ভবঘুরেকথা
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

২৪.
রাজারা তাদের নামের আগে পিছে কতকগুলি নিরর্থক বাক্য নিয়ে শ্রী জুড়ে তবে অপরকে উচ্চারণ করতে দেয়; নইলে তাদের মর্যাদা নষ্ট হয়।

২৫.
অচলা দৃপ্তস্বরে কহিল, নেমকহারাম উনি। তাই বটে! কিন্তু যাকে এক সময় বাঁচানো যায়, আর এক সময়ে ইচ্ছে করলে বুঝি তাকে খুন করা যায়?

২৬.
মানুষের দুঃখটাই যদি দুঃখ পাওয়ার শেষ কথা হত, তার মূল্য ছিল না। সে একদিকের ক্ষতি আর একদিকের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে পূর্ণ করে তোলে।

২৭.
অনেকের মঙ্গলের জন্য সামান্য ক্ষতিতে ভ্রূক্ষেপ করিবার অবসর পান না। সেইজন্য অনেক স্থলেই তাঁহারা নিরদয় নিষ্ঠুর বলিয়া জগতে প্রচারিত হন।

২৮.
সমাজের মধ্যে যাকে গৌরব দিতে পারা যায় না, তাকে কেবলমাত্র প্রেমের দ্বারাই সুখী করা যায় না। মর্যাদাহীন প্রেমের ভার, আলগা দিলেই দুর্বিষহ হইয়া উঠে।

২৯.
সত্য পালনের দুঃখ আছে, তাকে আঘাতের মধ্য দিয়ে বরঞ্চ একদিন পাওয়া যেতে পাড়ে কিন্তু বঞ্চনা প্রতারণার মিষ্ট পথ দিয়ে সে কোনদিন আনাগোনা করে না।

৩০.
মানুষ তো দেবতা নয়-সে যে মানুষ! তার দেহ দোষে-গুণে জড়ানো; কিন্তু তাই বলে তো তার দুর্বল মুহূর্তের উত্তেজনাকে তার স্বভাব বলে ধরে নেওয়া চলে না।

৩১.
প্রতিষ্ঠিত নিয়ম পালনের মধ্যে মানুষ যখন একান্ত মগ্ন হইয়া থাকে, চোখের দৃষ্টিও তখন তাঁহার রুদ্ধ হইয়া যায়। সে কোনমতেই দেখিতে পায়না কোনটা ধর্ম, কোনটা অধর্ম।

৩২.
আজ তাহার কেউ নাই; তাহাকে ভালবাসিতে, তাহাকে ঘৃণা করিতে, তাহাকে রক্ষা করিতে, তাহাকে হত্যা করিতে, কোথাও কেহ নাই; সংসারে সে একেবারেই সঙ্গ-বিহীন!

৩৩.
যারা আপনার মুখের অন্ন পরনের বসন জোগায়, সেই হতভাগা দরিদ্রের এই সব গ্রামেই বাস। তা’দিগকে দুপায়ে মাড়িয়ে থেঁৎলে থেঁৎলে আপনাদের উপরে ওঠার সিঁড়ি তৈরি হয়।

৩৪.
মানুষের চামড়ার রঙ ত তার মনুষ্যত্ব মাপকাঠি নয়। কোণ একটা বিশেষ দেশে জন্মানোই ত তার অপরাধ হতে পারে না! …ধর্মমত ভিন্ন হলেই কি মানুষে হীন প্রতিপন্ন হবে? এ কোথাকার বিচার!

৩৫.
ভালকে ভাল মন্দকে মন্দ বলায় কোন art-ই কোন্দিন আপত্তি করে না। কিন্তু দুনিয়ায় যা কিছু সত্যই ঘটে নির্বিচারে তাকেই সাহিত্যের উপকরণ করলে সত্য হতে পারে, কিন্তু সত্য-সাহিত্য হয় না।

৩৬.
কবি যে শুধু সৃষ্টি করে তা নয়, কবি সৃষ্টি রক্ষাও করে। যা স্বভাবতই সুন্দর, তাকে যেমন আরও সুন্দর করে প্রকাশ করা তার একটা কাজ, যা সুন্দর নয়, তাকেও অসুন্দরের হাত থেকে বাঁচিয়ে তোলা তারই আর একটা কাজ।

৩৭.
যে দুঃখকে ভয় …তারই দিয়ে আবার তারও চেয়ে বড় আদর্শ জন্মলাভ করবে; আবার তারও যেদিন কাজ শেষ হবে, মৃতদেহের সার থেকে তার চেয়েও মহত্বর আদর্শের সৃষ্টি হবে, এমনি করেই সংসারে শুভ শুভতরের পায়ে আত্মবিসর্জন দিয়ে আপন ঋণ পরিশোধ করে। এই তো মানুষের মুক্তির পথ।

৩৮.
বুঝি, ছোঁয়াছুঁয়ি-আচার-বিচারের অর্থ নেই, তবুও মেনে চলি; বুঝি, জাতিভেদে মহা অকল্যাণকর। তবুও নিজের আচরণে তাকে প্রকাশ করিনে। বুঝি ও বলি, বিধবা বিবাহ উচিত। তবুও নিজের জীবনে তাকে প্রত্যাহার করি। জানি খদ্দর পরা উচিত, তবু বিলাতি কাপড় পরি। একেই বলি আমি অসত্যাচার।

৩৯.
মানুষের দীর্ঘ-জীবনে তাকে অনেক পা চলতে হয়, দীর্ঘ পথটির কোথাও কাদা, কোথাও পিছল, কোথাও উঁচু-নীচু থাকে, তাই লোকের পদস্থলন হয়; তারা কিন্তু সে কথা বলে না, শুধু পরের কথা বলে। পরের দোষ, পরের লজ্জ্বার কথা চীৎকার করে বলে, সে শুধু আপনার দোষটুকু গোপনে ঠেকে ফেলবার জন্যই।

৪০.
মন্দের বিরুদ্ধে অত্যন্ত ঘৃণা জাগিয়ে দেওয়াও নাকি কবির কাজ। কিন্তু ভালর ওপর অত্যন্ত লোভ জাগিয়ে দেওয়া কি তাঁর থেকে ঢের বেশি কাজ নয়। তাছাড়া পাপ কে যতদিন না সংসার থেকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দেওয়া যাবে, যতদিন না মানুষের হৃদয় পাথরে রূপান্তরিত হবে। ততদিন এ পৃথিবীতে অন্যায়, ভুল ভ্রান্তি থেকেই যাবে…।

৪১.
নারীত্বের মূল্য কি? অর্থাৎ কি পরিমাণে তিনি সেবাপরায়ণা, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখকষ্টে মৌনা। অর্থাৎ তাহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে এবং তিনি কি পরিমাণে রূপসী অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন। দাম কষিবার এছাড়া যে আর কোন পথ নাই।

৪২.
যা সত্য, তাকেই সকল সময় সকল অবস্থায় গ্রহণ করবার চেষ্টা করবে। তাতে বেদই মিথ্যা হোক, আর শাস্ত্রই মিথ্যা হয়ে যাক। সত্যের চেয়ে এরা বড় নয়, সত্যের তুলনায় এদের কোন মূল্য নেই। জিদের বশে হোক, মমতায় হোক, সুদীর্ঘ দিনের সংস্কারে হোক, চোখ বুঝে অসত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করায় কিছুমাত্র পৌরুষ নেই।

৪৩.
সংসারে অনেক ঘটনার মধ্যে বিবাহটাও একটা ঘটনা, তার বেশি নয়; ওটাকেই নারীর সর্বস্ব বলে যেদিন মেনে নিয়েছেন, সেইদিনই শুরু হয়েছে মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো ট্রাজিডি। …চাটুকারের নানা অলংকারের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে যারা প্রচার করেছিল মাতৃত্বের নারীর চরম স্বার্থকথা, সমস্ত নারীজাতিকে তারা বঞ্চনা করেছিল।

৪৪.
তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, তোমারা দেশের গুণী ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদিগকে সর্বদা সম্মান দিতে কোনদিন যেন কার্পণ্য না করো। এই কথাটা সবসময় মনে রেখো যে, এতে কেবল তা’দিগকে সম্মান করা হয় মাত্র নয়, পরন্তু এইরুপ সম্মান প্রদর্শনে দেশের ব্যক্তিদিগের গুণের সমাদর করা হয়। আর দেশবাসীকে তাঁহার গুন সম্বন্ধে সচেতন করবার সুযোগ ঘটায়।

৪৫.
আত্মরক্ষার ছলেও মানুষের অসম্মান করা আমার ধাতে পোষায় না। দেখো না লোকে বলে আমি পতিতাদের সমর্থন করি। সমর্থন আমি করিনে, শুধু অপমান করতেই মন চায় না। বলি তাঁরাও মানুষ, তাঁদের নালিশ করতে মন চায় না। বলি, তাঁরাও মানুষ, তাঁদের নালিশ জানাবার অধিকার আছে, এবং মহাকালের দরবারে এদের বিচারের দাবী একদিন তোলা রইলো।

৪৬.
মিথ্যে দিয়ে ভুলিয়ে সত্য প্রচার হয় না। সত্যকে সত্যের মত করেই বলতে হয়। তবেই মানুষ যে যার বুদ্ধির পরিমাণে বুঝতে পারে। আজ না পারে ত কাল পারে। সে না পারে ত আর একজন পারে। না-ও যদি পারে, তবুও তাকে মিথ্যার ভূমিকা দিয়ে মূখরোচক করার চেষ্টার মত অন্যায় আর নেই। … মিথ্যা পাপ, কিন্তু মিথ্যায়-সত্যে জড়িয়ে বলার মত পাপ সংসারে অল্পই আছে।

৪৭.
যে সমাজে কেবলমাত্র পুত্রার্থের ভার্যা গ্রহণের বিধি আছে…তাকে তো আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারিনে …সতীত্ব তো শুধু দেহেই পর্যবসিত নয়,…মনেরও তো দরকার…কায়মনে ভাল্বাস্তে না পারলে তো ওর উচ্চস্তরে পৌঁছানো যায় না। মন্ত্র পড়ে বিয়ে দিলেই যেকোনো মেয়ে যেকোনো পুরুষকে ভালবাসতে পারে? এ কি পুকুরের জল যে, যেকোনো পাত্রে ঢেলে মুখ বন্ধ দিলেই কাজ চলে যাবে?

……………………….
আরো পড়ুন:
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাণী: এক
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাণী: দুই

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!