দর্শনের এই উভয় তত্ত্বেরই একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।
এ-সমাজের মানুষ একদিকে দেখছে সন্তান-উৎপাদন ব্যাপারে পিতার একটা ভূমিকা রয়েছে, আবার অপরদিকে তারা দেখছে যে, তা সত্ত্বেও পিতার সঙ্গে সন্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তারা ভাবছে, নারী থেকেই গোত্রের উৎপত্তি,- From the Woman sprang the clan; আবার অপরদিকে, অবজ্ঞাসূচকভাবে হলেও, পিতাকে–পুরুষকে- ‘জন্মদাতা’ বলে স্বীকার করতে তারা বাধ্য হচ্ছে- refer to him curtly as a begetter.
ফলে সাংখ্যের উৎস সংক্রান্ত নানারকম মতবাদ উদ্ভাবন করে তারা যেন তারই গোলকধাধায় পথ হারিয়ে যান, সমস্যাটি মোটের উপর রহস্যময়ই হয়ে থাকে। অপরপক্ষে, তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের গভীর সাদৃশ্যের কথা মনে রাখলে এবং তন্ত্রের উৎস-প্রসঙ্গে আমাদের যুক্তি স্বীকৃত হলে সাংখ্যের মতো ওই আপাত-বিস্ময়কর দার্শনিক চিন্তার উৎস আমাদের কাছে আর রহস্যময় হয়ে থাকে না।
এই মনোভাব নিয়ে এবং দেহভাণ্ডের অনুরূপ হিসেবেই যদি ব্রহ্মাওকে বোঝবার চেষ্টা করা যায়, তাহলে? তাহলে একদিকে যে-রকম বলতে হয় সৃষ্টির জন্য প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের একটা মিলন প্রয়োজন আবার অপরদিকে তা সত্ত্বেও বলতে হয় যে, প্রকৃতিই প্রধান, প্রকৃতিই সৃষ্টির আদিকারণ এবং পুরুষ শুধুই অপ্রধান নয়, উদাসীন, নির্লিপ্ত ও নিশ্চেষ্ট।
প্রশ্ন উঠতে পারে, দার্শনিক চিন্তাকে সমাজবাস্তবের এতোখানি হুবহু প্রতিবিম্ব মনে করবার চেষ্টাটা যান্ত্রিক, অতএব অবৈজ্ঞানিক, মনোভাবের পরিচায়ক কিনা? উত্তরে বলবো, দার্শনিক চিন্তার কাঠামোটা যে কতো গভীরভাবে সমাজবাস্তব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে তার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্বয়ং মার্ক্স্-এর(৭১৪) রচনাতেই দেখতে পাওয়া যায়-
…what would old Hegel say in the next world if he heard that the general (Allgemeine) in German and Norse means nothing but the common land (Gemeinland), and the particular, Sundre, Besondere, nothing but the separate property divided off from the common land 2 Here are the logical categories coming damn well out of “our intercourse” after all.
মাক্স-এর এ-উক্তি আমাদের বৈশেষিক দর্শনের সামান্য ও বিশেষ সংক্রান্ত সমস্যার উপর আলোকপাত করে কিনা, গবেষকেরা অবশ্যই তার আলোচনা তুলবেন। বর্তমানে আমাদের যুক্তি শুধু এইটুকু যে, হেগেল-দর্শনের সামান্য ও বিশেষ-এর মতো জটিল দার্শনিক ‘পদার্থে’র মধ্যে যদি এইভাবে সমাজবাস্তব প্রতিফলিত হয়ে থাকে তাহলে সাংখ্য-দর্শনের প্রকৃতির প্রাধান্য ও পুরুষের ঔদাসীন্যের মধ্যে মাতৃপ্রধান সমাজের প্রতিবিম্ব অন্বেষণ করা অন্তত আপাত-অযৌক্তিক মনোভাবের পরিচায়ক হবে না।
পুরুষের ভূমিকা সংক্রান্ত সাংখ্যের এই অন্তর্বিরোধ থেকে তান্ত্রিক ধ্যানধারণাও নিশ্চয়ই মুক্ত নয়। কেননা, প্রকৃতি আর পুরুষের তত্ত্ব নিয়েই তন্ত্র, এবং তন্ত্রেও প্রকৃতির প্রাধান্য এমনই প্রকট এবং তার পাশে পুরুষের ভূমিকা এতোই গৌণ যে, আপাত-দৃষ্টিতে এমন কি এ-কথাও মনে হওয়া অসম্ভব নয় যে, নেহাতই কৃত্রিম ও অসংলগ্নভাবে তন্ত্রে ওই পুরুষের কথা প্রবেশলাভ করেছে।
তন্ত্রের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা এই অন্তর্দ্বন্দ্বের দিকটির কথা উত্থাপন করিনি। তার কারণ আমাদের মনে হয়েছিলো, সাংখ্য-প্রসঙ্গেই এই দিকটির আলোচনা তোলা যুক্তিযুক্ত হবে। মূল তত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্যের সঙ্গে তন্ত্রের সাদৃশ্য সত্যিই বিস্ময়কর!
বস্তুত, এই কারণেই আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের উদ্ধত মন্তব্যটি থেকে শুরু করতে চেয়েছি। কেননা, তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের মৌলিক সাদৃশ্য সতিই বিস্ময়কর হলেও আরো বিস্ময়কর ঘটনা হলো আধুনিক বিদ্বানের সাংখ্যের উৎপত্তি সংক্রান্ত বহু আলোচনা করলেও এ-বিষয়ে তন্ত্রের সাক্ষ্যকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করে থাকেন।
ফলে সাংখ্যের উৎস সংক্রান্ত নানারকম মতবাদ উদ্ভাবন করে তারা যেন তারই গোলকধাধায় পথ হারিয়ে যান, সমস্যাটি মোটের উপর রহস্যময়ই হয়ে থাকে। অপরপক্ষে, তন্ত্রের সঙ্গে সাংখ্যের গভীর সাদৃশ্যের কথা মনে রাখলে এবং তন্ত্রের উৎস-প্রসঙ্গে আমাদের যুক্তি স্বীকৃত হলে সাংখ্যের মতো ওই আপাত-বিস্ময়কর দার্শনিক চিন্তার উৎস আমাদের কাছে আর রহস্যময় হয়ে থাকে না।
(চলবে…)
<<সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি প্রথম ।। সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি তৃতীয়>>
……………………….
আরও পড়ুন-
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি প্রথম
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি দ্বিতীয়
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি তৃতীয়
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি চতুর্থ
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি পঞ্চম
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি ষষ্ঠ
সাংখ্য-দর্শনের উৎস : কিস্তি সপ্তম
………………….
লোকায়ত দর্শন (২ম খণ্ড- বস্তুবাদ)- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………..
৬৯৪. সাংখ্যকারিকা ২১, গৌড়পাদভাষ্য।
৬৯৫. বিশ্বকোষ ৭:৫০৭।
৬৯৬. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী- বৌদ্ধধর্ম ৩৭ ৷
৬৯৭. H. Zimmer PI 282–সাংখ্যকারিকাকে লেখক আরো পরে (পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি ) রচিত বলে বিবেচনা করেন। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও (বৌদ্ধধর্ম ৩৮) একই মত পোষণ করেন।
৬৯৮. সাংখ্যকারিকা ৭০।
৬৯৯. ঐ ৭১।
৭০০. শঙ্করাচার্য- ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২.৪.৯।
৭০১. S. N. Dasgupta HIP 1:213.
৭০২. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade HIP 2:412.
৭০৩. Ibid. 2:413f.
৭০৪. H. H. Wilson SK 160.
৭০৫. P. B. Chakravarti ODSST দ্রষ্টব্য I
৭০৬. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- রচনাবলী (সাহিত্য-সংসদ ) ২:২২২।
৭০৭. মণীন্দ্রমোহন বস্তু- সহজিয়া সাহিত্য ৫২ ৷
৭০৮. উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য- ভারতদর্শনসার ১৪৯-৫০।
৭০৯. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op. cit. 2:428.
৭১০. ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২.২.৭। নিয়োস্থত তৰ্জমা কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:১৪০।
৭১১. ERE 11:191.
৭১২. P. R. T. Gurdon K xix-xx.
৭১৩. G. Thomson SAGS 153.
৭১৪. K. Marx. & F. Engels C 210.
৭১৫. ERE 6:706.
৭১৬. R. Garbe SPB Preface ix.
৭১৭. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী- বৌদ্ধধর্ম ৩৭।
৭১৮. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op cit. 2:415.
৭১৯. S.N. Dasgupta op. cit. 1:213.
৭২০. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op. cit. 2:418f.
৭২১. Ibid. 2:420f.
৭২২. Ibid. 2:426f.
৭২৩. E. H. Johnston Es.
৭২৪. S. K. Belvalkar & R. D. Ranade op cit. 2:416.
৭২৫. ব্রহ্মসূত্রভাষ ২. ১, ১২। তর্জমা- কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:৪৭।
৭২৬. ঐ ২, ১, ১। তৰ্জমা- কালীবর বেদাস্তবাগীশ ২৮।
৭২৭. ঐ। কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:১০।
৭২৮. R. Garbe IACOPVMCSS Preface xx-xxi.
৭২৯. H. Zimmer PI 281.
৭৩০. ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ১. ৪.১। তর্জমা- কালীবর বেদান্তবাগীশ ১:৪৯৭।
৭৩১. P. B. Chakravarti ODSST 4.
৭৩২. Ibid.
৭৩৩. তর্জমা- কালীবর বেদাস্তবাগীশ ২:১২৩-৪।
৭৩৪. তর্জমা- কালীবর বেদান্তবাগীশ ২:১২৮।
৭৩৫. কালীবর বেদান্তবাগীশ- সাংখ্য-দর্শনম্ ২২১-২।
৭৩৬. R. Garbe SPB Preface দ্রষ্টব্য।
৭৩৭. S. N. Dasguta op. cit. 1:213.
৭৩৮. R. Hume TPU.
৭৩৯. বরং আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি (পৃ. ৫৩৬ ), গীতা-বর্ণিত অসুরমতের সঙ্গেই সাংখ্যের আদিরূপের সংযোগ অনুমান করা যায়। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত মতটিই যদি আদি-অকৃত্রিম সাংখ্য হতো তাহলে অবশ্যই বাদরায়ণ সাংখ্য-খণ্ডনের জন্য অতো আয়োজন করতেন না।
৭৪০. ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ২. ১. ২.।
৭৪১. R. Garbe IACOPVMCSS Preface xii.
৭৪২. F. Engels LF 19.
৭৪৩. R. Garbe op. cit. Preface xix.